বনসাই

অন্তরীণ এক অতীতকে মুক্ত করে দিয়ে নীপবীথির এবার ঘরে ফেরার পালা। চৈত্র মাসের বেশ ক’টা দিন হয়ে গেলেও সেই দাবদাহ নেই এবার, কেমন একটা রিনরিনে ঠান্ডা ভাব। বয়সের ভারেই হয়তো আর সেই দহন তেমন অনুভূত হয় না নীপবীথির ।

চশমার কাচের ভেতর বার দুটো দিকই ভিজে লাগছে ওর। একটা কুয়াশার চাদরে যেন ভরে গেছে ভোরের আকাশ। বাড়ি থেকে আসার সময় তো একটা দুটো তারা দেখা যাচ্ছিল। এখন আর আকাশে তারা নেই। সবুজ গাছগুলোকে কুয়াশায় ঘিরে ধরেছে ,কেমন যেন বিবর্ণ লাগছে। নীপবীথি বাড়ি ফিরছিল। কী হালকা লাগছে আজ। আর যেন কোন কাজ নেই। কোন চাপ নেই। একটা চাপা ইতিহাসকে চেপে রাখার নিরন্তর অনুরণন নেই। আজ যেন আরো একবার মুক্তিযুদ্ধ জেতা ! ভাবতেই অবাক লাগে নীপবীথির, –প্রায় পঞ্চাশটা বছর একটা পলাশ গাছের বনসাইকে বয়ে নিয়ে বেড়ানো।

কুদ্দুসের কবরস্থান থেকে বাড়ি ফিরছে নীপবীথি। ওর স্বামী কুদ্দুসের চল্লিশ দিনের কাজ শেষ হয়েছে দিন কয়েক আগে। ফাঁকা বাড়ির সবেতেই কুদ্দুসের ছাপ– শুধু পলাশ গাছটিকে বাদ দিয়ে! ওটা নীপবীথির একার। যদিও হরেক রকম গাছের টবগুলোতে জল দেবার সময় ওটাতেও জল দিত কুদ্দুস। নীপবীথি বারণ করত না , তবে কেমন যেন লাগতো। কেমন একটা অনুভুতি ; না-পাক অবস্থায় কোন শুভ কাজে হাত দিলে যেমন লাগে তেমন।

কুয়াশায় ভরা মফস্বল শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরের রাস্তায় মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে নীপবীথির আজকে কত দৃশ্যপট তৈরি হচ্ছে। কত দিন হয়ে গেল । ওরা তখন সংসারের মাঝ আকাশে। ছেলেমেয়েরা বেশ ছোট, কুদ্দুসের পোষ্টিং তখন ওয়েলিংটনে। বনসাই হলে কি হবে, পলাশের চারাটা বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়েই ওদেশে গেছিল। কিন্তু কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে । প্রতিবছর দু’চারটে করে ফুল ফুটত–এবার যে একটাও না। বসন্তের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করল নীপা, তারপর কুদ্দুসকে বলল–“এবার তোমার শরণাপন্ন হতেই হ’ল। কিছু একটা করো, ওকে বাঁচাও।” নীপার আর্তিতে বুঝতে পারল- বনসাইটার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে ও।

অ্যামব্যাসিতে কাজ করার সুবাদে উপযুক্ত লোক খুঁজতে বেশি দেরী হলো না কুদ্দুসের। ডেকে নিয়ে আসা হল এক উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপিকাকে। তিনি এসে দেখলেন– ওষুধ, কীটনাশক অনুখাদ্য দিয়ে জীবন দিয়ে গেলেন গাছটাকে। যাবার সময় স্মিত হেসে বললেন–” শীতের দিনগুলোতে গরম দেশের রাষ্ট্রদূত সহজেই নিজের ঘরের পরিবেশ উষ্ণ করে নিতে পারেন। কিন্তু গাছটার জন্য কী তেমন কিছু করেছিলেন? আসলে বনসাইটারও বয়স হয়েছে। প্রবল শীতে আর অনুখাদ্যের অভাবে ওর প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছিল। “বেঁচে গেল গাছটা। নীপবীথি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। চোখ টিপে কুদ্দুস বলল–“গাছ তো নয়, সতীন সতীন ! কি আর বলি বলো, তোমাদের বাংলা স্যারেরা তো সতীনের পুংলিঙ্গবাচক কোন শব্দ তৈরি করে দিলেন না। ওই বনসাইটিই আমার সতীন!” কথাগুলো যতই হাসির ছলে বলুক না কেন –নীপার গভীরে গিয়ে ধাক্কা লাগে। খুব কি ভুল বলেছে কুদ্দুস? তবুও মজার প্রত্যুত্তরে স্মিত হেসে কুদ্দুসকে বলে– “তোমার নয় গো, তোমার শ্বশুরের সতীন ওটা!” আর মনে মনে বলে–“এর শিকড়ের সন্ধানে তোমার যাওয়ার দরকার নেই কুদ্দুস!”

