“যদি সঠিক পথ বেছে নেন, তাহলে আশা ছাড়বেন না।
কারণ যতই বাধা বিপত্তি আসুক না কেন, একদিন না একদিন ভালো মানুষদের জয় হবেই হবে।”
ব্রিটিশ স্বৈরশাসনকে উৎখাত করতে যিনি এমনভাবে সঠিক লড়াই এর পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন,মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮)।তাঁর কাছে এই লড়ায়ের সঠিক মন্ত্র ছিল সত্য ও অহিংসা। ২রা অক্টোবর এই দেশনায়ক, জাতির পিতার জন্ম দিন । তাঁর সত্য ও অহিংসার আদর্শ নিয়ে আলোচনার সূত্রেই তাঁর চিন্তা-চেতনার প্রভাব ও প্রাসঙ্গিকতা আজকের দিনেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রয়েছে কিনা সে সম্পর্কেও আলোকপাত করবো।
গান্ধীজির ঘোর সমালোচকরা তাঁকে নিয়ে নানাভাবে কুৎসা ও নিন্দা করে থাকেন। তাঁর প্রতি সহিংসতার চূড়ান্ত সীমায় গিয়ে তাঁকে হত্যাও করা হয় । জাতির পিতার ঘাতক নাথুরাম গডসে আজ অনেক বন্ধুর কাছেই গড্ । তাঁরই উত্তরসুরীরা যে আজ আমাদের দেশের শাসন ক্ষমতায় এটা বোধহয় অপলাপ নয়। তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দেশের অন্তর থেকে গান্ধীজির আদর্শ মুছে ফেলতে। তা সত্ত্বেও এই ধূমায়িত আঁধারেও তিনি সূর্যের আলোর মতোই ভারতীয় জনজীবনকে স্পর্শ করে আছেন, থাকবেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারায় ঐতিহাসিক ও অনৈতিহাসিক কারণে বাঙালির কাছে তিনি কিছুটা বিরাগভাজন হয়েছেন তা আমাদের অজানা নয়।এ আলোচনায় সে বিষয়ে আমি আলোকপাত করছিনা । নেতৃত্বে আধিপত্যবাদ তাঁকেও গ্ৰাস করেছিল তা অস্বীকার করতে পারিনা। রক্ত- মাংসে,দোষে-গুনে গড়া একজন মানুষ হিসেবেই তাঁকে আমি দেখতে চাচ্ছি । তাছাড়া তাঁর সত্য ও অহিংসা আদর্শের প্রাসঙ্গিকতা খোঁজার চেষ্টা করেছি মাত্র।
অহিংসা আমাদের দেশের এক প্রাচীন ঐতিহ্য । জৈন ধর্মের সঙ্গে এর বিশেষ সংযোগ থাকলেও বৌদ্ধ ধর্মে আমরা এর অনুশীলন বেশি দেখেছি। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের অহিংসা নীতির মূল কথা হলো সকল প্রাণী সুখে থাকুক। গান্ধীজি তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। হিংসা ব্যক্তি ও সমাজ সবটাই ধ্বংস করে এ চরম সত্য তিনি মেনে ছিলেন। গান্ধীজি তাই সে হিংসার পথে হাঁটতে চাননি।’অহিংসা’ শব্দের সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর নাম ওতপ্রোতভাবে ভাবে জড়িয়ে আছে। তিনি তাঁর এই অহিংস সত্যাগ্ৰহ নীতিকে প্রয়োগ করে ছিলেন ব্রিটিশ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের মঞ্চে। আন্দোলন মানে আমরা যেখানে সহিংসতা কিংবা অস্ত্রের কারবার বুঝি গান্ধীজি সেখানে ইংরেজদের বিদায় জানাতে অহিংসাকে একটি রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
গান্ধীজির এই অহিংসার মূলে ছিল অসীম ধৈর্য্য। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অধ্যাত্ম চেতনা, মানবিক মূল্যবোধ, বিশ্বাস,সাহস, লক্ষ্য ও পরিকল্পনা। কঠোর জীবন সাধনায় তিনি এ গুলোকে সহজাত করতে পেরেছিলেন। তাঁর মতে– “সত্য এবং অহিংসা পাহাড়ের মতোই সুপ্রাচীন।আমি যেটা করেছি তা হল এ দুটিকে নিয়ে বিরাটাকারের সাধ্যমতো পরীক্ষা নিরীক্ষা মাত্র । করতে গিয়ে আমি কখনো কখনো ভুল করেছি।শিখেছি সেই ভুল থেকে।” অহিংসা সম্পর্কে নিজের উপলব্ধির কথা যা বলেছেন তার সারকথা হলো, জগতে প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষ ছোটখাটো ব্যাপারে ঝগড়া ঝাঁটি,বাদবিসংবাদে জড়িয়ে পড়ে। আবার তারা তা মিটিয়েও নেয় অহিংসা নামক শক্তির দ্বারাই। তাঁর মতে ক্ষমা করা দুর্বল লোকের কাজ নয়।যুদ্ধ বিগ্রহ কিংবা বিক্ষিপ্ত অশান্তির ঘটনা খবরে আসে। শান্তির বর্ণনা, ভালোবাসার ইতিহাস লেখার দরকার হয়না, কেননা তা জীবন যাত্রার স্বাভাবিক নিয়ম বলেই মনে করা হয়। এই সত্য উপলব্ধি, সত্যাশ্রিত অহিংসাকে তিনি তাঁর জীবন সাধনার অঙ্গ করে তোলেন।
