বামপন্থিদের সামনে চ্যালেঞ্জঃ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এবং ভারতে
কোবাড গান্ধী (ভাষান্তরঃ বহ্নিহোত্রী হাজরা
কাউন্টার এরা (২০২৩)
৪৮ পাতা
বিনিময় মূল্য ৪০/-
‘সংকট’ এক বহুচর্চিত শব্দ, কয়েকবছর অন্তর বারবার ঘুরে ফিরে আসে।তার সমাধানে সেই প্রচলিত ক্যাটেগরি গুলি -objective situation -subjective preparation -programme-strategy-tactics সংক্রান্ত বিতর্কের আবর্তেই ঘুরপাক খায় আমাদের বামপন্থী আন্দোলন। আজ আমাদের সংকটের চরিত্র কিন্তু গুণগত ভাবে আগের চাইতে পৃথক। আজকের সংকটের চরিত্র তাত্ত্বিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক। এটা উপলব্ধি করতে না পারলে নতুন কোনো ভাবনা সম্ভব নয়। তাছাড়া মার্কসবাদেরও কোনো একমাত্রিক চেহারা মেনে নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে।এর জন্য কিন্তু, অনেকে যেমন মনে করেন, শুধুমাত্র সংসদীয় এবং সরকারের আসীন মার্কসবাদীরা নয় সমস্ত রকম পার্টিগত মার্কসবাদ-ই এই আওতায় পড়ে যায়।
‘আমাদের সমস্যা শুধু আমাদের রাজনৈতিক প্র্যাক্টিস-আমাদের চর্যার নয়-আমাদের সমস্যা আমাদের চিন্তার ধরণ-ধারণে … আমাদের চিন্তনবিধিতে। দিন বদলাতে হলে তাই বদলাতে হবে এই মনস্কতা, এই চিন্তাপ্রণালী’ (‘অপর’, ২০০৪)। মূলত এই বিষয়বস্তু কেন্দ্র করেই কোবাড গান্ধী তাঁর আলোচনার বিস্তার ঘটিয়েছেন ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২ বিজয়ওড়াতে সিপি আই আয়োজিত সেমিনারে উপস্থাপিত একটি বক্তৃতার বঙ্গানুবাদ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এত গভীর সংকট এর আগে দেখা দেয়নি এটা কোবাড আগাগোড়াই বিশ্লেষণ করে দেখানোর পর পর নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন – “এই সংকট সত্ত্বেও, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে কখনও এতটা দুর্বল হয়ে পড়েনি। আজ এরকম অবস্থা হল কেন? দুর্বলতা শুধু সাংগাঠনিক ভাবে নয় আদর্শগত ভাবেও। …কেন এমন হল? (পৃষ্ঠা-১০) …“আজ সব কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রে তা আইনি হোক বা আইনের আওতায় বাইরে থাকা পার্টি হোক-রাজনৈতিক ভাবে চরম দৈন্য চোখে পড়ছে। এই সংকট যেমন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তেমনি ভারতেও রয়েছে। এবং এটি শুধুমাত্র সাংগাঠনিক সঙ্কট নয়, যেখানে তারা ইতিমধ্যে প্রবল ভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। বরং সংকট আরও গভীরে -বিশেষ করে আদর্শের ক্ষেত্রে। তারা তাদের নিজেদের স্থবিরতায় আচ্ছন্ন এবং শূন্যস্থান পূরণের জন্য নতুন এবং সৃজনশীল কিছু বিবেচনা করতে অক্ষম।”(পৃষ্ঠা-১২)।
এই পটভূমি মাথায় রেখেই আলোচিত পুস্তকখানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান অংশবিশেষ -“কমিউনিজমের দার্শনিক সমস্যা” এবং কমিউনিস্টদের সামনে এই সময় প্রধান কাজ”। এই দুটি অংশ পাঠক এবং সমালোচকদের কাছে বিশেষ মনোযোগের দাবী রাখে। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি হলো ভারতবর্ষের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে ব্রাহ্মণ্যবাদ-জাতপাত বিরোধী আন্দোলনের ঐতিহ্য ও ইতিহাস।যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত রয়েছে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদ ও পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সংগ্রাম চালানো। দ্বিতীয় যে বিরুদ্ধে বিষয়টিও সর্বাধিক গুরুত্ব নিয়ে আলোচিত হয়েছে-সেগুলি নতুনভাবে স্বদেশী অর্থনীতির বিকাশের সূচনা করা -দেশজ সামগ্রী উৎপাদন ও ক্রয় করা ও গ্রামীণ অর্থনৈতিক উদ্যোগকে প্রশস্ত ও সম্প্রসারিত করা-ভারত থেকে সম্পদ নিষ্কাশনের ভয়াবহ রূপের চেহারা উন্মোচিত করা-এবং নির্দিষ্ট ভাবে সমাধান কল্পে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিকাশ-আঞ্চলিক ভাষার বিকাশ সাধন ইত্যাদি বিষয়সমূহ।
যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা প্রদানের ক্ষেত্রে উল্লেখিত হয়েছে “আনন্দপুর সাহেব প্রস্তাব -যেখানে বলা হয়েছিল প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক -মুদ্রার প্রচলন এবং জগতের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থাদি গ্রহণ ইত্যাদি ছাড়া অন্য সমস্ত বিষয়গুলির ক্ষমতা রাজ্যের হাতে বহাল থাকবে।
কোবাড গান্ধীর কথায় “যখন এই দুই আন্দোলন একটি দেশপ্রেমিক এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্ল্যাটফর্মে অঙ্গাঙ্গীভাবে জুড়ে যাবে-কেউ দুটিকেই গ্রহণ করবে, কেউ একটিকে গ্রহণ করবে কিন্তু একটি রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হতে পারে।” এই পর্যন্ত পড়ে অবশ্য স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক যে আজকের ভারতবর্ষে শ্রেণিসংগ্রামের চলমান ধারার বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রতিনিয়ত স্পষ্ট হয়ে উঠছে- সংগঠিত ও অসংগঠিত বিশাল শ্রমিক শ্রেণীর নতুন নতুন বৈশিষ্ট বিকাশলাভ করে চলেছে -তার বিভিন্ন স্তর ও পেশাভিত্তিক সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে সম্ভাবনা গুলি দেখা যাচ্ছে -সেগুলি সম্পর্কে আরো কিছু নির্দিষ্ট কার্যক্রম ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্পর্কে অভিমত গুলি কি হতে পারে? অর্থাৎ সমাজ রূপান্তরের প্রশ্নে একটি পূর্ণাঙ্গ সামগ্রিক কর্মসূচি comprehensive and holistic programme প্রণয়ন করতে গেলে আরো কোন কোন অংশে দৃষ্টি দেওয়াটা প্রয়োজন রয়েছে? একটি কমিউনিস্ট পার্টি ও তার পরিচালিত গণসংগঠন এবং তারও বাইরে গিয়ে যে স্বাধীন গণসংগঠন -নাগরিক সমাজ -প্রকৃতি-পরিবেশ সুরক্ষার সংগ্রাম-দলিত-আদিবাসীদের সংগ্রাম আজকের ভারতবর্ষে কি কি নির্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহণ করেছে- সে সম্পর্কেও আমাদের স্পষ্টতর উপলব্ধি প্রয়োজন।
প্রয়োজন রয়েছে বিশেষ করে ২০১৪ সাল থেকে সামগ্রিক ভাবে ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজ ক্রমাগত যে ভারতীয় ফ্যাসিবাদীকরণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে যার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে আগামী দিনে হিন্দুরাষ্ট্র কায়েম করা-তার বিরুদ্ধে ব্যাপক ভারতীয় জনগণের এক বৃহৎ যুক্তমঞ্চ গড়ে তোলা-এবং এর জন্য আশু ও দীর্ঘমেয়াদী রণনীতি ও রণকৌশল ই বা কি হতে পারে? যে প্রশ্ন সমূহও মতামতগুলি এখানে আমরা রাখলাম সেগুলি নিয়ে আরোও বিশদে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। এখানে তার খুব বেশি অবকাশ নেই।
পুস্তিকটির শেষ অংশে দুটি পরিশিষ্ট যুক্ত হয়েছে -প্রথমটি, নামাঙ্কিত হয়েছে -গ্রেট রিসেট।২০১৬ সালেই ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এর প্রধান ক্লাউস শোয়াব তাঁর গ্রন্থ –দি ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলিউশন -এ ভবিষ্যৎ এর জন্য একটি এজেন্ডা নির্ধারণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে ২০২০ এর বই-কোভিড ১৯: দ্য স্ট্রেট রিসেট এ আরও বিশদ আকারে এই এজেন্ডা বিষয়ক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ রাখা হয়েছে।এই পরিশিষ্টটি আজকের একবিংশ শতকের পুঁজি ও পুঁজিবাদ কে বোঝার জন্য অপরিহার্য।
