বিহতজনের উপাখ্যানঃ একটি বহুমাত্রিক পাঠ

by আনওয়ারুল হক

বিহতজনের উপাখ্যান
আবু সিদ্দিক
প্রকাশকঃ রবি প্রকাশ, বাঘাযতীন, কলকাতা
প্রথম প্রকাশঃ ২০২১
পৃষ্ঠাঃ ৯৬
হার্ড কভার
বিনিময়ঃ ২০০/-
ISBN: 978-81-945846-5-0

হঠাৎ ছন্দপতন! গৃহবন্দীত্বের নিদান।করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।বাঁচতে হবে তাই তালাবন্দিই একমাত্র পথ।কিন্তু যারা খেটে খাওয়া দিনমজুর,ছোট ছোট দোকানদার ও প্রান্তিক চাষী তাদের কি হবে? কাজ না করলে যাদের অন্ন জোগান ও দিন গুজরান কঠিন হয়ে পড়ে তাদের কথা না ভেবেই ‘করোনা এক্সপ্রেস’ থামাতে তো হয়।আর এই বন্দির সুযোগে একধরনের সুযোগসন্ধানী বড়ো ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্র গুদামজাত করে রেখে বাজারে কৃত্রিম অভাব তৈরি করে আক্রা দরে বিক্রি করে, এও এক ভয় ও আতঙ্কের আবহ লক্ষ্য করেছি।



অপরিকল্পিত লকডাউন সাধারণ নিম্নবিত্ত, পরিযায়ী শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত মানুষদের জীবনে কিরূপ হাহাকার নেমে এসছিলো তা প্রত্যক্ষ করে চলেছি আজও।সত্যি বলতে আমরা অনেকেই ভুক্তভোগী।সেই দরিদ্র, বঞ্চিত, ব্যথিত ও অসহায় মানুষদের চরম দুর্দিনে দুরাবস্থার কাহিনী ও আলো-আঁধারির লড়াইয়ের নানা দিক উঠে এসছে অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় আবু সিদ্দিক স্যরের কলমে বিহতজনের উপাখ্যান নামক গল্পগ্রন্থ তে।ভালো লাগলো পড়ে।

যেমন বাবুদের বাড়িতে আয়ার কাজ করা ‘কুরমি'(গল্পের নাম) করোনার কারণে কাজ হারায়।অভাব অনটনে মাসখানেক অতিবাহিত হওয়ার পর কিছু টাকা ধার বা অগ্রিম হিসাবে চায়তে গেলে বাবুর পরিবার(মি.সেন)বিরক্ত হয়।বিনা স্যানিটাইজে ছোটলোক বাড়িতে প্রবেশ করেছে বলে একরাশ ক্ষোভ উগরে দেয়।ডেটোল-পানি নিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করতে এগিয়ে আসে।বাড়ির গিন্নির কথায়-‘ন্যাকামি না করে যা বলছি…যতসব পাগলের কারবার’। কুরমির আকুতি- ‘দুর্দিনে আপনারা মুখ ফেরালে আমি কোথায় যাবো? তিনটি পেট।বসে বসে কতদিন চলবে? চোখ ছলছল করে উঠে কুরমির’।

অতিমারীর সময়গুলোতে ‘ছিয়ারন বেওয়া’ গল্পে পুলিশের গাড়ির টহল ও লকডাউন ভাঙলে তথা বাইরে বেরোলে ছয়মাসের জেল শুনে সাধারণ মানুষ ও মুরব্বিদের বলাবলি-‘বলি ঘর কি জেলখানা, না আমরা শালা কয়েদি,চুরি তো কিছু করিনি,সারাদিন হাড়ভাংগা খাটুনি।সন্ধায় একটু খোশগল্প, একটু চায়ে চুমুক, দু’একটা বিড়ির পুঙ্গায় টান না দিলে কি করে কাল মাঠে পুড়বো?’

দিন আনা দিন খাওয়া শ্রমিক ‘মকবুল’ গল্পে দেখি মকবুল কাজ হারিয়ে অসহায় হয়ে বিরক্তির সুরে বলে ‘…বেশি তো চাইনি।দুবেলা ডালভাত। তাও জুটাতে কালাঘাম।আল্লার কী কোন বিচার আছে? যত পার গরিবকে মার।এই চ্যাটের লকডাউন না কী চলছে এতে বড়োলোকদের তো আনন্দ। মাস গেলেই পয়সা…এই আল্লার বিচার!ভাইরাস আসলেই ভাল।গরীব বড়োলোক একসাথে মরব।এমনিতে শুধু আমরা মরি…।’

‘আলু’ গল্পে দেবেন নামক দরিদ্র এক চাষি মহাজনের কাছে সুদের মাধ্যমে পাঁচ বিঘা জমিতে ঋণ নিয়ে খুব কষ্টে আলু চাষ করেছে।অভাবের সংসার। প্রতিদিন আলু ক্ষেতে গিয়ে কত স্বপ্ন বুনেছে।ধার শোধ ও মেয়ে মিরার বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছেয় দিন দিন খেটেছে। ‘সামনে কত কাজ,আলু ঘরে তুলতে হবে কত কিছু জোগাড় করতে হবে,কিছু না দিই মেয়ের গহনা,ছেলের বাইক……।’ গ্রামের জাব্বারের মধ্যস্থতায় এক ধনী পরিবারের ছেলের সাথে মিরার বিয়ে পাকা করার আলোচনা চলে।দেবেন বড়োলোকের বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দিবে এই আশায় বুক বাঁধে। শেষে যৌতুক তথা চার চাকা গাড়ির দাবীতে হতাশ হয়।তবু তো মেয়ের বিয়েথা দিতেই হবে! ‘আলুর ফলন বেশ হয়েছে….এখন বাজার ভালো হলেই সব কষ্টের শেষ।’ কিন্তু পোড়া কপাল হলে যা হয়-‘এক সপ্তাহ ধরে মুষলধারে বৃষ্টি,মাঠে জল থই থই।চাষীদের মাথায় হাত,আলুর জমি জলের তলায়।পচে সব আলু শেষ। দেবেনের কথায়:- ‘সমন্ধির এই কাজ কি মানুষে করে! আলু কি মানুষে লাগায়। সর্বনাশ! ভাই সর্বনাশ! মহাজনের টাকা,সারের টাকা…. শালা বউ মেয়ে সব বন্ধক রাখতে হবে!’

যাই হোক গ্রামের সাধারণ দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষদের খোঁজ কে রাখে? যাদের খাটুনির ফলে বাবুরা আজ সুখী জীবন উপভোগ করছে তাদের হাল হকিকত কি? লেখক তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন এই গল্পের বইখানীর মাধ্যমে।

‘কেরু’, ‘খামারু’, ‘দিনু বাবু’, ‘শান্তি মুর্মু’ নামক চরিত্র সহ আরও নানান গল্পগুলো প্রত্যন্ত গ্রামীণ ‘বিহত’ মানুষদের অসহায়ত্বের জীবন যাপনের যেন জীবন্ত দলীল।যা পড়ে সত্যিই আমি সমৃদ্ধ।

You may also like