কুড়মি আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট
ছোটনাগপুর ভূখন্ডের অন্যতম প্রাচীন জনজাতি কুড়মি, ১৮৭১-১৯৪১ পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের প্রতিটি জনগণনায় আদিবাসী তালিকাভুক্ত থাকলেও ১৯৫০ সালে দেশের তৎকালীন মনোনীত সরকার দ্বারা কোনো কারণ ছাড়াই আদিবাসী তালিকা থেকে বাদ পড়ে। ব্রিটিশ শাসন কালে এই অঞ্চলে মাত্র ১৩ টি পৃথক জনগোষ্ঠী আদিবাসী তালিকাভুক্ত ছিল, কিন্তু ব্রিটিশ পরবর্তী সময়ে কুড়মি বাদে ১২ টি জনগোষ্ঠীকেই তালিকায় রাখা হয়। ঐ সময়, এই বিষয়ে ১৯৫০ সালের ১৭ ই ডিসেম্বর ডা. এইচ. এন. কুনজ্রু এবং অন্য ১৫ জন সদস্য তৎকালীনৎ প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন। ১৯৫১ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারী এর উওরে পন্ডিত জহরলাল নেহেরু লেখেন, ১৯৩১ সালের জনগননায় জাতি এবং জনজাতিকে আলাদা করে দেখানো হয়েছিল এবং জনজাতিকে প্রিমিটিভ ট্রাইব হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। এই কারণে যাদের প্রিমিটিভ ট্রাইব বলা হয়েছে তাদের প্রত্যেককে সিডিউল ট্রাইব হিসেবে সিডিউল করা হবে (বৃহৎ ছোটনাগপুরকে আদি বুনিয়াদ, অ্যডভোকেট সুনীল কুমার মাহাতো)।
কিন্তু আদিবাসী সমাজ, বিশেষ করে কুড়মি জনজাতির মানুষজন সেই সময় ‘শিক্ষা ও চেতনাগত’ দিক থেকে পিছিয়ে থাকায় সেই ভাবে প্রতিবাদী জনমত গড়ে তুলতে পারেনি। সত্তরের দশকে ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের সময় থেকে দেশের বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী ও প্রতিষ্ঠিত আদিবাসী নেতৃত্বেদের যৌথ উদ্যোগে কুড়মিদের আত্মপরিচয় ফিরে পাবার বিষয়টি গতি পায়। কুড়মিদের মধ্যে ধীরে ধীরে সচেতনতা গড়ে ওঠে। ঝাড়খণ্ড আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকারী রাজনৈতিক পার্টি ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার লিখিত পরিচালন নীতিতেও এই দাবিকে সমর্থন করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল মূল দাবি সনদ থেকে সরে এসে ২০০০ সালে আধা অধুরা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। স্তিমিত হয় কুড়মিদের আত্মপরিচয় ফিরে পাওয়ার দাবিও। আত্মপরিচয় ছিনিয়ে নেওয়ায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে কুড়মি জনজাতির মানুষজন ক্রমশ কোনঠাসা হতে থাকে।

এমতাবস্থায় ২০১০ সালের পরবর্তী সময় থেকে শিক্ষিত সচেতন যুব সমাজ এবং কুড়মি সমাজ নেতৃত্বের যৌথ প্রয়াসে কুড়মি জনজাতির আত্ম পরিচয় ফিরে পাওয়ার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জনমত তৈরী হতে থাকে।বর্তমান সময়ে ঝাড়খন্ড সহ বাংলা ও ওড়িশার (গ্রেটার ঝড়খন্ডের অংশ) কুড়মি জনজাতির মধ্যে সচেতনতা ও জনমত গড়ে ওঠায় আন্দোলন ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
বিশ্বের সমস্ত আদিবাসী মানুষ, যাদের জীবনশৈলী দীর্ঘকাল যাবৎ কাস্টমারি নিয়ম (স্বশাসনের অর্থনীতি, সামাজিক রীতিনীতি, পরম্পরা, দর্শন ইত্যাদি) দ্বারা পরিচালিত হত, তাদেরকে আকস্মিকভাবে সেই অবস্থা থেকে সরিয়ে দেওয়ার অর্থ, তাদের অস্তিত্বকে গা জোয়ারি করে মুছে দেওয়ার চেষ্টা। কোন বৃক্ষের শিকড়ের সঙ্গে ছেড়খানি হলে বৃক্ষ ধীরে ধীরে শুকিয়ে মারা যাবেই। ক্ষমতা হস্তান্তরের পরবর্তী সময়ে আদিবাসী কুড়মি জনজাতির সঙ্গে সেটাই হয়েছে।
কুড়মিদের বিভিন্ন নৃতাত্বিক প্রমান এবং প্রতিষ্ঠিত লিস্টেড আদিবাসী নেতৃত্বের সমর্থন
কুড়মি জনজাতির মূল পেশা কৃষিকাজ। কৃষিকাজ শিখে উৎপাদনের স্তরে পৌঁছানো অন্যতম একটি প্রাচীন জনজাতি কুড়মি। কৃষিকাজে সহায়ক হবে এই কারণে ছোটনাগপুর মালভূমির মূলত তিনটি নদী দামোদর, কংসাবতী ও সুবর্ণরেখা এবং বিভিন্ন ছোট খাটো নদী-নালার অববাহিকায় এদের জনবসতির ঘনত্ব সব থেকে বেশি। সমগ্র কুড়মি সমাজ মোট ৮১টি টোটেমে বিভাজিত এবং আজও তারা টোটেম বিশ্বাসী। একই টোটেমে বিবাহ নিষিদ্ধ। নিজেদের মধ্যে কুড়মালি ভাষায় কথা বললেও অবদমনের ফলে এবং বিকশিত জাতিসত্ত্বা গুলির আধিপত্যের কারণে যারা যে রাজ্যে বাস করে তারা সেখানকার ভাষা শিখে নিতে বাধ্য হয়েছে। পুরুলিয়ার ছৌ-নাচ, ঝুমুর গান, পাতা নাচ ও টুসু গীত এই কুড়মি সম্প্রদায়ের বিশেষ সংস্কৃতি। প্রকৃতি-পূজক কুড়মিদের করম, বাঁদনা, রহিন, টুসু ইত্যাদি প্রতিটি পরবই কৃষি ভিত্তিক এবং নারী কেন্দ্রিক। করম পরবের জাওয়া গীত আর বাঁদনা পরবে আহীরা গীত ঐ দুই উৎসবের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
