সকালের রোদ
অংশুমান রায়
শিল্পনগরী (বহরমপুর)
হার্ডকভার
পাতা- ১১২
বিনিময় মুল্য-১৫০/-
অংশুমান রায় মুর্শিদাবাদ জেলার একজন প্রসিদ্ধ ছোটগল্পকার। শিল্পনগরী থেকে তাঁর ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় ‘ঘুম ভেঙে যায়’ গল্পগ্রন্থ। এতে আছে নানান স্বাদের ৩৯টি গল্প। এর পর দীর্ঘ অপেক্ষা। ২০২১শে প্রকাশ পায় তাঁর আরও একটি গল্পগ্রন্থ, ‘সকালের রোদ’।আছে ১১২ পাতা জুড়ে ২৬টি টুকরো টুকরো ছবি। মরণের। যাপনের।জীবনের। এখানে ‘সকালের রোদ’-ই আলোচ্য।
প্রথমেই বলি গল্পগ্রন্থের নাম অতি সরল ও মধুর। এবং নামের সাংকেতিক দ্যুতি খুব বেগবান। সকালের রোদ।কড়া নয়, মিঠে। গায়ে লাগলে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়। বেঁচে থাকা সার্থক মনে হয়।আমার মতে অংশুমানের গল্পগুলির মূল আকর্ষণ লুকিয়ে আছে নিত্যদিনের মরার হাত থেকে জীবনকে ছিনিয়ে নিয়ে এক মূল্যবোধ নিয়ে বাঁচার প্রয়াসে। লুকিয়ে বা পালিয়ে বাঁচা নয়। হেরেও না হারার দৃঢ়তা নিয়ে বাঁচা।
গল্পগুলি সরল। বার্তা কঠিন। ‘লাল পলাশ’, ‘স্বস্তি!’, ‘অতঃপর’ এবং ‘ইঁদুরের খাঁচা’ গল্পগুলিতে উঠে এসেছে নারী নির্যাতনের বিষয়। ধর্ষণ এখন নিত্যদিনের ঘটনা। কাগজ খুললেই মেয়েদের বাপেদের মায়েদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। সাথে আছে বিউটি কম্পিটিশনের রমরমা- মেয়েদের উলঙ্গ করে দৃশ্যসুখ আস্বাদনের আইনানুগ ব্যবসা। দে হাততালি। লে চর্বির প্রসাদ!
লাভ ও লোভ পুঁজিবাদী সমাজের স্বীকৃত রুপ। আমরা কীভাবে তার স্বীকার হচ্ছি, এবং নানা অর্থনৈতিক ফাঁদে পড়ছি—তা উঠে এসেছে ‘চাষ’ গল্পে। বাজার অর্থনীতির নিয়ন্ত্রকরা সকলকেই কনজিউমার বানায়। মানুষের পরিচিতি এখন ক্রেতা।‘ক্রেতা’ গল্পে বিবেকের মুখে শুনতে পায়—‘মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কাছে আমরা সকলেই খরিদ্দার। সমস্ত স্তরের মানুষকে খরিদ্দার করতে হবে। মানুষকে কেনার অভ্যাস করে দাও। তারপর নিজেরাই আসবে। মনে পড়ল যে মানুষ ত্রিশ টাকায় দুপুরে আহার করত, সেই মানুষ দেড়শো টাকা দিয়ে বিরিয়ানি খাচ্ছে।’
ক্রেডিট কার্ড, হরেক কিসিমের ডিসকাউন্ট ও লোভনীয়, আকর্ষণীয় অফারেরে বন্য্যায় আজ আমরা প্লাবিত। প্রমোটার, ব্যবসায়ী পাড়ায় পাড়ায়।এই লোভের ফাঁদ থেকে ‘নিমাইবাবুর বাগান’ গল্পে দেখি নিমাইবাবুর বাঁচার চেষ্টা। ‘নিমাইবাবুর সুখের জীবন বেশি দিন গেল না। একদিন পটু এসে বলল—বাবা একটা ভাল প্রপোজাল এসেছে আমার কাছে।
–কিসের প্রপোজাল?
