রবীন্দ্র-নজরুল অমলিন সম্পর্ক

by দীপক সাহা

দীপক সাহা

সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি স্কুলের ঘটনায় তোলপাড় স্যোশাল মিডিয়া। স্কুল থেকে ফিরে এক ছাত্রী হঠাৎ খুব নিবিষ্ট হয়ে গুগল ঘাটছিল। দীর্ঘক্ষণ ল্যাপটপ নিয়ে গুগলে ব্যস্ত, যা সচরাচর করে না। তার বাবা তাকে কি হয়েছে জানতে চাওয়ায় প্রথমে বলছিল না। শেষে নিজেই জানতে চাইল, “বাবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি কাজী নজরুল ইসলামকে ওষুধ খাইয়ে অসুস্থ বানিয়ে দিয়েছিল?”

‘কোথায় শুনলে?’

‘ক্লাসের মিস বলেছে…’

‘আর কি কি বলেছে?’

তিনি বলেছেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি, তিনি বিশ্বকবি হতেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ষড়যন্ত্র করে হতে দেয়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলের সঙ্গে তাঁর বোনের বিয়ে দিয়েছিল। সেই মহিলার মাধ্যমে ওষুধ দিয়ে নজরুল ইসলামকে অসুস্থ বানিয়ে দেয়…’

সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রথম সূত্রই হল, রবীন্দ্রনাথকে নজরুলের সাথে তুলনা করে নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় করে প্রচার করা এবং নজরুলের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি কাল্পনিক শত্রুতার সম্পর্ক আবিষ্কার করে তা আরও বেশি নেতিবাচক করে প্রচার করে বাঙালিদের স্বচ্ছ মনকে অস্বচ্ছ বানান। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের দীক্ষা গ্রহণ তো দূরের কথা, শিশুদের মন বিষাক্ত করে তুলছে এরা। এসব শিক্ষকদের চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে বেশ কিছু উগ্র ধর্মান্ধ ব্যক্তি ও সংগঠন এই শিক্ষিকার পক্ষ অবলম্বন করেছে। এই সমস্ত শিক্ষকরা বাঙালি জাতির কলঙ্ক। বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির আকাশে এ এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্র! বাঙালি জাতির পক্ষে এ এক বিষময় পরিস্থিতি।

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল উভয়ই বাঙালির অক্ষয় নক্ষত্র। সাহিত্য জগতে তাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতির জন্য বিশ্ব দরবারে বাঙালির অহঙ্কার। এই দুই বিস্ময়কর প্রতিভাবান ব্যক্তির মধ্যে মিথ্যাচার প্রচার করে বিভেদের প্রাচীর তৈরি করে বাঙালি সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ সব ক্ষেত্রেই এক সাম্প্রদায়িক দূষণ ছড়ানোর অপচেষ্টা চলছে। কিছু স্বার্থান্বেষী সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন বিভেদকামী মানুষ রবীন্দ্রবিরোধী অবস্থান নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য মেতে আছেন। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যে সুকৌশলে পরিকল্পিতভাবে একটা বৈরী পরিস্থিতি তৈরি করে চলেছে একটি শ্রেনি। এই বিষবাষ্প তারা সুকোমলমতী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এধরণের শিক্ষকরা আসলেই সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর। যে মানসিকতা থেকে তারা এ ধরণের মিথ্যার চর্চা করেন তা বিষধর সাপের বিষের চেয়ে মারাত্মক। জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এক ভুল বার্তা গেঁথে যাচ্ছে। এভাবে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ-বিষ যারা ছড়াচ্ছে, তাদের কোন ক্ষমা নেই। কেন তারা পড়ানোর নামে আমাদের সন্তানদের রবীন্দ্র বিদ্বেষী, ও নজরুল সাহিত্যকে বিকৃত করার এতো বছর ধরে সুযোগ পাচ্ছে? আমাদের সমবেত প্রতিবাদ করার সময় এসেছে।

