ফরি পাগলার জয়

মোহাম্মদ আবদুর রহমান

সবার জীবনে সব সময় একই রকম অবস্থা থাকে না।পৃথিবীর মত মানুষের জীবনেও বিভিন্ন অবস্থা দেখতে পাওয়া যায়।সবাই চাই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে।তবে কিছু মানুষ নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়। তবে কখন যে সেই সব মানুষের জীবনে বসন্ত এসে উপস্থিত হয় সেও জানে না।আর যখন সে বুঝতে পারে তার জীবনে বসন্ত এসেছে তখন সে নিজেকে স্থির রাখতে পারেনা। ছোটো ছেলের মত অশ্রু বিসর্জন করতে থাকে।

ফরিদুল আলম সাহেবের বয়স সত্তরের কাছাকছি।তিনি খুব সরল প্রকৃতির মানুষ।খুব বেশি কথা বলেন না।নিজেই নিজের সাথে কথা বলেন।তার কোন বন্ধু নেই।তাই এলাকার সকলে তাকে পাগল বলে।এলাকায় সে ফরি পাগলা হিসেবে পরিচিত।ফরিদুল আলম সাহেবেরা তিনি ভাই ।তিনি সব ছোটো ।তার বড় দুই ভাই ছিলেন প্রচুর চতুর।তারা বুঝতে পারতেন ভালো মন্দ সব কিছুই।আর সেই সুযোগে ফরি পাগলকে পরাজিত করতেন।কিন্তু ফরি পাগলার জয় হতো। তারা নিজদের সব সময় ফরি পাগলা থেকে দূরে থাকতেন।এমন কি সে তাদের ভাই এই পরিচয় দিতে চাইতেন না।তবে ফরি পাগলা দাদাদের সব সময় শ্রদ্ধা করতেন।

পনেরো বছর বয়সে ফরি পাগলার বিয়ে হয় গ্রামের এক দুস্থ পরিবারের এক মেয়ে সহগীর সাথে।যেহেতু ফরি পাগলার বাবা ছিলেন প্রচুর জমির মালিক এবং খুব বিচক্ষণ মানুষ।তিনি বুঝতে পারেন তার ছোট ছেলের জন্য একটি বুদ্ধিমতী বৌমার দরকার।যাতে তিনি চলে যাওয়ার পর সে তাদের নিজেদের সংসার চালাতে পারে।প্রয়োজনে তাকে সকল কিছুই বুঝিয়ে দেবেন।তাই তিনি তার ছেলের বিয়ে দেন গ্রামের এক দুস্থ পরিবারের বুদ্ধিমতী মেয়ে দেখে।মেয়েটি ছিল প্রচুর বুদ্ধিমতী।মেয়েটি তার স্বামীকে বলতো তুমিও তোমার দাদাদের সাথে জমিতে যাও। তা শুনে সে তার দাদাদের সাথে জমিতে যেত।কিন্তু তার দাদারা বাজারে নিয়ে যেতেন না।তবে ফরি পাগলা কষ্ট পেতেন না। তিনি শাহরের ব্যস্ততা পছন্দ করতেন না।তার ভালো লাগতো মাঠে মাঠে ঘুরতে । তাকে ভালো লাগতো পাখির গান।ভোরের সুমিষ্টি মৃদু হাওয়া।তবে তার স্ত্রী এসব পছন্দ করতেন না ।সে বলতেন – বাজারে না গেলে সারা জীবন পাগল হয়ে থেকে যাবে।বাজারে গেলে বিভিন্ন মানুষের সাথে মিশলে বুদ্ধি বাড়বে।তবে তিনি কোন দিন বাজারে যেতেন না।

ফরি পাগলার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে।তবে তারা তার বাবার মত নয়।তারা তার মায়ের মত চালক।তারা সব সময় মাকে পীরের মত মানে।কিন্তু বাবাকে তেমন মর্যাদা দেয় না।তারা সব সময় বাবাকে অপরাধী বানায়।ফরি পাগলা বুঝতে পারে তার ছেলে মেয়েরা তাকে ভালোবাসে না।তাতে তিনি প্রচুর কষ্ট পান।কিন্তু নিজের হৃদয়ে জমানো কষ্ট গুলো প্রকাশ করতেন না।তবে তিনি মনে মনে বলতেন এই ফরি পাগলার জন্য তারা গর্বিত হবে।ফরি পাগলা তার স্ত্রীকে বলতেন, ‘মানুষের জীবন সব সময় একই রকম থাকে না।আমারও জীবনে বসন্ত আসবে।সুখের ফুল ফুটবে। পাখিরা গান গাইবে।সেই দিন তুমি বুঝতে পারবে।’

তার স্ত্রী বলতেন, ‘পাগলের জীবনে আবার বসন্ত আসবে! পাগলের জীবনে সারা জীবন একই রকম থাকবে।অন্ধের কাছে যেমন রঙিন পৃথিবী ঘন অন্ধকার।ঠিক তেমনই তোমার জীবন জুড়ে শুধুই ব্যর্থতার সুনামী বইবে।’

ফরি পাগলা গুন গুন করে বলে – তুমিও আমাকে পাগল বলো।আমি পাগল নয়।মানুষ আমাকেই পাগল বানিয়েছে।

