একটা লম্বা মিছিল চলছে। মাথায়  হলুদ ফেট্টি–মুখে শ্লোগান। আগ্রাসন।দাম্ভিক চলা। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।চলার পথে কোনো কোনো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।আদেশের ভঙ্গিতে বলছে, ‘ভোটটা ঠিকভাবে দেবেন কিন্তু। নইলে এ গাঁ থেকে নিকেশ করে দেবো।’ বাড়িগুলোর মুখ ভয়ে আতঙ্কে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তবু মুচকি হেসে হাত নাড়ছে।

এই পাড়ায় মাত্র দশ বারো ঘর মুসলমান। খেটে খাওয়া মানুষ।শরীরটাই সম্বল। শরীরটা সুস্থ থাকলে খাবার জোটে। বেশির ভাগই বিদেশ-বিভূইয়ে পরিযায়ী শ্রমিক।তবে ভোটের সময় সমস্ত শ্রমিকই বাড়ি ফিরে আসে। যেন ভোট পাখি।সবার ঠোঁটে একটি করে ভোট। নেতাদের হুকুম জারি করা থাকে ভোটে বাড়ি আসতে হবে। বাড়িগুলোতে ছেলেদের থেকে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। পাড়ার মুসলিম মহল্লায় একজন মাত্র  মাস্টারমশাই –আমান সাহেব পাঁচ মাস হলো অবসর গ্রহণ করেছেন। একজন সৎ ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ। সাতে পাঁচে থাকে না।শান্তি প্রিয় একজন মানুষ। চারিদিকের পরিবশ-অবস্থা দেখে শুনে নিজেকে বাড়িতে লকডাউন করে ফেলেছেন। আগেকার মতো চায়ের দোকানে গিয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে দেশ ও রাজনীতির  গল্প, গাঁ- ঘরের খোঁজ-খবর–এসব আর হয় না। সেখানে পাড়ার উঠতি যুবক যারা এ সমাজের ভাবী নেতা তারাই দখল করেছে।আমান সাহেব বৃদ্ধ  মানুষ। সকালে ব্যাগ হাতে বাজারে যান;বাজার করে বাড়ি ফেরে আসেন। তারপর, বারান্দায় চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ভাবতে থাকেন।

গ্রামের যে একটা নিবিড় আন্তর সৌন্দর্য ছিল তা আর নেই।সবুজ পালাবার পথ খোঁজে। গাঁয়ের মোড়ে ছোট পুলটার উপর একটা বড়ো ওভার পুল তৈরি হয়েছে। হাটের দিন বড্ড জ্যাম্  হতো।হাটের উত্তর দিকে গ্রামীণ ব্যাংকের একটি ব্রাঞ্চ খুলেছে। সনাতন ঐতিহ্যরা দেওয়াল থেকে পলেস্তারা খসে পড়ার মতো ঝরে ঝরে পড়ছে। গ্রাম ভাঙছে। মানুষের মন ভাঙছে। সংস্কৃতিও ভাঙছে। কঠিন একটা রুক্ষতা। একটা অবিশ্বাস –মনের খাঁজে ফাঁটল।অতীতের সঙ্গে আজকের কিছুকেই মেলাতে পারেন  না আমান মাস্টার।

আজ ভোট।পরিবেশ গরম।বাজারে মধুর দোকানের দরজায় কারা নাকি বোম ব্লাস্ট করেছে।  গোটা গ্রাম  রাতে ঘুমাতে পারে নি ।সবাই শঙ্কিত প্রহর গুনেছে। সকাল সকাল বাজারের ব্যাগ হাতে মাস্টার মশাই বাজারে রওনা দিলেন। বেরোনোর  সময় গিন্নি তাড়া দিয়েছেন, ‘দেরি করো না। ভোটের দিন গোলমাল হতে পারে। তাড়াতাড়ি বাজার করে ফেরো।’ বাজারে দলের  ফেস্টুন টাঙিয়ে ভোটের প্রচার চলছে। মাইকে কে যেন বলছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যান আর সকাল সকাল ভোটটা দিয়ে আসুন।