বাঙালির চিন্তনে, সংস্কৃতিতে নজরুল, রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ সদা বিরাজমান। তাঁরা উভয়েই বাঙালির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। জীবতাবস্থায় তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক সব সময় বজায় ছিল। পরস্পরের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল প্রগাঢ়। বাংলা ও বাঙালির পরিচয়ের ধারক ও বাহক এই দুই মনীষীকে নিয়ে আমাদের আরও সদর্থক চর্চা প্রয়োজন। বাঙালির নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে যদি তাঁদের সম্পর্কে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করার সুযোগ দেওয়া হয়। আখেরে বাঙালি জাতির কাছে সেটা হবে চরম দুর্ভাগ্যজনক। আমি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু আপামর বাঙালির মতোই আমার হৃদয় ও মননে উভয়ের সজীব উপস্থিতি টের পাই। সেই উপস্থিতির বোধ থেকে আজকের প্রতিবেদনে তুলে ধরার চেষ্টা করবো রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্র। চেষ্টা করবো সে সকল দুষ্টুচক্রের মুখের উপর মোক্ষম জবাব দিতে।

রবীন্দ্রনাথ যখন বিশ্বজয়ী তখন পর্যন্ত “কবি নজরুলের” জন্মই হয়নি। তখন তিনি অপ্রকাশিত প্রতিভার একজন মানব শিশু। রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তখন নজরুলের বয়স ১৩ বছর ৭ মাস। যখন নজরুলের মধ্যে কবি প্রতিভা অঙ্কুরিত তখনই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বজয় করে ফেলেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত রচয়িতার নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমরা এটাও জানি বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল। এখানেই যত বিতর্ক। কিছু মৌলবাদী ব্যক্তি ও দল রবীন্দ্রনাথকে মেনে নিতে পারেন না। এটা তাদের বিকৃত বোধের প্রকাশ। প্রকৃতপক্ষে তারা নজরুল অনুরাগীও নন। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল সম্পর্কে তাদের পড়াশোনা, জানাশোনা প্রায় নেই। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে ধর্মের নিরিখে বিভাজন করা যায় না।

দুই কবিই ছিলেন মানবতার পূজারি। তাঁদের সাহিত্যসাধনায় বিশ্বপ্রেমের নমুনা ঝুরিঝুরি। নজরুল তাঁর যাপিত জীবনচর্চায় ছিলেন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের মানুষ। সত্যি কথা বলতে, বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির আঙিনায় নজরুলের মতো অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু দুর্ভাগ্য অসাম্প্রদায়িক নজরুলকে মূলধন করে কিছু সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন মানুষ সমাজে বিষবৃক্ষ রোপিত করছে। রবীন্দ্রনাথের মহত্ব তাদের চিন্তনের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা মনে করেন রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে ঈর্ষা করতেন।রবীন্দ্রনাথই নজরুলের চরম শত্রু ছিলেন। কিন্তু বাস্তবে এর বিপরীতে প্রচুর উদাহরণ আছে।

প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধার সর্বোচ্চ আসনে রেখে নজরুল নিজের সৃষ্টিতে ডুবে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চিন্তা তিনি করেননি বরং স্বতন্ত্র একটি ধারা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে নিজের আসনটি পাকা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের একনিষ্ঠ ভক্ত হয়েও বাংলা সাহিত্যে মৌলিক প্রতিভার কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। অপরদিকে বয়সে অনেক কনিষ্ঠ হলেও নজরুলের প্রতিভার অসম্ভব গুণগ্রাহী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পড়তে পড়তে তাঁদের সুসম্পর্কের কথা ও গল্পই আজকের প্রতিবেদনের বিষয়।

কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২০ সালে কলকাতায় এসে পুরোপুরি সাহিত্য চর্চায় মগ্ন হন। ওই সময় থেকে কলকাতার ‘প্রবাসী’, ‘ভারতী’, ‘মোসলেম ভারত’, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’, ‘নবযুগ’ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় তাঁর কবিতা ও অন্যান্য রচনা প্রকাশ হতে থাকে। বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডায়ও নজরুল নিয়মিত যেতেন। রবন্দ্রীনাথের ব্যক্তিগত সচিব সুধাকান্ত রায় চৌধুরীর কবিতাও ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় বের হত। ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের কবিতা সুধাকান্ত মারফত পড়তেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নজরুল সম্পর্কে নিজের আগ্রহের কথা প্রকাশ করতেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় এবং আরও অনেকের কাছে। তাদের কাছে বিষয়টি জানতে পেরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন নজরুল। অবশেষে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যান নজরুল। দিনটি ছিল খুব সম্ভবত ১৯২১ সালের ২০ জুলাই। সেদিন রবীন্দ্রনাথের সৌম্য, শান্ত, জ্যোতির্ময় মূর্তি দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যান নজরুল। বিস্ময়ের ঘোরে নজরুল কোনও কথাই বলতে পারেননি সেদিন।