গান্ধীজি তাঁর জীবনে অহিংসার চেয়েও সত্যকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, “সহজাতভাবে আমি সত্যবাদী কিন্তু অহিংস নই।”
তিনি আরো বলেন, “সত্যের স্বার্থে আমি অহিংসাকেও বলি দিতে প্রস্তুত। প্রকৃত সত্যের সন্ধান করতে গিয়ে আমি অহিংসাকে আবিষ্কার করি । আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলি ঘোষণা করেছে সত্যের চেয়ে বড় ধর্ম আর কিছু নেই। কিন্তু তাদের মতে অহিংসা সর্বশ্রেষ্ঠ কর্তব্য।” পান্নালাল দাশগুপ্ত তাঁর ‘গান্ধী-গবেষণা’‘ গ্ৰন্থে গান্ধীজির সত্য সন্ধিৎসা সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন– ভগবানের নামে, ধর্মের নামে পৃথিবীতে কত অধর্ম ঘটছে তার ইয়াত্তা নেই। তার জন্য তিনি সত্যকেই এর শুদ্ধিকরণের মূল অস্ত্র হিসেবে দেখেছেন। সত্যের আঘাতে তিনি সব সত্যকে এমনকি ভগবানকেও যাচাই করে গ্ৰহন করতে চেয়েছিলেন । তবে গান্ধীজি তাঁর সত্য উপলব্ধি কখনো অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চাননি। কেননা ব্যক্তি বিশেষে সত্য আলাদা রূপে প্রতিভাত হতে পারে। তাঁর মতে অসততা হল অসত্য। সততা মানুষকে নির্ভীক ও ভয়শূন্য করে তোলে।
জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তিনি সত্য ও অহিংসার আদর্শ মেনে চলার সর্বোতভাবে চেষ্টা করেছিলেন। এ আদর্শ কতটা শক্তিশালী ছিল সে সম্পর্কে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন, “সব হাতিয়ার বর্জন করলেও একটি হাতিয়ার থেকে যায়,সেটির নাম নিরস্ত্র।তা থেকে কোনো মানুষকেই বঞ্চিত করা করা যায় না।”
গান্ধীজির এই অহিংস ও নিরস্ত্র আন্দোলনের ভয়াবহ পরিণতির কথা মাথায় রেখে ইংরেজ শাসক তাঁর উপর নির্যাতন করতে শুরু করে।বার বার তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। এতে তিনি বিন্দু মাত্র দুর্বল হননি। বরং গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই আন্দোলনের অগ্নিশিখা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে বৃহত্তর অংশের মানুষকে সংগঠিত করতে তাঁর এই লড়াই বিরাট কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল।
আমাদের জাতির জনক যেখানে মনে করতেন অহিংসা থেকে কখনো পঙ্কিলতার জন্ম হয়না সেখানে সেই জাতি আজ কতটা পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত সচেতন মাত্রেই লক্ষ্য করলে দেখবেন। অহিংসা তাঁর পথ, অহিংসা তাঁর লক্ষ্য। তিনি অহিংস সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। পরাধীনতার গ্লানি মুছে যাবার পর আমরা তাঁকে বেমালুম ভুলে গেছি। আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষিপ্ত ভাবে হলেও যেসব সহিংস ঘটনা ঘটে তার জন্য নিজে খুব লজ্জিত বোধ করি। বড় কষ্ট হয়।সেক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল যখন মজা লুটতে থাকে তখন কষ্ট দ্বিগুণ হয়। অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা বলা হয় না। বরং তাদের পুরস্কৃত করা হয়।তাহলে কি হবে গান্ধীকে জেনে ? শুধু মাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে ভায়ের বিপক্ষে ভাইকে লড়তে নানারকম প্ররোচনা দেওয়াই এক বৃহত্তর অংশের কারবারীদের কাজ ! কোথায় অহিংসা, কোথায় ভালোবাসা মানুষের জন্য মানুষের ?