তার স্ত্রী ক্ষুব্ধ বলে – পাগলের আবার পণ্ডিত হওয়ার ইচ্ছা।

ফরি পাগলা বিড় বিড় করে বলল – যত পাগল বলো।আমি কিন্তু পাগল না।

ফরি পাগলার বাবা মারা যাওয়ার পর বিষয় সম্পতি ভাগ করা হয়। তার দাদারা তাকে রেল লাইনের পাশের জমি গুলো দেয় । কারন রেল লাইনের পাশের জমি গুলোতে খুব বেশি ফসল হতো না।বিভিন্ন পশুতে ফসল খেয়ে নিত।ফরি পাগলা দাদাদের কথা বাধ্য হয়ে মেনে নিয়ে ছিলেন।কিন্তু তার স্ত্রী মনে নিতে পারেনি।তার স্ত্রী উত্তেজিত হয়ে ফরি পাগলাকে বলে ছিলেন, ‘তোমার দাদারা তোমাকে বিশাল ভাবে ঠকালো। আমাদের বেচেঁ থাকার চেয়ে মরে যাওয়ায় ভালো হতো।’

ফরি পাগলার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল।তার সামনের সকল কিছুই বর্ণহীন লাগছে।তিনি বুঝতে পারছেন তার দাদারা দুর্বলতার সুযোগ কাজে লাগাল।
তার স্ত্রী ফরি পাগলার চোখে অশ্রু দেখে আশ্চর্য হয়ে যান।কোন দিন সে তার চোখে অশ্রু দেখেনি।সে ভাবছিল তার স্বামীর অনুভুতি সৃষ্টিকারী যন্ত্র নেই।তাই তিনি তাকে জাপটে ধরে বললেন, ‘কেন কাদঁছ?’
সে বলল – আমার অযোগ্যতার জন্য ছেলে মেয়েরা চরম ক্ষতির সমুখখীন হলো।তবে দেখবে আল্লাহ এর নিশ্চয় একটা বিচার করবে।

রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিলেন কি করে তিনি ফরিদুল আলম থেকে ফরি পাগলায় পরিণত হলেন।যখন তিনি প্রাইমারী স্কুল পড়তেন তখন তিনি কথা কম বলতেন।ক্লাস ঘরের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।ফলে মাষ্টার হঠাৎ তাকে প্রশ্ন করলে অপ্রস্তুত ভাবে অন্য কিছুই বলে দেন। তখন মাষ্টার বলে ছিলেন ছেলেটা মনে হয় পাগল ।সেই থেকে পাগল বলা শুরু ।যেহেতু তার নাম ফরিদুল আলম ।তাই তাকে ফরি পাগলা বলে।তবে সে কোন দিন কোন ব্যক্তির ক্ষতি করেনি।পাগলের মত আচরণ করেন নি।আসলে তিনি নীরব থাকতে ভালো বসেন।আর এটাই তার অপরাধ।

এলাকায় আসতে আসতে তাকে সবাই ফরি পাগলা বলে ডাকতে শুরু করল।তিনি তার প্রতিবাদ করতেন না।তিনি মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে থাকতেন।কোনো মানুষের সাথে মিশতেন না।তাই কেউ কোন দিন তার বন্ধু হয়নি।সবাই তাকে নিয়ে তামাশা করেছে।তাকে দেখে তার পিতা খুব কষ্ট পেতেন।তার ঘরে এমন পাগল ছেলে জন্মেছে।তার বাবা সব সময় তার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করতেন। তিনি তাকে অনেক ডাক্তার দেখান ।ডাক্তার বলেন তার কোন সমস্যা নেই।সে মানুষের সাথে মিশলে আসতে আসতে স্বাভাবিক হয়ে যাবে।কিন্তু তিনি যার সাথে মিশেছে সেই তাকে নিয়ে মজা নিয়েছে।কেউ তার বন্ধু হয়নি।যেন সবাই তার শত্রু ।না হলে কেন সবাই তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবে? আসলেই সবল মানুষেরা দুর্বল মানুষকে আক্রমন করতে ভালোবাসে ।এই কথা ভালোই বুঝতে পেরেছেন ফরি পাগলা।

জমি ভাগ করার প্রায় দুই দশক পর তার জমির পাশ ঘেঁষে তৈরি হয় একটি নতুন রেল স্টেশন।আশেপাশে তৈরি হতে থাকে বাজার।আসতে আসতে তার ফাঁকা জায়গাটি পরিণত হয় বাজার।আর বাজারের মূল জায়গাটি ফরি পাগলার।যে দাদারা একদিন পরিকল্পিত করে পরাজিত করে ছিলেন।সেই পরাজয় পরিণত হয় জয়ে ।সেই দাদা আজ বেচেঁ নেই।তবে তার দাদাদের ছেলে মেয়েরা তাদের বাবাকে খুব ঘৃনা করে।তারা লোকের সামনে বলে তাদের পণ্ডিত বাবার জন্য আজ তারা অসহায়।

তবে ফরি পাগলার ছেলে মেয়েরা বিশাল আনন্দিত।তারা বুঝতে তাদের পাগল বাবার জন্যই এত মূল্যবান সম্পত্তির মালিক।এলাকার সবাই বুঝতে পারে ফরি পাগলার জয় হয়েছে। এখন ফরি পাগলা মাঝে মাঝে চিৎকার করে হাসে।এই হাসি হয়তো তার বিজয়ের হাসি!

You may also like