বিনয় হাজরা
১
‘ধর ধর ব্যাটাকে, ও একটা ছেলে ধরা’, কেউ একজন চিৎকার করছে আর তার সঙ্গে ছুটছে কয়েকজন উত্তেজিত মানুষ।
দুর্বল শরীরে ওদের সঙ্গে যুঝতে পারেনা রোগা পাতলা লোকটি।
পরণে তার রঙচটা প্যান্ট। একসময় সেটার ছাই রঙ ছিল হয়ত , এখন তা কালচে । গায়ে নীলচে হাওয়াই শার্ট। তার উপরের দুটিমাত্র বোতাম লাগানো, নীচের দিকের বোতামগুলো নেই। মুখে না কামানো কাঁচা পাকা দাড়ি ।ধুলোভর্তি পায়ে সবজে স্ট্রাপের হাওয়াই চটি।
ওকে ধরে ফেলে একজন জামার কলার ধরে মারতে উদ্যত হলে বিপন্ন মানুষটি হাত জোড় করে কিছু বলার বিফল চেষ্টা করে। গলায় কোন শব্দ বের হয় না। সে ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল।
ওদের মধ্যে নিখিল নামে একজন ওরই বয়সী লোক বলে উঠল : আরে এ তো হীরে মাণিক! আমার সাথে লগরে ক্লাস নাইনে পড়তো। বসনদার ছোট ভাই।
রাওতাড়ার বসন্ত সিকদার গ্রাম সংসদের নেতা। এবার সকলে থমকে যায়। অতবড় বাড়ির ছেলে! কী দুরবস্থা!
নিখিল আরো জানায় : ওর ভাল নাম সুমন্ত। মেজদা হেমন্ত রিষড়ায় কারখানায় চাকরী করত। বসনদা পার্টি করে। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়। তাই মেজভাই হেমন্ত কর্মক্ষেত্রে মা,ভাই ও বোনকে নিয়ে যায়। কিন্তু সেই কারখানায় হামেশা স্ট্রাইক ও কাজ বন্ধের ডাক দেয় শ্রমিক ইউনিয়ন। প্রায়শ লক আউট ঘোষণা করে মালিক পক্ষ। নিয়মিত বেতন পাওয়া যায় না। এতগুলি প্রাণীর খরচ চালানো কঠিন হওয়ায় হেমন্ত সবাইকে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। শহরে বেণীমাধব স্কুলে ক্লাশ টেনে ভরতি করা হয় সুমন্তকে। কিন্তু ওর থাকা খাওয়ার সুবন্দোবস্ত না হওয়ায় শহরে ওর থাকা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে পড়াশুনো চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। হঠাৎ করে সুমন্তর মাথার গোলমাল দেখা দিল। গুরুজনদের সম্মান করে না। যার তার কাছে বিড়ি চেয়ে খায়। কেউ বিড়ি খেয়ে ফেলে দিলে সেই পেঁদিটা তুলে নিয়ে খায়। মুখে সব সময় বিড়বিড় করে কিছু বলে যার কিছুই বোঝা যায় না। তারই মাঝে হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে অদৃশ্য কারও উদ্দেশ্যে অশ্লীল গালাগালি দিয়ে চিৎকার করে : খুন করে দেব , শেষ করে দেব । তারপর বলতেই থাকে হ্যাঁ তো , হ্যাঁ তো , হ্যাঁ তো।
স্কুলফাইন্যালের আগেই ওর পড়াশুনোয় বড় রকমের অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছিল। সেটাই মনে হয় মাথা খারাপের অন্যতম কারণ ।
২
খুব বুদ্ধি ছিল ওর লেখাপড়ায়। ইংরেজিতে সবার চেয়ে বেশি নম্বর পেত। ইংরেজি বানান নির্ভুল বলতে পারতো।
বাবা নাম রেখেছিল গোপীনাথ। মেজদাদা অনেক পরে সেই নাম বদলে দেয়। বড় দুই ভাই-এর নামের সাথে মিলিয়ে নাম দেয় সুমন্ত। তবে মা ডাকতো হীরে মাণিক আর বাবা ডাকতো মানু। মা বাবা দুজনেই প্রয়াত।
এবার দলের নেতা নিরঞ্জন জিগ্যেস করে : এখানে কী মতলবে ঘোরাঘুরি করছো?
