সম্প্রীতির সন্ধানে

by Abu Siddik

পাশাপাশি বাস, তবে কেন উদাসীন?
সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়
উদার আকাশ (ভাঙড়)
প্রথম প্রকাশঃ ২০২৩
পাতাঃ ১২০
বিনিময় মুল্যঃ ১২৫.০০

সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়। অবসরপ্রাপ্ত রেল কর্মচারী। লেখকের এক বিচিত্র নেশা হলো, সময় পেলে ঘুরতে, ঘুরতে খ্যাত বা অখ্যাত কোনও গ্রামে চলে যাওয়া। তারপর সেখানে গিয়ে সেই গ্রামের প্রকৃতি, মন্দির, মসজিদ, মাজার গির্জা ইত্যাদি দেখা ও সেখানকার মানুষ সম্পর্কে জানা। আনন্দের দিনগুলিতেও জেল, হাজত বা পাগলা গারদ ইত্যাদি জায়গায় বন্দি মানুষদের কথা তাঁর খুব মনে পড়ে। এবং এর প্রতিফলন তার একাধিক লেখাতে উঠে এসেছে। ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষের তিনি ঘোর বিরোধী।

সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই পাশাপাশি বাস, তবে কেন উদাসীন? ধর্মকে কেন্দ্র করে মানুষে মানুষের যে বিভেদের প্রাচীর গড়ে উঠছে, এই মেরুকরণের একেবারে বিপরীতে অবস্থান করে। তাঁর মতে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই রক্ত ঝরিয়েছে। সেখানে উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণ, দলিত আদিবাসী ইত্যাদির কোন ভেদাভেদ নেই। কিন্তু লেখক লক্ষ্য করছেন যে মূলত ধর্মকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে ঘৃণা, বিদ্রুপ, তাচ্ছিল্য ও ভুল ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে। এটি তার চোখের সামনে ঘটছে। এসব দেখে তিনি মর্মাহত হয়েছেন। এবং তিনি এই বিভেদ মানসিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ আমাদেরকে একটি সুন্দর ছোট্ট গল্পের বই উপহার দিয়েছেন। উনার আক্ষেপ যে, আমরা একবিংশ শতাব্দীতে পা দিয়েও কিছু কিছু মানুষের কাছে বাঙালির সংজ্ঞাটায় আজও স্পষ্ট হলো না।তার প্রতিবাদে তিনি এখানে মজার মজার অথচ হৃদয় বিদারক বাস্তব উদাহরণ দিয়ে অনেক কথা তুলে ধরেছেন।


১২০ পাতায় মোট ৪৬ টি টুকরো টুকরো ছবি ও সংলাপের মাধ্যমে তিনি জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ, আধিপত্যবাদ এবং সব রকমের সামাজিক কুসংস্কার সংকীর্ণতার বিরোধিতা করেছেন।

বেশিরভাগ শিরোনামই বাংলার মুসলমানদের সম্পর্কে কিছু হিন্দুদের ভুল ধারণাকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খেয়েছে। যেমন ‘পাশাপাশি বাস তবে কেন উদাসীন?’, ‘বোরখা ও হিজাব’, ‘মহরম নাকি সংক্ষেপে ঈদ’, ‘মুসলমানদের ব্যাপারে ভুল ধারণা’, ‘মুসলিম সম্বন্ধে এই ভ্রান্ত ধারণা কবে ঘুচবে?’, ‘ঈদের সকালে এ’কি শুনলাম?’, ‘ঈদের খুশিতে লুকানো ব্যথা’ ইত্যাদি।

কিছু গল্প ব্যক্তি কেন্দ্রিক– ‘গোলাম আহমদ মোর্তজাঃ এতটা উদাসীনতা প্রাপ্য ছিল না’, ‘গোলাম আহমেদ মুর্তজা সাহেবের লেখা আজও প্রাসঙ্গিক’, সম্প্রীতির ধারক ইতিহাসবিদ ও লেখক খাজিম আহমেদ’।কিছু গল্পে উঠে এসেছে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে আপামর বাঙালির কিছু উৎসবের ছবি। ঈদ, দুর্গাপুজো, ফুরফুরা শরীফের ঈসালে সওয়াব ইত্যাদির কথা।

আর কিছু ছবি একেবারেই গ্রাম কেন্দ্রিক।যেমন, ‘গ্রামের নাম ট্যাংরা’, ‘গাঁয়ের নামটি বীনা’।

কিছু গল্পে উঠে এসেছে বাঙালি মুসলমানদের পরিচয়ভিত্তিক সমস্যা। তারা বাঙালি না মুসলমান? ‘ভারতে মুসলিম বাঙালির বিকৃত পরিচয় কবে ঘুচবে?’, ‘বাঙালির অগ্রগতিতে চাই দুই সম্প্রদায়েরই সমান উন্নতি’।

কিছু ছবিতে আমরা পাই বাংলার সম্প্রীতির উদাহরণ– ‘সৌহার্দ্য উদারতা বজায় থাকুক’ , ‘কোথায় মেলে এমন স্নেহ উদারতা’, ‘সম্প্রীতির মজবুত নীড় বাংলা, একে রক্ষা করা দরকার’, ‘সম্প্রীতির বাংলা, নানা নজির’ ইত্যদি।

আর নয়টি গল্প রয়েছে বাংলা ভাষাকে নিয়ে– ‘মাতৃভাষাঃ ভারতের প্রতিনিধি ও কলাকুশলীরা’, ‘রাকিব কি ভুল করেছিল’, ‘এদের জন্যই কি ছিল ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ!’, ‘২১শে ফেব্রুয়ারির আক্ষেপ’, ‘মাতৃভাষা দিবসের জিজ্ঞাসাঃ বাঙালি কারা?’, ‘ভাষা দিবসের আক্ষেপ’, ‘হায় ভাষা দিবস, তুমি কার!’