অনেকেই বিহারের কুর্মী আর ছোটনাগপুর মালভূমির কুড়মি জনগোষ্ঠীকে একই মনে করে থাকেন। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ ভারতের সিভিল সারভেন্ট এইচ এইচ রিজলের (H H Risley) লেখা ট্রাইবস এন্ড কাস্ট অফ বেঙ্গল (Tribes and Castes of Bengal) রিপোর্টের Ethnographic Glossary- তে পরিষ্কার এই দুই জনগোষ্ঠীকে পৃথক ভাবে দেখান হয়েছে।
সাঁওতাল ও অন্যান্য সিডিউল আদিবাসীদের একাংশ এই আন্দোলনের বিরোধিতা করলেও ৮০-৯০ এর দশকে শিবু সোরেন, এন ই হোরো সহ একাধিক সিডিউল আদিবাসী নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবী কুড়মিদের দাবির পক্ষে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন। ১৯৮৭ সালে ২৭- ই ডিসেম্বর আদিবাসী কুড়মি সমাজের ব্যানারে পুরুলিয়া জেলার আড়ষা থানার অর্ন্তগত ঝুঁঝকা গ্রামে জনসভার আয়োজন হয়, উপস্থিত মানুষের সং খ্যা ছিল প্রায় লক্ষাধিক। জনসভায় কুড়মি নেতৃ্ত্বের সঙ্গে সঙ্গে সিডিউল আদিবাসী, অআদিবাসী রাজনৈ্তিক নেতত্বও উপস্থিত ছিলেন। কেন্দ্র সরকারের অধীনে ১৯৮৯ সালে গঠন হওয়া উচ্চস্তরীয় ঝাড়খন্ড সংক্রান্ত কমিটির রিপোর্ট ১৯৯২ সালের ৩০-ই মার্চ কেন্দ্র সরকারের তৎকালীন গৃহ রাজ্যমন্ত্রী এম এম জ্যাকব সংসদের দুই সদনে পেশ করেন। যেখানে কুড়মি জনজাতিকে অসরকারি আদিবাসী বলে উল্লেখ করা হয়েছিল (ঝাড়খন্ড কি সমরগাথা, শৈ্লেন্দ্র মাহাতো)।
কেন কুড়মি আন্দোলন ঝাড়খন্ডীদের জাতি বিকাশের সহায়ক
ব্রিটিশ সময়কালের ভুলিয়ে ফুসলিয়ে এবং গা জোয়ারি করা বিস্থাপন ছাড়া বিগত ৭৫ বছরে বৃহত্তর ঝাড়খন্ডের ভূমি সন্তানরা বাইরের রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে কি মাত্রায় পাকাপাকি ভাবে মাইগ্রেশন হয়েছে? এবং ভিনভাষা ও সংস্কৃতির অন্যান্য রাজ্যের (ভিন্ন জাতির, ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির) মানুষজন কর্মসংস্থানের উদ্দ্যেশে এসে বৃহত্তর ঝাড়খন্ড জুড়ে কি মাত্রায় পাকাপাকি ভাবে মাইগ্রেশন হয়েছে ও হচ্ছে? যে হারে অন্যান্য রাজ্যের মানুষের মাইগ্রেশন হচ্ছে তাতে করে কি বৃহৎ ঝাড়খন্ডের জনবিন্যাস পরিবর্তন হচ্ছে না? এবং জনবিন্যাসের এই পরিবর্তনের ক্রম অনুসরণ করেই ঝাড়খণ্ডে আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক স্বায়ত্বতার সম্ভাবনাও দিন দিন খর্ব হচ্ছে। আগামীদিনে সেখানকার মানুষদের বহু চর্চিত ‘রোহিঙ্গা অবস্থা’ হয়ে যাওয়া কি বাস্তবতা নয়? কারণ রোহিঙ্গারাও কেউ আকাশ থেকে টপকায় নি, কিন্তু আজ তারা ভিটে মাটি ছাড়া বাস্তু হারা। তারা আগ্রাসন আর আধিপত্যের শিকার। ব্রিটিশ সময় কালে বিস্থাপিত হওয়া সুন্দরবন এবং উওরবঙ্গে ঝাড়খন্ডীদের অবস্থা তথৈবচ, এগিয়ে থাকা জাতিসত্বা গুলি দ্বারা তারা ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম সহ বিভিন্ন আগ্রাসনের শিকার। আসামের ঝাড়খন্ডী সন্তানরাও অস্তিত্ব নিরাপদ রাখতে বর্তমানে আন্দোলনরত। একই ভাবে আদিবাসিত্ব এবং সমগ্র জনজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বিস্তীর্ণ ঝাড়খন্ড জুড়ে কুড়মিরাও আন্দোলনরত।

এসটি তালিকায় অন্তর্ভুক্তি কী শুধুমাত্র কুড়মিদেরকেই সুবিধা দেবে? এই আন্দোলনকে শুধুমাত্র কুড়মি জনজাতির সমাজের আন্দোলন হিসাবে দেখলে বা ভাবলে মনে হবে যে এই আন্দোলন শুধুমাত্র কুড়মিদেরকেই সমৃদ্ধ করবে এবং তারা বোধহয় ৬ শতাংশ সংরক্ষণের সুবিধা পাওয়ার জন্যই লড়ছে। কিন্তু আসলে সেরকমটা নয়। কুড়মিরা আদিবাসী স্টেটাস ফিরে পেলে সমগ্র অঞ্চলের আদিবাসী জনগণের জনসংখ্যাকে বৃদ্ধি ও শক্তিশালী করবে।পঞ্চম ও ষষ্ঠ তপসিলিতে অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা বৃ্দ্ধি পাবে। ঠিকাদারের বঞ্চনা, শোষণ কুড়মি, সাঁওতাল, মুন্ডা সহ সকলের জন্যই সমান। তাই এ লড়াই শুধুমাত্র সংরক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে আগামীদিনে বৃহত্তর ঝাড়খণ্ড গঠনের সঙ্গে ঝাড়খন্ডীদের জাতি বিকাশের পথকে প্রশস্ত করবে। আর সেই সম্ভাবনাকে ধারণ করে বলেই ওখানকার সম্পদ লুঠের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত মানুষজন এই আন্দোলনের প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ বিরোধিতা করছে এবং সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।
ভারতে চাইলেই যেমন কেউ উচ্চবর্ণের হতে পারে না, ঠিক তেমনি আদিবাসী বা ক্ষত্রিয় হতে পারে না। ‘দুধ-দই-ছানার’ মতো আকস্মিক ভাবে কোন জনজাতির আত্মপরিচয় তৈরী হয় না। ক্ষত্রিয় হিসেবে পরিচিতি এদেশের শ্রেণী বিভাজিত অর্থনীতির (বর্ণ ব্যবস্থার) অংশ বিশেষ। উল্টোদিকে কোন জনজাতির আদিবাসী সত্ত্বা গোষ্ঠী ব্যবস্থার পরবর্তী পর্যায়ে কাস্টমারি অর্থনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সময়ে সময়ে শ্রেণী বিভাজিত ব্যবস্থার শাসকগণ অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চাপালেও বিস্তীর্ণ ছোটনাগপুর জুড়ে কুড়মি জনজাতি তাদের চিরাচরিত সংস্কৃতি ও পরম্পরা আজও দৃঢ়তার সঙ্গে বহন করে চলেছে। এই দাবির পক্ষে কুড়মিদের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। কুড়মিদের আদিবাসী সত্ত্বা ফিরে পেতে লিস্টেড আদিবাসীদের একাংশ যে সব যুক্তি সামনে আনছেন তাতে করে মনে হচ্ছে মানব সভ্যতার ইতিহাস হাজার লক্ষ বছরের নয়, মাত্র ৬০-৭০ বছরের। ভাষা-সংস্কৃতি এবং আদিবাসীদের ক্ষেত্রেও ইতিহাস হাজার লক্ষ বছরের।
এদেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই বাংলা বাঙালিদের, ওড়িষ্যা ওড়িয়াদের, মহারাষ্ট্র মারাঠিদের, ইত্যাদি। একই কথা এদেশের সমস্ত রাজ্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য কিন্তু ‘ঝাড়খণ্ড এবং বৃহত্তর ঝাড়খন্ডের’ বিভিন্ন অংশ ঝাড়খন্ডী ব্যতীত প্রত্যেকের। ঝাড়খন্ডীদের অবস্থা নিজ ভূমে পরবাসীর মত।
বিষয় পরিষ্কার। স্বতন্ত্র ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, অর্থনীতি ও ভূ-সীমানা ছাড়া কোন জাতি তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। কুড়মিদের আত্মপরিচয় ফিরে পাওয়া বিগত ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিল। আর এই দাবি ঝাড়খন্ডীদের জাতি হিসেবে বিকশিত হওয়ার জন্যও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক। নিশ্চিত ভাবেই ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের তৎকালীন নেতৃত্ববৃন্দ মূর্খ ছিলেন না। সাম্রাজ্যবাদী যুগে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক স্বায়ত্বতা ছাড়া কোন জাতির বিকাশ এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা মুশকিল। ২০০০ সালে খাতায় কলমে ঝাড়খন্ডীরা আধা-অধুরা ঝাড়খন্ড রাজ্য পেলেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈ্তিক ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। সময় থাকতে সচেতন না হলে সমূহ বিপদ। তাই সিডিউল আদিবাসী সহ প্রত্যেক ঝাড়খন্ডীকে জাতি হিসেবে বিকাশের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র স্বার্থ পরিত্যাগ করে সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে এবং জাতির পরিপূর্ণ বিকাশের লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে। বর্তমান সময়ে পূঁজিবাদী ব্যবস্থা ও তাদের সহযোগী বিভিন্ন শক্তির বিরুদ্ধে, যে জাতি / জনজাতি জোটবদ্ধ হয়ে লড়াই করতে পারবে না সেই জাতির অস্তিত্ব সংকটজনক হয়ে উঠবে। কুড়মিদের ছিনিয়ে নেওয়া আদিবাসী স্বত্বা ফিরে না পেলে বা তাদের শেষ হওয়াতে বাকি ঝাড়খন্ডীরা নিরাপদে থাকবে তো? নাকি পরিস্থিতি দাঁড়াবে ‘ঘুঁঠে পোড়ে আর গোবর হাসের মতো’।
কুড়মিদের আত্মপরিচয় ফিরে পেতে প্রতিবন্ধক শক্তি কারা ও কেন? ছোটনাগপুরকে চার রাজ্যে অন্তর্ভুক্তি এবং অর্থনীতি–রাজনীতিতে বহিরাগতদের কব্জা
দেশের অন্যান্য রাজ্য গুলির মতো ঝাড়খন্ডীদের প্রকৃত অর্থে জাতি বিকাশ (স্বতন্ত্র ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভূখন্ড এবং অর্থনীতি) না হওয়া পর্যন্ত এখানকার বিভিন্ন জনজাতি গুলির মধ্যে নিজ নিজ গোষ্ঠী স্বার্থে সংঘর্ষ হওয়া অস্বাভাবিক না। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী যুগে এতে প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশী হয়। তৃতীয় পক্ষ (আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, এদেশের দালাল ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি, দালাল সামন্তীয় শক্তি, দালাল রাজনৈতিক নেতা এবং ঝাড়খন্ডের বর্তমান চামচা ও বেলচারা) নিজেদের স্বার্থে সময়ে সময়ে সংঘর্ষের আগুনে ঘি ঢেলে যায় অবাধ ও নিরবচ্ছিন্ন লুঠ চালিয়ে যেতে।
ব্রিটিশ পরবর্তী ভারতে নির্বিরোধ ‘বৃহত্তর ঝাড়খণ্ড‘ লুঠের চার মুখ্য বিন্দু:
১) গা জোয়ারি করে, কোনো কারণ ছাড়াই কুড়মি জনজাতিকে আদিবাসী তালিকা থেকে বাদ দেওয়া। এর ফলে বৃহত্তর ঝাড়খণ্ড জুড়ে ব্যাপক হারে আদিবাসী সংখ্যা কমিয়ে তাদের জল, জঙ্গল, জমিনের অধিকারকে হনন করা এবং খনিজ লুঠের রাস্তাকে প্রশস্ত করা।
২) বৃহত্তর ঝাড়খণ্ডকে বিভাজন করে চার ভিন্ন ভাষিক ও সাংস্কৃতিক রাজ্যে (বিহার, উড়িষ্যা, পশ্চিম বঙ্গ ও মধ্য প্রদেশ) অন্তর্ভুক্ত করা। অর্থনৈতিক শোষণের উদ্দ্যেশ্যে তাদের জাতি আগ্রাসনের মুখে ফেলে দেওয়া। ঝাড়খন্ডীদের ভৌগলিক-ঐতিহাসিক-সাংস্কৄতিক পরিচয়কে মুছে দেওয়ার চেষ্টা।
৩) ঝাড়খন্ডের ভৌগলিক সীমানা পাল্টে এবং কুড়মিদের আদিবাসী লিস্ট থেকে বাদ দেওয়ার মাধ্যমে বৃহত্তর ঝাড়খণ্ডকে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির মতো পঞ্চম ও ষষ্ঠ তপসিলিতে আসা থেকে বিরত রাখা।