আর একটি ঘটনা। ৭ জানুয়ারি, ১৯২২। সকাল বেলা ‘বিজলী’ পত্রিকার চারটি কপি হাতে করে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির সামনে হাজির কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তখন তার বয়স মাত্র ২৩। ‘গুরুজি আপনাকে হত্যা করব, গুরুজি আপনাকে হত্যা করব, গুরুজি, গুরুজি’ বলে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিমায় চিৎকার করছেন নজরুল। জোড়াসাঁকো পুরো বাড়িটাই ছিল শান্ত, স্নিগ্ধ, সুন্দর আর রমণীয়। অথচ রবীন্দ্রনাথ একটু বিরক্ত বা বিব্রতবোধ করেননি, বিন্দুমাত্র অসন্তুষ্ট হননি। রবীন্দ্রনাথ উপর থেকে বললেন, ‘কী হয়েছে? ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেন? এসো, উপরে এসে বসো?’ এবার ‘বিজলী’ হাতে উপরে উঠলেন নজরুল। রবীন্দ্রনাথকে সামনে বসিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিমায় বিদ্রোহী কবিতাটি শুনিয়ে দিলেন–যা আগের দিন ছাপা হয়েছে বিজলী পত্রিকায়। রবীন্দ্রনাথ বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে এতক্ষণ শুনছিলেন, স্তব্ধ হয়ে নজরুলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কবিতা পড়া শেষ হলে তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন এবং দু’হাত প্রসারিত করে তরুণ কবিকে বুকে টেনে নিলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ কাজী, তুমি আমাকে সত্যিই হত্যা করবে। আমি মুগ্ধ হয়েছি তোমার কবিতা শুনে। তুমি যে বিশ্ববিখ্যাত কবি হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তোমার কবিতার জগৎ আলোকিত হোক, ভগবানের কাছে এই প্রার্থনা করি।’

জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে সেদিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের মিলন মুহূর্তটি সাধারণ ব্যাপার ছিল না। কারণ, নজরুল জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ৩৮ বছর পরে। সময়ের এই দূরত্বটা বেশ বড়। অবস্থাগত দূরত্বটা ছিল আরও বেশি প্রসারিত। রবীন্দ্রনাথের জন্ম ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ছিল শিল্পচর্চার একটি প্রধান কেন্দ্র। অপরদিকে নজরুলের পারিবারিক পটভূমিতে এ ধরনের কোনও সুযোগ ও সুবিধাই ছিল না। তাঁর জন্ম প্রান্তিক, অত্যন্ত অনগ্রসর এক এলাকায়। ভূমিষ্ট হয়েছিলেন যে গৃহে সেটি ছিল খড় দিয়ে ছাওয়া এবং মাটির তৈরি। নয় বছর বয়সে তিনি তাঁর পিতাকে হারান। পিতার নাম কাজী ফকীর আহমদ, যে নাম আভিজাত্যের দ্যোতক নয়। তাঁর নিজের নাম দেওয়া হয়েছিল দুখু মিঁয়া। যে বাঙালি মুসলমান সমাজে নজরুলের জন্ম, সেটিও প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের তুলনায় ছিল কমপক্ষে পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে। সবদিক থেকে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের ব্যবধানটা ছিল বিস্তর। কিন্তু সেই ব্যবধান ঘুচিয়ে স্বীকৃতির প্রথম মঞ্চায়ন হয় ১৯২২ সালের ৭ জানুয়ারি জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের আনন্দে উদ্বেলিত নজরুলকে বুকে টেনে নিয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবির স্বীকৃতি দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

