আসাদ আলী প্রায় তিন বছর ধরে অসুখে ভুগছে। প্যারালাইসিস। কোনো কাজ-কাম করতে পারা তো দূরের কথা, একা একা পেশাব করতেও যেতে পারে না। তিন সন্তানের বাবা। বয়স পঁয়ত্রিশের বেশি হবে না। তার দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলের বয়স এগারো বছর। মেয়ের সাত। ছোট ছেলের চার। তাদের সংসারে আয়-রোজগার একেবারেই নেই। এতদিন স্ত্রী জমেলা বিবির বিড়ি বাঁধার উপর নির্ভর করে সংসার চলত। কখনও কখনও গ্রামের কোনো কোনো সুহৃদ ব্যক্তির দয়া-দাক্ষিণ্যও আসতো। এখন তারা খুবই বিপাকে পড়ে গেছে। বিড়ির কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি সারা দেশের কাজই থমকে গেছে। পৃথিবীতে যে নিষ্ঠুর ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে! এ মহামারীতে অনেকেই গৃহবন্দি। তারা চায় না অকালে পৃথিবী ছাড়তে। যথেষ্ট পরিমান খাদ্য সামগ্রী নিয়ে তারা বাড়ির মধ্যে ঢুকেছে। অধিকাংশ সময় ব্যয় করছে বাড়ির মধ্যেই। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদেরও বুঝিয়ে-সুজিয়ে চার দেওয়ালের মধ্যে রাখছে।
আসাদের বড় ছেলে নাহিদ। খুব সাহসী। কিন্তু এ মহামারীর কথা শুনে তার খুব ভয়। মৃত্যুর ভয় নয়। বাবার মতো তারও যেন প্যারালাইসিস না হয়ে যায়। সে কোনো ভাবেই বাড়ির বাইরে যেতে চায় না। মা জমেলাও ছেলেকে বাড়ির বাইরে পাঠাতে চায় না, কিন্তু বাধ্য। তাদের জীবন অন্যদের মত নয়। অপরের দয়ার উপর তাদের নির্ভর করতে হয়। কেউ কেউ দু-চার কেজি করে চাল দিয়ে গেছে তাদের। তরকারির কথা, পেঁয়াজ-লঙ্কার কথা কেউই ভাবেনি। কয়েকদিন ধরে একই খাবার খেয়ে ছেলেমেয়েরা বিরক্ত হয়ে গেছে। ভাতে নুন মাখাতে মাখাতে মেয়ে বলেই ফেলে, ‘রোইজ রোইজ লিছলাক্কা আলুর সানা দিয়া ভাত খ্যাইতে কি আর ভালো লাগে! তাও তো ফের আকজারা কইর্যা আলুর সানা। ভাতে নুন মাখাইতে হইছে। ক্যাইলকানে এগলা আর খাবো না। অন্য তরকারি করতে হইবে তেবে খাবো। কহ্যা দিনু।’
মেয়ের আবদার শুনে জমেলার মনে দুঃখ হয়। কষ্ট পায় বাবা আসাদও। কিন্তু তাদের যেন কিছুই করার নেই। মেয়েকে আশ্বাস দেওয়ার মত কোনো ভাষাও নেই তাদের কাছে। লবণ আর আলুর ভর্তা মাখানো ভাত নীরবে খেতে থাকে।
সেরাত্রে আসাদের ঘুম আসে না। ঘুম আসে না জমেলারও। দুশ্চিন্তায়। ছেলেমেয়েদের আবদার পূরণ করবে কী করে! তারা দু-জনেই বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে থাকে। এমন করতে করতে গভীর রাত হয়ে যায়। আসাদ জমেলার পেটে হাত রেখে মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করে, ‘জমেলা, তুমি কি জেগে আছো?’
