রবীন্দ্রনাথ আজও আমাদের সত্ত্বায়, চিন্তায়-চেতনায়, মননে ও অনুভবে

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ববরেণ্য স্বনামধন্য এক উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক। বাংলা সাহিত্যের এক কালজয়ী স্রষ্টা। জীবনের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পগত সৌন্দর্যের চরম উৎকর্ষতায় কবিগুরুর সাহিত্য, গল্প- উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনি, প্রহসন, রূপক নাটক এবং সংগীত আজও এক চিরন্তন কালের পথনির্দেশক হিসেবে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার ন্যায় দণ্ডায়মান। শুধু কবি গীতিকার নন, ঔপন্যাসিক বা নাট্যকার নন, শিল্পী বা  চিত্রকর নন, দেশপ্রেমিক এবং মহান চিন্তানায়ক হিসেবেও কবিগুরুর অবদান আজও অসামান্য।

কবিগুরু আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি, চিত্রকলা, ভাষাতত্ত্ব, ইতিহাস, সমাজ জীবন, প্রত্নতত্ত্ব, রাষ্ট্রীয় আদর্শ, শিক্ষা, অর্থনীতি, ধর্ম, বিজ্ঞান এবং চিন্তায় ও মননে যে এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছেন— সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। কেবলমাত্র সংখ্যার বহুলতায় নয়, দৃষ্টিভঙ্গির অভিনবত্বে এবং প্রকাশ রীতির চারুত্ত্বে কবিগুরুর প্রবন্ধ-সাহিত্যও আজও অতুলনীয়। শিক্ষা, ইতিহাস, রাজনীতি এবং সমাজনীতি বিষয়ক প্রবন্ধেও রাবীন্দ্রিক উদার মানসমুক্তি ও দৃঢ় আদর্শ-নিষ্ঠা বারেবারে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, যে কবি, যে সাহিত্যিক তাঁর কাব্যপ্রতিভা, নাট্যনির্মাণ ক্ষমতা, দার্শনিক চিন্তাশক্তি, সার্বভৌমিক ধর্মানুভূতি, বৈজ্ঞানিক কৌতূহল সবকিছু মিলিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সব কবিকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন, তাঁর সম্পূর্ণ পরিচয় পেয়েছেন ক’জন বাঙালি?

কবিগুরুর মহাপ্রয়াণের পর গঙ্গায় গড়িয়েছে অনেক জল। পরিবর্তিত হয়েছে ভারতীয় তথা বাঙালির সাংস্কৃতিক ধারা। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক আদর্শগত দ্বন্দ্বে জাতি আজ দিশাহারা। চিন্তা ও মননেও পড়েছে পশ্চিমী প্রভাব। প্রবল আর প্রকট হয়ে উঠেছে নবীন আর প্রবীণের দ্বন্দ্ব। হারিয়ে গিয়েছে মানবিক মূল্যবোধ। কবিগুরু কিন্তু প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির যা শ্রেষ্ঠ তা অকপটে গ্রহণ করার কথা বলেছেন। উভয় সভ্যতার যা একান্ত অসত্য ও মানবতা-বিরোধী তা বর্জন করার নির্দেশও দিয়েছেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা একান্তভাবে পরস্পরবিরোধী নয়, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার মেলবন্ধননেই পৃথিবীতে এক মহাজাতি গঠিত হবে— এই ছিল কবিগুরুর সারা জীবনব্যাপী সাধনার মূলমন্ত্র।

আজ সারা ভারতে সাম্প্রদায়িকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রবল ঢেউ ভারতীয় জীবন ও জাতীয় সংহতিকে নানাভাবে বিপন্ন করেছে। বিপর্যস্ত করছে দেশের সুস্থ জীবনকে। ব্যাহত করছে দেশের প্রগতি। দিকে দিকে বেজে উঠেছে রক্তমাখা হিংস্র শ্বাপদের হু-হুঙ্কার সর্বব্যাপী অসত্য অন্যায় ভ্রষ্টাচার, আদর্শবিচ্যুতি, অনৈক্য, সংঘর্ষ ও রক্তপাত আমাদের জাতির জীবনকে অধঃপতনের নরক টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এমন দিনে রাবীন্দ্রিক আলোকে আমাদের আত্মসমীক্ষা একান্ত প্রয়োজন।

মনে রাখতে হবে, কবিগুরু একটি সুমহান দেশ ও জাতির শাশ্বত প্রতীক — চিরকালীন প্রতিনিধি। আজ দেশের এই সংকটময় সময়ে মানুষ যদি রবীন্দ্র চেতনায় পরিশোধিত করে নেয় নিজেকে, যদি বিশ্বের প্রতিটি মানুষ রবীন্দ্রবাণীর আদর্শে সর্বাত্মক মানবমুক্তি ও মানব প্রগতির লক্ষ্যে এগিয়ে চলার শপথ নেয় আমৃত্যু, তা হলে আমাদের স্বদেশ ও পৃথিবী সর্বপ্রকার ধ্বংস-বিভীষিকা, হিংসা, অসাম্য, অবক্ষয়ী মূল্যবোধ ও অশান্তির নরকগ্লানি থেকে পরিত্রাণ পাবে। জীবন ও জীবনাতীতকে উপলব্ধি করার, মর্ত্য-পৃথিবী ও মর্ত্য-মানবকে ভালবাসার, বিশ্ব ও বিশ্ব মানবকে আপন করে নেওয়ার যে মূলমন্ত্র আমরা কবিগুরুর কাছ থেকে পেয়েছি, তা যদি চিত্ত-বর্ণ-ধর্ম-গর্ব পৃথিবীবাসী জীবনের মূল মন্ত্র করে নিতে পারি, তা হলে যুদ্ধ-হত্যা-মৃত্যু-ভীত এই মর্ত্যালোকই চিরন্তন শান্তিনিকেতন হয়ে উঠবে। এই পৃথিবী হয়ে উঠবে মৈত্রী, অহিংসা ও প্রেমের অমরাবতী। আমরা সেই দিনের প্রতীক্ষায়। 

You may also like