১৯২১ সালের অক্টোবরে শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় নজরুলের। রবীন্দ্রনাথের সচিব নিশিকান্ত রায় চৌধুরী সেই সাক্ষাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘গুরুদেবের পাশে দু’জন আগন্তুক সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, তাদের একজনকে আঙ্গুলি-নির্দেশে দেখিয়ে দিয়ে দাদা সুধাকান্ত আমাকে বললেন— ঐ দেখ কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এই কথা বলে দাদা গিয়ে নজরুলের সান্নিধ্যেই বসলেন। নজরুলের পাশেই ফেজ-পরা, কাঁচা-পাকা দাড়ি নিয়ে একজন বসে আছেন; তিনি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি কবি গুরুকে বলছিলেন, ট্রেনে আসতে আসতে কাজী সাহেব আপনার ‘গীতাঞ্জলি’র সব ক’টা গান আমাকে গেয়ে শুনিয়েছেন। কবিগুরু বললেন, তাই নাকি? অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি তো! আমার ‘গীতাঞ্জলি’র গান সবতো আমারই মনে থাকে না। কাজী সাহেব বললেন, গুরুদেব, আমি আপনার কণ্ঠে আপনার একটি গান ও একটি কবিতা শুনতে চাই। শুনে কবিগুরু বললেন, সে কি? আমি যে তোমার গান ও আবৃত্তি শোনবার জন্য প্রতীক্ষা করে আছি, তাড়াতাড়ি শুরু করে দাও, আমাকে আবার রাত্রিবেলার লেখায় ব্যাপৃত হতে হবে। নজরুল দ্বিরুক্তি না করে আবৃত্তি শুরু করলেন ‘আগমনী’ কবিতাটি (‘একি রণ-বাজনা বাজে ঘন ঘন’)। আবৃত্তির পর কবিগুরু তাকে গান গাইবার আহ্বান জানালেন। এবার তার কণ্ঠে করুণ সুর বেজে উঠল— ‘কোন সুদূরের চেনা বাঁশি ডাক শুনেছিস ওরে চোখা।’ এই ছিল তাঁদের একে অপরের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ৬০ আর নজরুল ইসলামের ২২। কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরিতে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভা। নজরুল সভাকক্ষে ঢুকেই সোজা মঞ্চে উঠে বিশ্বকবিকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে মাথায় আশীর্বাদ নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে যাচ্ছিলেন। মঞ্চ থেকে নামার মুখেই রবীন্দ্রনাথ খপ করে নজরুলের হাত ধরে টানলেন। না নজরুল, তুমি নিচে নয়, তুমি এই সভায় আমার পাশেই বসবে। ৬০ বছরের বিশ্বকবির পাশে ২২ বছরের বিদ্রোহী কবি।

গান্ধিজীর অসহযোগ আন্দোলনের ডাক আসলে নির্ভিক কবি নজরুল তাতে যোগ দেন। এ সময় তিনি ‘ধূমকেতু’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। এবার নজরুলের ‘ধূমকেতু’র জন্য রবীন্দ্রনাথ যা লিখে পাঠালেন, তা রীতিমতো রাজনীতি, প্রত্যক্ষ গণজাগরণের সংকেত। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘আয়রে আয় চলে ধূমকেত/ আঁধারে বাঁধ তোর অগ্নি সেতু/ দুর্দিনের এই দুর্গশিরে/ উড়িয়ে দে তোর বিজয়কেতন’। রবীন্দ্রনাথের এই আশিসবাণী কবিতাটি ধূমকেতুর প্রতি সংখ্যায় মূদ্রণের জন্য কবির হস্তাক্ষর ব্লক করানো হয়। প্রথম পৃষ্ঠায়ই সম্পাদকীয় প্রবন্ধ। তার ঠিক উপরেই রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা কবিতাটি প্রতি সংখ্যায় ছাপানো হত। ধূমকেতুতে নজরুলের যে কবিতাগুলো ছাপা হয়, সরকার তা রাজদ্রোহী বলে মনে করে এবং তার ফলে নজরুলের জেল হয়। ১৯২৩ সালে জানুয়ারি মাসে কলকতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে এক বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ড দেন।