‘হাঁ। নিন আসে না।’ চোখ দুটি বন্ধ করে জমেলা উত্তর দিল।
‘তুমার নিন আসে না কিনে তা হামি বুঝতে পারছি। কিন্তু কী করবো কহো? হামি যে নিরুপায়! আইজ যদি হামি ভালো রহইতুক, তেবে এগলা দিনেও পেজ-মরিচ, আদা-রসুন বেচা রোজগার কইর্যা আনতুক। চাংড়া-পাংড়াকে অভাব বুঝতে দিতুক না। রোইজ রোইজ আলুর সানা দিয়্যা ভাত খ্যাইছে… কিছুদিন পর হয়তো এটাও খ্যাইতে পাইবে না।’ বলে আসাদ হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। কাঁদে জমেলাও।
তাদের কান্নার শব্দে বড় ছেলে নাহিদের ঘুম ভেঙে যায়। অন্ধকার ঘর। কেউ কাউকে দেখতে পায় না। চৌকিতে শুয়ে রয়েছে তিন ভাই-বোন।মেঝেতে বাবা-মা। নাহিদ যে জেগে গেছে বাবা-মা তা বুঝতে পারে না। নাহিদও বুঝতে দেয় না।বাবা-মা লজ্জা পেতে পারে ভেবে। সে চোখ বন্ধ করেই বাবা-মায়ের কথাগুলো শুনতে থাকে।
জমেলা কেঁদে কেঁদেই স্বামীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘তুমি ভ্যাইবো না নাহিদের আব্বা। কেহ না কেহ ফের চাউল-দাইল হামরাকে দিয়্যা য্যাইবে। আল্লাহ হামরাকে না খিলিয়্যা মাইর্যা ফেলবে না।’
চোখের জল মুছতে মুছতে আসাদ বলে, ‘ভাইরাসের ভয়ে বহুত মানুষ পল্টি মুরগি খায় না। ওই গুনে পল্টি সস্তা ল্যাইগা গেছে। এত্তা সস্তা বাজারেও একটা পোল্টি মুরগি হাংরে বাড়ি আইলো না। একেবারে চাংড়া-পাংড়ার জু লেলিয়া গেল গোস-মাছের গুণে।’
‘বেটিটা কহ্যাছে ক্যাইলকা আর নুন-আলুর সানা দিয়্যা ভাত খ্যাইবে না। অর তো জিদ থামাহা মুশকিল হয়্যা য্যাইবে। এখনিকা কী যে করি, হামি ভ্যাইবা তল পাই না!’ এ বলে জমেলা চোখের জল মুছে পাশ কেটে শুয়ে যায়।
আসাদ স্ত্রীকে কী পরামর্শ দেবে ভেবে পায় না। সেও নীরব থাকে।
নাহিদ বাবা-মায়ের কান্না শুনে নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারে না। নীরবে সেও কেঁদে ফেলে। তার বাবা-মা কতটা অসহায় তা সে বুঝতে পারে। মহামারীর ভয় এবার তার মন থেকে উড়ে যায়। বাড়ির বাইরে গিয়ে তাকে কিছু করতে হবে। কী করবে, তা সে ভাবতে থাকে। বাকি রাতটুকু ভাবতে ভাবতে সে পার করে দেয়। তার আর ঘুম আসে না। সূর্যোদয়ের পূর্বে সে বিছানা ত্যাগ করে। বাসি মুখ ধোয়ার যেন সময়ই নেই তার কাছে। মাকে না জানিয়েই একখানা ছেঁড়া ব্যাগ হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে।
নাহিদদের বাড়ির চার বাড়ি পরেই ফায়েজ শেখের বাড়ি। ফায়েজের বাড়ি পার হয়েই আম বাগানের দিকে যেতে হয়। ফায়েজের আট বছরের ছেলে আসিফ দাঁড়িয়ে আছে তাদের বাড়ির সদর দরজার বাইরে। নাহিদকে দেখে সে বলে ওঠে, ‘নাহিদ, এত্তা স্যকাল স্যকাল কুনঠে য্যাইছি?’
‘বাগানের দিকে যাবো।’
‘কী করতে?’
‘কাম আছে।’
‘হামিও যাবো। হাংকে লিয়্যা যাবি?’
‘না। তোর বাপ তোকে মারবে।’ এ বলে নাহিদ রাস্তা চলতে শুরু করে। আর পেছনে পেছনে তাকে অনুসরণ করে আসিফ। খানিক দূর এগিয়ে নাহিদ থেমে যায়। আসিফকে সে বুঝিয়ে বলে, ‘এগলা দিনে বাহিরে বাহারিস না বেশি। হামার তো বাহিরে বাহারতে ভয় হইছে। কিন্তু কী করবো? হামার দরকার আছে তাই। না হলে বাড়ির মইধেই রহইতুক। তোরা মহাজন, বাড়ির বাহিরে আসার দরকারই নাই। বাড়ির মইধেই তোরা রহইতে পাইছি তো তোর মন চাহে না বাড়ির মইধে রহইতে। হামি তোর মতন বাড়ির মইধে রহইতে পাইলে বরতিয়া য্যাইতুক। তুই হামার সাথে য্যাইস না। বাড়ি যা।’
এমন সময় আসিফের বাবা ফায়েজ তাদের দিকে এগিয়ে আসে। তাকে দেখে নাহিদ তার হাতের ব্যাগখানা জঙ্গলের দিকে ছুঁড়ে দেয়। তারপর সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। পিছন থেকে ডাক পড়ে, ‘এই নাহিদ, খাড়া হ।’ নাহিদ থেমে যায়। দাঁড়িয়ে থাকে।
