ডাইনি হত্যার মূলে শ্রেণি বৈষম্য ও আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সংঘাত

ডাইনি হত্যর উৎস সন্ধানে
সুপর্ণা লাহিড়ী বড়ুয়া
সেতু প্রকাশনী, ২০১৬
পাতা ১৪৪
মুল্য ১২৫

“দেশ একবিংশ শতকে। স্মার্ট ফোন, স্মার্ট সিটির আলোর তলায় তবুও নিকষ অন্ধকার– ‘ডাইনি হত্যা'”

সুপর্ণা লাহিড়ী বড়ুয়া মোট ১৮টি অধ্যায়ে ডাইনি হত্যার উৎস সন্ধানে বইটি লিখেছেন। পরিশ্রমসাধ্য ও তথ্যবহুল। তবে ডাইনির উৎস সন্ধান করতে গিয়ে উনি আমাদের একরকম অচ্ছুৎ ইতিহাসের দিকও তুলে ধরেছেন। ‘ভারতীয় নারীর মেরুকরণ’, ‘নবজাগরণের একচোখামি’, ‘জনজাতির জীবনে ডাইনি’ -ইত্যাদি অধ্যায়গুলো তারই প্রমাণ দেয়। আবার সেখানে উনি এনেছেন ভারতের নানা রাজ্যের ক্ষেত্রভিত্তিক রিপোর্ট, ‘ডাইনি নিধনের স্ন্যাপশট’, ‘ডাইনি শিকার’-এর বিভিন্ন প্রসঙ্গ, যা বাস্তব ও বিবেক দংশনে সক্ষম। নিয়ে গিয়েছেন আমাদেরকে ডাইনি হত্যার বিশ্ব পরিক্রমায়। তুলে ধরেছেন মনুবাদের পিতৃতান্ত্রিক আস্ফালন, বাজার-অর্থনীতির শোষণ ও উপজাতি-জনজাতিদের বহু বঞ্চনার জ্বলন্ত দলিল। ক্ষেত্রসমীক্ষা, তত্ত্ব, তথ্য সহযোগে হাজির করেছেন ডাইনি প্রথার উৎস , রসদ ও একে কাজে লাগিয়ে শোষণ ও শাসনের বহুস্তরভিত্তিক দৃঢ় আলোচনা।

সৃষ্টির উষালগ্নে মানুষ ছিল বড় অসহায়। বেঁচে থাকার জন্য সর্বদা লড়াই করতে হতো। অস্তিত্বের জন্য লড়াই। তখন মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রাহক, খাদ্য উৎপাদন করতে তারা জানত না‌। কিন্তু জন্মসূত্রে তারা শিখেছিল কিভাবে মিলেমিশে দলবদ্ধ ভাবে থাকতে হয়। গুহা জীবন থেকে বর্তমান মানব সভ্যতা দীর্ঘ পথ পরিক্রমা পর্যালোচনা করতে গেলে এটা বুঝতে আমাদের খুব একটা অসুবিধা হবে না–মানুষ যতদিন উৎপাদন করতে শেখেনি ততদিন তারা বোঝেনি বৈষম্যের সমীকরণ। বিজ্ঞানের দৌলতে আস্তে আস্তে মানব সভ্যতা যত উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে ততই দক্ষতার সঙ্গে শিখে নিয়েছে মানুষকে শোষণ করা, অত্যাচার করা ও ঠকানোর কৌশল।

বিজ্ঞান মানুষ ও তার জীবনদানকারী সভ্যতাকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে এসেছে। ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষকে পৌঁছে দিয়েছে আধুনিক সভ্য ইতিহাসের দোরগোড়ায়। একদা গুহাবাসী, অরণ্যচারী মানুষ আজ ছুটে চলেছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। একদা সে প্রকৃতির কাছে অসহায় ভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল। অতঃপর গুহা জীবনে পশু সদৃশ সেই মানুষ পাথর ঘষে আগুন জ্বালাতে শিখলো । আর সেই আলোতেই আস্তে আস্তে ঘুচে যেতে থাকলো মানব সভ্যতার অন্ধকার। মানুষ আজ উন্নতির চরম শিখরে। সমগ্র পৃথিবীর উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করেছে। মানব জীবনে এসেছে অভাবনীয় বেগ, ঘুচে গেছে দূর দূরান্তের ব্যবধান। মানুষকে দিয়েছে অনিঃশেষ সম্ভাবনার অপ্রতিরোধ্য জয়যাত্রা।

