রুপন্তি খুব আহ্লাদী মেয়ে প্রপা বেশ চটপটে মেয়ে।সাত বছর আর সাড়ে পাঁচ বছর বয়স হলে কি হবে দুজনেই খুব বুদ্ধিবতী। সারাদিন নিজেরা বানিয়ে বানিয়ে কত রকমের খেলা খেলে তার ইয়াত্তা নেই।
সেদিন রুমানা খান জরুরি কাজে বাইরে যাবে ওরা বায়না ধরে ওরাও যাবে।
কি আর করা কাজের সময়টুকু মামাতো ফুফাতো বোনেরা গাড়িতে থাকবে ফেরার পথে গাড়ি ঘুরিয়ে একটু বেড়িয়েও আসবে।
করোনাকালের আগে এমনি ঘোরাঘুরি মাঝেমাঝেই করেছে।
করোনায় স্কুল বন্ধ বাইরে যাওয়াও সীমিত।
গাড়ি চলছে রুপন্তি আর প্রপা দাদী নানীর গা ঘেষে বসে আছে।রুমানা খান রুপন্তির দাদী আর প্রপার নানী।প্রপাকে দেখাচ্ছে প্রপার মায়ের স্কুল। দেশের নামকরা স্কুল “মনিপুর স্কুল “।গল্প করছে প্রপার কাছে।
এই স্কুলটা আগে একটা ভাড়া বাসায় ছিল এখন রুপনগরে নিজস্ব জমিতে বিশাল জায়গায় বিশাল ভবন।এই স্কুলেই পড়ছে রুপন্তি প্রপার দুই ভাই দীপ্র আর সৌর
একটু এগিয়ে গিয়ে দেখতে পায় কামার্স কলেজ। এখানেও প্রপার মা ইন্টারমিডিয়েট পড়েছে।
চেনা শহরটা দ্রুত পালটে যাচ্ছে ওর সামনে দিয়ে।
মুগ্ধ হয়ে শুনছে রুপন্তি ও প্রপা।
ওদের দুই প্রজন্ম আগেরজনের মনে রাখা ওদের প্রিয় হয়ে ওঠা মিরপুরকে দেখছে ওরা।
রুমানা খান যখন মিরপুরে বসতি গড়ে তখন খুব কম দোতলা বাড়ি দেখছে, আর এখন ছয়তলার ফাঁকফোকর দিয়ে একতলা খুঁজে পাওয়া দুস্কর। আগে ছিল
সবুজ মিরপুর আর এখন ইট গ্রীল টাইলসের মিরপুর।
মার্কেটের শহর খাবারের দোকানের শহর মসজিদ মন্দিরের শহর বললে ভুল হবে না আজকের বর্ধিত মিরপুরকে। দেশ সেরা বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরেই কি গড়ে উঠলো আধুনিক মিরপুর?
