গবেষক তাজউদ্দিন বিশ্বাসের জন্মদিবস: স্মৃতি সুধাপান

টুকটুকি হালদার

“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।

মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি।।”     

শ্রীমদ্ভগবদগীতা (২ : ৪৭)

স্বধর্ম বিহিত কর্মে তোমার অধিকার আছে, কিন্তু কোনো কর্মফলে তোমার অধিকার নেই। কখনো নিজেকে কর্মফলের হেতু বলে মনে কোরো না, এবং কখনো স্বধর্ম আচরণ না করার প্রতিও আসক্ত হয়ো না।

গবেষক তাজউদ্দিন বিশ্বাসের এটিই ছিল তাঁর জীবনদর্শন। আজীবন তিনি কর্মই করে গেছেন, কিন্তু ফলভোগের আশা কখনো করেননি; ফলভোগ করেছে বা করছে দেশ ও দশের মানুষ।

আজ ১৩ই মে, তাজউদ্দিন বিশ্বাসের জন্মদিবস। তাঁর স্মৃতি সবসময় মনে আনাগোনা করলেও আজ এই বিশেষ দিনে তাঁর বিষয়ে কিছু অজানা অগ্রন্থিত কথা বলতে মন চায়। আমার সঙ্গে তাজ জেঠুর বয়সের পার্থক্য প্রায় বছর চল্লিশের। কিন্তু তাঁর শেষ পাঁচ বছরের ছায়াসঙ্গী তথা কর্মসঙ্গী হিসেবে কাজ করেছি নিরলস। এই স্মৃতিচারণা আমার মণিকোঠায় লুকিয়ে থাকা কিছু টুকরো স্মৃতিকথার বেণিবন্ধন। 

 ২০১৫-২০১৬ সালের আগে মুর্শিদাবাদ জেলার ডোমকল ব্যতীত তাজউদ্দিন বিশ্বাসের পরিচিতি তেমন ছিল না। সকলের কাছে তাঁর প্রথম পরিচয় তাঁর অন্যতম গ্রন্থ ‘মুর্শিদাবাদের ইতিহাস : পরগণা গোয়াস’ গ্রন্থটি অধ্যয়নে, ব্যতিক্রমী নই আমিও। মূলত এই বইটির জন্যই তিনি জনসমক্ষে এসেছেন। তৎপূর্বে তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদবাসীর কাছে রাস্তা চলতি অজানা পথিক। পথিক হয়েই খুব কম বয়স থেকে গবেষণার ভূত মাথায় চাপিয়ে গ্রাম গ্রামান্তরে ঘুরেছেন – এটাই ছিল তাঁর নেশা; তবে এটি তাঁর পেশা ছিল না। নেশায় এমন বুঁদ হয়েছিলেন যে, পারলেই তিনি সরকারী কর্মী হয়ে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাতে পারতেন, সে যোগ্যতা ও সামর্থ দুই-ই ছিল; কিন্তু ঐ যে নেশা, যা মানুষের পেশাকেও অনেক সময় ছাপিয়ে যায়। নেশাকে জীবনসঙ্গী করতে গিয়ে বারবার অর্থকষ্ট, নানান সমস্যা সহাস্যে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। বেঁচে থাকার সামান্য খোরাক পোশাকের জন্য আইনী সহায়কের পেশা বেছে নিয়ে সংসার চালিয়েছিলেন। আবার যখনই তিনি কন্যাদের বিবাহ দিতে ও পুত্রদের রোজগারী বানাতে সক্ষম হয়েছিলেন, তখনি তিনি পেশা ত্যাগ করেন। জীবনের শেষ দশ-বারো বছর গবেষণার নেশাতে মত্ত হয়ে, সাংসারিক সমস্ত দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করে, পুরোপুরি গবেষণা ও লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেছিলেন।

