এদেশের কৃষি ব্যবস্থা রক্তাল্পতায় ধুঁকছে

সুখ-সমৃদ্ধি, ভোগ-বিলাসের জন্য মানুষ কত কিছুই করে। বাড়ি, গাড়ি, সম্পদ, কত কী। এত কিছু করেও যদি তার খাদ্য না থাকে তবে এমন সুখ-সমৃদ্ধির কোনো অর্থই হয় না। অর্থাৎ সুখ-সমৃদ্ধি বা ভোগ-বিলাসের অন্যতম এবং একমাত্র ভিত্তিই হল খাদ্য। এই খাদ্য আসে চাষাবাদ থেকে। কিন্তু কী দুঃখজনক আশ্চর্যের কথা, যে চাষাবাদ থেকে সারা পৃথিবীর মানুষ খাদ্যের মত অতীব গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী পেয়ে থাকে, সেই চাষাবাদের প্রতি কতই না অবহেলা। শুধু খাদ্যই নয়, পৃথিবীর প্রায় যাবতীয় কিছুর কাঁচা মালই চাষাবাদ থেকে আসে। অথচ সেই চাষাবাদের উপকরণ তথা বীজ, সার, বিষ, তেল অন্যান্য আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি প্রভৃতির দাম ভীষণ চড়া। তারপর কষ্ট করে ফলানো ফসল বেচতে গেলে তখন তার মূল্য নির্ধারণ করে দালাল, ফড়ে ও ক্রেতারাই এবং তা নিয়ে কেনা-বেচায় চলে প্রহসন।

আর সেই চাষাবাদে রত চাষিদের জীবনে বিন্দু পরিমাণ সুখের ছোঁওয়া নেই। তারাই এক মুঠ্যে ভালো খাবার খেতে পান না। অসুখ-বিসুখে ভালোভাবে চিকিৎসা করাতে পারেন না। ভালো পোশাক পরতে পারেন না। মাথা গুঁজবার মত একটু বাসস্থান বানাতে পারেন না। সন্তান-সন্ততিকে ভালো করে লেখাপড়া করাতে পারেন না। এবং এমনও ঘটে যে, চাষি পরিবারের ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে কেউ ছেলে বা মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না। কেনইবা চাইবে? অনিশ্চয়তার সঙ্গে সম্পর্ক কেইবা করতে চায়?

তাদেরকে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, থানা-হাসপাতাল বা যে কোনো জায়গাতেই সিঁটিয়ে থাকতে দেখা যায়। এর কারণ সামাজিক আচরণ তাদের মানসিকতায় ঢুকিয়ে দিয়েছে, “তোরা চাষা। ধুলোবালি, ময়লা-কাদা, আবর্জনা-জঙ্গল, পোকামাকড় নিয়ে তোদের কাজ। তোরা ঘৃণ্য!” —- এই সমাজ ইতর প্রাণীর নামগুলো গালি হিসেবে ব্যবহার করে। যেমন গাধা, কুত্তা, ইঁদুর, ছুঁচো। সেই রূপ গালির ক্ষেত্রে চাষি শব্দের বিকৃতি চাষা শব্দের ব্যবহারটি তাদের ইতরবাচক সংজ্ঞা নির্দেশ করে যে, “তোরা গাধা, কুকুর, ইঁদুর, ছুঁচোর সমতুল্য।”

চাষিরাও জোর গলায় প্রতিবাদ জানাতে পারেন না যে, তোদের ঝাঁ-চকচকে অন্তঃসারশূন্য সভ্যতা আমাদের জন্যই এত রঙিন। আমরা অন্ন তুলে দিলে তবেই তোদের মুখে উঠবে, নয়তো গেরস্তের আঙিনায় খাবারের আশায় লেজগুটিয়ে বসে থাকা সারমেয়টি হয়ে বসে থাকতে হবে তোদেরকে। এসব বলে ক্ষোভে ফেটে পড়তে পারেন না তারা। কারণ পেটে ভাত নেই। গলায় আওয়াজ নেই। রোদে পোড়া, ঘামে ভেজা, ক্ষুধার্ত দুর্বল শরীরে ক্ষয়। অন্যদের মত তারা ধর্নায় বসতে পারেন না। কর্ম বিরতি দিতে পারেন না, বরং ফসলের ভালো দাম না পেলে কোনো চাষি যদি ফসল বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন অন্য চাষি সেটাকেই দারুণ মওকা মনে করে চলতি মূল্যেই তা বেচে দেন। ফলে তারা ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হতে পারেন না। মনে ক্ষোভ থাকলেও তা বিদ্রোহের রূপধারণ করতে সক্ষম হয় না। এজন্যেই যুগ-যুগ ধরে তাঁরা পরাজয়ের শিকার হতে বাধ্য হয়ে আসছেন।

