বাঙালি মুসলমানদের জীবন ও ইতিহাস

by তৈমুর খান

বঙ্গের মুসলমান: সমাজ-পীড়নের দহনবৃত্তান্ত
আবু সিদ্দিক
গাংচিল (২০২৩)
পৃষ্ঠা ৩৬০
মূল্য ৬৫০
হার্ডকভার

নিজের কথা,নিজেদের কথা নিজের মতো করে বলা, আত্মানুসন্ধান এবং আত্মসমালোচনাও যখন আত্মোপলব্ধির প্রজ্ঞায় তুলে আনা হয়, স্বাভাবিকভাবেই তখন সেই কথার মধ্যে কপটতা থাকে না। সত্য ও অনাবিল আত্মদর্শনের মুখোমুখি দাঁড়াবার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এরকমই একটি নিরলস গবেষণালব্ধ গ্রন্থ ‘বঙ্গের মুসলমান সমাজ-পীড়নে দহন বৃত্তান্ত'(জানুয়ারি ২০২৩), লিখেছেন ইংরেজি সাহিত্যের বিশিষ্ট অধ্যাপক আবু সিদ্দিক। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে ইতিপূর্বে কোনো বই লেখা হয়েছে কিনা জানি না, এই বইটিই আমার প্রথম নজরে পড়ল। মোট ৪০ টি প্রবন্ধে বাঙালি মুসলমান সম্পর্কে যাবতীয় পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। তিনটি প্রবন্ধ লেখা হয়েছে ইংরেজিতেও। অতীত এবং বর্তমান, অর্থনীতি এবং সামাজিক, রাজনীতি এবং বঞ্চনা, ধর্ম এবং স্বাধীনতা বিষয়গুলি প্রতিটি প্রবন্ধের মধ্যেই সম্পৃক্ত হয়েছে। গ্রন্থটির তথ্য এবং বাস্তবতা সম্পর্কে কারোরই কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই। যথাযথ যুক্তি পারম্পর্য এবং অভিজ্ঞতার নিরিখে প্রতিটি বিষয়কেই তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করেছেন।

পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ প্রান্তিক বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিচয় মানুষ আজও জানে না, জানলেও সে সম্পর্কে উদাসীন। নিরপেক্ষ কোনো মিডিয়া নেই, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সম্পর্কে পড়ানোর কোনো বই নেই। তাদের মেধা, জীবনদর্শন, চেতনা, সুকুমার গুণাবলীর মূল্যায়ন করারও কোনো বিবেক নেই। দিনের পর দিন তারা অবহেলিত, শুধুমাত্র ধর্মীয় ব্রাকেটে তাদের সংখ্যালঘু করে রেখে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলি ভোটে জয়লাভ করার জন্য তাদের ফুটবল হিসেবেই ব্যবহার করে আসছে। মুসলিম জনগোষ্ঠীর ২৮% বাংলায় বসবাস করেও কী মারাত্মকভাবে উপেক্ষিত সেই বহুমাত্রিক বঞ্চনার পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা উঠে এসেছে।

প্রবন্ধগুলির নামকরণ ভীষণ আকর্ষণীয়: ভদ্রলোকের চোখে মুসলমান, বাংলার মুসলমান ও বিশ্ব মুসলমান, বাঙালি হিন্দুর চোখে বাংলার মুসলমান, বাংলার মুসলমান ও শিক্ষা, বাংলার মুসলমান ও রাজনীতি, বাংলার মুসলমান ও মিডিয়া, হিংসা, দ্বেষ ও দাঙ্গা, সাহিত্যে মুসলমানের ছবি, বাঙালি মুসলমানের উর্দু প্রীতি, বাংলার মুসলমান ও তিন তালাক, বাংলার মুসলমান ও মহরম, বাংলার মুসলমান কেমন আছে, বাংলার মুসলমানদের স্বকীয়তা, বাংলার মুসলমান ও সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি।