সেবার দেশে ফেরার বিমানে বনসাইটাকে নিয়ে সে কী অশান্তি! কিছুতেই ওটাকে বিমানে মালপত্রের সঙ্গে তুলতে দেবে না। নীপাও নাছোড়বান্দা। শেষে, কুদ্দুস ওর রাষ্ট্রদূতের পরিচয় দেখিয়ে ব্যাপারটা ম্যানেজ করেছিল। নীপার ভয় ছিল, মালপত্রের চাপে গাছটা মারা না যায়। জার্নির সারাটা পথে নীপা বিশেষ কথা বলে নি। সামান্য একটা গাছের বামনকে নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত প্রেম কুদ্দুসেরও ভালো লাগেনা। প্লেন থেকে নেমে বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে বনসাইটাকে আঁকড়ে ধরে বসেছিল নীপা। কুদ্দুসের মনে হচ্ছিল, নীপা বোধহয় ক্রমশ মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।

কুদ্দুসের জীবন বড় ব্যস্ত। সারাদিন সারারাত ফোন, ল্যাপটপ ,মেল — গুরুত্বপূর্ণ লোকের আনাগোনা। আর তার সঙ্গে সর্বদা যেন একটা গোপনীয়তার বেড়াজাল। নীপাও জানে, — বিদেশ দফতরের কাজে এটাই স্বাভাবিক। এখানে নীপার কোনো ভূমিকা নেই, কোন কিছু জিজ্ঞাসা করার অধিকারও নেই। ওর সারাটা দিন শুধু হরেক রকমের গাছপালা, একটা বনসাই , আর ফেলে আসা রুক্ষমাটির সেই পলাশতলার তরুণীবেলার আবছায়াকে স্পষ্ট করে তোলা!

পড়াশোনায় মেধাবী নীপবীথির কলেজের পড়া শেষ হলে বাবা আব্বাসউদ্দিন চেয়েছিল মেয়ে ঢাকাতেই পড়াশোনা করুক। তবে মায়ের ইচ্ছে ছিল মেয়ে যাক শান্তিনিকেতনে। মায়েরাই সাধারণত মেয়েদেরকে দূরে পাঠাতে শঙ্কা বোধ করে। নীপবীথির মা –নীলা, এক্ষেত্রে এত দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিল যে শেষমেষ মেয়েকে শান্তিনিকেতনে পড়ানোর ব্যাপারটা ফাইনাল হয়েছিল।।

নীলা নিজেও এক সময় কয়েকটা বছর কাটিয়েছে ছাতিমতলার চারপাশে। শান্তিনিকেতন, শব্দটা শুনলেই নীলার মধ্যে কেমন একটা চাঞ্চল্য , কেমন একটা নিরাসক্ত তপস্বীর আকর্ষণ এখনো কাজ করে । তৃপ্তি -অতৃপ্তি ,মুক্তি -বন্ধন নীলাকে অবশ করে তোলে।

নীলার মধ্যে অদ্ভুত একটা উদাসীনতা আছে,– আবার একটা আশ্চর্য রকমের আসক্তিও আছে। মাঝে মাঝে সব ভেঙে চুরমার করে দিতে ইচ্ছে হয়। আবার পরক্ষনেই মনে হয়, কিছুইতো ভাঙা যাবে না। একসময় সে নিজেও খুব ভাল ছাত্রী ছিল। কিন্তু কিছুতেই ভেঙ্গে দিতে পারেনি পারিবারিক রক্ষণশীলতাকে। এখন হঠাৎ তার মনে হয়েছে মায়ের বাঁধ ভাঙার দৈনতাকে মেয়ে নীপা যদি নিজের সামর্থ্য দিয়ে ছাপিয়ে যেতে পারে!