আলো ঝলমলে মিরপুরে তিন প্রজন্ম ধরে এই শহরে বসবাস করছে রুমানা খান।
নতুন তৈরি হওয়া ফুড এরিয়ায় খেতে গেছে নাতনিদের নিয়ে। রুপন্তি আর প্রপা খাবার পছন্দ করা থেকে যাবতীয় সব ঠিকঠাক করছে।
নিজেরা খেয়ে পার্সেল নিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে ওরা। গাড়ি দোকানে ঢুকেই গ্যারেজে পাঠিয়ে দিয়েছে। ভীড়ের রাস্তায় গাড়ি আরো ভীড় বাড়াবে। তারচেয়ে
গ্যারেজে নিরাপদে গাড়ি থাকুক, আর ওরা হেঁটে ফুরাক হাঁটাপথের দূরত্ব।
আগের শান্ত দরিদ্র শহরটায় ধনী বিলাসীর ছাপ প্রকট হয়ে উঠছে রাতারাতি।বদলে যাওয়া সুন্দরী শহরটা দামী হচ্ছে দিনকেদিন। জমির দামও আকাশছোঁয়া।আগারগাঁওতে লাগছে সরকারি ছাপ। সেই ছাপকে কেন্দ্র করেই বানিজ্যিক আবহাওয়ায় আধুনিক বৈচিত্র্যময় রুপ নিচ্ছে।
খাবারের গলিটা পার হতে হতে মনে হয় কারো কোন দুঃখ নেই অভাব নেই। সবার সুখীমুখ পিছলে নামছে খুশি আর শান্তি বার্তা।
প্রতিটি পরিবার খুব সুখী। মানুষগুলো আনন্দময় জীবন যাপনে অভ্যস্ত।
রুমানা খান তার চেনা জায়গায় অচেনা অত্যাধুনিক বহুতল বিল্ডিংএর পাশে দাঁড়ায়।ওরাও তিন প্রজন্ম ধরে বসবাস করছে মিরপুরে।
রুমানা খানের পরিবার আর এই বহুতল বিল্ডিংএর মালিকের পরিবারের মধ্যে খুব ভাল বন্ধুত্ব ছিল। এখন দীর্ঘ অযোগাযোগ। দুটো পরিবারই কর্ম ব্যাস্ত।কত বছর হলো দেখা নেই।
গেটের কাছে দাঁড়াতেই দারোয়ান এগিয়ে আসে। কত তলায় কার বাড়িতে যাবেন জিজ্ঞেস করতেই রুমানা খানের চোখে ভাসে একতলা বাড়ির কালো কলাপসিবল গেটে দাঁড়িয়ে ডাক দিতেই বের হয়ে আসতো জোবেদা আপা। বিছানায় গড়িয়ে বারান্দায় বসে মুড়ি ভর্তা আর দুধ চায়ের তুমুল আড্ডা বিকেল থেকে তরুন রাত গড়িয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরতো।দারোয়ানের কাছ থেকে জেনে যায় জোবেদা আপা মারা গেছে বছর দশেক আগে তার স্বামীও তিন বছর আগে চলে গেছেন।
ছেলে মেয়েরা বাড়ি ভাগাভাগি করে নিয়েছে। কেউ এখানে থাকে না। সব ভাড়া দেয়া। মাসের দশ তারিখের মধ্যে একদিন ভাড়া নিতে আসে। বিলটিলগুলো দারোয়ান দিয়ে কাগজপত্র গুছিয়ে রাখে।
কে কোনতলা নিয়েছে বা পেয়েছে জিজ্ঞেস করতেই রুমানা খান ভূমিকম্পের উপর দাঁড়িয়ে আছে এমন চমকে ওঠে!!
এ বাড়ির ভাগাভাগি আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী শেষ হয়ে আদালত অবধি গড়িয়েছে।
জোবেদা আপার সুন্দর গোছানো নিপাট সংসার। লক্ষীমন্ত মেধাবী ছেলেমেয়ে।
এক টেবিলে বসিয়ে এক পাতিলের রান্না করা ভাত বেড়ে খাইয়েছে।বড় কোনটার জামা কাপড় ছোট হয়ে গেলে সেলাই করে ছোটটাকে পড়িয়েছে।
আপা আর তার স্বামী আপ্রাণ সংগ্রাম করে চারটা সন্তানকে লেখাপড়া করিয়েছে।বড়টার এস এস সির ফলাফলে আপার স্বামী অনেক মিষ্টি এনে বন্ধুদের বাড়িতে বাড়িতে বিলিয়েছে প্রসন্ন মনে।
