আবু সিদ্দিক
বইঃ আপনি কি দেশদ্রোহী?
লেখকঃ পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশকঃ আর বি এন্টারপ্রাইসেস, কলকাতা
প্রথম প্রকাশঃ ২০২১
পৃষ্ঠাঃ ১৫৯
পেপারব্যাক
বিনিময়ঃ ২০০/-
ISBN: 978-81-942559-3-2
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৫৯ পাতার আপনি কি দেশদ্রোহী? বইটি ভাল লাগলো।কারণ অনেক কথা যেগুলি বলা দরকার তা তিনি রাখঢাক না করে বলেছেন।মোট ১১টি অধ্যায় আছে—আর এস এস নামক ফ্যাসিস্ট সংগঠনে আমার পনের বছর; আর এস এস ও বিজেপির সেকাল ও একাল; আমাদের মুসলমান বন্ধুরা; ফ্যাসিজম ও ঘৃণার পলিটিক্স—বিজেপি, আর এস এস, ও ট্রাম্প; কেন এই সংখ্যালঘু বিদ্বেষ; আমেরিকা নামক প্রোপাগান্ডা—মোহ ও মোহমুক্তি; আপনি কি দেশদ্রোহী? আমি কি দেশদ্রোহী?; বিজেপি আজ কেন এত জনপ্রিয়? মোদি আজ কেন এত জনপ্রিয়?; বাংলায় বিজেপি?; মানবসভ্যতার শেষ সংকট—বিশ্লেষণ ও দিগদর্শন ও ২০২১ সাল। ভারত নামে পুরনো দেশ—নতুন সঙ্কট, নতুন সংগ্রাম।মূলতঃ আর এস এস, বিজেপি, মোদি, ট্রাম্প, ফ্যাসিজম বিরোধী লেখা।সাথে স্থান পেয়েছে ভারতের মুসলমান ও আমেরিকার ইমিগ্রেন্টদের বলির পাঁঠা করার নিরন্তর খেলা। আছে গদি মিডিয়ার নির্লজ্জ চাটুকারিতা ও বহুজাতিক সংস্থার সাথে রাজশক্তির মধুচক্রের রমরমার বেহায়াপনা।আর আছে ৪৩ পাতা জুড়ে আর এস এসের সঙ্গে তাঁর ১৫ বছরের নানা অভিঞ্জতার কথা।
লেখক আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের হোয়াইট সুপ্রিমেসি বা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ আর ভারতের ব্রাহ্মণ্য সুপ্রিমেসি বা হিন্দুত্ব আধিপত্যবাদ কে এক করে দেখেছেন।শ্বেতাঙ্গরা কালো ও বাদামি মানুষদের নিম্নস্তরের লোক বলে ঘৃণা করে। ব্রাহ্মণরা ও হিন্দুত্ববাদীরা দলিত, মুসলমান, ও কমিউনিস্টদের ঘৃণা করে।আমেরিকার কে কে কে আর ভারতের নানা জানা-অজানা হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের মধ্যে হুবুহু মিল আছে।ল্যান্ড অফ ফ্রিতে বলির পাঁঠা ইমিগ্রেন্ট্ররা। আর এখানে মুসলমানরা।দু দেশেই বিশাল সংখ্যক মানুষ জেলে পচছে। বিজেপির মেন্টর আরএসএস একসময় হিটলার ও নাৎসিদের সমর্থন করেছে, গান্ধীকে হত্যা করেছে, মুচলেখা দিয়ে ব্রিটিশদের জেল থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। আর অশিক্ষিত ভাঁড়, যুদ্ধদানব, নারীবিদ্বেষী, বর্ণবিদ্বেষী ট্রাম্পের বাবা ছিল কে কে এ এর সদস্য।