উল্লেখ্য বাংলার মুসলমানকে ভিন্ন ভাষাভাষি, ভিন্ন দেশের মুসলমানদের সঙ্গেও এক করে দেখা হয়।এটা যে কত বড় ভুল এবং হাস্যকর তার যথাযথ তথ্য দিয়েছেন। বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের এক বিন্দুও মিল নেই। ধর্ম এক হলেও আর সমস্ত বিষয়ই আলাদা। এমনকি লেখক এক জেলার মুসলমানদের সঙ্গে অন্য জেলার মুসলমানদেরও তফাত দেখিয়েছেন। মুসলমানদের বাঙালি না ভেবে শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে মুসলমান হিসেবে রেখে দিয়ে এদের বঞ্চনা করা হয়। সব সময়ই ‘বোরখা-তালাক-মাদ্রাসা-টুপি-দাড়ি’ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়। সাম্যবাদী গণতন্ত্র প্রেমিক মুসলিম সত্তাকে উপেক্ষা করা হয়। রাজনৈতিকভাবে প্রচার করা হয় বাংলাদেশী-সন্ত্রাসী-সিমি-গরু পাচারকারী-জাল নোটের কারবারি-বধূ নির্যাতনকারী-পোলিও টিকা না নেওয়া জিহাদী হিসাবে। মুসলমান নামেই তারা গন্ধ পায় সন্ত্রাসবাদের, পাকিস্তান প্রীতির এবং দেশদ্রোহীর। সুতরাং নির্যাতিত, পীড়িত, বঞ্চিত মুসলমানদের উন্নত সংস্কৃতির জীবনধারাকে স্বীকার করা হয় না। বাঙালি মুসলমানদের এই না বলা ব্যথার, মানবিক সত্তার এবং বাঙালি জীবনধারার সামগ্রিক ছবি পেলাম।

তবে গ্রন্থে মুসলমানদের দোষ-ত্রুটির কথাতেও লেখক রাখঢাক করেননি।বিজ্ঞান ও পাশ্চাত্য শিক্ষা থেকে দূরে থাকা, খারিজি মাদ্রাসায় পড়ে বক্তৃতা করা, ‘পরকালে সব হবে’ এসব ভেবে মূলস্রোত থেকে দূরে থাকা তাদের পিছিয়ে পড়ার কারণও। মিশনগুলি শিক্ষার কাজে এগিয়ে এলেও বর্তমানে তারা ব্যবসায় পরিণত করেছে একথাও অকপটে লিখেছেন। একজন লেখক-কবিকেও, একজন বিজ্ঞানীকেও অসাম্প্রদায়িক প্রমাণ করতে হয় এ বিষয়ে তাজউদ্দিন বিশ্বাসের উদাহরণ এনেছেন। এটি খুবই বেদনাদায়ক ও স্পর্শকাতর।

বর্তমান মিডিয়ায় মুসলমানদের সম্পর্কে মিথ্যাচার হয়, কুরবানী নিয়ে নেতিবাচক এবং মহরম নিয়ে খুশির সংবাদ প্রচার করা হয়। এটা যে কত বড় বিভ্রান্তিমূলক তা বলাই বাহুল্য। কেমন আছে বাঙালি মুসলমান, তালাকপ্রথা আইনের উপযোগিতা, বাঙালি মুসলমান-কবিদের হতাশাজনক অবস্থান এসবও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে তুলে ধরেছেন। সাচার কমিটির পর আজও পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তন হয়েছে কিনা সে বিষয়টিও নির্ণয় করেছেন।

সমগ্র বইটিতে তথ্য পরিবেশনের কারণে সাবলীল ভাষা ব্যবহারের অন্তরায় ঘটেছে যাতে সাধারণ পাঠকও মাঝে মাঝে অসুবিধায় পড়বেন। তবে সাহসী লেখা, পরিশ্রম ও নিষ্ঠার কদর দিতেই হয়।

—————————————————-

(বঙ্গের মুসলমান সমাজ-পীড়নের দহন বৃত্তান্ত: আবু সিদ্দিক, গাঙচিল, মাটির বাড়ি, ওঙ্কার পার্ক, ঘোলাবাজার, কলকাতা-৭০০১১১, প্রচ্ছদ:সন্তোষ দত্ত, মূল্য ৬৫০ টাকা।)

You may also like