নজরুল প্রেসিডেন্সি জেলে (আলিপুর জেল) থাকা অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নামের গীতিনাট্যটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে তিনি লেখেন, ‘শ্রীমান কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কল্যাণীয়েষু।’ রবীন্দ্রনাথ এই প্রথম অত্যন্ত আপনজনদের বাইরে একজন অপরিচিতকে বই উৎসর্গ করলেন, যে ব্যক্তির তখন বয়স মাত্র ২৪ এবং সেই তরুণকে সম্বোধন করলেন কবি বলে। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন সাহিত্যিকদের ‘খেয়ামাঝি’। তিনি প্রত্যেককেই নিজ নিজ ঘাটে পৌঁছে দিতেন। প্রেসিডেন্সি জেলে গিয়ে নাটকটি নজরুলের হাতে দিয়ে উৎসর্গ পৃষ্ঠা খুলে বললেন, ‘এই দেখ, তোর জন্য কবি কণ্ঠের মালা এনেছি।’ নজরুল বইটি তুলে নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে বুকে চেপে ধরলেন। পরবর্তীকালে নজরুল লেখেন, ‘গুরুদেবের এই আর্শীবাদী মালা পেয়ে আমি জেলের সর্বজ্বালা, যন্ত্রণা, ক্লেশ ভুলে যাই।’

আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে নজরুলকে হুগলি জেলে আনা হয়। জেলের বৈষম্যমূলক আচরণ ও উৎপীড়ন-নিপীড়নের প্রতিবাদে নজরুল অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। বন্ধুবান্ধব নজরুলকে অনশন থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এ সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলঙে অবস্থান করছিলেন। নজরুলের বন্ধুরা শিলঙে চিঠি পাঠালেন গুরুদেব যেন নজরুলকে অনুরোধ করেন অনশন ভাঙার। জবাবে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘আদর্শবাদীকে আদর্শ ত্যাগ করতে বলা, তাকে হত্যা করারই সামিল। অনশনে যদি কাজীর মৃত্যুও ঘটে তাহলেও তার অন্তরের সত্য ও আদর্শ চিরদিন মহিমাময় হয়ে থাকবে।’ চিঠিতে এ কথা লেখার পর উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে টেলিগ্রাম করলেন, ‘Give up your hunger strike, Our literature claims you’ এই চিঠি ও টেলিগ্রাম থেকে বোঝা যায় নজরুলের আদর্শের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল এবং ব্যক্তি নজরুলের প্রতি কতটা স্নেহশীল ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

১৯২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর নজরুল প্রকাশ করলেন নতুন পত্রিকা ‘লাঙল’। এবারেও ‘লাঙল’-এর সূচনায় থাকলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি লিখলেন: ‘ধর হাল বলরাম আন তব মরু-ভাল হল/ বল দাও ফল দাও স্তব্ধ হোক ব্যর্থ কোলাহল’। এরই মাঝে নজরুল ইসলাম কবিতা ও গানের অনেকগুলো বই নিয়ে বের করলেন ‘সঞ্চিতা’। উৎসর্গবাক্যে লিখলেন, ‘বিশ্বকবি সম্রাট শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রী শ্রী চরণারবিন্দেষু।’ নজরুল ইসলামও ১৯২৮ সালে নজরুল তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন ‘সঞ্চিতা’ রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন।রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে ১৯২৩-এ আর নজরুল রবীন্দ্রনাথকে বই উৎসর্গ করেছিলেন ১৯২৮ সালে।

মন চাইলেই নজরুল চলে যেতেন শান্তিনিকেতনে। উদ্দেশ্য গুরুদেবের সাক্ষাৎ। মাঝে মাঝে পাগলামীও করতেন খুব বেশি। রবীন্দ্রনাথের স্নেহাধিক্যে অদ্ভূত সব কাণ্ডকারখানা ঘটিয়ে ফেলতেন নজরুল। একদিনের ঘটনা সম্পর্কে নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তীকে নজরুল বলেন, ‘একবার শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম এবং ছিলুমও দিন কয়েক। একদিন দুপুরের পরে কবি বসেছিলেন একা দেহলীর বারান্দায়। বেতের একখানা পিঠ উঁচু চেয়ারে। পায়ের কাছে বসে ওঁর একখানা পা টেনে নিয়েছিলাম কোলের উপর। ইচ্ছে ছিল, একটু টিপে দেব। তারস্বরে কবি চেঁচিয়ে উঠলেন, ওরে, ছাড় ছাড় হাড়গোড় আমার ভেঙে গেল। অপ্রস্তুতের একশেষ। আমি সরে বসেছিলুম। আমার দিকে ফিরে চেয়েছিলেন কবি। চোখ তাঁর পিটপিট করছিল। মুখে মৃদৃ হাসি। বলেছিলেন, ক’খানা গান লিখলে আজ? নাকি খালি চ্যাঁচালেই? মুখ ভাড় করে, মাথা নিচু করে আমি বলেছিলুম, মাঝে মাঝে কী মনে হয়, জানেন?—কী? একটা লাঠির বাড়ি মাথায় মেরে আপনাকে শেষ করে দি?— কেন?—কেন? তাহলে আপনার পাশাপাশি চিরকাল লোকে আমার নাম করবে। আর আমার ছবিও আপনার ছবির পাশে ছাপা হবে।– কী সর্বনাশ! ওরে কে আছিস, শিগগিরিই আয়। এ পাগলের অসাধ্য কিছু নেই। কবির কণ্ঠ একটু উঁচুই হয়েছিল, কয়েকজন এসেও পড়েছিল। তাদেরকে সবিস্তারে কবি আমার কথার ফিরিস্তিও শুনিয়ে দিলন।’ কী সুমধুর সম্পর্ক ছিল তাঁদের মধ্যে!