লেখক আমেরিকার শ্রেণীবিন্যাস খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করেছেন।আমেরিকার প্রথম শ্রেণির নাগরিক হলো ধনী শ্বেতাঙ্গ ও ইহুদি পুরুষ—এরা গড়পড়তা প্রায় ছ’ ফুট, ছিপছিপে রোগা। এরা ভাল খায়, ভাল পড়ে, ভাল হাসে, ভাল গাড়ি চালায়, অনেকের বাড়িতে বন্দুক আছে, আর বাড়ির খুব কাছেই চার্চ বা সিনাগগ থাকে। ইচ্ছে হলেই কেউ বেড়াতে যায় ফ্লোরিডা, ফ্রান্স, বা পাহাড় বা সমুদ্রের ধারে কেনা নিজের রিসর্টে। কেউ বা যায় আবার ন্যুড কলোনিতে। দ্বিতীয় শ্রেনি? পুরুষের জায়গায় নারী বসালেই হবে।দ্বিতীয় কারণ একই কাজ করলেও মেয়েরা পুরুষের থেকে কম বেতন পায়। এছাড়া কিছু ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সও আছে। তৃতীয় শ্রেনির নাগরিক কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ যাদের অর্থ, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি আছে। এরা ইমিগ্রেন্টদের বিরোধিতা করে, যুদ্ধকে সমর্থন করে। চতুর্থ হলো কৃষ্ণাঙ্গ গরিব পুরুষ ও নারি। পুরুষরা ওবেসিটি ও ডায়াবেটিস আক্রান্ত, মেয়েরা হাঁপানিতে, আর অল্পবয়সী ছেলেরা পুলিশের গুলিতে শেষ হয়, বা প্রাইভেট ও সরকারি কয়েদখানায় সারাজীবন পচে।পৃথিবীর প্রতি চারজন বন্দির এক জনের স্থান এই সব পাওয়ার দেশের প্রাইভেট বা সরকারী কয়েদখানায়।প্রাইভেট প্রিজন আমেরিকার একটি রমরমা বিজনেস এবং এর শেয়ার স্টক মার্কেটে বিক্রি হয়।১ মিলিয়ন কালো ও অন্যান্য সংখ্যালঘুরা প্রাইভেট জেলে পচছে।সত্যি কথা বলতে কি এই বন্দিরাই আমেরিকার একশ্রেনীর মানুষের কাছে খুব লাভজনক ইনভেস্টমেন্ট।
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় পেইড মিডিয়ার কথা বলতে গিয়ে ‘জার্নালিজম অফ এক্সক্লুশন’- এর কথা বলেছেন। কী কী কাগজে বা টিভিতে স্থান পাচ্ছে, সেটাও যেমন দেখা দরকার, তেমনি কী কী থাকা উচিত ছিল, কিন্তু নেই, সেটা দেখা আরও জরুরি। বাদ দেওয়ার সাংবাদিকতা কেন? কেন খবর বাদ দেওয়া হচ্ছে? কেন বিশেষ খবর প্রথম পাতার পরিবর্তে শেষের পাতার এক কোণে লুকিয়ে আছে? এসব ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে।মিডিয়া ও রাজনৈতিক দলগুলির সাথে তার নেক্সাস সবসময় ঘৃণা ও বিদ্বেষ বিক্রি করছে।হিটলার জু-দের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের গ্যাস চেম্বারে অথবা মেশিন গানের মুখে মাস মার্ডার করে একটি মডেল আমাদের উপহার দিয়েছেন। দেশের সকল ব্যর্থতা, গ্লানি, দুর্নীতি, কলঙ্ক ও অর্থনৈতিক সমস্যার মূলে সংখ্যালঘু জুদের টার্গেট করেন। এই মডেল রুয়ান্ডায় হুটুরা টুটসিদের বিরুদ্ধে কাজে লাগান। কম্বোডিয়ায় পল পট শাসকরাও তা করেছে। শ্রীলঙ্কায় তামিলদের উপর, দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের, আর আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ানদের বিরুদ্ধে কাজে লাগান হয়। এখন আমেরিকায় বাবা মায়ের কাছ থেকে বাচ্চাদের কেড়ে নিয়ে খাঁচায় বন্দি করে রাখা বা বিভিন্ন প্রাইভেট কারাগারে লক্ষ লক্ষ কালো মানুষ বা ইমিগ্রেন্টদের বন্দি করে রাখা—আর তাদের সম্পর্কে ভুরি ভুরি মিথ্যা প্রোপাগান্ডা সর্বত্র সমানে চলছে যেমন চলছে ভারতের মুসলমানদের বিরুদ্ধে।মুসলমানদের শত্রু শ্রেনি হিসাবে দেখাতে আর এস এস ও বিজেপি অনেকাংশে সফল হয়েছে। এর পেছনে পদলেহি নীতিহীন মিডিয়ার মাহাত্ম্য আমরা সবাই জানি।