এবার ক্ষীণ কণ্ঠে সে বলে : আমি ছেলেধরা লই গো। হেঁটে হেঁটে সিউড়ি থেকে এই পাতা ডাঙ- এ এলম। বাসঅলা পয়সা না দিলে নামিন দেয়। ব্যাডা খিদে পেয়েঁছে , তমরা কুছু খেতে দেবে?
নিরঞ্জন একজনকে খাবার আনতে পাঠায়।
ওকে সঙ্গে নিয়ে দলটি আসে তাদের ভিভজ্যিওর ক্লাবের কার্যালয়ে।
সুমন্ত অফিসের সামনে ঝোলানো ইংরেজিতে লেখা সাইন বোর্ডটা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে, বলে ওঠে : এঃ , এত বানান ভুল ক্যানে? ওয়াই ফর ইয়োলো বাদ পড়ে গেইছে তো! সূয্যির আলোর সাতটা রঙের পেথম অক্ষরগুলান পর পর বসালেই তো ভিভজ্যিওর বানান হবে। জানো তো সাতটা রঙ কী কী?
ক্লাব ঘরে এলে নিরঞ্জন বলে : কিছু মনে কোরো না। আমরা তোমাকে ভুল ভেবেছিলাম। নাও , চপ মুড়ি খাও।
মুড়ি খাওয়ার পর নিখিল মিষ্টি দিতে এলে সুমন্ত বলে : আগুতে জল, তাবাদে মিষ্টি খেতে হয়। শোন নাই মধুরেণ সমাপয়েৎ? মিষ্টির পরে আর কুছু লয়।
নিখিল আবার বলতে শুরু করে স্কুুল জীবনের কথা। তখন আমাদের ক্লাস টেন।কঠিন ইংরেজি বানানগুলো আমাদের শেখাতো যেমন, কমিটি , সোসাইটি , ডিসিশন, অ্যাকোমোডেশন, ডিসিপ্লিন। একবার ডিসিপ্লিন নিয়ে রচনা লিখতে বলা হল ক্লাসে। তা হীরে মাণিকের রচনা হল সেরা। মাস্টার মশাই মুগ্ধ হয়ে পড়ে আমাদের শুনিয়েছিলেন। আমাদের মুখস্থ করতে বলেছিলেন। যেমন : সেনাদের হুকুম মানতে হয়, সে প্রসঙ্গে ও লিখেছিল দে আর নট টু আস্ক হোয়াই, বাট টু ডু অ্যাণ্ড ডাই। গ্রহ তারকার গতিবিধি বিষয়ে লিখেছিল স্টারস অ্যাণ্ড প্লানেটস ডু নট মুভ বাই ফিটস অ্যাণ্ড স্টার্টস। লিখেছিল : চান্সেস অ্যাণ্ড অ্যাক্সিডেন্টস আর অ্যালায়েসেস অফ ইগনোরেন্স ।নিরঞ্জন বলে : বাপরে! তোর তো সব মুখস্থ দেখছি!
৩
তা থাকবে না? ও আমাদের কত প্রিয় বন্ধু ছিল ! আজও মনে পড়ে : হ্যাপী প্রিন্সের গল্প। হ্যাপী প্রিন্স থাকতো যে বাড়িতে তার নাম স্যানস সৌসি, মানে যে বাড়িতে দুঃখ প্রবেশ করে না। হীরে মাণিক কী সুন্দর পড়তো, সোয়ালো, সোয়ালো লিটিল সোয়ালো।
সুুমন্তর মানসিক চিকিৎসার জন্য ওর দাদারা অনেক চেষ্টা করেছে। কলকাতা , বর্ধমান বহরমপুর নিয়ে গেছে।ভরতি করেছে বর্ধমানের চিকিৎসালয়ে। বর্ধমানে গিয়ে সেখানে মহিলা রোগীদের দেখে বোকা পাঁঠার মত মুখটা উঁচু করে থুতনির নিচে তর্জনী আঙুল ঠেকিয়ে মুখে শব্দ করে : ম্ – ম্ ব্যা – অ্যা ফু -উ , ম্ – ম্ ব্যা ফু – উ , কখনও বা প -অ , ব -অ
ডাক্তারবাবু শুধালেন : প-অ , ব -অ মানে কি?