আমান সাহেব বাজার শেষ করে বাড়ি মুখো হয়েছেন। এমন সময় কয়েক জন অল্প বয়স্ক ছোকরা চোখ রগড়ে বলল, ‘স্যার, আপনাকে কিন্তু আমরা আশা করছি। সাবধানে থাকবেন, হ্যাঁ।’ ‘সামনে এগোবেন, এমন সময় একজন টুপ্  করে প্রণাম করে বলল “কেমন আছেন স্যার।” আমান মাস্টার কেমন হকচকিয়ে গেলন। তারপর, বললেন, ‘ভালো আছি।আর কেমন থাকব।দেখছই তো দিনকাল ভালো নয়। আগের মতো কিছুই নেই।’ স্যার  আমি ফিজিক্সে ফাস্টক্লাস নিয়ে অনার্স পাশ করলাম।”বাহ্ , খুব ভালো খবর। আরো বড় হও।’

এবার হাঁটতে হাঁটতে ভাবছেন, সাহা বাড়ির ছেলে। অরিন্দম সাহা। খুব ভালো ছেলে। সেবার মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্কুল-ফাস্ট হয়েছিল।অঙ্কে বরাবর একশোতে একশোই পেতো। ছেলেটাকে অঙ্ক করিয়ে খুব আরাম পেতাম। ভাবতে ভাবতে বাড়ির কাছেই চলে আসলেন।

বাজারটা বাড়িতে রাখলেন ।একটা ধপাস্  শব্দ হলো।  গিন্নির একটু খটকা হলো। বেরুতে দেখে বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছ ? টিফিন খেয়ে যাও।’ ‘এসে খাব ‘।মনে মনে বললেন, এরা আমাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে ছাড়বে। ভোট মিটলেই এন আর সি নিয়ে পাবলিককে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে। তাই ঝক মারার কাজটা আগে  সেরে আসি।

বুথে এসে দেখলেন লাইনে কয়েক জন দাঁড়িয়ে আছে। তিনিও দাঁড়িয়ে পড়লেন। বুথের ভেতরে দেখলেন এক ছোকরা রীতিমতো নির্দেশ দিচ্ছে। বুথে  সমস্ত দলের এজেন্টই নেই।।মাস্টার মশাইয়ের মাথার রগ চড়চড় করে গরম হতে লাগল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে ভোট দিয়ে বাড়ি ফিরলেন। বাড়ি ফিরে স্নান সারলেন। খেয়ে নিলেন। কিন্তু ভোটের দিন কি ঘুমানো যায়?

বারান্দায় একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। রাজনীতি না করলেও জীবনে বাঁ-দিক দিয়ে হেঁটেছেন। গোটা পাড়াটা এক সময় তাঁর কথাতেই ভোট দিত। আজ দিন পাল্টেছে ।কিন্তু মানুষের অবস্থা অবর্ণনীয়ভাবে খারাপ হয়েছে। ঘরেবাইরে মানুষ আজ আতঙ্কিত। নিজেরাই নিজেদের সুরক্ষার বলয় তৈরি করে নিতে চাইছে। নেতাদের গা ঘেষে ঘেষে  থাকছে।

কিছুক্ষণ পর আকাশ জুড়ে ঘন অন্ধকার নেমে এল। কালো মেঘ। অন্য সময় হলে বুথের আশে পাশে বসে গল্প করে সময় কাটত। আজ চেয়ারে বসে ভাবছেন, কেমন ভোট হচ্ছে? কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে গেছেন। কোথায় বোম পড়লো? কালো ধোঁয়া আকাশ ফুঁড়ে উপরে উঠছে। ভয়ংকর অন্ধকার! একটু পরে  তাকিয়ে দেখলেন পড়ন্ত  বিকেলের লাল সূর্যের আলোয় পৃথিবীটা ভরে গেছে। কিন্তু এ আলোয় কেমন একটা জ্বলন্ত আগুনের বিগ্রহ। হ্যাঁ, সেটা ভারতবর্ষের মানচিত্র।যেন মানচিত্রের বিশেষ বিশেষ অংশ জ্বলছে। গুজরাত জ্বলছে, আহমেদাবাদ জ্বলছে।আসাম জ্বলছে ।সেই আগুন ক্রমশ পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তের দিকে ধেয়ে আসছে ।তাহলে কি, গোটা ভারতবর্ষটাই জ্বলবে। আমান মাস্টার চিৎকার করে উঠলেন–‘আগুন’।                                       

ভোট পরবর্তী রাজনীতির দাঙ্গায় রাজ্যে সত্যি সত্যিই আগুন জ্বলে উঠল।
                

You may also like

Vinnokatha
Prothom Khondo
Price: Rs.260/-
www.vinnokatha.in
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে। সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে।সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
Vinnokatha
Prothom Khondo