ছাত্রছাত্রীদের গান শেখানোর জন্য নজরুলকে শান্তিনিকেতনে গিয়ে স্থায়ীভাবে থাকতে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু কোলাহল, হৈ চৈ, করতালিপ্রিয় নজরুল কলকাতা ছেড়ে শান্তিনিকেতনের উদার, শান্ত তপোবনে থাকতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্রনাথের ডাকে সাড়া না দিলেও তাঁর প্রতি নজরুলের ছিল প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবোধ। আমৃত্যু এই শ্রদ্ধাবোধ অটুট ছিল। তাঁদের উভয়ের দেখা-সাক্ষাৎ, চিঠি-পত্র আদান-প্রদান হতো নিয়মিত। চিঠি-পত্রে এবং ব্যক্তিগত সম্বোধনে নজরুল রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুজি’ বলতেন। রবীন্দ্রনাথও নজরুলকে অকাতরে স্নেহ সুধা ঢেলে দিতেন। সহ্য করতেন নানা উৎপাত।

রবীন্দ্রনাথে ‘গোরা’ উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়নের সময় নরেশ্চন্দ্র মিত্র সংগীত পরিচালকরূপে নজরুলকে মনোনীত করেন, তখন সুরকার হিসেবে নজরুলের জনপ্রিয়তা সবার উপরে। চলচ্চিত্রটি যখন মুক্তি পেতে যাচ্ছে, তখন বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড থেকে আপত্তি ওঠে যে, বোর্ডের অনুমতি না নিয়ে ছবিতে রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করা হয়েছে এবং সুরও যথাযথ নয়; অতএব ছবিটি মুক্তি লাভ করতে পারে না। প্রযোজকের মাথায় হাত! নজরুল কালক্ষেপণ না করে ফিল্মের প্রিন্ট ও প্রজেক্টার নিয়ে ট্যাক্সি করে শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথের কাছে চলে গেলেন। সব শুনে রবীন্দ্রনাথ বললেন, কী কাণ্ড বলো তো? তুমি শিখিয়েছ আমার গান, আর ওরা কোন আক্কেলে তোমার দোষ ধরে? তোমার চেয়েও আমার গান কি তারা বেশি বুঝবে? আমার গানের মর্যাদা কি ওরা বেশি দিতে পারবে? এ কথা বলে আগেই লিখে রাখা অনুমতি পত্রে স্বাক্ষর ও তারিখ দিয়ে দিলেন। নজরুল রবীন্দ্রনাথের স্নেহ থেকে কোনও দিন বঞ্চিত হননি।