বইটি পড়ে আমার প্রথমেই ক্ষিতিমোহন সেনের হিন্দু মুসলমানের যুক্ত সাধনা -র কথা মনে পড়ে। অমর্ত্য সেনের মতে ভারতের মহান ধর্ম গুলিকে এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বলে মনে করলে ভারতের বর্ণাঢ্য ইতিহাসের অনেকটাই অজানা থেকে যায়। এই সম্পর্ককে আরও বিকৃত করা হয় যদি কেবলই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও ধ্বংসাত্মক ঘটনাগুলির নিরিখেই এর বিচার করা হয় যেগুলি আজকের ভারতীয় রাজনীতিতে মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষিতিমোহন সেন কেবলমাত্র হিন্দু মুসলমানের যোগাযোগের ইতিবাচক দিকগুলির আলোচনাতেই থেমে থাকেননি। তিনি এও দেখিয়েছেন যে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে জোরালো মতবিনিময় প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্যতে বেশ দখল ছিল যা আজকে ভারতে এবং বহির্বিশ্ব অত্যন্ত জরুরী বলে মনে হয়।(ক্ষিতিমোহন সেন, হিন্দুধর্ম (২০১২) , প্রস্তাবনা, অমর্ত্য সেন, পৃষ্ঠা ১১)। মনে আসে মধ্যযুগে ভারতের অসামান্য সাহিত্যকারদের নাম। কবীর দাদু সুরদাস মীরাবাঈ তুলসীদাস রহিম প্রভৃতির চোখে ধরা পড়া ভারতের ঐতিহ্যগত মিলনের মধুর পথ l মনে পড়ে রেজাউল করীমের হিন্দু মুসলমান সংস্কৃতি সমন্বয়ে নিয়ে তাঁর উদার চিন্তাভাবনার কথাও।

সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পতে কোন গুরুগম্ভীর তত্ত্ব, তথ্য বা তাত্ত্বিক পর্যায়ের অতিকথন নেই। গল্পগুলি অন্তরের তাগিদ থেকে লেখা। আর গল্পগুলি তার নিজের দেখা ও শোনা বাংলার মানুষের এক অনাবিল জীবনচরিত। এবং এতে সংশ্লেষিত হয়েছে গল্পকারের গভীর মরমীয় অনুভূতি। এ এক অনন্য সম্মিলিত প্রয়াস, ভাবের আর দর্শনের। একেবারে ঝরঝরে একেবারে সাদামাটা একেবারে সাধারণ কথা বার্তায় উঠে এসেছে হিন্দু এবং মুসলমানদের পাশাপাশি বাশের বহুমাত্রিক চিত্র, রোদের ও ছায়ার, আলো ও আঁধারের, গ্রহণের ও উপেক্ষার।

গল্পগুলি মূলত ট্রেনে, বাসে, চা বা কফির টেবিলে, পথে-ঘাটে এবং এগুলি অতি সাধারণ কথোপকথনের সামান্য আড্ডায় বিন্যস্ত হয়েছে। এবং তারই মাধ্যমে লেখক শিক্ষিত অথচ অশিক্ষিত মানুষদের বহু মুখোশ খুলে দিয়েছেন। উদ্দেশ্য, বাংলার বুকে সম্প্রীতি ও সহানুভূতির পরিবেশ ও সেই পরিবেশের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।

এখানে বলি গল্পকার পিছিয়ে রাখা মানুষজনদের ক্ষমতায়নের দিকগুলিরদিকে নজর দেননি।শুধু মুখের কথাতেই সম্প্রীতি হয় না। সম্প্রীতি হবে তখনই যখন উভয় সম্প্রদায় সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের দিকগুলো সম্পর্কে উদার ও সহনশীল হবে। তাদের শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বছরের পর বছর বঞ্চিত রেখে, উপেক্ষা ও অপমানিত করে, পিছিয়ে রেখে শুধু মুখে সম্প্রীতির কথা বললে সম্প্রীতি হয় না। এই সহজ কথাগুলো সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পগুলিতে উঠে আসেনি।

কিন্তু যেগুলি মেলে সেগুলিরও গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনের যাপনের মধ্যে দিয়ে তিনি যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা তুলে ধরেছেন তা সত্যি আজকের দিনে খুব কম মানুষই করে। সোনা বন্দোপাধ্যায় এক্ষেত্রে একজন ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ। মরমী গল্পকার। এক বড় হৃদয়।

সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি বাস, তবে কেন উদাসীন? পড়ুন, ও পড়ান।

You may also like