ফায়েজ বিদ্যুৎগতিতে এসেই নাহিদের কান ধরে টান দিয়ে বলে, ‘তোরাকে হামি কাত্তাবার কহ্যাছি যে, বাড়ির বাহিরে আসবি না। তোঘরে দেখা-দেখি হাংরে চাংড়া-পাংড়াও বাহিরে আসতে চাহইছে। তোরা কি হামরাকে আর বাঁচতে দিবি না?’ এবার নাহিদকে ধাক্কা দিয়ে বলে, ‘যা, বাড়ি যা। বাড়ির বাহিরে যেন আর দেখতে না পাই।’ এ বলে ফায়েজ নিজের ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। নাহিদ কানে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।
ফায়েজ বাড়ির মধ্যে যেমনই প্রবেশ করে তেমনই নাহিদ জঙ্গল থেকে ব্যাগটা তুলে নিয়ে বাগানের দিকে দৌড় লাগায়। তার ভয় হচ্ছিল, যদি ফায়েজ তাকে বাগানের দিকে যেতে দেখে তাহলে আবার সে ফিরে এসে তাকে মারবে। তাই ফায়েজের দৃষ্টির আড়াল হওয়ার জন্যই দ্রুত দৌড়ে পালায় নাহিদ।
এদিকে মা জমেলা ছেলের জন্য চিন্তিত। বেশ কিছুদিন ধরে ছেলে নাহিদ অসুখের ভয়ে বাড়ির বাইরে বের হয় না। কিন্তু আজ সূর্যোদয়ের পূর্ব থেকেই বাড়িতে নেই। এখন ন’টা বাজে। এতক্ষণ ধরে সে আছে কোথায়? মা জমেলা এসব ভেবে অস্থির হয়ে পড়ে। ছেলের উপর রাগও হয়। মনে ভাবে বাড়ি ফিরলেই তাকে মারবে। না জানিয়ে যাওয়ার জন্য।
এমন ভাবতে না ভাবতেই নাহিদ ভর্তি ব্যাগ পিঠের দিকে ঝুলিয়ে বাড়ি প্রবেশ করে। মা ছেলের ব্যাগ লক্ষ্য করেনি। তার দৃষ্টি ছিল ছেলের ক্লান্ত হাসি মুখের দিকে। মা আরো রেগে যায়। এতক্ষণ ধরে খেলে খেলে ক্লান্ত হয়ে গেছে ভেবে। এখন তো বেশি খেলা করাও যাবে না।খেললেই ক্ষুধা পাবে বেশি। তারা এত খাবার পাবে কোথায়? এমন ভাবতে মায়ের কষ্ট হলেও পরিস্থিতি অনুযায়ী ভাবতে হচ্ছে। নাহিদ মায়ের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘আম্মা পান্তা ভাত আছে? না অরা সবটা খায়্যা লেছে? বড্ড ভোক ল্যাইগাছে। রহইলে দে খাবো।’
অকারণে নাহিদের ক্ষুধা পেয়েছে ভেবে মা আরও রেগে গিয়ে তার কান ধরে জিজ্ঞাসা করে, ‘এতক্ষণ কুনঠে আহাল্লি কহা? কামের কথা কহইতে গেলে বাড়ির বাহিরে যাইতে ভয় লাগে, আর খেলতে যাইতে ভয় লাগে না?’
কান ধরার জন্য নাহিদ চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। মা জমেলা ততক্ষণাৎ নাহিদের কান ছেড়ে দেয়। কান ধরার জন্য নাহিদ এতটাই ব্যথা পায় যে, কানে হাত দিয়ে মাটিতে বসে গিয়ে কাঁদতে থাকে। মা খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, বেশি জোরে তো হামি তোর কান ধরিনি, তো ফের এত্তা কানছি কিনে?’
নাহিদ কানে হাত দিয়েই কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘রোইজ রোইজ নুন আর আলুর সানা দিয়্যা ভাত খাইতে ভালো লাগে না। ভাবনু, আইজ কচুর শাক দিয়্যা ভাত খাবো তাই বেহান ভোরে বিছাননে উইঠাই কচুর শাক আনতে যাইছিনু বাগানের দিকে। হামার সাথ ধরছিল আসিফ। হামি অকে লিয়্যা য্যাইতে চাহিনি, তাও অর বাপ হামার কান ধইর্যা টানাটানি করলে। এত্তা জোরে কান ধইর্যা টাইনাল্লো, মনে হইছিলো কানটা পাড়-পাড়িয়া উইঠালো। আর ফের তুই ওই কানটাই ধরলি। আগে নে তো বেদনাতে টনটন করছিলোই।’
মা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। কেঁদে কেঁদে বলে, ‘সহ্য কইর্যা লে বাবা, সহ্য কইর্যা লে।আসিফের বাপ তোকে ম্যাইরাছে, একথা কাহোকে কহিস না বাবা। অরা একদিন দশ কেজি চাউল দিয়্যাছিলো হামরাকে।ফেরও হয়তো কুনু দিন দিবে। তোর ম্যাইরের কথা যদি কাহোকে কহ্যা দিস, তেবে আর অরা কুনুদিন কিছু দিবে না। তোর বাপ খাটতে পারে না। হামার বিড়ি বাঁধার কাম নাই। পরের দয়ার উপরে ভরসা কইরাই এখনিকা দিন কাটাইতে হইছে। হাংরে বাড়ি আর দু’দিনের খাবার আছে। তারপর হয়তো তোর আনা রোইজ কচুর শাকই খায়্যা রহইতে হইবে।
নাহিদ চোখ কচলাতে কচলাতে বলে ওঠে, ‘হামরা এত্তা গরিব কিনে আম্মা?’
‘আল্লাহ জানে।’ একথা বলে জমেলা চোখের জল মুছে নিয়ে ব্যাগ থেকে পড়ে যাওয়া কচুর শাকগুলো একটা একটা করে ব্যাগের মধ্যে ঢুকাতে থাকে।