এভাবেই মিডিয়া ক্ষমতার অন্ধ ভক্ত হয়ে বিদ্বেষ চাষ করছে ও ডলার কামাচ্ছে। সাধারণ মানুষকে ভোগ ও নানারকম লোভ, লালসার তীরে বিদ্ধ করা হচ্ছে। ফলে মানুষের আগ্রহ কমছে সিরিয়াস বিষয় নিয়ে চিন্তা করা, আলোচনা-সমালোচনা করা। সবাই তাৎক্ষণিক এন্টারটেইন্মেন্ট ও ‘ফান’ চায়। ডিমান্ড থাকলে সাপ্লাই তো দিতেই হবে, তাতে সমগ্র এক্স ওয়াই জেনারেশন মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ হলে কী করা যাবে! ‘এরা অফ পোস্ট রিজন’ বা ‘এরা অফ পোস্ট ট্রুথ’ অর্থাৎ যুক্তি উত্তর যুগে বা সত্য উত্তর যুগে চিন্তার দৈন্যতা, বিশ্লেষণের দৈন্যতা নিয়ে কে মাথা ঘামায়?আর ঘুমিয়ে পড়া মানুষ ও ঘুমিয়ে থাকা জনগণ শাসকশ্রেণির কাছে আশীর্বাদ। ঞ্জান, প্রশ্ন, বিতর্ক, চ্যালেঞ্জ, বিশ্লেষণ ও বিরোধিতা তাদের কাছে অভিশাপ। ফলে যুক্তি উওর যুগের হাওয়া, সাথে উগ্র জাতীয়তাবাদের উগ্রতা ও কর্পোরেট পুঁজিকে কাজে লাগিয়ে শাসক শ্রেণির মানুষের মগজ ধোলায়ের বিজনেস বেশ রমরমা।প্রফিট বিফোর পিপল বা মানুষকে পণ্য করে এক শতাংশ সীমাহীন অর্থের অধিকারীদের কাছে নিরানব্বই শতাংশের দাসত্ব আজ বেআব্রু।
আমরা প্রত্যেকেই স্থিরভাবে বিশ্বাস করি আমেরিকা হল সব পাওয়ার এক মহান দেশ বা মর্তের স্বর্গ। ছেলেমেয়েদের, বাড়ির বউদের পরামর্শ দিই, ‘আমেরিকা যাও, ডলার কামাও, ফুর্তি মারো, বাড়ি গাড়ি কেনো। এ পোড়ার দেশে কিছু হবে না।’ অন্যথা বলার সৎ সাহস আমাদের কাহারও নেই। তবুও জেনে রাখা ভালো কিছু কথা।অস্ত্রের ব্যবসাই আমেরিকার নাম্বার ওয়ান ব্যবসা। আর এই ব্যবসাই আমেরিকার বিদেশনীতির ধারক ও বাহক।বহু যুদ্ধ হচ্ছে যেখানে যুযুধান দুই দেশই মার্কিনি সমরাস্ত্রের উপর নির্ভরশীল। অনেকক্ষেত্রেই এরা ঐতিহাসিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে একই ভূখণ্ড ছিল। যেমন, ভারত ও পাকিস্থান। যেমন, ইরান, ইরাক, সিরিয়া। যেমন, উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া। ইংল্যান্ড-আমেরিকা চায় যে পৃথিবীর এ প্রান্তে ও প্রান্তে হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, যুদ্ধ যাতে চিরকালীন বজায় থাকে।আসলে আমরা হলাম ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের দাবার ঘুঁটি।
