দীপক সাহা
এক টুকরো মিঠেল হাওয়ায় মত বাংলার আঙিনায় হাজির বাঙালির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, আবেগ, প্রেরণা, ভালোলাগা, ভালোবাসার পয়লা বৈশাখ। আজ পয়লা বৈশাখ। নববর্ষ। ইংরেজি-হিন্দিমুখী প্রজন্মের কাছে ‘বেঙ্গলি ডে’। আম-বাঙালির বছর বদলের উৎসব। বাঙালির বাঙালিত্ব জাহির করার দিন। বাঙালির কাছে এই দিনটি পুরাতন বছরের সমস্ত রিক্ততা, শূন্যতা ও তিক্ততাকে পেছনে ফেলে নতুন বছরকে আহ্বান করার অঙ্গীকার। যতই বাঙালির মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির অস্তিত্ব নিয়ে নিন্দুকেরা ভ্রু কুঁচকান না কেন, পয়লা বৈশাখ আসলেই অন্তত একদিনের জন্য বাংলার আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে বাঙালিয়ানায়।
বাংলা সনের জন্মবৃত্তান্ত, রাজা শশাঙ্ক না সম্রাট আকবরের আমলে, সেই তাত্ত্বিক আলোচনা না হয় অন্য অবসরে বাঙালি বৈঠকি মেজাজে করা যাবে। বরং আজ বৈশাখের আগমনে আসুন সবাই একসাথে গলা মেলাই — এসো হে বৈশাখ, এসো এসো। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-রাজনীতির ভেদাভেদ ভুলে বাঙালির বৃহত্তর পরিবার আজ মেতে উঠেছে বর্ষবরণ পালনে। বাংলায় সেকুলার উৎসবের বড়ো বিজ্ঞাপন পয়লা বৈশাখ। ধর্ম নিরপেক্ষতা বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতির মূল ভিত্তি। নববর্ষ বরণ উৎসব সেই ভিত্তিকে আরও আঁটোসাটো করে। সেইজন্য বাংলার বুকে উৎসাহ ও উদ্দীপনায় ইংরেজি নববর্ষ যেমন পালিত হয়, অনুরূপ বাংলা নববর্ষও সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়। এটাই বাঙালিয়ানার স্বকীয়তা। রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ভেদাভেদের উর্ধ্বে বৃহত্তর বাঙালি এখন এক সাংস্কৃতিক জাতি।
পয়লা বৈশাখ মানে বাঙালির সারা বছরের দৈনন্দিন একঘেয়েমি থেকে একটু মুক্তির স্বাদ। ঝোলা হাতে সকালে মাছের বাজারে অন্ধ্রের কাটাপোনা কিনে বাড়ি ফিরে, বাসে-ট্রেনে বাদুড়-ঝোলা হয়ে , ডিএ-র দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন, নিয়োগ দুর্নীতিতে ঘেঁটে ঘ শিক্ষাব্যবস্থা, পঞ্চায়েত ভোটের প্রাক্কালে রামনবমী, হনুমান জয়ন্তীর শোভাযাত্রাকে ক্যাপিটাল করে রাজনৈতিক দলগুলোর দড়ি টানাটানি, অফিসে কর্মছেদ দিয়ে রাহুলের সাংসদপদ খারিজ ও আদানি তর্জায় চায়ের পেয়ালায় তুফান তুলে পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে শুভ নববর্ষের প্রভাতি কিরণে বাঙালি সাজে আজ বাঙালি রবীন্দ্রসদন চত্ত্বরে ভিড় করছে অন্তত একদিনের জন্য বাঙালি হতে ।