কিন্তু একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে গর্বের সঙ্গে দৃপ্ত কন্ঠে আমরা বলতে পারি কি–অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, জাত পাত এসবের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছি। আজও মানুষের মনের গভীরে তন্ত্র-মন্ত্র, ঝাড়ফুক, ভূত-প্রেত, ডাইনি, জিন ইত্যাদি জায়গা করে নিয়েছে। ফলে ভন্ড সাধু সন্ন্যাসী, জ্যোতিষী, ওঝা, তান্ত্রিকদের দ্বারা মানুষ নিত্য প্রবঞ্চনার শিকার হচ্ছে। প্রদীপের শিখা চারপাশের অন্ধকার দূর করলেও প্রদীপের তলায় রয়ে যায় ঘন অন্ধকার। ডাইনি হত্যার মতো কু-প্রথা আমাদের সভ্যতার গৌরবকে ম্লান করছে । কেন এই ডাইনি প্রথা? লেখক সুপর্ণা লাহিড়ী বড়ুয়া ভারত তথা বিশ্ব ইতিহাসের তুলনামূলক আলোচনা করে খুব সুন্দর ভাবে ডাইনি হত্যার উৎসের সন্ধান দিয়েছেন।

আজ শিক্ষার আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে সত্য, মিথ্যাকে আমরা যাচাই করতে শিখেছি। তবুও রয়ে গেছে সমাজে ডাইনি প্রথা। আজও খবরের কাগজে উঠে আসে অসহায় মা কিংবা বিধবা নারীর ডাইনি সন্দেহে অকথ্য অত্যাচারের খবর । একাকী মায়েদের বা নারীদের জন্য এ সমাজ আজও নিরাপদ নয়। সাধারণত দেখা গেছে যে সমস্ত নারীরা পরিবারে বা সমাজে অবহেলিত, স্বামী পরিতক্তা বা বিধবা বেছে বেছে সেই সমস্ত নারীদেরই ডাইনি অপবাদ দেয়া হয়। আবার যে সব নারীদের অর্থ-সম্পত্তি আছে, যারা সমাজে কিছুটা কর্তৃত্বের জায়গা দখল করতে সক্ষম হয়েছে, তাদেরকেও ডাইনি অপবাদে লাঞ্ছিত করা হয়। এর পিছনে যেমন ব্যক্তিস্বার্থ জড়িয়ে থাকে তেমনি থাকে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। ডাইনি প্রথা নামক ভয়াবহ কুসংস্কারের বিষে এখনো জর্জরিত ভারতের আদিবাসী অধ্যুষিত প্রত্যন্ত অঞ্চল। উঠে আসে অসম, পশ্চিমবাংলা, ঝাড়খন্ড, ছত্রিশগড়, বিহার, উড়িষ্যা , রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাস্ট্র রাজ্যের নাম। সর্বত্রই মূলত উপজাতি, আদিবাসী বা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমাজে ডাইনি হত্যার পরিবেশ রচিত হয়েছে।