আমেরিকার দু’নম্বর ব্যবসা হল ড্রাগস। কোকেন, এলএসডি, মেট এবং আরও ভয়ঙ্কর সব মাদক। প্রধানত কলম্বিয়া ও মেক্সিকো, এবং কিছুটা আফ্রিকা থেকে ড্রাগস চোরাপথে আমেরিকায় আসে। তার সঙ্গে সঙ্গে আসে হিংস্র মাফিয়া, আর অসংখ্য আগ্নেয়াস্ত্র। তিন নম্বর হল সেক্স। সেক্স ট্রাফিকিং করে লক্ষ লক্ষ অল্পবয়েসি মেয়েদের ও ছেলেদের ক্রীতদাসের মতো বন্দি করে রাখা হয়। এখানে প্রস্টিটিউশন অবৈধ। সোনাগাছির মতো সেক্স ওয়ার্কারদের ইউনিয়ন এখানে কেউ কল্পনাই করতে পারে না। কিন্তু এই গোপনতার আড়ালে চলছে অবিশ্বাস্য এক লাভজনক ব্যবসা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে পর্ণ ইন্ডাস্ট্রি। সাথে আছে টাইমস স্কোয়ার এলাকার পীপ শো, বা ন্যুড ড্যান্স বার। কিন্তু এসব এখন অচল পয়সা। ইন্টারনেট পর্ণ আমেরিকাকে গ্রাস করেছে। এবং এখন তার সবচেয়ে বড় কনজিউমার হল সৌদি আরব ও ভারত।
আজকের ভারতের শাসকশ্রেণীর হাতিয়ার ধর্ম-ব্যবসা, রামমন্দির, ও সিউডো সীমান্ত সংঘর্ষ, আর মুসলমান বিদ্বেষ।একদিকে পুজো-যাগযজ্ঞ-তাবিজ, মাদুলি, বলি-মানত আর একদিকে মদ-ড্রাগস-সেক্স-পর্ণ-রাজনৈতিক পেশিপ্রদর্শন।ধর্মবাদ আর ভোগবাদ, বিলাসিতা, বৈভব, আর লোভ, ‘হ্যাভ ফান’!রেসিজম, ফ্যানাটিসিজম, ভায়োলেন্স, সংকীর্ণতাবাদ, হিন্দুত্ববাদ, হোয়াইট সুপ্রিমেসি, নারীবিদ্বেষ, মুসলমান বিদ্বেষ, ইমিগ্রেন্ট বা ইন্ডিজেনাসদের উৎখাত এখন আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ভারত বা ব্রাজিলের শাসকদের মুখ্য এজেন্ডা।তাদের সাথে আছে পুঁজিবাদীদের অফুরন্ত আশীর্বাদ।
আমেরিকায় বাকস্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে ঠিকই। কেউ তা কেড়ে নেয় নি। কিন্তু যেটি হয়েছে সেটি হল বিতর্কের পরিসরটিকে সংকীর্ণ করা। আর সেই সংকীর্ণ পরিসরে বিশেষ বিশেষ বিতর্ককে ভীষণ জীবন্ত করে তোলা।আর ই্যসুগুলি শাসকশ্রেণীর মতো করেই আলোচিত হবে।আমেরিকার প্রেসিডিনশিয়াল ডিবেট কখনও যুদ্ধ আগ্রাসন, দারিদ্র্য, চরম বৈষম্য, পুলিশি হত্যা, প্রাইভেট প্রিজন, অথবা মনস্যান্টো। এক্সন, গোল্ডম্যান স্যাক্স বা কোকা কোলা কোম্পানির বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ ভায়োলেন্সের কথা উল্লেখ করে না। বহু ভারতীয় বিজেপিকে দুর্নীতিমুক্ত পার্টি বলে মনে করেন, অথচ তারা বিজয় মালিয়া, নীরব মোদির কথা মুখে আনে না। এমএলএ এমপি কেনাতে বিজেপি সিদ্ধহস্ত। ভোটের আগে বিজেপির লক্ষ কোটি কালো টাকার খেলা এমনভাবে সুকৌশলে দালাল মিডিয়া, হোয়াটস্যাপ, আইটি সেল আড়াল করে রেখেছে যে মানুষ বিজেপির দুর্নীতিকে দুর্নীতি বলেই মনে করছে না।ব্যাঙ্ক, রেলওয়ে থেকে ইন্স্যুরেন্স সব আম্বানি আদানিদের কাছে বেচে দেওয়াতে মানুষ উল্লসিত। মোদির থালা বাটি বাজানোতে আর মোমবাতি জ্বালানোতে অনেক বিজেপি বিরোধী, গোমূত্র-বিরোধী মানুষও করোনা আবহাওয়ায় ভয়ের হাত থেকে সাময়িকভাবে মুক্তি পেয়েছিলেন বলে মনে করেন। অন্যদিকে দেশজুড়ে অর্থনীতির ধ্বংস, কৃষক বিদ্রোহ, এবং নাগরিক স্বাধীনতা হরণ মিডিয়ার একমুখী প্রোপাগান্ডায় হারিয়ে যাচ্ছে। বিরোধিতা করলেই তাকে দেশদ্রোহী অথবা সন্ত্রাসী অথবা, আরবান নকশাল, বা টুকরে টুকরে গ্যাং বলে ছাপ দিয়ে দিলেই খেলা শেষ।