পয়লা বৈশাখী মেজাজে আজ বাংলা উৎসবমুখর। সমষ্টিগত সুন্দরের নান্দনিক প্রকাশের মধ্যে দিয়ে উৎসবের মহিমা বিকশিত হয়। সেই উৎসবের শরিক হতে সকাল সকাল স্নান সেরে বাঙালি চলেছে কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর বা পাড়ার কালীমন্দিরে। বাংলা টিভি চ্যানেলে বর্ষবরণ উদযাপন করতে বাঙালি সাজে সেলিব্রিটিদের আনাগোনা। নববর্ষকে ঘিরে বাঙালি পোশাক ও খাদ্যতালিকা বাঙালিয়ানা জীবনবোধের এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। বর্তমানে পয়লা বৈশাখ মানেই পোশাকে-প্রচ্ছদে রঙের প্লাবন, রবীন্দ্র, নজরুল, বাউল দর্শন। নববর্ষ মানে নতুন পাঁজি, লাল মলাটের হালখাতা। যদিও হালে কম্পিউটারের অতিরিক্ত নাক গলানোতে হালখাতার হাল বেশ খারাপ। এদিকে গাজন, চড়ক, চৈত্র সংক্রান্তি পেরিয়ে দিনভর নতুন বছরের প্রথম দিন হয়ে ওঠে বাংলার সর্বজনীন কৃষ্টি-সংস্কৃতি, আচার-উপাচারের মিলনমেলা। শহরে বিশ্বায়নের প্রভাবে উৎসবের খোলনলচে বদলে গেছে , কিন্তু, গ্রাম বাংলায় এখনো মেঠোসুরের ছোঁয়া জীবিত।
বর্ষবরণ উদযাপন বাঙালির একান্তই নিজস্ব কৃষ্টি- সংস্কৃতি। বাংলার পারিবারিক তথা সমাজ-জীবনের ভাবাবেগকে প্রশ্রয় দিয়েছে পয়লা বৈশাখ। আর এই ভাবাবেগের সাথে লেপ্টে আছে বাঙালির নস্টালজিয়া, ভালোলাগা, ভালোবাসা। সময়ের সাথে সাথে অভিরুচি, মূল্যবোধও পালটায়। কালের স্রোতে নববর্ষ পালনের পুরাতন রীতিনীতি, প্রথার জায়গা দখল করছে আধুনিক আদবকেতা। আটপৌরে লাল পাড় শাড়ি, রঙিন ধুতি পাঞ্জাবি পরে টিপিকাল বাঙালি বেশে , মিষ্টির হাঁড়ির ছবির সাথে শিরোনাম– শুভ নববর্ষ –ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্সট্রাগ্রামে ঢেউ । পয়লা বৈশাখ যথার্থই আজ বাঙালিয়ানাময়। অন্তত একদিনের জন্য আজ বাঙালি হওয়ার চেষ্টা। তাই জিন্স প্যাণ্টের বদলে নতুন পাঞ্জাবির ভাজ ভেঙে, কড়কড়ে মার দেওয়া রঙিন ধুতির কোঁচা অনভ্যস্ত হাতে পাঞ্জাবির পকেটে গুঁজে দিনভর বাঙালিয়ানার অভিনয় করা। উলুধ্বনি, শঙ্খ ধ্বনি, নাচ, গান, কবিতা, আড্ডা, ক্ষুদেদের নাটক – আজ পাড়ার ক্লাবে নীল, লাল, সবুজ, গেরুয়া সব রঙ মিলেমিশে বেনীআসহকলার এক অনন্য সুন্দর পরিবেশ। দিনভর হৈচৈ, হুল্লোড়, বাঙালি খানাপিনা, কিশোর-কিশোরীর আড়চোখে চাউনি, হাসি, আড্ডার পয়লা বৈশাখী কোলাজের ছবি।