–আমাদের জমিটা যদি ভাড়ায় খাটাই তবে প্রচুর টাকা পাব…
–কেন ভাড়ায় খাটাতে যাব? সেসব তো আমি ভাবিনি…
–আমি রাজি নয়।’
নিমাইবাবু কতদিন গররাজি থাকতে পারবেন? এর উত্তর আমরা সবাই কম বেশি জানি।কি গ্রামে, কি শহরে, বাড়ি আগলে রাখা এখন কঠিন। সামনে পিছনে পিল্লাই ফ্ল্যাট, মধ্যেখানে এক চিলতে সবুজ ঘেরা একতলা, দোতালা বাড়ি। প্রতিদিন প্রমোটারদের নানা কিসিমের প্রলোভন থেকে কে দূরে থাকতে পারবেন? আর থাকলেও কতদিন? আর সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে, আঙুল তো একটু বাঁকাতেই হবে প্রমোটারদেরকে।
দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষদের মেরে খাওয়া, তাদের কায়িকশ্রমকে দিনের শেষে হিসাবের খাতাতে কারচুপি করা, তাদেরকে কারণে অকারণে অপমান, গালিগালাজ করা একটু উঁচুস্তরের সচ্ছল মানুষদেরও মজ্জাগত। ‘ভ্রমণ’, ‘ছন্দপতন’, ‘উপরি’ এবং ‘দ্বিধা’ গল্পে এসব দৃশ্য আমাদের চোখে ধরা দেয়। ‘উপরি’ গল্পে মুসলমান শ্রমিক নেই। আছে নির্মল আর বিলাস। তারা একটি মোমবাতি কারখানায় কাজ করে। নির্দিষ্ট ঘণ্টার কাজের শেষে মালিকের বাড়িতে যায়। মালিকের বউ ডেকেছে। পুরনো আলমারি, ফ্রিজ এসব সরাতে।নতুন আসবে।কাজের শেষে এক কাপ চা খাওয়ার প্রস্তাব জোটে বটে। তা আবার কাজের মেয়েদের জন্য বরাদ্ধ কাপেই। ওরা চা না খেয়েই পা ফেলে খোলা রাস্তায়।বাড়ির দিকে। বিড়ি ধরাই দুজনেই। মাথার উপরে চাঁদ। কি শান্ত চারিদিক।
করোনাকালে শারীরিক দূরত্ব রাখার চেষ্টায়, সরকারের ‘স্টে এ্যট হোম’ মন্ত্রে মানুষের সামাজিক দূরত্বকে আরো বাড়িয়েছিল। মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। লেখক এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতার চিত্র তুলে ধরেছেন তার ‘দূরত্ব’ গল্পে।
সারা বিশ্বই এখন যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ পিছনে ফেলে দিয়ে ধর্মীয় উন্মত্ততা্র আগ্রাসনে মেতে উঠেছে। ধর্মের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে রাষ্ট্রনায়করা তাদের ক্ষমতার বলয়কে অক্ষত রাখতে সচেষ্টা হচ্ছেনl রাষ্ট্রের শোষণ অনাচার অত্যাচার এবং মিথ্যাচার সবই এখন মানুষ মেনে নিয়েছে, নিতে বাধ্য হয়েছে। এইসব দেখে লেখকের আক্ষেপ ও হতাশা ধরা পড়েছে তার ‘দ্বিধাদ্বন্দ্ব’, ‘আকাশ পেরিয়ে’ ও ‘পরবাসী’ গল্পগুলিতেl ‘পরবাসী’ গল্পে উঠে এসেছে নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন, এনআরসির কথাl সত্যিকারের কথা আসলে ভিন্ন। দেশের মানুষকে ব্যস্ত করে রাখা একের পর এক কাগজ সংশোধনের অজুহাতে। কর্মসংস্থান নেই।বেকারে ভর্তি দেশ।আর সকলেই ব্যস্ত কাগজ সংশোধনে।
গণতন্ত্র এখন ভয়তন্ত্রে পরিণত হয়েছে। তার প্রতিচ্ছবি উঠেছে তার গল্প ‘গণ(ভয়)তন্ত্র’-এ। ভোট এসেছে। চারিদিকে ভীষণ অশান্তি। বেশিরভাগ জায়গায় শাসক দল বিরোধীশূন্য করে দিয়েছে। কিছু এলাকায় ভোট হচ্ছে।সব মানুষের মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করছে, এবং অনেকেই ঠিক করেছেন বুথে না যাওয়ার।ঝামেলা এড়াতে।
গল্পকারের ভাষা সহজ সাবলীল। শব্দ চয়নও তাই। কিন্তু আপাত সরল শব্দের মধ্যেই নিত্যদিনের জীবনের নানা জটিলতা গুলি উঠে এসেছে তাঁর সাবলীল কলমের আঁচড়ে।বইটির সামাজিক মূল্য আছে। আরও প্রচার কাম্য। পাঠকেরা সংগ্রহ করলে ঠকবেন না বলে আমি মনে করি।
হ্যাঁ, শুধু নান্দনিকতার খোঁজে আছেন যাঁরা, তাঁদের কথা আলাদা।