 তাজউদ্দিন বিশ্বাস তাঁর গবেষণা, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার কাজ শুরু করেন প্রায় তিরিশ বছর বয়স থেকে আর গ্রন্থপ্রকাশ শুরু হয় সত্তরের কাছাকাছি বয়স থেকে। এর মাঝে কোনো গ্রন্থ, এমনকি কোনো প্রবন্ধও প্রকাশিত করেননি। আমরা যাঁরা একটু লেখালেখির মধ্যে থাকি বা দু-চারটি গ্রন্থ পড়েছি বা নতুন কিছু ভাবনা ভেবেছি তখনই সেটা লিখে তার প্রকাশের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকি। আমি বারবার তাজ জেঠুকে জিজ্ঞাসা করেছি “আপনি এতদিন কেন লেখেননি?” উত্তর এসেছে সদাহাস্য চেহারায়, “লিখেছি আমি অনেক ছোট থেকেই, কিন্তু মনের মতো লেখা হয়ে উঠতে গেলে লেখাগুলিকে দীর্ঘদিন ফেলে রাখতে হয়, সময়ের ব্যবধানে লেখাগুলি পড়লে নিজের প্রকৃত মূল্যায়ন করা যায়, এতদিন শুধু লিখেছি আর কেটেছি। এইভাবেই কাটতে লিখতে গিয়ে জীবন সায়াহ্নের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছি।”

 তাজউদ্দিন বিশ্বাস অত্যন্ত সৃজনশীল মানুষ ছিলেন। তাঁর গ্রন্থাগার অনেকেই দেখেছেন এবং প্রথম নজরেই বিস্ময়াভূত হয়েছেন। এই বিস্ময়ের কারণ কিন্তু তাঁর প্রচুর বইয়ের সম্ভার দেখে নয়, কারণ এর থেকেও বড় লাইব্রেরী অনেক বইপ্রেমীর ঘরেই দৃষ্ট হয়। এই বিস্ময়ের কারণ হল, তাঁর বই সংরক্ষণের কৌশল। প্রত্যেকটি বই তার আয়তন মাফিক প্লাস্টিক মোড়কের মাধ্যমে বিন্যস্ত করে সুসজ্জিত করা রয়েছে, যা সহজেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

 তাজউদ্দিন বিশ্বাসের সংগ্রহ ছিল বহুমুখী বিষয়কেন্দ্রিক। তিনি বইপ্রেমী ছিলেন, অনেকেই থাকেন। বেশিরভাগ সংগ্রহপ্রেমী মানুষ নিজের গ্রন্থাগারে বই রাখেন, পত্রিকা রাখেন, সংবাদপত্রও দেখেছি। কিন্তু তাজউদ্দিন বিশ্বাসের সংগ্রহশালায় এগুলি ব্যতীত আরো এমন কিছু ব্যতিক্রমী সংগ্রহ আছে যা আমাদের আশ্চর্য করে বইকি। আমি উনার সাথে একাধিকবার বিভিন্ন ক্ষেত্রসমীক্ষায় গিয়েছি, অবাক হয়েছি রাস্তায় পড়ে থাকা সামান্য কাগজ দেখলেও তিনি সেটি তুলে পড়তেন এবং তেমন হলে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিতেন। আমি প্রথম প্রথম খুব অবাকই হতাম। তারপর তিনি আমার মনের শঙ্কা দূর করবার জন্য তাঁর সংগ্রহের কিছু নমুনা দেখিয়েছিলেন, সেখানে সংগৃহীত হয়েছে রাস্তায় পড়ে থাকা লিফ্লেট থেকে শুরু করে দেওয়ালের পোস্টার পর্যন্ত। প্রত্যেকটি কাগজ তার নিজস্ব সারবস্তু অনুযায়ী সাদা কাগজের উপর আঠা দিয়ে আটকিয়ে অসাধারণ বাঁধাই কৌশলের মাধ্যমে সজ্জিত হয়েছে। হঠাৎ কোন ব্যক্তি প্রথম দর্শনে তাঁর গ্রন্থাগারের সঠিক মূল্যায়ন করতে অসমর্থ হবে। তাঁর গ্রন্থাগারের সঠিক মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজন তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি।

 ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য, আইন, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব এমন কোন বিষয় নেই যে তাঁর সংগ্রহে নেই। শুরুর সময় থেকে সাজানো রয়েছে সকল গেজেটিয়ার, অ্যাটলাস ভলিউম, একাধিক বিষয়কেন্দ্রিক মানচিত্র (আমার সচক্ষে দেখা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মানুষ তাঁর বাড়িতে আসতেন শুধুমাত্র মানচিত্র দেখবার জন্য, আমার ধারণা তাঁর সংগৃহীত মানচিত্রের নমুনাগুলি একত্রিত করে একটা গ্রন্থ রচনা সম্ভব) প্রভৃতি। তাঁর সংগ্রহের ছোট একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, তিনি এমন কিছু ঐতিহাসিক নথি আমাকে দেখিয়েছিলেন, যেগুলি প্রায় জীর্ণ। ব্রিটিশ আমলে ইতিহাসসাক্ষ্য ঐতিহাসিক ব্যক্তির সই ও স্ট্যাম্পসহ বিভিন্ন নথি, যা আমাকে বাক্‌রুদ্ধ করেছিল। উনি সেগুলি তেমনভাবেই অক্ষত রেখেছেন, নিজের সংরক্ষণের কৌশল তাতে আরোপ করেননি। তাজ জেঠু আমাকে বলেছিলেন, “আমি এইগুলি এক কপি জেরক্স করে রাখতে চাই, কিন্তু দোকানে দিলে তাঁরা কপি করে নিতে পারে। এই আশঙ্কায় কখনো দিইনি, তোমার যদি একটা স্ক্যানার থাকত তাহলে তোমাকে দিতাম।” আমি রসিকতা করেই বলেছিলাম, “আমিও তো চুরি করে নিতে পারি”। উনি হেসে বলেছিলেন, “তুমি ছাপিও, অনুমতি দিলাম।” আসলে কিছুই নয়, এটি তাঁর আমার প্রতি অসীম স্নেহ ও বিশ্বাসের প্রতিফলন।

 বর্তমানে আমি অস্থায়ীভাবে মেদিনীপুরের বাসিন্দা। মুর্শিদাবাদ আমার জন্মভূমি ও গবেষণার ক্ষেত্রভূমি। পরিবারের টানে ও গবেষণার তথ্যসংগ্রহের তাগিদে বারবার আমার ভূমি আমাকে টেনেছে। তাই যে কদিন আমি মুর্শিদাবাদে থাকতাম, সেই কদিনের ক্ষেত্রসমীক্ষার একটি পূর্বতালিকা তাজ জেঠু করে রাখতেন। এমনও হয়েছে টানা সাতদিন সাত জায়গা পরিদর্শন করেছি। আমার এই বয়সেও প্রতিদিনের সফরে বারবার ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, কিন্তু তাজ জেঠুকে কখনো দেখিনি ক্লান্ত হতে। অত্যধিক যাতায়াতের কারণে ক্ষেত্রসমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্যগুলিও দিনের শেষে মূল্যায়ন করার সামর্থ আমার ছিল না। সেইসময় শুধু সংগ্রহ করেই রাখতাম, পরবর্তীতে মূল্যায়ন করতাম। কিন্তু তাজ জেঠুর পরিশ্রমের কথা ভেবে আমাকে অবাক করত প্রায়শই।

