শঙ্খ ঘোষ প্রতিটি কবিতায় যেমন কষ্টকে দেখেছেন, তেমনি কষ্টের উৎস থেকেই কবিতার নির্মাণ করেছেন এবং পরিণতিতে স্বপ্নকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছেন। তাঁর কবিতায় এই স্বপ্নাকাঙ্ক্ষারই অমরত্ব প্রাপ্তি। ছন্দের ভেতর অন্ধকার থাকলেও, কিংবা মূর্খ বড়ো, সামাজিক না হলেও, কিংবা শূন্যের ভেতর ঢেউয়ের উপস্থিতি উপলব্ধি করলেও জীবনের সংরাগে বারবার তা উচ্ছল হয়ে উঠেছে। বাস্তব পৃথিবীর হাহাকার, ক্লেশ, সংঘাত, বিবর্ণতা কবিকে অস্থির করলেও আত্মজ্ঞানের পরিধিতে কবি সমাহিত সংহত স্রষ্টা হিসেবেই বহুমুখী পর্যটনে তাকে ধারণ করেছেন । তাই কবিতার শিল্পনৈপুণ্যের সিদ্ধিতে কোনও ঘাটতি দেখা দেয়নি। আমাদের বাহ্যিক দৃষ্টি এবং অন্তর্দৃষ্টির আলোয় এক প্রসন্নতার ঘোর সৌজন্য এসে উপস্থিত হয়েছে।
স্মরণে
-
-
একদিন চুপিচুপি বাড়ির কিষান ফেরেসতুল্লার সঙ্গে বাল্য বয়সে গিয়েছিলেন আলকাপের আসরে।তাঁদের গ্রামের কয়েকটি গ্রাম পরে, শ্রীপুরে। তখনও তিনি স্কুলে ভর্তি হননি। সময়ের পূর্বেই পৌঁছে যান। অধিক কৌতূহল নিয়ে ঢুকে পড়েন তৎকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ আলকাপ শিল্পী রিয়াজুদ্দিনের ডেরায়। তাঁরা তখন খানাপিনায় ব্যস্ত। বালক কাশেমকে ডেকে নেন খেতে। খাওয়া হলে দু’আনা পয়সা দিয়ে বলেছিলেন ফিতা এনে দিতে। কাশেম ছুটে যান দোকানে। দামদর করে ফিতা কিনেন ঠিকই কিন্তু পকেটে হাত দিয়ে দেখেন পয়সাটা নেই। ভয়ে ফিরে আসতে পারেননি। রিয়াজুদ্দিন সাহেব লোক পাঠিয়ে ধরে আনেন। ঘটনা শুনে তাঁর মনে হয় পয়সাটা সে খেয়ে নিয়ে এখন মিথ্যে কথা বলছে। সটান কষে দেন একটা থাপ্পড়। বালক কাশেম উল্টে পড়েন এবং জ্ঞান হারান। কয়েকজনের শশ্রুষায় সুস্থ হয়ে উঠেন এবং আসরে বসে গান শোনেন। সেদিনই তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, তিনিও একদিন কবিয়াল হবেন এবং রিয়াজুদ্দিন সাহেবকে প্রতিযোগিতায় হারাবেন।
-
-
সালটি ১৯৭২, তিনি কলকাতা ন্যাশনাল লাইব্রেরির মেঝেতে রাশি রাশি লিটল ম্যাগাজিন অনাদরে পড়ে থাকতে দেখে খুবই মনোকষ্ট পেয়েছিলেন। এই ছোট ছোট পত্রিকা করুণ দশা তথা শেষ পরিণতি ফেলে দেওয়ার কথা জানতে পেরে তাঁর মন প্রচণ্ড ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল। বিস্তর ধুলোয় লুটোপাটি খাওয়া লিটল ম্যাগাজিনের চরম দুর্দশার ক্ষোভ তার মনে জন্ম নিয়েছিল লিটল ম্যাগাজিন রক্ষণাবেক্ষণ ও সংগ্রহের জেদ। এই জেদের শেষ পরিণতি হয়েছিল তাঁর ট্যামার লেনের পৈতৃক নিবাসে একতলার ছোট ছোট দুটো ঘরে। ৭৫০টি বই নিয়ে ১৯৭৮ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠা করেন লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র, যা পরবর্তীতে লিটল ম্যাগাজিনের বিশাল সংগ্রহশালা হয়ে উঠেছিল সমস্ত পাঠকদের কাছে।
-
আত্মিকসংকট থেকে আত্মঅন্বেষণ, দগ্ধচৈতন্যের হাহাকার, মানুষের সামাজিক অবস্থান ও আইডেন্টিটির ক্রাইসিস ফুটে উঠল। মানবিক সম্পর্কের অবক্ষয়ও প্রতিফলিত হল। অর্থনৈতিক শোষণের প্রেক্ষাপট মনন দক্ষতায় রূপ দিলেন। এক একটা ছবিও যেন কবিতার ভাষা পেয়ে গেল। প্রতিটি চিত্রকল্পই নিজস্বতা অর্জন করল।
তাঁর কবিতার কথনভঙ্গিই বলে দেয় বাংলা ভাষায় তা কতটা নতুন স্টাইল। সিনেমা ও কবিতায় তিনি সেই ভাষারই খোঁজ করেছিলেন। প্রথমত তিনি সময়কে নিয়েই বেশি ভেবেছিলেন। অর্থাৎ সময়ের কী চাহিদা ছিল, সময়ের কী স্বর ছিল, কেমন অভিক্ষেপ দরকার তা তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। আবার এই সময়ের উত্তরণও তিনি চেয়েছিলেন সুররিয়ালিজমের মাধ্যমে। সময়ের কাছেই তিনি মানুষের সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থান, মানুষের দেশকাল অর্থনীতির অবস্থাও অনুধাবন করেছিলেন।
-