সুমন্ত লাজুক হেসে বলে : বুঝলেন না ? মানে পশ্চিম বঙ্গ গো।
আর মুখে ওরম পাঁঠার মত শব্দ করছো কেন?
উটো হনছে ওই ছুতোরদের মিনু আর সেকারোদের কুটির জন্যি। উয়োরা কালীঘরের ভিতরি টেনে নিয়ে গিয়ে কত খারাপ কাজ করতো। সি আমি বলতে লারবো! উয়োরা লুভ ধরিন দিল। সেই থেকে আমি আর থির থাকতে লারি। মেয়ে দেখলেই মুখ থেকে ওরম শব্দ বেরিন যায়।
ডাক্তার বাবু বললেন : ওকে ভরতি করতে হবে। মাথায় শক দিতে হতে পারে।
মেজদাকে বললেন: ওর মধ্যে কামভাব ভর করেছে। ওর একটা বিয়ে দিতে পারবেন? ক’দিন পর ওকে ছেড়ে দেব। তারপর বিয়ে দিলে ও সুস্থ হয়ে যেতেও পারে।
ওই রকম বদ্ধ পাগলকে কোন মেয়ে বিয়ে করতে রাজী হবে?
ছাড়া পাবার পর মেজদা ওর জানাশোনা পাশের গ্রামের এক গরীব ব্রাহ্মণ পরিবারে যোগাযোগ করে অনেক বুঝিয়ে একটি মেয়ের সাথে সুমন্তর বিয়ে দিতে ওদের রাজী করালো। বিয়ে নির্বিবাদে সুসম্পন্ন হল। এরপর ভালই ছিল। ওদের দুটি ফুটফুটে সন্তানও হল। প্রথমে মেয়ে ও পরে ছেলে। তারা এখন বড় হয়েছে। বড় জ্যেঠু মেয়ের বিয়ে দিয়েছে আর মেজ জ্যেঠু ছেলের লেখাপড়া তদারকি করেছে।ছেলে বেঙ্গালুরুতে ভাল কাজ করে। ওর বউ অকালে মারা গেলে পর ছেলে বাবাকে নিয়ে গিয়ে নিজের কাছে রেখেছিল বেশ কিছুকাল। কিন্তু সেখানে ওর মন বসল না। ছেলেকে কিছু না বলেই সে পালিয়েই আসে।
৪
ভবি ভুলবার নয়। কিছুদিন পর আবার খেপামি শুরু হল। ঘর থেকে যখন তখন বেরিয়ে যায়। সারাদিন ধরে টো টো করে দূর দূরান্তে হেঁটেই চলে যায় । স্নান খাওয়া নেই ।গ্রামের সব মানুষের নাম, যথা লেদা কালী লুধাই , দারু, মাথা মোটা কেলে এমনকি স্ত্রীদের নাম ওর মুখস্থ।
এক কাকার উপর ওর খুব রাগ। কাকা সিধু সিকদারের উদ্দেশ্যে কুকথার বান ডেকে যায়। সিধু কাকার অপরাধ নাকি একবার বলেছিল: খেপার মন বৃন্দাবন। এছাড়াও রাগের অন্য একটা কারণ ছিল। সিধু সিকদার প্রত্যহ দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে যেত গ্রামেরই ল’পদ মোড়লের ঘরে। সেখানে তার স্ত্রী বিজুলি সিধুর সেবা করতো। তখন ল’পদ বাইরের দরজায় গার্ড দিত যেন কেউ না আসতে পারে। এই নিয়ে সুমন্ত প্রকাশ্যে খিস্তি দিত সিধুর নামে।