৪) ঝাড়খন্ডীদের উপর চার ভিন্ন রাজ্যের ভাষা ও সংস্কৃতি চাপিয়ে সেইসব রাজ্যের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হতে বাধ্য করা। কোন জাতি/জনজাতির চিরাচরিত ভাষা-সংস্কৃতি আধিপত্যের শিকার হলে সেই জাতি / জনজাতিও আপস করতে বাধ্য হয়। সেক্ষত্রে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হয়।
ইতিহাস এবং লাভ-লোকসানের বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই কুড়মিদের পরিচয় ছিনিয়ে নেওয়ার সঙ্গে প্রভাবশালী শক্তি টাটা সহ অন্যান্য শিল্প গোষ্ঠীর স্বার্থ সরাসরি জড়িয়ে রয়েছে। কারণ ছোটনাগপুরে জমি অধিগ্রহনে বড় বাধা ছিল ১৯১০ সালে লাগু হওয়া CNT Act (ছোটানাগপুর ট্যানাসি অ্যাক্ট)। এই আইন আদিবাসীদের জমি অ-আদিবাসীদের হাতে হস্তান্তরকে নিষিদ্ধ করে। তাই CNT Act-এর বাধা সরিয়ে জমি অধিগ্রহনের কারণেই নিয়ম-কানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কুড়মিদের আদিবাসী লিস্ট থেকে বাদ দেওয়া হয়। এরফলে আদিবাসী তালিকা থেকে বাদ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বোকারো, ধানবাদ ও রামগড় সহ বিস্তীর্ন ছোটনাগপুর জুড়ে CNT Act এর আওতার বাইরে চলে আসে আদিবাসী কুড়মি জনজাতির বসত অঞ্চলের জমি। এরপর জমি অধিগ্রহন এবং ৬০-এর দশক থেকে এই অঞ্চল গুলোতে একের পর এক বিভিন্ন ভারি শিল্প গড়ে উঠতে থাকে। দেশীয় বিকাশ ভালো বিষয় কিন্তু সেই বিকাশের অর্থনীতিতে কুড়মিরা তো বটেই সেই সঙ্গে অন্যান্য আদিবাসী এবং সাধারণ ঝাড়খন্ডীদের ভাগিদারিত্ব হয়েছে কী? এখানকার মানুষজন শিক্ষা, স্বাস্থ্যের ন্যূনতম পরিষেবাও ঠিকমতো পায়নি। জীবন ধারনের বাকি মৌলিক অধিকার গুলি থেকে রয়েছে বঞ্চিত। এই ষড়যন্ত্র জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। জাতীয়- আন্তর্জাতিক বড় বড় রাঘব বোয়ালরা আমাদের শত্রু, যাদের সচরাচর আমরা চোখেও দেখি না। সামনে আসে তাদের বিভিন্ন ভ্যারাইটির লালিত পালিত পোষ্যরা।
কুড়মিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মুখেদের মধ্যে মুখোশধারীদের লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় কি? চলমান কুড়মি আন্দোলন ঝাড়খণ্ড লুটেরা জাতীয়-আন্তর্জাতিক কায়েমী স্বার্থের চোখের বালি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবে মাত্র তারা আওয়াজ দেওয়া শুরু করেছে। আন্দোলন তীব্র হলে, দমন করতে দাঁত, নখও বেরিয়ে আসবে। ঝাড়খন্ড বিরোধী বিভিন্ন কায়েমী শক্তির সুবিধার্থে, জনজাতির যে সব নেতৃত্ব নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে আপামর ঝাড়খন্ডবাসীর সঙ্গে বেইমানি করবে, সাময়িক ভাবে তারা সুবিধা পেলেও দীর্ঘমেয়াদী ভাবে বেইমান হিসেবেই চিহ্নিত হবে। বৃহত্তর ঝাড়খণ্ড জুড়ে তখনও লুঠ ছিল, আজও লুট চলছে। লুটেরা একই, শুধু মাধ্যম বদলেছে। লিস্টেড আদিবাসীদের ও অন্যান্য ঝাড়খন্ডীদের সামান্য অংশের অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নতি সামগ্রিক ভাবে ঝাড়খণ্ড ও ঝাড়খন্ডীদের উন্নতিকে দর্শায় না। বর্তমানে ঝাড়খন্ডীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক বেহাল দশা নিয়ে সারা দেশ ওয়াকিবহাল। কুড়মিদের লড়াই শুধু কুড়মিদের জন্যে নয়, কুড়মিদের লড়াই বৃহত্তর ঝাড়খণ্ড জুড়ে প্রত্যেক নিপীড়িত, শোষিত, অসহায় ঝাড়খন্ডবাসীর জন্যও। আর লড়াই বৃহত্তর ঝাড়খণ্ডকে প্রকৃত অর্থে দিকু মুক্ত করতে।
এই প্রাসঙ্গিকতায় কিছু প্রশ্ন:
১) ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের দাবি সনদের কতগুলি পূর্ণতা পেয়েছিল? না পেলে কেন পাই নি?
২) কেন আধা অধুরা ঝাড়খন্ড রাজ্য গঠনে নেতৃত্ব আপস করে?
৩) বাংলা, ওড়িশা, ছত্রিশগড় অংশের অন্তর্ভুক্তি এবং অন্যান্য এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলির মতো ঝাড়খন্ডীদের অর্থনীতির উপর নিয়ন্ত্রন থাকলে আমাদের ঘরের ছেলেদের কি পরিযায়ী হতে হত?
৪) তৎকালীন ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের নেতৃত্বর একাংশ, যারা ঝাড়খন্ড আন্দোলনের আদর্শকে ত্যাগ করে রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন তারা, তাদের পরিবার এবং বাকি ঝাড়খন্ডীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা কি অনুরূপ?
লিস্টেড আদিবাসীরা কেন এই আন্দোলনকে সমর্থন করবে? যুব সমাজের পরিযায়ী হওয়া এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক বিষয়ে বেহাল অবস্থা

ঝাড়খন্ডী এবং সিডিউল আদিবাসীদের একাংশ যারা বিস্তীর্ণ ঝড়খন্ড জুড়ে কুড়মিদের আত্মপরিচয় ফিরে পাওয়ার আন্দোলনের বিরোধিতা করছেন। তাদেরকে কিছু প্রশ্ন:
১) ঝাড়খন্ড জুড়ে বিভিন্ন খনিজ উত্তোলন এবং শিল্পের থেকে দূষণ ব্যতীত ঝাড়খন্ডীদের স্বাভাবিক প্রাপ্তি কি?