বোলপুরে আসার দিন নীপাকে সি-অফ করার সময় নীলা বলেছিল- “সাবধানে থেকো। ঠিক করে পড়াশুনা করো।” কিছুক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকার পর বলেছিল – “তুমিও যেন পলাশের বনে হারিয়ে যেও না।” টস করে এক ফোঁটা জল পড়েছিল নীলার চোখের কোণ থেকে। অনেকদিন পর চোখে জল এসেছিল তার।

শান্তিনিকেতনে নীপার স্যার বিশ্ববন্ধুবাবু। স্যারের সঙ্গে খুব সখ্যতা হয়ে গেছে বিদেশিনী ছাত্রীটির। বিশ্ববন্ধুবাবু ক্লাসের শুরুতে সবাইকে বলে দিয়েছিলেন –“আমি তোমাদের সকলের বিশুদা, আর বিশুদ্ধ বন্ধু , কেমন?” এই প্রবাসে এমন একজন মানুষকে কাছে পেয়ে বেশ আছে নীপা। আর নীপা যে তাঁর ছাত্রী, সেটাও উনি ভুলে যান মাঝে মাঝে। অনেকদিন পর যেন প্রবাসী কন্যা বিপত্নীক বাবার কাছে এসে উঠেছে। নীপা হোস্টেল থেকে মাঝে মাঝেই আসে মালঞ্চে। মালঞ্চ — বন্ধু স্যারের বাড়ি। অকৃতদার খ্যাপাটে মানুষটি বড়ই অগোছালো। গোটা ঘর ও উঠোনে অবিন্যস্ত জীবন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আড়ালে ছাত্রছাত্রীরা স্যারের নাম দিয়েছে বিশু পাগলা। সেটা খুব ভালোই জানেন বিশ্ববন্ধুবাবু, আর এই আড়ালের ডাকটিকে বেশ ভালোই লাগে। সেই বিশু পাগলার মতো গান গাইতেও বেশ লাগে স্যারের। চোখের জলের জোয়ার যখন দুঃখের পারাবারকে প্রকট করে তোলে– তখন আশপাশ থেকে শ্রোতারা নিশ্চুপ হয়ে তা শোনে। গান, গাছ আর এক অদ্ভুত উদাসীনতা এই নিয়েই স্যারের সংসার। ক্লাসে পড়ানোর সময়ও এসব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। গাছ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করাটা উনার হবি। কত গাছ কত ফুল, কীট পতঙ্গ,গাছের ভিতর দিয়ে কখন তাদের আনাগোনা, তার জন্যই যেন বেঁচে থাকা। মালঞ্চে যারা আসে তাদেরকে গাছের চারা উপহার দেন। ওই চারাগুলোর মধ্যে দিয়েই যেন নিজেকে অঙ্কুরিত করা– নিজেকে বিস্ফারিত করা। কথার মাঝে মাঝে প্রায়শই বলেন–” জানিস, একদিন ওপার বাংলা থেকে এসেছিলাম , আবার খুব ইচ্ছা করে চাকরি শেষে ওদেশে চলে যাব। কিন্তু তোরাই শিক্ষিত হয়ে দেশের প্রাচীর তৈরি করেছিস, পাসপোর্ট-ভিসা করেছিস ,আর যাই কেমনে? তাছাড়া আমার এই এত গাছ!”– কথার শেষে উদাস হয়ে তাকান মালঞ্চ ভরা, ছাতিম পলাশ শিমুলের দিকে।

একদিন নীপবীথির কোর্স শেষ হয়ে এল। এবার বাড়ি ফেরার পালা। আত্মীয়স্বজন না থাকা মালঞ্চের প্রৌঢ় অধ্যাপক মানুষটির মধ্যে একটা নাড়ির টান অনুভব করে সে। বারবার মনে হয় এই একা মানুষটিকে নিয়ে যেতে পারলে খুব ভালো হতো। সকালেই গাড়ি নীপার। শেষবারের মতো মালঞ্চে গেল নীপা। প্রণাম করতেই স্যার বললেন– “তোর জন্য একটা পলাশের চারা বনসাই করা আছে। ওটা নিয়ে যা। আমার তো আর ফেরা হলোনা । আমার প্রতিনিধি হয়ে ওটাই ফিরে যাক ও দেশে। হয়ত বুঝতে পারবি একদিন ওর মাঝে কী বিশাল এক বৃক্ষ স্থির হয়ে আছে।”

ফিরে এলো নীপবীথি। আগেও বাড়ি এসেছে দু চারদিনের জন্য। এবার পাকাপাকি ভাবে ফিরে এলেও কেমন একটা উদাসীন প্রীতিরসে স্নিগ্ধ হয়ে আছে ওর মন। নীলা মেয়েকে বোঝার চেষ্টা করে। নীলা ভাবে মেয়ের মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করবে–যেমন ওর নিজের করত। নাকি গভীর সমুদ্রের স্রোত উপরে বোঝা যাচ্ছে না। নীলা নিজেও এক সময় ওখানকার নৃতত্ত্ব বিভাগের কৃতী ছাত্রী ছিল। নীলা নীপাকে পর্যবেক্ষণ করে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কিন্তু কোথাও তো কোন পরিবর্তন নেই। বরং মেয়ের মধ্যে এক সুবাসিত পার্থিবতা অনুভব করে। শুধুমাত্র একটা ব্যাপারে মেয়ের বড় টান অনুভব করে– সেটা হল ওই নবাগত পলাশের চারা। বড় যত্ন করে গাছটাকে বাগানের এমন জায়গায় রেখেছে যাতে প্রথম অরুণ কিরণ পলাশের কচি পাতাগুলোকে স্পর্শ করে যেতে পারে।