উনি সকাল থেকে সন্ধ্যারাত পর্যন্ত সারাদিন ক্ষেত্রসমীক্ষায় ঘুরবে সেটা জানা সত্ত্বেও ভোররাত্রে উঠে পূর্বদিনের ক্ষেত্রসমীক্ষায় উঠে আসা তথ্যগুলির মূল্যায়ন করতেন। আর ক্ষেত্রসমীক্ষার উদ্দেশ্যে আমরা যখন বাস বা ট্রেন ধরতাম তখন ব্যাগ থেকে নিজের হাতে লেখা কিছু লেখালেখি আমাকে দিয়ে বলতেন, “দেখো তো, কালকের ক্ষেত্রসমীক্ষায় উঠে আসা তথ্যগুলি ঠিকমতো বিন্যস্ত হয়েছে কিনা!’’ আমি অবাক হই আরো এই ভেবে যে, উনার কাছে একটা ডায়রি পেন ব্যতীত কিছুই থাকত না, কারণ আমার কাছেই সব অডিও ভিডিও থাকত। তিনি মূলত স্মৃতি ও ডায়রি অবলম্বন করে পূর্বদিনের সমস্ত তথ্য সাজিয়ে সুন্দর একটি লেখা দিনের দিন লিখে ফেলতেন। এটি আমাকে আশ্চর্য করত। আমি তাজ জেঠুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম দিনে কখন লেখালেখি করা উচিত? উনি উত্তরে বলেছিলেন, “সারাদিন মানুষের সাথে আলাপচারিতা করো, সামাজিক কাজে আত্মনিয়োগ করো, আর যেখানে যা পাচ্ছো, পড়ো; কিন্তু লেখালেখির প্রকৃত সময় ভোর ৩টে থেকে ৬টা। এইসময় তোমার হাত থেকে যে লেখা বেরোবে সেইটাই অমৃত হয়ে উঠবে।” আমি হেসে বলেছিলাম, “তাহলে হয়তো কোনদিনও লেখালেখি হল না আমার।” তবে সেদিন অনুধাবন করেছিলাম কতটা অধ্যবসায় ও লেখার প্রতি নিষ্ঠা থাকলে এমনভাবেও কাজ করা যায়।       

 প্রবন্ধের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার কোনো ছাপ রাখতে চাই না, তবুও কিছু কথা না বললে তাজউদ্দিন বিশ্বাসের মহানুভবতার কথা অপ্রকাশিতই থেকে যায়। উনি জাতিতে মুসলিম। মুসলিম জাতির রীতি-নীতি, আদব-কায়দা, সমাজ-সংস্কৃতি উনার নখদর্পণে থাকবে – এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু হিন্দু সংস্কৃতি ঐতিহ্য নিয়ে উনার গভীর জ্ঞান ও অন্তর্দশন আমাদের সকলকে আশ্চর্য করত। একদিন একটি সাহিত্যিক আলোচনা সভায় হিন্দুধর্ম বিষয়ক উনার বক্তব্য সকলকে অভিভূত করেছিল, তাঁর জ্ঞানের সুবিস্তৃত পরিধি প্রত্যক্ষ করে উপস্থিত সকল সুপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষক গবেষক বুদ্ধিজীবী মানুষসহ সাধারণ দর্শক দাঁড়িয়ে করধ্বনি দিয়েছিলেন। সেইদিনই তিনি ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর পরবর্তী গ্রন্থের পরিকল্পনা ও নকশা তৈরি রয়েছে, তাকে শুধু শব্দসজ্জায় সজ্জিত করে ছাপানোর অপেক্ষা। গ্রন্থনাম ‘মুর্শিদাবাদের ইতিহাস : গ্রাম ও সংস্কৃতি’। সৌভাগ্যবশত এই বইয়ের কম্পিউটারের টাইপ ও বিন্যাসের কাজে আমি নিযুক্ত ছিলাম। ফলত আমি দেখেছি কতটা পরিশ্রম থাকলে এমন ধরণের গ্রন্থ লেখা সম্ভব। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, তিনি বইটি অর্ধসমাপ্ত রেখে পরলোকে গমন করলেন। দুশ্চিন্তার বিষয়, গ্রন্থটি আদৌ প্রকাশিত হবে কিনা আমি জানিনা, তবে যদি কখনো প্রকাশিত হয় তবে পাঠকসমাজ দেখবেন, মুর্শিদাবাদ জেলা সংস্কৃতির এমন বিস্তৃত পর্যালোচনা পূর্বে খুব কম হয়েছে এবং পরবর্তীতে আদৌ আর হবে কিনা সে বিষয়েও দ্বিধা রয়েছে। এককথায় এই গ্রন্থটি হবে মুর্শিদাবাদ গ্রামসংস্কৃতির এনসাইক্লোপিডিয়া। যেহেতু তিনি গ্রন্থটি সমাপ্ত করে যেতে পারেননি, ফলত ভবিষ্যতে কোন ব্যক্তি আদৌও উনার গদ্যশৈলী অনুযায়ী গ্রন্থটি সমাপ্ত করতে পারবেন কিনা এটা যেন অনেক বড় প্রশ্নচিহ্ন। কখনো যদি গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় তাহলে গ্রাম-সংস্কৃতির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলেই আমার বিশ্বাস।