২) আগামীদিনে যে খনিজ উত্তোলন এবং শিল্প হবে সেখান থেকে বিস্থাপন ছাড়া ঝাড়খন্ডীদের আর কিছু প্রাপ্তি থাকবে কি?
৩) শিল্পাঞ্চল গুলিতে বসতি স্থাপনে এবং কর্মসংস্থানে ঝাড়খন্ডীদের প্রাপ্তি কি?
৫) এক সময়ের ৫০০ টাকার বালির বর্তমান বাজার মূল্য ৫০০০-৭০০০ টাকা। আমাদের প্রাপ্তি কি? বালির এই মূল্য কাদের পকেট গরম করছে?
৬) প্রাকৃ্তিক সৌন্দর্য কেন্দ্রিক বিভিন্ন বেড়ানোর জায়গা গুলিতে হাজারো রিসর্ট। ঝাড়খন্ডীদের অংশীদারিত্ব রয়েছে কি? ঝাড়খণ্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে?
৭) ঝাড়খন্ডের অর্থনীতিতে ভূমি সন্তানদের ভাগিদারিত্ব কত শতাংশ? রাজনৈতিক কর্তৃত্ব কাদের নিয়ন্ত্রণে, ভেবে দেখেছেন?
৮) ব্রিটিশ পরবর্তী সময়ে ঘর চালাতে বাপ-ঠাকুরদাদের তো বাইরের রাজ্যে কাজে যেতে হয় নি, তাহলে বর্তমানে কেন আমাদের ভাইদের ঘর-দুয়ার ছেড়ে দূর-দূরান্তের রাজ্যে পরিযায়ী হতে হচ্ছে। ভেবে দেখেবেন না?
৯) অবদমিত আদিবাসীদের জল, জঙ্গল, জমিন ছিনিয়ে নেওয়া উন্নয়নে এদেশের উপকারী ও মধ্যসত্বা ভোগী কারা?
১০) বিস্তীর্ণ ছোটনাগপুর / বৃহত্তর ঝাড়খন্ড জুড়ে এরা (উপকারী ও মধ্যস্বত্ব ভোগী) কোন কোন জাতিসত্ত্বার অর্ন্তগত?
১১) বৃহত্তর ঝড়খন্ডের অর্থনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তি কাদের? কাদের অর্থনৈতিক কর্তৃত্বে ভূমি সন্তানরা বিস্থাপিত ও পরিযায়ী হতে বাধ্য হয়েছে /হচ্ছে?
১২) ধারাবাহিক ভাবে এখানকার মানুষের শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে বেহাল দশা কেন?
সংবিধান সিডিউল তালিকাভুক্ত আদিবাসীদের জল, জঙ্গল, জমিনের অধিকার দিয়েছে (কুড়মীরা না হয় বঞ্চিত)। কিন্তু সাংবিধানিক ভাবে লিখিত মালিক হয়েও জল-জঙ্গল-জমিনের অর্থনীতি থেকে আমরা লিস্টেড আদিবাসীরা বঞ্চিত। কেন? কুড়মিদের জন্য কি, ভেবে দেখবেন না? বৃহত্তর ঝাড়খণ্ড জুড়ে কম বেশী একই পরিস্থিতি। কুড়মিরা নিজেদের অধিকার ফিরে পেতে, আগামী প্রজন্মের জন্য মাটি বাঁচানোর লড়াই লড়ছে। আমরা আদিবাসীরা সেই লড়াইয়ের সহযোগী হব নাকি অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক বিরোধিতার মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখব? ৫-৬ % সংরক্ষণ এবং কুড়মি বিরোধিতার মধ্যে আমাদের ‘জল-জঙ্গল-জমিনের’ প্রতি অধিকার এবং অস্তিত্ব নিরাপদ থাকবে কি?
যদি আমরা মনে করি যে কুড়মিদের দাবি এবং প্রাপ্তির কারণে আমরা অসুরক্ষিত বা বঞ্চিত হব, তাহলে অবশ্যই সাংবিধানিক ভাবে বিরোধিতা ও মতামত উপস্থাপন করব। আমাদের সমাজ নেতৃত্ব কুড়মিদের সমাজ নেতৃত্বের সাথেও কথা বলতে পারে। কিন্তু প্রত্যেক ‘প্রতিবাদ-সংবাদ’ ন্যায়-যুক্তি সঙ্গত ও বিজ্ঞান সম্মত হোক। মাটির লড়াই, ঘরের লড়াইতে, দিকু শক্তির বিভিন্ন রাজনৈতিক পার্টিকে ডেকে আনার ভুল করবেন না। নচেৎ হাজার হাজার বছর ধরে পূর্বপুরুষদের একসঙ্গে ও শান্তিপূর্ণভাবে থাকার পরম্পরায় দাগ লেগে যাবে। মাঝি মাহাতো ভাই-ভাই স্লোগান ঝাড়খণ্ড আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছিল কিন্তু কায়েমি শক্তির কুচক্রে লিস্টেড ট্রাইব ও মাহাতোদের মধ্যে যে উত্তেজনা তৈরী হচ্ছে তাতে করে দুর্বল হচ্ছে ঝাড়খণ্ডীদের মৌলিক অধিকারের লড়াই। মণিপুরের ঘটনা থেকে ঝাড়খণ্ড-ঝাড়খন্ডী শুভাকাঙ্খীদের শিক্ষা নিতে হবে।