তাঁর মতে, রাজনীতিতে প্রকৃতপক্ষে শক্তিশালী শ্রেণী হল নিম্নবর্গ, কিন্তু উচ্চবর্গের মানুষ এযাবৎকাল ইতিহাস লিখেছেন, এবং ইতিহাসের রসদ তাঁরাই জুগিয়েছেন। ফলে উচ্চবর্গের ইতিহাস হয়ে উঠেছে জাতীয় ইতিহাস চর্চার বিশেষ নমুনা, যেখানে নিম্নবর্গের ইতিহাস উপেক্ষিত হয়ে এই প্রয়াস একটি অলিখিত আদিকল্পের জন্ম দিয়েছে। গুহর মতো তুখোড় ইতিহাসবেত্তারা তথাকথিত এই জাতীয় ভাবনার মিথ ভেঙে ইতিহাস চর্চার নবায়ন ঘটিয়েছেন সাবলটার্ন স্টাডিজের মধ্য দিয়ে। নিপীড়িতের ইতিহাস, সাহিত্যের উত্তর-ঔপনিবেশিক পাঠ, অথবা রাজনীতি, নৃতত্ত্ব, শিল্পের ইতিহাস বা সংস্কৃতিপাঠ—সবেতেই এই ‘মানবচেতনা’র আবিষ্কার করেছেন রণজিৎ গুহ। তাঁর মতে ক্ষমতা বৃত্তের বাইরে থাকা শ্রমিক, কৃষক, নিম্নমধ্যবিত্ত, গ্রাম ও শহরের গরিব জনতা, আদিবাসী, নিম্নবর্ণ, মহিলা শ্রেণীর ভূমিকা বা অবদানের উল্লেখ যথাযোগ্য ভাবে নির্মিত হয়নি। এই প্রথাগত ইতিহাস চর্চার গতিধারা বদলে দিয়েছেন ।
-
ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য, আইন, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব এমন কোন বিষয় নেই যে তাঁর সংগ্রহে নেই। শুরুর সময় থেকে সাজানো রয়েছে সকল গেজেটিয়ার, অ্যাটলাস ভলিউম, একাধিক বিষয়কেন্দ্রিক মানচিত্র (আমার সচক্ষে দেখা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মানুষ তাঁর বাড়িতে আসতেন শুধুমাত্র মানচিত্র দেখবার জন্য, আমার ধারণা তাঁর সংগৃহীত মানচিত্রের নমুনাগুলি একত্রিত করে একটা গ্রন্থ রচনা সম্ভব) প্রভৃতি। তাঁর সংগ্রহের ছোট একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, তিনি এমন কিছু ঐতিহাসিক নথি আমাকে দেখিয়েছিলেন, যেগুলি প্রায় জীর্ণ। ব্রিটিশ আমলে ইতিহাসসাক্ষ্য ঐতিহাসিক ব্যক্তির সই ও স্ট্যাম্পসহ বিভিন্ন নথি, যা আমাকে বাক্রুদ্ধ করেছিল।
-
ভাই ভাই যুযুধান মধ্যযুগীয় রক্তখেলায়!
শেষ রাতের আঁধার আর পূবালীর মাঝে
সেহেরির অন্ন মুখে, বোধের গভীরে
আজ আমি তোমাকেই দেখেছি রবীন্দ্রনাথ! -
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, চিঠিপত্র, গবেষণা, অনুবাদ সাহিত্য, দর্শন, চিত্রকর্ম, সমাজ সংস্কারমূলক কাজ দিয়ে সর্বজনীন থেকে বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছিলেন। অন্যদিকে নজরুল তাঁর কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধে খুব সচেতনভাবে মানবতাবাদ, সাম্যবাদ, বিপ্লব, নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের মনোবেদনা তুলে ধরে বাঙালি তথা বিশ্বমানবের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। সুতরাং কে বড়? কে ছোট?— এ বিবেচনায় যাওয়া মূঢ়তা ছাড়া আর কিছু নয়। কেউ কারও সমকক্ষ নন, প্রতিদ্বন্দ্বীও নন।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল আমাদের জাতীয় জীবনে অপরিহার্য দুটো নাম, দুটো পরিচয়, দুটো বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চেতনা। বাঙালির বলা-কওয়া, চাওয়া-পাওয়া ও নিজেকে ও অপরকে বর্ণনার জন্য রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল অতীব প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ যেমন, তেমনি নজরুলও আমাদের চেতনার রঙে মিশে আছে।রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুল ইসলামের আন্তরিক সম্পর্কের রসায়ন মুসলিম ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মৌলবাদীরা মানতে পারে না।
-
স্বামীর মৃত্যুর জন্য আমরাও দায়ী। কারণ আমরা প্রশ্ন করাকে এড়িয়ে গিয়েছি অথবা আমরা যথেষ্ট প্রশ্ন করিনি , তুলিনি সঠিক আওয়াজ যতটা তুললে এই হত্যা গুলো বন্ধ হতে পারত। ফাদার স্ট্যান স্বামী রাঁচির একটি মিশনারী আবাসিক স্কুলের প্রধান ছিলেন। সম্ভবত সেই প্রথম খ্রীস্টান মিশনারী যেখানে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল যীশু নয়, বীরসা মুন্ডার মূর্তি । কিন্তু বীরসার লড়াইয়ের ইতিহাস তো রাষ্ট্র আমাদের ভোলাতে চায়। রাষ্ট্র তো মুছে দিতে চায় আদিবাসী জনজাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি, সমাজকে। তাহলে স্ট্যান স্বামীর এই কাজ রাষ্ট্রের পছন্দ হবে কেন?