আর দেখা গেছে প্রায় প্রতিটি ডাইনি হত্যার পিছনে ব্যক্তিগত সম্পত্তি, মাটি, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, শ্রেণী বা আর্থসামাজিক সংঘাত নিবিড় ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। দেখা গেছে প্রান্তিক মহিলাদের আর্থ-সামাজিক যে উচ্চ স্থান রয়েছে, মাতৃ প্রাধান্যের যে ধারাবাহিকতা চলে আসছে তাকেই টার্গেট করা হচ্ছে। তবে এই ঘটনাকে শুধুমাত্র কুসংস্কারে ফলাফল এমন বললেই ডাইনি হত্যা সমাধান হবে না। যদি আমরা ধরেই নিই কুসংস্কারে প্রভাবেই হয় তবে প্রশ্ন আসে, এই বিশাল সংখ্যক প্রান্তিক মানুষ কুসংস্কার আচ্ছন্ন পরিবেশেই থেকে গেছে এই দায়িত্বটা ঠিক কার? তবে কি তাদের মধ্যে ডাইনি হত্যা পরিবেশকে সচেতন ভাবে টিকিয়ে রাখা হয়েছে?



ডিজিটাল যুগ। প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিভিশন ইন্টারনেট বহুজাতিক কোম্পানির প্রসাধন সামগ্রী পৌঁছে গেছে কিন্তু পৌঁছাতে পারেনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য , হাসপাতাল। পৌছায়নি বিজ্ঞান চেতনার আলো। ওঝা সম্প্রদায়ের চিকিৎসাই সম্বল‌। বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা শুভ অশুভ শক্তির অছিলায়। ডাইনি প্রথাকে টিকিয়ে রাখার অর্থ হলো সব ধরনের বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা। বৈষম্য থাকলে বাজার বাড়বে। সচেতন বা অসচেতন গ্রাহক তৈরি হবে। মানুষের শুভ চিন্তার বিনাশ ঘটবে। উন্নয়ন শব্দটা যতদিন পিরামিডের আকারের হয়ে থাকবে ততদিন শুভ-অশুভ শক্তির মাঝে দ্বন্দ্ব থাকবে।


ডাইনি প্রথা কেবল ভারতবর্ষে নয়, বিশ্বের অনেক দেশ, অঞ্চল বা সংস্কৃতিতেও এটি বর্তমান। এখনও ডাইনি অপবাদে জলে ডুবিয়ে, পুড়িয়ে মারা, গলা কেটে দেওয়া, গাছে বেঁধে পিটিয়ে মেরে ফেলার মত পৈশাচিক ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে। যার পিছনে রয়েছে নানা ধরনের অভিসন্ধি। আবার ইতিহাস খুলে দেখতে গেলে এমন নির্মম সত্য উদঘাটিত হয় যা আমাদের অবাক করে, তা হল পিতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ডাইনি হত্যার গভীর সম্পর্ক। পিতৃতন্ত্র শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে একটি বিশেষ লিঙ্গের প্রতাপ, পুরুষের আধিপত্যবাদ যার বহিঃপ্রকাশ।যা পরিবারের অভ্যন্তরে ,শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সব ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাই। পৃথিবীর সর্বত্রই এই ব্যবস্থা ভিন্ন ভিন্ন রূপে তার শিকড় ছড়িয়েছে। তাইতো পিতৃতন্ত্র শব্দটার মধ্যে নিহিত হয়ে থাকে বৈষম্য, অসম্মান, শোষণ, দমন, সংঘাত আর অত্যাচারের হাতছানি।

রেনেসাঁর আবির্ভাব বিশ্বে এক নতুন তরঙ্গে সৃষ্টি করেছিল। গড়ে তুলেছিল যুক্তির পরিবেশ। মানুষ সবকিছু অন্ধভাবে গ্রহণ করার পরিবর্তে যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে গ্রহণ করতে শিখলো। তা সত্য। তবে নারীবাদী দার্শনিক ও ইতিহাসবিদরা দেখিয়েছেন তথ্যসহকারে যে বিশ্বে রেনেসাঁর উদ্ভাবই ডাইনি হত্যাকে তীব্র করে তুলেছিল। কীভাবে? উওর খুঁজতে হলে আমাদের উঁকি দিতে হবে অনেক আগের পৃথিবীতে, অতীতে। অবাক লাগে দার্শনিকরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নানা বিষয় নিয়ে চিন্তা করেছেন কিন্তু মহিলাদের সম্পর্কে রীতিমতো তাঁরা ছিলেন অসহানুভূতিশীল। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরতে পারি প্লেটো, অ্যারিস্টোটল, কান্ট প্রমূখ দার্শনিকদের কথা।