প্রিয় বন্ধু সুমন্তর সঙ্গে নিখিলের যোগাযোগ ছিল ওর বিয়ে হওয়া পর্যন্ত , এমনকি সে বর্ধমানে মানসিক ডাক্তারের কাছেও গিয়েছিল।
নিখিল সোৎসাহে বলে এঠে : জানো নিরুদা , হীরে মাণিক খুব ভাল গান গাইতো। শ্যামল মিত্রর গানগুলো নিখূঁত গাইতে পারতো, মুখেই মিউজিক দিত
গানের কথা শুনে সুমন্তর চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে , বলে একটো গান গাইবো? কোন সম্মতির অপেক্ষা না করেই শুরু কর : টেনেং টে নাক টেং , টেনেং টে নাক টেং — আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন।
গান শেষ হলে নিরঞ্জন বলে : ও সত্যিই হীরে মাণিক। আমি বসনদাকে ফোন করে ডাকবো। ওর ঠিকমত চিকিৎসা হয়নি। এবার আমি দেখবো। দেখি কিকরে সুস্থ না হয়। কাজটা কঠিন, তবে কঠিন কাজই তো করে আনন্দ। ও এখানেই ক্লাব ঘরে থাকবে। ছেলে মেয়েদের পড়াবে। এখানকার ছেলেমেয়েরা নগরী , মাধাইপুরে স্কুলে যায়, ওরা টিউশন পড়তে পায় না। মেয়েরা গানও শিখতে পারবে।
সুমন্ত বলে ওঠে : আমার বিদ্যে তো কেলাস টেন পর্যন্ত , তাও পড়াতে পারবো মুনে হয়। ইংরিজি ছাড়াও সব বিষয়ই পারবো , ত্যাবে অঙ্কটো লাববো । আর গান বলতে রবি ঠাকুর, নজরুল, শ্যামাসঙ্গীত ইগুলান শেখাইতে পারবো ।
নিরঞ্জন উৎসাহিত হয়।
৫
বলে দেখ নিখিল, লেখাপড়া আর গান এইগুলোই ওর ওষুধ ।কেউ বুঝল না । একটু থেমে আবার বলে : তক্তাপোষ তো একটা আছেই , কিছু বিছানা মশারি আনতে হবে। আমি নতুন জামা প্যান্ট আজই আনবো। টেপ রেকর্ভার আর ক্যাসেট দিয়ে যাবো। গান শুনলে ওর মন ভাল থাকবে। তুই রাত্তিরে ওর কাছে থাকবি।
নাপিতদের ছেলেটাকে বলল: ওর দাড়ি কামিয়ে ভাল করে সাবান মাখিয়ে চান করিয়ে দে।
স্নানের কথা শুনে চমকে ওঠে সুমন্ত : না , না চান করবো না। জল ঠাণ্ডা লাগে।
নিরঞ্জন আশ্বাস দেয় : জল তাতিয়ে দেবে, ভয় নাই। দিনের বেলা লেবা পাহাড়ের বিটি এসে খাবার তৈরি করে দেবে।
সুমন্ত এ কথা শুনে বলে : বিটিছেলে? ডাগর পারা? দেখতে ভালো? বলেই সুমন্ত পাঁঠার মত মুখটা উঁচিয়ে মুখে সেই শব্দ করে : ম্ -ম্ ব্যা ফু -উ , ম্- ম্ ব্যা ফু -উ।
নিরঞ্জন এবার ধমক দেয় : কোন অসভ্যতা করবে না। লোকে জানলে মেরে পিঠের ছাল ছাড়িয়ে দেবে, বলেই নিরঞ্জন ফোন করে বসনদাকে আসতে বলে। এই ব্যবস্থার কথা তাকে অন্তত একবার জানানো দরকার।