মাঝেমধ্যে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের মধ্যে সাহিত্য বিষয়ে বাদ-প্রতিবাদ, ঝগড়া-বিবাদ যে হয়নি, তা নয়। কিন্তু কখনই সেই বিবাদ বিচ্ছেদে রূপ নেয়নি। জেলের মধ্যে কথা প্রসঙ্গে নজরুল নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষ কোনও দিনও কবির কাঙ্গাল নয়, ছিলেন বাল্মীকি, ব্যাস, কালিদাস- রবীন্দ্রনাথের সমতুল্য কেউ নন।’ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নজরুলের এ ধারণা সারাজীবন অটুট ছিল। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘বিশ্বকবিকে আমি শুধু শ্রদ্ধা করে এসেছি সকল হৃদয়-মন দিয়ে, যেমন করে ভক্ত তার ইষ্টদেবতাকে পূজা করে। ছেলেবেলা থেকে তাঁর ছবি সামনে রেখে গন্ধ-ধূপ, ফুল-চন্দন দিয়ে সকাল সন্ধ্যা বন্দনা করেছি। এ নিয়ে কত লোক ঠাট্টা বিদ্রুপ করেছে।’ কথাশিল্পী মনিলাল গঙ্গোপাধ্যায় একদিন নজরুলের এই ভক্তি-শ্রদ্ধার কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বললেন নজরুলের উপস্থিতিতেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেসে বলেছিলেন, যাক আমার আর ভয় নেই তাহলে।

একবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের দার্জিলিংয়ে দেখা হয়। এ সময় নজরুল প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি তো ইতালি গেছেন সেখানে কবি দ্যনুনজিও’র সঙ্গে দেখা হয়েছিল কি না? রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেছিলেন, ‘দেখা হবে কি করে তিনি যে তোমার চেয়েও পাগল’। নজরুল নিজেই লিখেছেন, ‘তখন আমার মনে হতো আমার পূজা সার্থক হলো, আমি বর পেলাম।’ ‘অনেক দিন তাঁর কাছে না গেলে নিজে ডেকে পাঠিয়েছেন। কতদিন তাঁর তপোবনে (শান্তিনিকেতন) গিয়ে থাকবার কথা বলেছেন। হতভাগা আমি তাঁর পায়ের তলায় বসে মন্ত্র গ্রহণের অবসর করে উঠতে পারলাম না। বনের মোষ তাড়িয়েই দিন গেল’। নজরুল তাঁর শেষ অভিভাষণে উল্লেখ করেছেন, ‘কবিগুরু তাকে প্রায় বলতেন – এই উন্মাদ তুই প্রস্তুত হ’। তোর জীবনে বিরাট ট্র্যাজেডি অপেক্ষা করছে শেলীর মত, কিটসের মত। তুই নিজেকে প্রস্তুত কর।'(শেষ অভিভাষণ)

রবীন্দ্রনাথের বয়স আশি বছর পূর্তি হয় ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে। তখন কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে লিখেন, ‘অশ্রুপুষ্পাঞ্জলি’। ১৯২০ থেকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পূর্বকাল পর্যন্ত রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক স্নেহ ও শ্রদ্ধার। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে নজরুল যে গভীরভাবে শোকাভিভূত হয়েছিলেন তার পরিচয় রবীন্দ্রনাথের পরলোকগমনে তাৎক্ষণিকভাবে রচিত নজরুলের বিভিন্ন কবিতা ও গানে পাওয়া যায়। এই দিন (২২ শ্রাবণ’ ১৩৪৮) কাজী নজরুল ইসলাম আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র থেকে ধারাবর্ণনা প্রচার করেন। তিনি আবৃত্তি করেন ‘রবিহারা’ কবিতা এবং রচনা করেন ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’। এ ছাড়া ‘সালাম অস্তরবি’ এবং ‘মৃত্যুহীন রবীন্দ্র’ নামে দুটি কবিতা রচনা করেন।

এ রকম অসংখ্য উদাহরণ সামনে আনা যায়। নজরুল-রবীন্দ্রনাথের এই চিরায়ত মধুর সম্পর্ক সম্পর্কে বিন্দু-বিস্বর্গ না জেনেই বাঙালি সমাজের একাংশ নজরুল-রবীন্দ্রনাথকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা চালায়, তাদেরকে নিয়ে রাজনীতি করে, উভয়কে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার মাপকাঠিতে মেপে দ্বিখণ্ডিত করে। সম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় বিভাজনে তাঁদের দু’জনকে শত্রু বানিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু নজরুল-রবীন্দ্রনাথকে যারা সত্যিকার অর্থেই জেনেছেন, বুঝেছেন, ধারণ করতে পেরেছেন, তারা স্বীকার করবেন প্রকৃত অর্থেই তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। নজরুলের প্রতি রবীন্দ্রনাথের স্নেহ ছিল অপরিমেয়, অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথের প্রতি নজরুলের ছিল অতল শ্রদ্ধা। তাঁদের মধ্যে শত্রুতা তো দূরে থাকুক, মনোমালিন্যও কোনও দিন হয়নি। অসম্ভব প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ নিজের সারা জীবনের সুপ্ত শক্তির সাকাররূপ নজরুলের মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন। সে কারণে তিনি নজরুলকে বুকে টেনে নিয়েছেন, পাশে বসিয়েছেন, স্নেহ-শাসনে নজরুলের জীবন পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন কানায় কানায়।