গান্ধী কেন আজ বেশি করে প্রাসঙ্গিক সেকথা বলতে গিয়ে বলতেই হয় যে, রাজনীতির যে আসল উদ্দেশ্য নিঃস্বার্থ মানব সেবা তা আজ কোথায়? কজন নেতা মন্ত্রীর মধ্যে তা আছে? খুঁজে পাওয়া বড়োই দুষ্কর!অপেক্ষাকৃত কম দুর্নীতিগ্ৰস্ত,কম ক্ষতিকারককে আমরা ভালো বলে প্রতিষ্ঠা দিতে চাচ্ছি। হায়রে অভাগা দিশেহারা জাতি গান্ধীজি কি এই সত্য ও সততার জন্য লড়াই করেছেন? আমাদের কাছে এখন চরম সত্য হলো আত্মপরতা কায়েম আর উদরপূর্তি ! পুঁজিপতিদের পেটমোটা করে পিছন দিক দিয়ে নিজেদের আখের গোছানো । যেনতেন প্রকারে টিকে থাকতে হবে।কখনো তোতা পাখি,কখনো পেশি শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষের বেঁচে থাকাটাই একমাত্র লক্ষ্য বলে ভাবতে শেখানো হচ্ছে ! আমরা চোখের সামনে দেখলাম, জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষক নির্বাচনেও সাদা খাতা আর টাকা জমা দিয়ে চাকরি।গরিব নিপীড়িত শোষিত বঞ্চিত অসহায় মানুষের জন্য সামান্য কিছু ভিক্ষা মুষ্টি ছুঁড়ে দিতে দেখছি। এটাই বুঝি উন্নয়ন, এরই নাম প্রগতি । আর এসবকিছুর মানদন্ড ঠিক হবে শুধু মাত্র ধর্মের নামে!যাঁকে নিয়ে আজকের এ আলোচনা তিনিও তো আদ্যোপান্ত একজন ধার্মিক মানুষ ছিলেন, কিন্তু ধর্ম ব্যবসায়ী ছিলেন না। আমৃত্যু একাকার হয়ে থাকার জন্য লড়াই করেছেন। এমনকি মৃত্যুর জন্যও তাঁর এই একাকার নীতিই দায়ী বলে মনে করা হয়।
গান্ধীজির প্রাসঙ্গিকতা আজ দেশের বা প্রদেশের শাসকদের কাছে খুব । শাসক তো আসলে শাসকই । শাসক তার চলার পথে আদর্শ বিচ্যূত হয় । স্বৈরাচারিতা, দুর্নীতি তাদের গ্ৰাস করে । সেক্ষেত্রে বিরোধী বা সাধারণ মানুষকেই তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়। সেক্ষেত্রেও মানুষকে সত্য ও অহিংস ভাবেই সংগঠিত হতে হয় এই তাঁর শিক্ষা। সেক্ষেত্রেও আজ আর গান্ধীর আদর্শ অনুসৃত হতে দেখা যায় না বললেই চলে। বর্তমানে পেশীবহুল স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে এপথ কতটা ফলপ্রসূ সে প্রশ্ন থেকেই যায়!আমাদের দেশের জন্য এ পরিস্থিতি খুবই হতাশাজনক!
বহু আন্তর্জাতিক নেতাকর্মীকে তিনি প্রভাবিত করেছেন, আজো করেন। পাঁচবার নোবেল পুরস্কার এর জন্য নাম গেলেও তাঁকে কমিটি পুরস্কার দিতে পারেনি। তাঁর অনেক ভাবশিষ্য যেমন বারাক ওবামা,নেলসন ম্যান্ডেলা প্রমুখ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি বোধ হয় নোবেল পুরস্কার এর উর্ধ্বে ছিলেন। সবশেষে বলি, এই মহান নেতার সত্য, অহিংসা, ত্যাগ তিতিক্ষা ও মিলে মিশে থাকার আদর্শ দেশের প্রতিটি হৃদয়ে স্থায়ী আসন লাভ করুক। তাঁর সত্য, সততা ও অহিংসার আদর্শ ছোট বড় প্রতিটি রাজনৈতিক নেতার আদর্শ হোক। এই কামনার মাধ্যমেই বোধ হয় আজকের দিনে তাঁর প্রতি সবচেয়ে উত্তম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করা হবে।
তথ্যসূত্রঃ
১) আমার আত্মজীবনী–মহাত্মা গান্ধী
২) আমার ধর্ম, আমার শিক্ষা–মহাত্মা গান্ধী
৩) মহাত্মা গান্ধী–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪) গান্ধী-গবেষণা–পান্নালাল দাশগুপ্ত
৫)গল্পকথায় গান্ধীজি –বিপুলরঞ্জন সরকার।