বেশ গরম পড়েছে । সন্ধ্যার মুখে বাগানে একটা চেয়ারে চুপ করে বসে ছিল নীপা। দুপুরে ওর ছোটমাসি নীলাকে ফোন করে ওর বিয়ের ব্যাপারে কিছু কথাবার্তা বলেছে। ছোটমেসোর এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের ছেলে কুদ্দুস। ফরেন সার্ভিসে যোগ দেওয়া এমন পাত্র হাতছাড়া করা যায় না– এটাই এ বাড়ির সবার ইচ্ছা। নীলা মেয়ের পাশে এসে বসে। নীপাকে জিজ্ঞাসা করে– ” ক’দিনের ব্যস্ততায় জিজ্ঞাসা করা হয়নি, পলাশের ওই বনসাইটিকে পেলে কোথায়? কোথাও কিনলে? নাকি তোমাদের সমাবর্তনের স্মারক এটি? তোমার এমন বৃক্ষপ্রীতি আগে তো ছিল না। এটির কল্যাণে তুমি এখন একআধটু বাগানে এসে বসো।– যাইহোক, ছোটমাসি আবার একটু আগে ফোন করেছিল, কুদ্দুসের বাড়িতে বিয়ের তাড়া আছে। ওকে মনে হয় খুব শিগগিরই পোস্টিং দিয়ে বাইরে পাঠানো হবে। আর বাইরে যাবার আগে বিয়েটা সেরে নিতে চায় ওরা।তোমার মতামত জেনেই আমি ফোন করব একটু পরে।”

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর নীপা বলে– “ওই বনসাইটা আমাদের নৃতত্ত্ব বিভাগের বিশ্ববন্ধু স্যারের উপহার। ওর নাম শুনেছ? তোমাদের সময় ডিপার্টমেন্টে উনি ছিলেন নাকি? প্রিয় ছাত্রছাত্রীদেরকে শুধুমাত্র গাছের চারা উপহার দিতে স্যার কী যে ভালোবাসেন ! জানো তো মা, স্যারের বাড়ির নাম মালঞ্চ। মালঞ্চে বেশ পুরনো পলাশের একটা গাছ আছে – ওই গাছের চারা থেকে তৈরি করা এই বনসাইটা। এবারে বাড়ি আসার সময় গাছটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন–” এটাকে নিয়ে যাও ওদেশে, আমার প্রতিনিধি ভেবে।”– জানো মা, গাছটার মধ্যে বন্ধুস্যারকে যেন দেখতে পাই আমি।

সন্ধ্যা গড়িয়ে অন্ধকার নেমে এসেছিল–কেউ কারোর মুখ দেখতে পাচ্ছিল না। নীলা হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে–” সে কী! বিশ্ববন্ধু! এ গাছ বিশ্ববন্ধু তোকে দিয়েছে? আর কী, আর কী বলেছে সে ?” –মায়ের এই আর্তনাদের কারণ নীপা বুঝতেই পারেনা। নীপা কিছুতেই বুঝিয়ে ওঠাতে পারেনা, এর মধ্যে বিশেষ কোন কারণ নেই, অন্য কোন লুকোছাপা নেই, কোন বিশেষ জটিল সমীকরণ নেই। মাকে শান্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।