কিন্তু এ পরাজয় শুধু কৃষি বা কৃষকের একার নয়। এ পরাজয় সকল স্তরের মানুষের। একথা বুঝতে চায় না কেউ। তাই তো সরকারও একটু ফিরে চায় না, বরং সরকারসহ সর্ব স্তরের মানুষ তাদেরকে শেষ করে দেওয়ার নিদারুণ চক্রান্তে সামিল। দেশি-বিদেশি পুঁজিলোভী কর্পোরেট কোম্পানিগুলির কলুষ হাতে হাত মিলিয়ে কৃষি ব্যবস্থাকে খতম করার চক্রান্তে সামিল। অল্প শ্রম ও অল্প খরচে অত্যধিক ফলনের লোভ দেখিয়ে দেশীয় শস্যের পরিবর্তে আবোল-তাবোল শস্যের আমদানি করা হচ্ছে দেশে। এভাবে দেশের অনেক ফসল বিলুপ্তির পথে, যেগুলো প্রাকৃতিক শক্তি, গুণ ও পুষ্টিক্ষমতায় সমৃদ্ধ। আর যেগুলো আমদানি করা হচ্ছে সেগুলো সম্পূর্ণটাই রাসায়নিক সার ও কীটনাশক নির্ভর। ফলে ষড়যন্ত্রটা কী এবং কেন, তা তলিয়ে দেখলে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরনোর সম্ভাবনা। অথচ কৃষকমহলেরও এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই।



অন্য কিছুর জন্য দেশে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয় না। খাদ্যের অভাবের জন্যই হয়। চাষিদেরকে পঙ্গু করে চাষাবাদকে কোমায় পাঠানো মানে দুর্ভিক্ষকে প্রকাশ্য স্বাগত জানানো।

আজ সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রী, ক্রিকেট প্লেয়ার বা অন্যান্য ক্ষেত্রের কর্মীদের পারফর্মেন্সের জন্য কত অ্যাওয়ার্ডস, অর্থ, প্রশংসা, প্রতিপত্তির ছড়াছড়ি। অথচ এসব বিনোদনমাত্র। পেটের ভাতটা চাষাবাদ থেকেই আসে। অথচ এই চাষিদের জন্যই কোনো সুরক্ষা নেই, যোজনা নেই। নেই কোনও প্রকল্প, যা আছে তা হেঁয়ালিমাত্র।



চাষাবাদে গুরুত্ব দেওয়ার অর্থ এই নয় যে, সিনেমা বা ক্রিকেট সব কিছু শিকেয় তুলে সবাই চাষাবাদ করুক বা চাষিদেরকে বুকে নিয়ে নাচানাচি করুক, বরং চাষিদেরকে সম্মানের চোখে দেখা হোক। তাদেরকে দেশের অন্নদাতা মনে করে জীবন যাপনের মান উন্নত করার প্রকল্প চালু করা হোক। শুধু মুখেই “জয় জওয়ান, জয় কিষাণ” স্লোগান নয়, বাস্তবায়ন হোক এর মর্মার্থ। কিন্তু মোটেও তা হয় না। তবুও সর্ব প্রকার অবহেলা আর যন্ত্রণা বুকে ধারণ করে চাষি বেচারা নীরবে চাষ করে চলেন। আব্বাস উদ্দিনের গানে আছে, “সব মানুষের আহার জোগাই আমরা না পাই খাইতে,/বাজান চল যাই নাঙল বাইতে।” কিন্তু এভাবে আর নয়। ভেঙে পড়েছে কৃষিব্যবস্থা। চাষিরা আর চাষ করতে চাইছেন না। চাষের পাততাড়ি গুটিয়ে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন তারা। কারণ যে কাজ করে বড়জোর পেটের ভাত জোগাড় করতেই হিমসিম, সে কাজ তারা করতে চাইবেন কেন?

তবে মোদ্দা কথা হল, দেশ-সভ্যতা, সংস্কৃতি-শিক্ষা ও সুস্থ স্বাভাবিক জীবনকে সুরক্ষিত করতে হলে চাষাবাদের মধ্য দিয়ে সবুজায়ন সুনিশ্চিত করতে হবে। এজন্যে সর্ব স্তরের মানুষকে চাষাবাদের সৃষ্টিশীলতা বিষয়ক সচেতনতার আওয়াজ তুলতে হবে। এর অন্যথা হলে আমাদের প্রস্তুত হতে হবে দুর্ভিক্ষের মত যমদূতের হাতে পাকড়াও হবার জন্য।

You may also like