আমেরিকা চায় যুদ্ধ ও ঘৃণার মাধ্যমে পৃথিবীর সব সম্পদ দখল করতে এবং তা ওয়ান পার্সেন্টদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা করে দিতে, আর ভারত চায় তার তল্পিবাহক হয়ে ভারতের সব সম্পদ দখল করতে এবং তা ওয়ান পার্সেন্টদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা করে দিতে। তার জন্য মুসলমান বিরোধিতা, নতুন কৃষি আইন তৈরি, ইউনিয়ন বিরোধিতা, নিচু জাত উঁচু জাতের মধ্যে লড়ায়, মন্দির, মসজিদ, গরু খাওয়া, এন আর সি, সিউডো ওয়ার, সীমান্ত উত্তেজনা, ইত্যাদি দিয়ে মানুষকে ব্যস্ত রাখা। যাতে কেউ অর্থনৈতিক মন্দার কথা, পরিবেশ ধ্বংসের কথা, কর্পোরেট পুঁজির কথা, দেশকে আইএমএফ এর কাছে বিক্রির কথা মুখে না নিয়ে আসে। আর মিডিয়া তাদেরই দোসর। প্রশ্ন করলেই তার গলা টিপে ধরা হচ্ছে। ডিসেন্টারদের জন্য আছে জেল, টর্চার আর মৃত্যুর পরোয়ানা। এই সব কিছুই মার্কিন নিও-লিবারাল পুঁজিবাদের ফসল। ভারত ও বাংলাদেশ সেই বিষবৃক্ষের উৎকৃষ্টতম ক্ষেত্র। কারণ প্রায় সত্তর বছর ধরে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, ভোটের নামে চিটিংবাজি, আর ধর্ম, জাত নিয়ে সুবিধাবাদী রাজনীতি আজকের ধর্মান্ধদের রাস্তা পরিষ্কার করে দিয়েছে। আমাদের ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্থান, ফিলিপিন্স বা বর্মার মানুষদের এখন শুধু বেঁচে থাকার সংগ্রাম ছাড়া আর কিছু করার নেই। মনুষ্যেত্বর জীবনযাপন ছাড়া আর কিছু করার নেই।
গোঁড়া ক্রিশ্চিয়ানিটির প্রধানরা, শাসকদের সাহায্যে মডারেট ও লিবারাল খ্রিস্টান ও নাস্তিক ও দার্শনিক-কবি-বিঞ্জানীদের সমাজচ্যুত করে, এবং মাঝে মাঝেই হত্যা করে, ক্ষমতা দখল করেছে। তারপর সারা পৃথিবীতে দুশো তিনশো বছর ধরে ত্রাসের রাজত্ব করেছে। এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকায় ব্রিটিশ, পর্তুগি্ স্প্যানিশ, ডাচ এবং ফরাসিরা সম্পদ লুণ্ঠন করেছে, হত্যা, ধর্ষণ, লুট করে সেসব দেশকে সর্বস্বান্ত করেছে। আর ইতিহাসে আমাদের পড়ানো হয় এই লুটেরা ছিল আধুনিক সভ্যতার আলোর বাহক।এবং আমরা তা তোতাপাখির মতো দিন রাত আওড়াই। আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস আলাদা কিছু নয়। রেড ইন্ডিয়ানদের বা ইন্ডিজেনাসদের ভাগিয়ে দিয়ে সম্পদ ও ক্ষমতা দখল।একদিকে তাদের মেয়েদের ধর্ষণ আর একদিকে গির্জা প্রতিষ্ঠান করে উন্নত সভ্যতার আলো বিচ্ছুরণ।বলিহারি কম্বিনেশন! পুরনো মডেল এখন ধরণ পাল্টে শোষণের চাকাতে অতিমাত্রিক গতি যোগ করেছে মাত্র।