আমাদের দেশে কুড়মি সহ সেই সমস্ত আদিবাসী, যাদের সংবিধানে এখনও পর্যন্ত সিডিউল করা হয় নি বা বাদ দেওয়া হয়েছে, তাদের অবস্থাও ভারি মাত্রায় সংকট জনক। সঙ্কট থেকে বাঁচতে দিকুদের চিহ্নিত করা, দূরত্ব বজায় রাখা, সেই সঙ্গে অস্তিত্বের জন্য লড়াই করা চালিয়ে যাওয়া। চিরাচরিত ভাবে এটিই আমাদের পূর্বপুরুষদের দেখানো সংগ্রামের রাস্তা। অথচ দু’দশ পয়সার সামান্য ব্যক্তি স্বার্থে আজ আমরা উচ্চবর্ণ, অ-আদিবাসীদের ফাঁদেই নাচছি। এইভাবে দিকু শক্তির ‘চাপলুসি আর জু হুজুরি’ করে আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের আগামী প্রজন্ম বাঁচবে তো? কাস্টমারি অর্থনীতি দ্বারা পরিচালিত সমাজ ব্যবস্থা আর শ্রেণী বিভাজিত অর্থনীতি দ্বারা পরিচালিত সমাজ ব্যবস্থা এক না। ১৯৫০ পরবর্তী সাংবিধানিক পরিস্থিতি আমাদের জন্য মোটেই অনুকূল নয়।
প্রগতিশীল, বুদ্ধিজীবী অংশের নীরবতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন এবং আন্দোলনের সহায়ক শক্তি
আমাদের দেশের তথাকথিত বিপ্লবী ও প্রগতিশীল মানুষেরা সময়ে সময়ে আন্তর্জাতিক (নেপাল, বাংলাদেশ, প্যালেস্তাইন, ফ্রান্স ইত্যাদি) পরিস্থিতি নিয়ে সদা ব্যস্ত। অথচ জাতীয়- আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়ে ইনাদের সেরকম মাথা ব্যথা নেই, সময়ও নেই। প্যালেস্তাইনের জাতি মুক্তির লড়াইয়ের জন্য কান্নাকাটিতে দেশে বন্যা হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি। অথচ দেশের মধ্যে কুড়মি জনজাতিকে বিগত ৭৫ বছর ধরে রাষ্ট্র গা জোয়ারি করে তাদের পরিচয় হনন করে রেখেছে, সেই দিকে উনাদের বিন্দুমাত্র নজর নেই। আসলে দূর থেকে ব্যালকনিতে বসে লড়াই দেখার মজাটাই আলাদা। আঞ্চলিক সমস্যা নিয়ে কথা বললে শুধু বাতলামি করেই নিস্তার পাওয়া যায় না, দায়িত্বও নিতে হয়। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়াই কুড়মিরা তাদের ছিনিয়ে নেওয়া পরিচয় ফিরে পাওয়ার মরণপন লড়াই লড়ছে। জাতীয়-আন্তর্জাতিক কায়েমি শক্তি, রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের সহযোগী দালাল নেতা ও বিভিন্ন পর্যায়ের সামন্ত শক্তি তাদের অধিকার, অস্তিত্বকে বিলীন করে জমি ও জমির নীচে থাকা খনিজ সম্পদ লুঠতে মরিয়া। এই লড়াইতে ‘শ্রম দাসত্ব’ এবং ‘অর্থনৈতিক- রাজনৈতিক’ স্বাধীনতা পেতে চাওয়া প্রত্যেকেই আমাদের সহযোগী ও বন্ধু শক্তি। জাতিমুক্তি ও শ্রম দাসত্ব থেকে মুক্তির আন্দোলন পরস্পরের পরিপূরক। কুড়মিদের আন্দোলনকে যারা বিরোধিতা করছে বা করবে, হয় তারা ক্ষুদ্র ব্যক্তি স্বার্থে কায়েমি শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে , না হয় তারা বিশুদ্ধ মূর্খ।
রেল অবরোধ এবং পুলিশি নিপীড়ন
কুড়মি জনজাতির মানুষজন তাদের ছিনিয়ে নেওয়া পরিচয় ফিরে পেতে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের ছত্রছায়ায় দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় কুম্ভকর্ণ নিদ্রায় থাকা ‘রাজ্য-কেন্দ্র’ সরকারের ঘুম ভাঙ্গাতে আদিবাসী কুড়মি সমাজ এবং কুড়মিদের অন্যান্য সামাজিক সংগঠন গত শণিবার (২০/০৯/২০২৫) বিস্তীর্ন ঝাড়খন্ড জুড়ে রেল টেকার ডাক দেয়। উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ডে শান্তিপূর্ণ ভাবে রেল টেকা আন্দোলন সংগঠিত হলেও জঙ্গল মহলের চার জেলার চেহারা ছিল অন্যরকম। আন্দোলনের ধার্য্য দিনের আগের থেকেই গ্রামে গ্রামে পিকেটিং, পুলিশি টহল, অত্যাচার, নেতাদের আটক এবং গ্রামবাসীদের ধমক চমক দেওয়া শুরু হয়। কেন? রাজ্য প্রশাসনের চোখে জঙ্গলমহল কি রাজ্যের উপনিবেশ? এবং সেখানকার ভূমি সন্তানরা কি রাজ্যের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক? অবরোধ, আন্দোলন থেকে উঠে আসা নেত্রী, উনার অতীতের রাজনৈতিক সংগ্রামের কথা কি ভুলে গিয়েছেন? নাকি উনার জন্য এক সংবিধান আর রাজ্যবাসীর (বিশেষ করে কুড়মিদের) অবস্থা ছাগলের তৃ্তীয় সন্তানদের মতো? নাকি বর্ণবাদী, আধিপত্যবাদী মানসিকতা নিয়ে কুড়মিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে দমিয়ে রাখার চেষ্টা?