প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন নারীদের অনুকরণ করা উচিত নয়।সে নারী বয়স্ক হোক কিংবা কম বয়সী। তিনি বলেন, যে নারী স্বামীর নিন্দা করে তাকে অনুসরণ করা উচিত নয়। যে নারী নিজের সুখের বড়াই করে বা দুঃখে বিহ্বল হয়ে পড়ে, যে নারী প্রেমাসক্ত অথবা অসুস্থ তাকেও মোটেই অনুসরণ করা উচিত নয়। অ্যারিস্টোটল লিখেছেন, মেয়েদের কোন উচ্চ দর্শন নেই । তাঁরা ভীরু, গুরুত্বপূর্ণ কাজের অযোগ্য এবং এই অযোগ্যতার জন্য তাঁদের লজ্জাও নেই। নারী সুন্দর, সে মুগ্ধ করে সেটাই যথেষ্ট।কান্ট লিখেছিলেন মেয়েদের জ্যামিতি শিখে লাভ নেই। দেকার্তের তত্ত্ব তাদের কষ্ট করে না বুঝলেও চলবে। নারী শক্তিকে দমন করার এ এক আশ্চর্য প্রয়াস আমরা দেখতে পাচ্ছি।

রেনেসাঁর পরবর্তী সময়ে তার প্রভাব থেকে গিয়েছিল। তাইতো ডাইনি অপবাদ নিয়ে যখন নারীবাদী দার্শনিকরা সরব হলেন তখন প্রশ্ন উঠেছিল, কেন এতটা একপক্ষীয় ভাবে দার্শনিকরা মহিলাদের হেয় করলেন? স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে নারীর জাগরণের প্রকৃত দোয়ার খুলে দেয় নি নবজাগরণ।

বিশ্ব ইতিহাসে দুটি সময়কে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরা হয় একটি হলো আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা আর একটি ফরাসি বিপ্লব। ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে ফ্রান্স তথা সামগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে থাকে স্বাধীনতা, সাম্য, মৈত্রী ও যুক্তির মেলবন্ধনের প্রক্রিয়া। ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতায় বিশ্বাস এই ধরনের অবৈজ্ঞানিক ভাবনা- চিন্তার পরিবর্তন শুরু হয়। পরিবর্তে ব্যক্তির স্বাধীনতা, মানুষের অধিকারের মত বিষয়গুলো সামনে আসে। ইতিহাসের সেই পর্ব কে নিয়ে যখন কাটাছেঁড়া করা হচ্ছে তখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠছে। আসলে দার্শনিকর রাইট অব ম্যান বলতে কি শুধুমাত্র পুরুষের অধিকার কে বুঝিয়েছেন? নারীরা কিন্তু ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে রয়ে গেলেন। তাহলে কি এর একটা বড় কারণ বোধ হয় সে সময়কার আর্থ-সামাজিক পটভূমিকা। মাতৃতান্ত্রিকতার রূপান্তর। নারীকে অপশক্তির প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার এক শক্তিশালী রাজনীতির উত্থান। যার মূল উদ্দেশ্য নারীকে দুর্বল ও ক্ষমতাহীন প্রতিপন্ন করা।

পিতৃতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তাই জড়িয়ে রয়েছে ডাইনি অপবাদ ও শাস্তির নির্মম ইতিহাস। তাই তো এ কথা বলতে কোন দ্বিধা নেই যে ডাইনি হত্যার উৎসস্থলের মধ্যে পিতৃতন্ত্রের গল্প নিহিত আছে। পিতৃতন্ত্র আসলে পুরুষ প্রধান সমাজেরই মনস্তত্ত্ব। নারী ও পুরুষকে দুটি ভিন্ন মনস্তত্ত্বে ভাগ করেছে এই সমাজ। পুরুষ শাসক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে, আর নারীকে শোষিত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করতে হয়।’witch hunting’ বা ডাইনি শিকার। সত্যি এক ধরনের শিকারই বটে। এই শিকার হিটলারের নির্দেশে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ ইহুদি নিধনের ঘটনাকেও ম্লান করে দেয়। সারা ইউরোপ জুড়ে এক সময় ডাইনি নিধনের যে যজ্ঞ চলেছিল তার বর্ণনা পড়লে আজও শরীর ও মন কেঁপে ওঠে।পাশ্চাত্যে নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রথম ঢেউ ডাইনি হত্যার বুকে দাঁড়িয়েই দানা বেঁধেছিল।

ডাইনি হত্যার মতো এই অমানবিক প্রথা যখন আমাদের সমাজ ব্যবস্থার গভীর থেকে গভীরে শিকড় বিস্তার করছে তখন কি আমাদের মনে প্রশ্ন ওঠে না আদৌ কি ডাইনি বলে কিছু আছে? আমাদের মনের কুচিন্তা যখন মনকে আচ্ছন্ন করে তখন মানুষের মন দুর্বল হয়। আর সেই দুর্বল পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অলৌকিকতা মনে স্থান করে নেয়। আর কার্য-কারণ সম্পর্ককে যখন যুক্তি দিয়ে বিচার করা সম্ভব হয় না তখন মনে অলীক কল্পনা জায়গা করে নেয়। আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো প্রাচীন ভারতীয় সমাজে যাদুবিদ্যা, ঝাড়ফুঁক, চাল পড়া, তেল পড়া, তুকতাকের প্রচলন ছিল।যার প্রমাণ আমরা ‘অথর্ববেদ’-এ পাই। এমনকি মহাকবি দন্ডীর উদাহরণ আমরা এখানে টানতে পারি। তাঁর কাব্যে ব্যবহৃত কয়েকটি বাক্য “রাতে আমি শ্মশানেই শুয়ে থাকি…সেদিন রাতে দেখলাম, এক কৃষ্ণবর্ণা নারী চিতা থেকে অর্ধ দগ্ধ মৃতদেহ টেনে নিয়ে যাচ্ছে”। কৃষ্ণবর্ণ নারী নিশ্চয় ডাকিনী…”

বর্ণ ব্যবস্থায় বিভক্ত যে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থা সেদিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই সমাজের উচ্চ বর্ণের মহিলাদের মধ্যে ডাইনি নেই। কারণটা খুব স্পষ্ট। আসলে উচ্চ বর্ণীয় নারীর জীবন পিতৃতন্ত্রের শিকড়ে বাধা ছিল, তাই সেখানে ডাইনির অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। অথচ আদিবাসী প্রান্তীয়, জনজাতি সমাজে ডাইনি অপবাদ ও নিধন করার প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে। এই ডাইনি অপবাদ নিয়ে যত ধরনের চর্চা বা আলোচনা হয়েছে তাতে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস প্রসঙ্গটি খুব সহজেই চলে এসেছে। কিন্তু নেপথ্যে লুকিয়ে থাকা আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কুচক্রের আলোচনা সেভাবে হয়নি, পিতৃতন্ত্রের প্রভাব বিস্তারের প্রসঙ্গ সেভাবে আসেনি।

এই ডাইনি হত্যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বৈষম্যের রাজনীতি। একজন স্বাধীনচেতা মহিলাকে সরাসরি অপশক্তির প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত করে অপমান করা হয় এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে সুকৌশলে বোঝানো হয় যে এই ধরনের স্বাধীনচেতা মহিলাদের আসলে বেঁচে থাকার অধিকার নেই। কারণ এই মহিলারা অপশক্তিকে নিজেদের শরীরে বয়ে বেড়ায়। কৌম ভিত্তিক জনজাতিক মহিলারা স্বাধীন মনোভাবাপন্ন, উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। তাই দেখা গেছে যেখানে মাতৃ প্রাধাণ্যের ধারা রয়েছে, সেখানেই ঘটেছে ডাইনি অপবাদের ঘটনা। যেমন আসামের কামরূপের মেয়েদের বলা হয় তারা নাকি জাদু জানে। তারা নাকি পুরুষদের ভেড়া বানিয়ে রাখার কৌশল জানতো। কেন এই অপবাদ? এ কি কেবল পিতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে।