আমেরিকা ও ব্রিটিশ শাসকশ্রেনীর মিডিয়া, পুঁজি, ব্যবসা, শিক্ষা ব্যবস্থা, চিকিৎসা বিঞ্জান, তাদের বিনোদন ও জীবনদর্শন এখন মানবসভ্যতার একমাত্র মডেল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর একদিকে ইসলাম ও অন্যদিকে চিন এদের সামনে এখন মুখ্য বাঁধা সম্পূর্ণ বিশ্বকে গ্রাস করার পথে। একদিকে তাই হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্ট শক্তিগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে চিনকে দাবিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চলছে। আর অন্যদিকে ভারতের মুসলমানবিরোধী সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে মার্কিন মিডিয়া ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও অপপ্রচার করে চলছে। মরক্কো, টিউনিসিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, এমনকি সাদ্দাম হোসেনের ইরাকেও যে স্বাধীনতা ও সমানাধিকার নারীরা ভোগ করে এসেছেন, আসছেন, ল্যাটিন আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে মেয়েদের যে সমানাধিকার ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আছে, সম্মান আছে, তা আমাদের দেশে কখনও প্রচার করা হয় না।ইরাক ধ্বংসপ্রায়, আফগানিস্থান বিলুপ্তি হয়ে গেছে, সিরিয়ার প্রায় তিন হাজার বছরের প্রাচীন শহর মুয়াদামিয়া, হোমস, আলেপ্পো ম্যাপ থেকে আজ অবলুপ্ত। বসরায় আজ আর গোলাপ ফোটে না। ব্রাজিলের ট্রপিক্যাল রেনফরেস্ট চিরতরে অবলুপ্তির পথে।কুমেরুতে লারসেন সি আইসবার্গ শেষবারের মতো ভেঙে আলাদা হয়ে গেল। পুণ্যতোয়া গঙ্গা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত নদী। নিজে চোখে দেখা হরিদ্বারের হিন্দুরা হর কী প্যারীতে মৃত মানুষদের বালিশ-বিছানা-কম্বল ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে।আমার ছোটবেলার ভালবাসার শহর কাশী পরিবেশ দূষণে মৃতপ্রায়। সেখানে গাছের পাতার রং সবুজ নয়, ছাই-এর মতো কালো।
মুসলমানদের চারটে করে বউ থাকে আর ভুরি ভুরি সন্তানের জন্ম দেয়—এই প্রোপাগান্ডা দেশে বিদেশেরে লোকেরা খুব খায়।আমি বহুকাল থেকে মুসলমান মানুষদের দেখে আসছি—পাকিস্থান থেকে পেরু, বাংলাদেশ থেকে বলিভিয়া, আর ইরান থেকে ইন্দোনেশিয়া—কখনও কারুর চারটে বউও দেখি নি, আর দু-তিনটের বেশি সন্তান তো দেখিই নি।বরং অর্থোডক্স ইহুদিদের এই নিউ ইয়র্কেও দেখেছি, আর ইজরায়েলে গিয়ে জেরুজালেম, নাজারেথ, হাইফাতে দেখেছি—কালো হিজাব পরা ইহুদি নারীরা পাঁচটা ছটা সাতটা বাচ্চা নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আরে এক জেনারেশন আগেই আমার বাবার দিকে মায়ের দিকে আট-দশটা করে পিসি কাকা মামি মেসো এসব ছিল।