বলতে দ্বিধা নেই পড়শি দেশ যখন পয়লা বৈশাখ দিনটিকে রীতিমত আত্মস্থ করে নিয়েছে হৃদয়ে-মননে, বৈশাখী উৎসবকে রূপ দিয়েছে একটি জাতিসত্ত্বার ‘ কার্নিভালে ‘, এ-পার বাংলায় আমরা তখন হুজুগে বাঙালিয়ানার প্রদর্শনীতে ব্যস্ত। নববর্ষ বরণে এ-পার বাংলায় কোথায় যেন এক অগোছাল দায়সারা ভাব। পয়লা বৈশাখকে আমরা অনেকে স্রেফ একটা ছুটির দিনের মেজাজেই কাটিয়ে দিই। আক্ষেপ হয়, বাঙালিরা পয়লা বৈশাখকে বেণীমাধব শীল, মদন গুপ্তের পঞ্জিকার বাইরে বের করতে পারল না। আমরা অনেকেই বলতে পারবো না আজ বাংলার কত সন। বাঙালি আজ বড়ই বাংলা-বিমুখ। বাড়িতে বাংলা ক্যালেন্ডার ঠাকুর ঘরেই ঠাঁই পায়, ড্রয়িং রুমে শোভা পায় চকচকে ইংরেজি ক্যালেন্ডার। কিন্তু মেঘঘন আকাশে এক চিলতে রোদ্দুরের মতো আম-বাঙালি মনে রাখে পয়লা বৈশাখ, ২৫ শে বৈশাখ এবং ২২ শে শ্রাবণ। এটাই ভরসার জায়গা।
ঠাকুমা, মায়ের আন্তরিকতার কড়াইয়ে স্নেহের ফোড়ন দেওয়া ব্যঞ্জনপদের হাতছানিকে উপেক্ষা করে শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে বাঙালি নতুন প্রজন্ম ভিড় জমায় সুক্তো, মোচার ঘন্ট, ডাল-চচ্চড়ি, দই-পটল কি কাঁচকলার কোপ্তার স্বাদ নিতে নামি-দামি রেঁস্তোরায়। ফিরে এসে সন্ধ্যায় পাড়ার ক্লাবের সামনে ছোট্ট জায়গায় রঙিন ককটেল পানীয় সহযোগে জমিয়ে আড্ডা। পাশে চড়াসুরে সাউন্ড বক্সে রিঅ্যালটি-শো-খ্যাত শিল্পীর বাংলা রিমিক্স গান। তারপর রাতের গভীরতায় যে যার বাড়ি। বাঙালি হয়ে ওঠার মুখোশটা পোশাকের সাথে সাথে আবার এক বছরের জন্য হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখা। পরের সকালে ঘুম ভাঙলে ‘একদিনের বাঙালি’র মনে হয় গত দিনটা কেমন যেন ঘোরের মধ্যে কেটে গেল। আবার মাছের বাজারে অন্ধ্রের কাটাপোনা আনতে টি-শার্ট গলিয়ে ব্যস্ত রাস্তায়।
বিশ্বায়নের প্রভাবে উৎসবের মধ্যে এখন আর সেই একাত্মতা, সেই আন্তরিকতা নেই। তার পরিবর্তে আছে আড়ম্বর, জৌলুস আর কৃত্রিমতা। চতুর্দিকে বাহারি আয়োজন। ফলে উৎসবের মধ্যে সেই পূর্ণতাবোধ নেই। আবেগের থেকে আয়োজনের প্রাধান্য বেশি। পয়লা বৈশাখ বাঙালি উপভোগের চেয়ে ভোগ করি বেশি। পয়লা বৈশাখ নিয়ে বাঙালির হঠাৎ একদিন হ্যাংলাপনা বছরের বাকি দিনগুলোকে কেমন যেন হতশ্রী করে তোলে। উৎসবের চাকচিক্য চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, কিন্তু, মন ছুঁতে পারে না। ‘একদিনের বাঙালিয়ানা ‘ রোজনামচায় পরিণত করতে না পারলে পয়লা বৈশাখ উদযাপনের সম্পূর্ণতা প্রকাশ পাবে না। পয়লা বৈশাখ হোক বাঙালির অহঙ্কার। বাঙালির প্রকৃত জাতীয় উৎসব। এক আঁচলা খুশি আর একমুঠো হাসিতে ভরে উঠুক বাঙালির পয়লা বৈশাখ।