আপা তার বড় ছেলেটিকে দেখিয়ে বলতো ও আছে তাই, আমি আমার অন্য সন্তানদের জন্য চিন্তা করি না। ওর যা দায়িত্ববোধ ভাইবোনদের প্রতি।
ছেলেমেয়েগুলো লেখাপড়া শেষ করে ভাল ভাল চাকুরী করে। মানুষ হয়েছে সবাই।
“মানুষ হয়েছে”, চিন্তা করে থেমে যায় রুমানা খান।
সত্যি কি মানুষ হয়েছে ওরা! না আকৃতিতে বড় হয়েছে।
বড় ছেলেটা ভাইবোনদের ঠকানোর চেষ্টা করেছিল!! দারোয়ানের কাছে জানতে পারে।
দাঁড়িয়ে থাকে রুমানা খান, আলো পিছলে পড়া সফেদ টাইলসে মোড়া বাড়ি আর কালো মিশেল খয়েরী গেটের সামনে।
প্রতিটি ফ্ল্যটে আলো জ্বলছে। আনন্দের ঝর্ণাধারা তিরতির করে বইছে।থেকে থেকে যেন সুখের সুর উপচে পড়ছে বাড়িটা থেকে।
হঠাৎ–রেড ওয়াইন-রঙের একটা এ্যালিয়ন এসে থামে গেটের কাছে। পেছনের দুপাশের দরজা খুলে সদ্য কিশোরে পা দেয়া দুজন ফুলপরী ছটফট করে নামে। জোছনা মাখা কিশোরী দুজন খাবারের দোকানের দিকে ছোটে। ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে আসে যে যুবকটি তার মুখে জোবেদা আপার স্বামীর মুখ বসানো।বয়স মিলিয়ে চিনতে পারে তাকে ।জোবেদা আপার ছোট ছেলে!!
ও কি চিনতে পারবে? মনে মনে হিসাব মেলায় কতদিন পর দেখলো ওকে। ওর কৈশোর তারুণ্য যৌবন প্রাপ্তির স্তরগুলো রুমানা খানের চোখের আড়ালেই হয়েছে।
টলোমলো পায়ে হাঁটতে শেখা শিশুটির কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে চেনানোর জন্য এগুতেই শুনতে পায় যুবকটি দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করছে লাট বাহাদূর এসেছিল? গ্যাসের সমস্যার সমাধান করেছে না ভাড়ার টাকা নিয়ে চম্পট দিয়েছে।
না সে বিষয়ে তো কিছু কয় নাই।
-হারামজাদা খালি সমস্যা বাঁধায়? ঠিক আছে তুমি হিসাব ঠিক কর আমি আসছি। ও তুমি তো আবার তার লোক। বেতন তো আমিও দেই নাকি।
দারোয়ান মুখ নিচু করে থাকে। যুবকটি এগুতে থাকে।
রুমানা খানের কাছে এগিয়ে আসে দারোয়ান।
দুই ভাইয়ের একেবারে মিল নেই। কেউ কাউরে দেখতে পারে না। আমার হইছে জ্বালা হে কয় আমি তার লোক, তায় কয় আমি এর লোক। মাইয়াগুলান আরো দজ্জাল। আমার শান্তি নাই এমুন চাকরির কপালে ঝাড়ু!
রুমানা খান দেয়ালের টাইলসে হাত রাখে ঐশ্বর্যের সৌখিনতায় পিছলে যায় হাত।শান্তি সুখের ভূমিতে ঐশ্বর্য অনৈক্য আর অসুখী দীর্ঘশ্বাসের ভবন ছেড়ে পথে নামে।রঙিন আলোতে ঝকমকে পথ আনন্দে মুখরিত হয়ে আছে।
প্রত্যেকের মুখ হাসিখুশি।
মরিচ বাতির রঙিন পথ ছেড়ে এগিয়ে আসে একটু। আকাশে তাকায়। কুয়াশার আকাশে চাঁদ আছে তারাও আছে আশেপাশে।
ওর সামনেই বদলে গেল শহরটা!! সুন্দরী শহরটার ভেতরে কত বুকচাপা কান্না কান পেতে শুনতে শুনতে বাড়ির পথ ধরে…