বেশ কিছু দিন ধরে বাংলাদেশের গায়ক নোবেল-এর একটি মন্তব্যকে ঘিরে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। নোবেল বলেন, রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হওয়ার উপযুক্ত নয়। জাতীয় সংগীতের মতো স্পর্শকাতর, প্রতিষ্ঠিত ও সর্বজনীনভাবে গৃহীত বিষয় নিয়ে নোবেলের মতপ্রকাশ অভিসন্ধিমূলক। গায়ক রবীন্দ্রনাথকে হেয় করা ও রবীন্দ্রসংগীত কিংবা জাতীয় সংগীত নিয়ে এমন ঘটনার অবতারণা এই প্রথম নয়, দেশের রাজনীতি-শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ইতিহাস সাক্ষী— বহুবার জাতীয় সংগীত-রবীন্দ্র বিদ্বেষের ঘটনা ঘটেছে। তারা রবীন্দ্রনাথের নাম মুছে দিতে চাইছে। মিথ্যাচার দিয়ে তাঁকে হত্যা করতে চাইছে। এদেরই পূর্বসুরীরা একসময় নজরুলকে মুরতাদ অর্থাৎ নাস্তিক বলে ঘোষণা করেছিল। বিদ্রোহী কবির মৃত্যুর পর তারা মিছিল করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্ত্বরে যেন কবির মৃতদের সেখানে কবর দেওয়া না হয়। আর এখন তারাই নজরুলপ্রেমে গদগদ।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, চিঠিপত্র, গবেষণা, অনুবাদ সাহিত্য, দর্শন, চিত্রকর্ম, সমাজ সংস্কারমূলক কাজ দিয়ে সর্বজনীন থেকে বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছিলেন। অন্যদিকে নজরুল তাঁর কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধে খুব সচেতনভাবে মানবতাবাদ, সাম্যবাদ, বিপ্লব, নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের মনোবেদনা তুলে ধরে বাঙালি তথা বিশ্বমানবের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। সুতরাং কে বড়? কে ছোট?— এ বিবেচনায় যাওয়া মূঢ়তা ছাড়া আর কিছু নয়। কেউ কারও সমকক্ষ নন, প্রতিদ্বন্দ্বীও নন। দুজনই ছিলেন দুজনের শুভাকাঙ্ক্ষী।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের ছিল গভীর সখ্য। নির্মল গুরু-শিষ্য সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল বাঙালি জাতি ও বাংলার দুই মহান ব্যক্তিত্ব ও বাংলা সাহিত্যের সর্বাধিক জাজ্বল্যমান তারকা। তাঁদের মহত্ব আর ঔদায্য বাঙালির গর্বের বিষয়। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল আমাদের জাতীয় জীবনে অপরিহার্য দুটো নাম, দুটো পরিচয়, দুটো বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চেতনা। বাঙালির বলা-কওয়া, চাওয়া-পাওয়া ও নিজেকে ও অপরকে বর্ণনার জন্য রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল অতীব প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ যেমন, তেমনি নজরুলও আমাদের চেতনার রঙে মিশে আছে।রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুল ইসলামের আন্তরিক সম্পর্কের রসায়ন মুসলিম ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মৌলবাদীরা মানতে পারে না। তাই দুই মহান প্রতিভাধর বাঙালির সুসম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টি করতে নানা ধরনের সমালোচনা, আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র অবিরামভাবে চলে আসছে। সাহিত্যের মর্মমূলে প্রবেশ করার যোগ্যতা বা অধিকার যারা রাখেন না, তারা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে বিচার করেছেন ধর্ম দিয়ে। তারা বুঝতে পারেননি মানবিকতার সাধনাই করে গেছেন চিরকাল রবীন্দ্র-নজরুল।

You may also like