অতীতে রাজ্যের উচ্চবর্ণের মানুষদের ‘নিম্নবর্ণ-মুসলিমদের’ প্রতি ঘৃনা এবং ‘বর্ণবাদী -সাম্প্রদায়িক’ দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়েই ব্রিটিশরা বাংলা বিভাজন করতে সক্ষম হয়েছিল। রাজ্যের বাঙালি কেন্দ্রিক (বিশেষ ভাবে উচ্চবর্ণ এবং উচ্চবিত্ত) শাসন ব্যবস্থায় রাজ্যের অন্যান্য জনজাতিদের প্রতি হীনদৃষ্টি, সেই বিভাজনের আগুনে ঘি ঢালছে না তো? কুড়মি জনজাতি বিগত ৭৫ বছরের সাংবিধানিক বঞ্চনায় জর্জরিত, সেখানে রাজ্য সরকারের সহানুভূতিশীল হওয়া তো দূরের কথা উল্টে ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ মারছে। যত দিন যাচ্ছে কুড়মিদের আত্মপরিচয় ছিনিয়ে নেওয়া এবং সি আর আই রিপোর্টে কমেন্টস এবং জাস্টফিকেশন কেন আটকে রাখা হয়েছে তা জলের মতই পরিষ্কার হচ্ছে।
ঝাড়খণ্ডী এবং কুড়মি জনজাতির মানুষদের আশু কর্তব্য
লড়াই দীর্ঘ মেয়াদি ও কঠিন। তথ্য, তত্ত্বে সমৃদ্ধি ও দৃঢ়তার সঙ্গে লড়াই করতে না পারলে রাষ্ট্রের ‘আমলা-হামলা- মামলার’ কানা গলিতে ঘুরতে ঘুরতেই জীবন-জীবিকা শেষ হয়ে যাবে। একই ভাবে ঝাড়খন্ডীদের জাতিমুক্তি, জাতি বিকাশের লড়াইও থমকে যাবে। তাই দিকু শক্তির ফাঁদে পা নয় এবং ষড়যন্ত্রে তাদের সহযোগী না হয়ে ‘দুনিয়ার অবদমিতরা’ এক হয়ে ‘মানব মুক্তি’ ও ‘বাস্তুতন্ত্র বাঁচানোর’ সংগ্রামে সামিল হোন। হাতে হাত মেলান। সংগ্রাম, অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার, সংগ্রাম আগামী প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখার। বৃহত্তর ঝাড়খন্ডের গঠন এবং বৃহত্তর ঝাড়খন্ডের অর্থনীতিতে ঝাড়খন্ডীদের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ঝাড়খন্ডীদের মৌলিক সমস্যা গুলির সমাধান সম্ভব নয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আদিবাসী সমুদায়, জাতি হিসেবে মুক্ত না হয়েও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে যদি সেই দেশের সংবিধান তাদেরকে বিশেষ অধিকার ও স্বায়ত্বতা দেয়। উন্নত দেশ (আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যন্ড ইত্যাদি) গুলিতে যদিও বা কিছু অধিকার দিয়ে থকে বিকশিত (ভারত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিন আফ্রিকা, ব্রাজিল ইত্যাদি) এবং অনুন্নত দেশ (বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, মায়ানমার সহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ) গুলিতে সেটুকুও নেই। দিন দিন যে সামান্য সাংবিধানিক অধিকার দিয়েছে তাও ষড়যন্ত্র করে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। সমস্ত পলিসি পূঁজিপতি, শিল্পপতি কেন্দ্রিক।
তাই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কুড়মি জনজাতির সাথীদের প্রাথমিক পর্যায়ে পরিচয় ফিরে পাওয়া, দ্বিতীয় পর্যায়ে ‘আঞ্চলিকতা ও সংস্কৃতিকে’ প্রাধান্য দিয়ে অন্যান্যদেরকে সঙ্গে নিয়ে জাতি (ঝাড়খন্ডী) হিসেবে পূর্ণাঙ্গ বিকশিত হওয়া এবং পরবর্তী পর্যায়ে এগিয়ে থাকা অন্যান্য জাতি গুলির পর্যায়ে বিকশিত হওয়াই আমাদের বিকল্প হওয়া উচিৎ বলে মনে করি।
আদিবাসীদের স্বায়ত্বতা হননে অপসংস্কৃতির আমদানি এবং বিকশিত জাতিসত্তা গুলির আগ্রাসন
সংস্কৃতিকে শত চেষ্টা করেও বাঁচান যায় না, যদি না আমরা আমাদের অর্থনীতিকে বাঁচাতে পারি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সমস্যার সমাধান জাতিমুক্তি ও সর্বহারা মুক্তি বা সামগ্রিকভাবে মানবমুক্তি ছাড়া আদৌ সম্ভব কি?

পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বর্তমান ব্যবস্থায় বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও আঞ্চলিক ধাঁচাকে সামনে রেখে বিকশিত জাতিগুলি অর্ধ-বিকশিত, অবদমিত, ক্ল্যান বা গোষ্ঠী গুলির উপর আগ্রাসন চালাচ্ছে এবং সেই শৃঙ্খলে অর্ধ-বিকশিত জাতিগুলি আবার অবদমিতদের উপর আগ্রাসন চালাচ্ছে। নারী, পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সৎ ভাবে শারীরিক, মানসিক শ্রমে খেটে খাওয়া মানুষ, যাদের শ্রমে এই পৃথিবী গতিশীল, উৎপাদন ব্যবস্থা ও অর্থনীতি বেঁচে রয়েছে, উৎপাদনে কৃতিত্ব যাদের ষোলো আনা তাঁদের প্রাপ্তির ভাঁড়ার অতি সামান্য বা শূন্য। এই বিশ্বের সমস্ত ধরনের ধন-সম্পদ লুটছে উন্নত জাতি রাষ্ট্রগুলির (developed country) ধন কুবেররা এবং সাহায্য কারী উন্নয়নশীল (developing country) ও অনুন্নত (underdeveloped country) রাষ্ট্রগুলির দালাল শিল্পপতি, দালাল ব্যবসায়ীরা। এই দালালরা তাদের তাবেদার নেতাদের সামান্য কিছু উচ্ছিষ্ট দিয়ে সেই সব দেশের সম্পদ সৃষ্টিকারী জনগণকে পদদলিত করে রেখে উৎপাদনের উদ্বৃত্ত শোষণ করে যাচ্ছে।
বিকশিত ও অর্ধবিকশিত জাতিগুলির অর্থনৈতিক আগ্রসনের ফলে আমাদের দেশের অবদমিত জাতিগুলির মৌলিক সংস্কৃতি গুলি চাপিয়ে দেওয়া ‘অপসংস্কৃতি (ডিজে কালচার, অশ্লীল নৃত্য, যৌনতা সর্বস্ব সঙ্গীত, শিল্পকলা, নৃত্য ইত্যাদি) ও আগ্রাসনের’ (ভগবান বিরসা, টুসু দেবী, ব্রাহ্মণ কর্তৃক করম পূজা ইত্যাদি) শিকার হচ্ছে।