শেষে আমার আর জেঠুর হার্দিক সম্পর্কের দু-এক কথা বলতে মন চাই। উনি আমাকে তাঁর তৃতীয় কন্যা হিসেবেই সব জায়গায় পরিচয় দিতেন। একদিন কলেজস্ট্রীটের পুরোনো বইয়ের দোকানে গেলে জেঠুকে দোকানদার বলেছিলেন, “আজ মেয়েকে নিয়ে এসেছেন!” আমি রসিকতা করেই বলেছিলাম, “কী করে বুঝলেন, আমি উনার মেয়ে?” দোকানদার বলেছিলেন, “একই আদলের মুখ তো!” জেঠু উনাকে বলেছিলেন, “মেয়ে না হলে এত চেহারার মিল থাকে! হ্যাঁ আমারই মেয়ে।” উনি আমাকে আমার গবেষণাকর্মে প্রভূত উপকার করতেন আর আমিও নিস্বার্থভাবেই উনাকে শ্রদ্ধা করতাম। তাজ জেঠু মারা যান ৩রা এপ্রিল, ২০২১। আমি মার্চ মাসে বহরমপুর থাকার সুবাদে উনার সাথে বেশ কয়েকবার ক্ষেত্রসমীক্ষাতেও গিয়েছিলাম। আমাদের শেষ একসঙ্গে ক্ষেত্রসমীক্ষা ছিল ২১শে মার্চ ভগবানগোলা থানায় এবং আমার মেদিনীপুর ফেরার দিন ছিল ২৪শে মার্চ। জেঠু আমাকে ২১শে মার্চ বললেন, ‘’২৪শে মার্চ নয়, তুমি ৩রা এপ্রিল মেদিনীপুর ফিরবে। আমরা আরো দু-তিন জায়গা এর মধ্যে ঘুরবো”। আমি সম্মতি জানিয়েছিলাম। উনি হঠাৎ ২৭শে মার্চ সন্ধ্যারাতে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে অসুস্থ হলেন, বহরমপুর মেডিক্যালে কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলেন আর প্রায় এক সপ্তাহ জীবন-মরণের যুদ্ধ করে ৩রা এপ্রিল সকালে মারা গেলেন। ৩রা এপ্রিল জেঠুর মারা যাওয়ার খবর পেতেই বুঝলাম উনি কেন আমাকে ৩রা এপ্রিল পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ থাকার কথা বলেছিলেন। এখন মনে হয় তাঁর অন্তর্যামী চেয়েছিল শেষকালের শেষ কয়টা দিন আমি যেন ওনার ছায়াসঙ্গী হয়েই থাকি।   

তাজউদ্দিন বিশ্বাস সম্পর্কীত কিছু তথ্য

জন্ম    ১৩ মে ১৯৪৬ সালে মুর্শিদাবাদ জেলার ডোমকল থানার ফতেপুর গ্রামে।

মৃত্যু   ৩রা এপ্রিল ২০২১ সালে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।