হিন্দুত্ববাদীদের গান্ধীহত্যার, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের, গুজরাট গণহত্যার, দিল্লী গণহত্যার রক্তাক্ত ইতিহাস আজ ধূসর মলিন। যে প্রজন্ম এখন প্রধানত বিঞ্জানবিরোধী, তাগা-তাবিজপন্থী, আর যেখানে শিক্ষা বিশ্লেষণ বিতর্কের জায়গা নেই, যেখানে আমেরিকার ভোগবাদ সকলকে গ্রাস করেছে, সেখানে মানুষ প্রস্তুত হয়েই আছেন মনুষ্যত্বের প্রধান ঘাতকদের রাজসিংহাসনের আসনে বসিয়ে তাদেরকে নানামাত্রায় অলংকৃত করার জন্য।তাদের কাছে দেশের দুর্দশা আবার কী জিনিস? বাংলাদেশের লোক বলে, সে-দেশে এখন আর কেউ না খেয়ে থাকে না। ভারতের লোক বলে, মোদী দেশকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। রেফ-টেপ,রায়ট-ফায়ট, ওসব দেশদ্রোহীদের চক্রান্ত।পাকিস্থানের বন্ধুদের মুখে একই কথা। সুতরাং বিন্দাস থাকুন। মল-দেবী আর মাল-দেব আপনাকে দেবেন সাহারা। ফেসবুক আর হোয়াটস্যাপের ব্লক অপশন—আপনাকে দেবে ২৪/৭ পাহারা।
আমরা ভাবছি, আমরা খুব ভাল আছি। কারণ, বাস্তব পরিস্থিতি এতই নিষ্ঠুর ও করুণ যে নিজেদের কাছে নিজেদের পিঠ চাপড়ানো ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই। কে আর সদাই মনমরা হয়ে থাকতে ভালবাসে? তাই সবাই সব মেনে নিয়েছি। হাসপাতালে-নার্সিংহোমে ডাক্তার দালালদের মারপ্যাঁচ, বিনাদোষে পুলিশি হয়রানি, অফিস-আদালতের দুর্নীতি, পাড়ার দাদাদের মাস্তানি,ক্রিকেট-জুয়া, সুশান্ত-রিয়া কেচ্ছা, ঘরে বাইরে নারী-নির্যাতন, প্রমোটাররাজ, জাতি-বিদ্বেষ, মোড়ের মাথায় নেতাদের কদর্য আস্ফালন—সব মেনে নিয়েছি। যা কিছু অশুভ সব তা নিখুঁতভাবে আত্তিকরণ করতে শিখেছি।আর এভাবেই বেঁচে আছি। আর তাতেই আনন্দ আর ধরে না রে!
আরও একটি কথা বলে রাখি যারা দিবারাত্র মুসলমানদের বা বাংলাদেশিদের গাল পাড়ছেন তারা জেনে রাখুন আগামি ঠিক এক প্রজন্মের মধ্যে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের শহরগুলিতে বাংলা ভাষা লুপ্ত হয়ে যাবে। আর রবীন্দ্রনাথ, নজরু্ জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণ, সুনীল,শক্তি, মুজতবা, লীলা, সত্যজিৎ, পরশুরাম, মানিক, তারাশঙ্কর, শরদিন্দু, শঙ্খ, নীরেন্দ্রনাথ, জয়, মহেশ্বেতা পড়ার লোকও কমে যাবে। বাংলা গান আর কেউ গাইবে না। বাংলা ভাষা, আর এই নক্ষত্রপুঞ্জ অথবা মহাসাগরের মণিমাণিক্য বেঁচে থাকবে প্রধানতঃ ওই বাংলাদেশিদের জন্যই। বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ তারাই তো দিয়েছেন।
তাই আজ দরকার বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির উত্থান। এমন একটা শক্তি যে আমাদের ভয় ও ভোটের সুযোগ নেবে না, এবং প্রতিবার ভয় দেখিয়ে তাদের মধ্যে ‘লেসার ইভিল’ বা অপেক্ষাকৃত কম শয়তানকে ভোট দিতে বাধ্য করবে না। প্রয়োজন এক শক্তিশালী ও সৎ গণআন্দোলনের,যার নেতৃত্ব দেবেন এমন নারী ও পুরুষ, যাদের নৈতিক চরিত্র, শিক্ষা ও অন্তর্দৃষ্টির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা আছে। যাদের কিনে ফেলা যাবে না বা যারা বিক্রি হতে সন্মত হবে না কোনওভাবেই, কোনওঅবস্থাতেই, কোনওদিনই।