এই অন্ধকারে বড় অচেনা লাগে পরস্পরকে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর নীলা বলে–” তুমি বোধহয় সব জেনে এসেছ। ভুল করেছিলাম তোমাকে ওখানে পড়তে পাঠিয়ে। তবে আমার দিকটাও জেনে রাখো। মালঞ্চের ওই পলাশ গাছ আমার নিজের হাতে লাগানো। ওর সবকিছু আমার। কারো ভাগ নেই ওতে। একটা পাতাও কেউ ছিঁড়তে পারেনা ওই বৃক্ষের। বিশ্বকে কথা দিয়েছিলাম– একদিন ওর নীচে ঘর হবে আমাদের। একদিন নিশ্চিত ফিরব ওখানে। কিন্তু আর ফেরা হলো না। সেই উত্তাল বৈরিতার সময় আমাকে হঠাৎ ফিরে আসতে হয়েছিল মায়ের চিঠি পেয়ে।দেশ স্বাধীনতা পেতেই , তোমার নানা, তোমার মামা ঢুকল জেলে– দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ওরা ছিল রাজাকারদের সঙ্গে। দিশাহারা মাকে ফেলে আর ফেরা গেল না শান্তিনিকেতনে। আমার দেশের স্বাধীনতায় আমাদের উদ্বেলতার
সীমা রইল না, কিন্তু আমার পরাধীনতার কথা জানিয়েছিলাম বিশ্বকে। আমি জানতাম মালঞ্চে আমি আছি– বিশ্ব আছে। আমার শরীর-মনের সর্বত্র জুড়ে আছে সেই প্রথম পলাশ।”

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর নীলা আবার বলল–” বেশ, খুব শিগগিরই তোমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। পলাশের বনসাইটা তোমার সংসারেই থাক। যত্ন করে রেখো। “পরদিন নীলাকে আর ঘুম থেকে তোলা গেল না। ডাক্তার এসে সবকিছু দেখে শুধু বললেন–“এত ঘুমের ওষুধ পেলেন কোথায়?

বিয়ের পর কুদ্দুস পলাশের বনসাইটাকে নিয়ে নীপার অকারণ আদিখ্যেতা একেবারে পছন্দ করত না। আর তার সঙ্গে ছিল ওটাকে দেশ বিদেশে ঘুরে নিয়ে বেড়ানোর হ্যাপা। ওর ডিপ্লোমেটিক চরিত্রে এগুলো একেবারে অসহ্য।

তীর্যকভাবে নীপাকে বলতো, –“তোমার বনসাই বনস্পতি।” কুদ্দুসেরও ভিতরে ভিতরে একটা সন্দেহ ছিল কোন এক গোপন গভীর রহস্য আছে গাছটার মধ্যে। যে জন্য ওটাকে কোল ছাড়া করতে চায়না নীপা। নীপা একদিন শান্তভাবে বলেছিল — “কুদ্দুস,তোমার যেমন পররাষ্ট্রনীতি আছে, দেশ-বিদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে নিজের দেশকে মিলিয়ে দেবার চাকরি আছে, তোমার যেমন কথাবার্তা চালচলনে গভীর গোপনীয়তা আছে, আমার তেমনি আছে এই গাছটি। দুটো দেশের দুটো জাতির স্পর্শ ধরে রেখেছে আমার এই বনসাইটা। পিতৃতুল্য বন্ধু স্যারের স্মৃতি আছে ওটাতে। গাছটিকে মুক্তি দিলে যে অনেক কিছু হারাতে হয়। আর তোমাকে একটা কথা বলতে চাই, ওই স্যার আমার ও আমার মায়ের দুজনের শিক্ষক ছিলেন। ওটা নিছক একটা গাছ নয়– ওটা একটা প্রতিশ্রুতি যেটা তোমাকে বুঝতে হবে না। “এই কঠিন কথাগুলো শোনার পর কুদ্দুস আর কখনো কিছু বলেনি। বুঝেছিল, এক অপত্যের অধিকার নিয়ে নীপা গাছটিকে আগলে রেখেছে।

প্রায় সকাল হয়ে এলো। কবরস্থান থেকে বাড়ি ফিরছে নীপবীথি। মা , বাবা, কুদ্দুস এক এক করে সবাই ওখানে। ছেলে মেয়েরাও স্বাভাবিক নিয়মে দূরে। সংসার এবার ফাঁকা হয়ে এলো। ক’দিন থেকেই ভাবছিল কী দরকার আর বনসাইটাকে ঘরে রেখে। রাত শেষের অন্ধকারে বনসাইয়ের মাটির পাত্রটিকে ভেঙ্গে দুর্বল হাতে একটু গর্ত খুঁড়ে বসিয়ে দিয়েছে কবরস্থানের নরম মাটিতে। একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে নক্ষত্র খুঁজেছিল নীপবীথি। তারাদের দেশে কোন একটি তারা বন্ধু স্যার তো হবেই ..!

এবার গাছটা বেড়ে উঠুক। কুয়াশা সরে গিয়েছে কখন যেন। আকাশ পরিষ্কার। চশমার বাইরে দিকের কাচেও কোন ছাপ নেই। আর একটাও তারা নেই আকাশে। একা একা বাড়ি ফিরছে নীপবীথি। চৈতালী পথে বড় হালকা লাগছে আজ!

You may also like