মৃত্যুর পূর্বে প্রকাশিত গ্রন্থ

১)  মুর্শিদাবাদ জেলায় কমিউনিস্ট নেতৃত্বের সম্পর্ক – ২০১৪

২)   মুর্শিদাবাদের ইতিহাস : পরগণা গোয়াস – ২০১৬ বইটি প্রকাশের দুবছরের মধ্যে ‘আউট অফ মার্কেট’, যদিও ৭৫০টি কপি মুদ্রিত হয়েছিল। আজও অনেকে বইটি সংগ্রহের জন্য যোগাযোগ করেন।)

৩)    মুর্শিদাবাদের ইতিহাস : গ্রাম ও গড়ন – ২০১৮

মৃত্যুর পরে প্রকাশিত গ্রন্থ

১)  মুর্শিদাবাদের ইতিহাস : গ্রাম ও মানুষ – ২০২২ (গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী কোরোনা অতিমারীর কারণে বিলম্ব হয়েছিল, আর ২০২১  সালে প্রকাশিত হওয়ার পূর্বমুহূর্তে উনি মারা যান।)

স্মারকগ্রন্থ

১)    টুকটুকি হালদারের সম্পাদিত – শ্রদ্ধাস্পদেষু গবেষক তাজউদ্দিন বিশ্বাস স্মারক গ্রন্থ – ২০২১

অসমাপ্ত কাজ

১)     মুর্শিদাবাদের ইতিহাস : গ্রাম ও সংস্কৃতি

২)     মুর্শিদাবাদের ইতিহাস : জল ও জঙ্গল

৩)    মুর্শিদাবাদের ইতিহাস : ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব

৪)     মুর্শিদাবাদের দলীয় রাজনীতির গ.সা.গু

৫)    চেনা হরিহরপাড়ার অচেনা বৃত্তান্ত

উক্ত অপ্রকাশিত অসমাপ্ত কাজগুলি ব্যতীত আরো কিছু লেখালেখি তিনি করছিলেন, আমার অজ্ঞতাবশত সেগুলি উল্লেখ করতে পারলাম না। এছাড়া আমি মনে করি তাঁর সংরক্ষণ থেকে আরো কিছু গ্রন্থ রচনা সম্ভব। তাজউদ্দিন বিশ্বাসের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে ‘মুর্শিদাবাদের ইতিহাস : গ্রাম ও গড়ন’ গ্রন্থের জন্য তিনি ভারতীয় দলিত সাহিত্য অকাদেমী থেকে “ডঃ আম্বেদকর ফেলোশিপ রাষ্ট্রীয় সম্মান-২০১৯” সম্মাননা পান। ঐ একই গ্রন্থের জন্য হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রন্থটির ইংরেজী ভাষান্তরণ প্রকাশের ইচ্ছাও প্রকাশ করেন। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, দিল্লিসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে তিনি সংবর্ধিত ও সম্মানিত হন।  

পরিশেষে এইটুকুই বলতে চাই, তিনি পঁচাত্তর বছর বয়সে মারা গেলেন। সাধারণদৃষ্টিতে তিনি স্বাভাবিক বয়সেই মারা গেছেন। কিন্তু পাঠকসমাজের কাছে তিনি অত্যন্ত অকালেই চলে গেলেন। মাত্র পাঁচ-ছয় বছরের লেখনীতে তিনি যেসব অমূল্য কাজ আমাদের উপহার দিয়েছেন, সেখানে তিনি আরো কিছু বছর জীবিত থাকলে মুর্শিদাবাদ জেলা নিজেকে নতুন করে দেখবার অবকাশ পেত। তাঁর এমন হঠাৎ চলে যাওয়া আমাদের গবেষণা জগতের চরম ক্ষতি বলেই মনে করছি।  

You may also like