এছাড়াও ডাইনি সনাক্তকরণের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আদিবাসী মানুষদের প্রান্তিক প্রমাণিত করার চক্রান্ত। ওঝা বা “জনগুরু” র অস্তিত্ব ছিল বিপদজনক। বিশ্বের সর্বত্রই মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠলে কে কার উপর আধিপত্য চালাবে? তাইতো এই শ্রেণীর মানুষদের কাছে হাসপাতাল, ডাক্তার এগুলো স্বপ্ন। ওঝারাই শেষ কথা। তারাই সমাজের রক্ষা কর্তা, তাই তাদের এত বাড় বাড়ন্ত। ওঝার কু দৃষ্টি যাদের উপর পড়বে তাদের আর নিস্তার নেই। তারা ডাইনি অপবাদে দণ্ডিত হতে বাধ্য।

ডাইনি প্রথা একটি সভ্য দেশ ও জাতির অগ্রগতির পথে বড় বাধা। পৃথিবীর ইতিহাসে এ এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে এই জঘন্য কু-প্রথার চর্চা, ডাইনি অপবাদে নির্যাতন, হত্যা করা ইত্যাদি অহরহ ঘটছে। একটি সভ্য জাতির পক্ষে সত্যিই তা লজ্জাজনক। এখনও যারা বঞ্চিত শিক্ষার আলো, অর্থনৈতিক অগ্রগতির সুফল, বিজ্ঞানের আশীর্বাদ থেকে দূরে তাদেরকে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসতে হবে। এই সামাজিক ব্যাধিকে সমূলে উৎপাটিত করতে হলে চাই জনজাগরণ। জন মনের আমূল পরিবর্তন না হলে সমস্যার সমাধান হওয়া অসম্ভব। এই দায় যেহেতু আমাদের সকলের তাই এই কুপ্রথা দূর করতে হলে আমাদের শিক্ষিত সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। সংস্কার করতে হবে ভেতর থেকে, মানুষের মন থেকে।

তাই প্রয়োজন যুক্তিবাদী মানসিকতার চর্চা। সচেতনতামূলক শিবিরের আয়োজন করতে হবে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে। বিভিন্ন সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে জনসচেতনতা গড়ে তোলার জন্য। এক্ষেত্রে প্রচার মাধ্যম বা মিডিয়াও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। প্রয়োজন ডাইনি শিকার বিরোধী কঠোর আইন প্রণয়ন। তবে হয়তো এর শেকড় সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব। যারা অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে প্রাণপনে আঁকড়ে ধরেছেন আলো তাদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে। তাদের দেখানো সেই আলোয় যেন আলোকিত হতে পারে বহু জীবন। পচনশীল সমাজের হিংস্র মানুষদের বিষ দাঁত কে উপেক্ষা করে, দমে না গিয়ে জীবন দিয়ে হলেও জ্বালিয়ে গিয়েছেন যারা সত্যের আলো, সেই আলোতেই দূর হয়ে যাক ডাইনি প্রথা নামক অভিশাপের অন্ধকার। দিগন্তে ফুটে উঠুক এক নতুন ভোরের আলো।

বইটির বহুল প্রচার কাম্য। গবেষক ও সাধারণ পাঠকদের কাছেও বইটি সমানভাবে গ্রহণযোগ্য।

(লেখক সুপর্ণা লাহিড়ী বড়ুয়া গবেষক । বাংলা ও অসমীয়া দুই ভাষাতেই তিনি সাহিত্যচর্চা করেন । মানবীবিদ্যা তাঁর গবেষণা ও ভালোলাগার বিষয়।)

You may also like