আরেকজন লেখক রিচার্ড ফ্লোরিডার গ্রন্থ আলোচনা করে কোবাড দেখিয়েছেন-যে এদের মতে ২০০৮-২০০৯ সালের অর্থনৈতিক মন্দাকে সংকট হিসাবে না দেখিয়ে -দেখানো হয়েছে সমগ্র অর্থনৈতিক কাঠামোকে ঢেলে সাজানোর এক সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে। সমাজকে পুনর্গঠনের এ ছবিকে কোবাড গান্ধীকে জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ এবং অ্যাল্ডাস হ্যাক্সলির ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড-এর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রবক্তা/ প্রবক্তারা কতগুলি সম্ভাবনায় ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছেন -যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, ইন্টারনেট অফ থিংস, স্বায়ত্তশাসিত যানবাহন, 3-ডি প্রিন্টিং, ন্যানো টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, পদার্থ বিদ্যা, এনার্জি স্টেরেজ এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটার এর উদীয়মান প্রযুক্তিগত ক্ষেত্র।
ক্লাউস শোয়াব গ্রেট রিসেটের তিনটি মূল উপাদান বর্ণনা করেছেন। প্রথমটি হল ‘স্টেকহোল্ডার অর্থনীতি’ দ্বিতীয় কীভাবে বেসরকারি বিনিয়োগ এবং পেনশন তহবিলের সঙ্গে বৃহৎ মাপের মহামারি ব্যয়ের কর্মসূচি যেমন সবুজ শহরে পরিকাঠামো নির্মাণ এবং তৃতীয় উপাদানটি হল জনসাধারণের কল্যাণের জন্য চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উদ্ভাবনগুলিকে কাজে লাগানো।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম -গ্রেট রিসেটের ধারণাগুলিকে তুলে ধরার জন্য বলেছে-অনুপ্রবেশকারী সরকার -সাউন্ড ওয়েভ মাইন্ড কন্ট্রোল -মাইক্রোচিপ যথাপিল-লকডাউন ব্যবস্থা গ্রহণ করা ভবিষ্যতের জন্য ডাইস্টোপিয়ান পরিকল্পনা গ্রেট রিসোর্ট -বাক স্বাধীনতা অজ্ঞতায় বদল আনা -পোশাকে ডিজিট্যিল পাসপোর্ট -শরীরের মধ্যে স্মার্টফোন স্থাপন ইত্যাদি ইত্যাদি।এর ই অনুষঙ্গে রচিত পরিশিষ্ট (২) এর ক্যাবাল অংশটি। আপাতত এইটুকুই বলা যায় যে ক্যাবাল মূলত প্রধান এ এম জির শীর্ষ বিনিয়োগকারীদের নিয়ে গঠিত একটি গোষ্ঠী যারা তাদের জনহিতৈষী এবং অন্যান্য সংস্থার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বেশিরভাগ বড় কর্পোরেট গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং কার্যত বিশ্বব্যাপী তাদের অক্টোপাসের মতো শুঁড় দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে রাখে।
কোবাড এর বক্তব্য “এখানে বেশিরভাগ ‘বাম’-এরা মহামারি বিধিনিষেধের আড়ালে ক্যাবালদের ‘স্ট্রেট রিসেট’ এজেন্ডাকে বুঝতে পারে নি। কমিউনিস্ট এবং বামেদের উপলব্ধি করতে হবে যে ক্লাউস শোয়াবের “স্ট্রেট রিসেট” আসলে কিন্তু বিলিয়নেরা ক্লাব (ক্যাবলদের নেতৃত্বে) এবং তাদের জল্লাদের জন্য প্রয়োজনীয় একটি ফ্যাসিবাদী মডেল মাত্র।”
সবশেষে এটাই বলার যে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে যদি আরোও বিভিন্ন আলোচিত এবং অনালোচিত দিক যদি আলোচনা থেকে উঠে আসে-নতুন তত্ত্ব জিজ্ঞাসা যদি উত্থাপিত হয়-তাহলেই এই পুস্তিকা সংক্রান্ত আলোচনা আরোও কার্যকরী রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। এই বিশেষ বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে বিশেষ কয়েকটি গ্রন্থ প্রতিবেদকের মনে পড়ছে যেমন-(১), Marxism and the Indian Left: From ‘interpreting’ India to ‘changing’ it, Sumanta Banerjee (Purbalok Publication, Kolkata, 2012); (২) Challenges for the Indian Left, edited by Murjaban Jal (AAKAR Books,2017); (৩) After the Revolution: Essays in Memory of Anjan Ghosh, edited by Partha Chatterjee (Orient Blackswan, 2020): (৪) Rebuilding the Left, Marta Harnecker (Zed Books, 2007) ইত্যাদি।
প্রতিবেদকের মত এই প্রাসঙ্গিক গ্রন্থগুলি আমাদের আলোচনাকে আরো ও সমৃদ্ধ ও বিকশিত করে তুলতে সাহায্য করবে।