বিশ্বের বিকশিত জাতিগুলি (ইংরেজ, জাপানিজ, সুইডিশ, ড্যানিস্, ফ্রেঞ্চ, জার্মান ইত্যাদি) কি সংস্কৃতি বাঁচাও, ভাষা বাঁচাও আন্দোলন করে থাকে? নাকি তুলনামূলকভাবে সম্পদশালী হিন্দিভাষী মাড়োয়ারি ও গুজরাটিরা হিন্দী বাঁচাও বলে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে? তামিল, তেলেগু, বাঙালি, মারাঠিরা মিথ্যে ও আপেক্ষিক অহমিকায় বাঁচছে অবদমিতদের উপর আধিপত্য ফলিয়ে। এরাও বিকশিত এবং তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ ও অর্ধ-বিকশিত জাতিগুলি দ্বারা হিন্দি আধিপত্যের শিকার। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানরা মাতৃভাষা না শিখে চাকরি পাওয়ার জন্য ইংরেজি আগে শিখছে। মারাঠি, তামিল, বাঙালি ইত্যাদি অর্ধ বিকশিত জাতিসত্তা গুলিকেও মাঝে মধ্যে ভাষা-সংস্কৃতি কেন্দ্রিক আন্দোলন ও আগ্রসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলনে দেখতে পাওয়া যায়।
আমাদেরকে এমন এক সংস্কৃতিতে সিক্ত করানো হয়েছে যেখানে প্রতিবেশীদের অভাব অনটনে খুশি হয় অন্য প্রতিবেশী। প্রতিবেশীর অর্থনৈতিক সাফল্য ও সমৃদ্ধিতে অখুশি হয় অন্য প্রতিবেশী। দেখি না যে বিশ্বের ২০ শতাংশ মানুষের কাছে বিশ্বের ৮০ শতাংশ সম্পদ কুক্ষিগত এবং ৮০ শতাংশ মানুষ মাত্র ২০ শতাংশ সম্পদ নিয়ে কষ্টকর জীবন অতিবাহিত করছে। একদিকে অর্থের মোচ্ছব, অন্যদিকে সামান্য সম্পদে ‘অভাব, অনটনের’ জীবন। বর্তমান সময়ে সব কিছুই আন্তর্জাতিক। তবে ব্যক্তি বিশেষের আঞ্চলিক, জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক হওয়া তার মালিকানাধীন সম্পদের সমানুপাতিক হারে। আমেরিকা, ইউরোপ, রাশিয়া, চীন, জাপানের পণ্য এদেশে বিক্রি হচ্ছে। মুনাফাও চলে যাচ্ছে সেইসব উন্নত দেশে। ভারত কি বাণিজ্যিক ভাবে সমতা রক্ষা করতে সক্ষম নাকি অসম বাণিজ্যে নিজের দেশের সম্পদ হারাচ্ছে ক্রমাগত? নিরবচ্ছিন্ন শোষণকে চালিয়ে যেতেই জাতিসত্তার উপর আগ্রাসন ও অবদমন চলে। যে আগ্রসন-রথের দুই চাকা ‘ভাষা ও সংস্কৃতি’। ভাষা, সংস্কৃতির দখল নিলে মন, মস্তিস্ক, বাজারের দখল নেওয়া সহজ হয়ে যায়। মোটের উপর উন্নত দেশগুলির বড়ো বড়ো কর্পোরেট ও তাঁদের দালাল শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, রাষ্ট্র নেতাদের স্বার্থেই ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসন।
পরিশ্রম বা কাজে-কর্মের প্রতি অনীহা বা পরজীবী সংস্কৃতি ছোটনাগপুরবাসীদের কোন সময়েই ছিল না। বরং রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত চাকরবৃত্তি ও চাকুরিতে ছিল অনীহা। কিন্তু অর্থনৈতিক আগ্রাসনের ফলে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে, তাতে করে ছেলে-মেয়েরা দু-দশ পয়সার চাকুরির জন্য আজ লালায়িত। ছেলেরা ভিন দেশে পাড়ি দিচ্ছে চাকর বৃত্তি করতে, মুনিশ খাটতে। গাঁ-ঘরে বয়স্ক মানুষরা ছাড়া কেউ নেই। কে করবে সংস্কৃতি চৰ্চা? কারা বাঁচাবে সংস্কৃতি? তাই নিজ মাটিতে নিজের শাসন প্রয়োজন, কোন ভিনদেশী বা ভিনভাষীর আধিপত্য নয়। সেই লক্ষ্যে জঙ্গল মহল সহ উড়িষ্যার অংশকে নিয়ে গ্রেটার ঝাড়খন্ডে অন্তর্ভুক্তি আবশ্যক। সেই লক্ষ্যে আন্দোলন চালিয়ে যেতে এবং আন্দোলনকে মজবুতি দিতে কুড়মিদের ছিনিয়ে নেওয়া আদিবাসী সত্ত্বা ফিরে পাওয়া জরুরী।
উপসংহার
জাগতিক যা কিছু ঘটনা তার সবকিছুর পেছনেই রয়েছে বৈজ্ঞানিক কার্য-কারণ সম্পর্ক। কোন কিছুই অলৌকিক, ঐশ্বরিক বা আকস্মিক ঘটনা নয়। এবং যেসব ঘটনার এখনও ব্যাখ্যা হয়নি বা সীমিত মানুষের মধ্যে জটিল তত্ত্ব রূপে রয়েছে তারও সহজ রূপ জন-মানসে আসবে অতীতের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দ্বারা ঘটনার ব্যাখ্যা ও আবিষ্কারের মতোই। কয়েক’শ বছর আগে পর্যন্ত যে মহাকাশ বিজ্ঞান ছিল কৌতূহলের বিষয়, জন-মানসে বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত ছিল, সেই মহাকাশ বিজ্ঞানের সহজ সরল ব্যাখ্যাতে আজ কম-বেশি প্রত্যেকেই অবগত। সাংস্কৃতিক, ভাষিক, ইতিহাস থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্ত আগ্রাসনের পিছনে বিশেষ কারণ নিহিত রয়েছে। আমরা বুঝতে পারিনা বা আমাদের জানতে দেওয়া হয় না। সমস্যার গোড়ায় পৌঁছতে না পারলে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
একইভাবে সামাজিক ব্যাধি ও সামাজিক সমস্যাগুলির নিদান খুঁজতে আমাদের অর্থনীতি, দর্শন, রাজনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চৰ্চা করতেই হবে। কুইনাইন যত তেতোই হোক, রোগ প্রতিরোধে কুইনাইন সেবন আবশ্যক। শত ব্যস্ততার মাঝেও আমরা নখ, চুল, ত্বক, জামা-কাপড় সব কিছুরই পরিচর্যা করি। সেই একই রকম গুরুত্ব দিয়ে সমাজের পরিচর্যা নিয়ে আমরা ভাবি কি? পরিচৰ্যাহীন ত্বক, নখ ও সমগ্র শরীরের যে অবস্থা হয়, সমাজেরও সেই একই অবস্থা। আগামী প্রজন্মের জন্য, বৃহৎ ঝাড়খন্ডের (ঝাড়খন্ডীদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দাসত্ব থেকে মুক্তি) জন্য শহীদ সিধু-কানু, বীরসা মুন্ডা, তিলকা মাঝি, রঘুনাথ মাহাতো, নির্মল মাহাতদের বলিদান ব্যর্থ যাবে কি? শহীদ সংগ্রামীদের দেখানো পথে জল, জঙ্গল, জমিন ও অস্তিত্বের লড়াই জারি থাকুক।
উলগুলান হোক কুড়মি সহ অবশিষ্ট প্রত্যেকের আদিবাসী পরিচয় ফিরে পাওয়ার জন্য। উলগুলান হোক জল-জঙ্গল-জমিন ও বাস্তুওতন্ত্র বাঁচাতে। উলগুলান হোক শ্রম দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে।
জোহার।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
