ব্রাহ্মণ্যবাদ, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধ স্বর

by Abu Siddik

প্রান্তজনের সাহিত্যচর্চা
সুরঞ্জন মিদ্দে
নান্দনিক (২০১৯)
২০৭ পাতা
হার্ডকভার
মূল্যঃ ২৭৫/-

“কিছুই ফুরায় না পৃথিবীতে মুন্ডারি দেশ-মাটি-পাথর-বন-নদী- ঋতুর পর ঋতুর আগমন–সংগ্রামও ফুরায় না, শেষ হতে পারে না। পরাজয়ে সংগ্রাম শেষ হয় না।”
মহাশ্বেতাদেবী, অরণ্যের অধিকার

অধ্যাপক-গবেষক-প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক সুরঞ্জন মিদ্দের ২০৭ পাতার ‘প্রান্তজনের সাহিত্যচর্চা’ মূলত প্রান্তজন ও তাঁদের সাহিত্যচর্চার একটি রূপরেখা আমাদের সামনে হাজির করে। সেখানে যেমন এসেছে প্রান্তিক মানুষের কথা, তাঁদের জীবন বাস্তবতা, তাঁদের জীবন সংগ্রামের কথা, তেমনি উঠে এসেছে তাঁদের বিশ্বাসের, ধর্মের, এক বিরাট মনোজগতের চিরায়ত ছবি। এ যেন সহস্র মানুষের সহস্র জয়গান, সহস্র স্বর। ‘চর্যাপদ’ থেকে শুরু করে লেখক একে একে টেনেছেন ডোম জনজাতির “ধর্মমঙ্গল’, সাঁওতালি সংস্কৃতি, লালন সাধকদের কথা। এসেছে পতিত বাংলার বাইবেল ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’-এর কথা। আম্বেদকরের স্বপনের প্রসঙ্গ নিয়ে এসে বলেছেন অন্ত্যজ খৃস্টানসম্প্রদায়ের কথা। তেমনি আবার উঠে এসেছে গুরুসদয় দত্ত ও মযাহারুল ইসলামের সাহিত্যচর্চার প্রসঙ্গ। মতুয়া অশ্বিনী গোঁসাই হাজির হয়েছেন শোষিত শ্রেণির শিল্পী হিসাবে। লেখক বিশ্লেষণ করেছেন মহাশ্বেতাদেবীর ‘অরণ্যের অধিকার’ মুন্ডাজীবনের এক মহাসংগ্রাম হিসাবে। এসেছে নিম্নবর্গের কথাকাব্য ‘পিতৃগণ’ ও ‘আগুনের বর্ণমালা’। শেষে এসেছে অমিতকুমার মণ্ডলের ‘মারণ দ্বীপের যাপনলিপি’, অর্থাৎ সুন্দরবনের অতীত ও বর্তমান মানুষের বেঁচে থাকার, টিকে থাকার অসম লড়াই।

উপাদানের বৈচিত্র্য, পরিবেশনায় ভিন্ন ভিন্ন–গান, ছড়া, কবিতা, গল্প-উপন্যাস, শিল্পী-সাহিত্যিকদের আবির্ভাবের ব্যবধান সময়ের নিরিখে। কিন্তু সমগ্র বইটি এককের মাত্রা পেয়েছে শ্রমজীবীর, প্রান্তিকমানুষের প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্তানের খাতিরে। যদি, ধর্ম ও বিশ্বাসের কথা সরিয়ে রাখি, তবুও আজকের পরিবেশধর্ষণের দিনে বইটির অবাদন কিছু কম নয়। আমার হিসাবে তো বহুল। আর লোকজীবনের আয়না হিসাবে মিদ্দের বিষয় নির্বাচন ও সেগুলির লৌকিক ও তাত্ত্বিক পরিবেশন পাঠকদের হৃদয়ে ও চিন্তার জগতে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে। মানুষ মানুষনিয়ে বাঁচে। মানুষ ও প্রকৃতি একে অপরের পরিপূরক। এটিও একটি দিক।

লেখকের কথাঃ

ভারতীয় উপমহাদেশে দেশজ জনগোষ্ঠীগুলি নিজের স্বকীয়তা ও মৌলিকত্বে সমুজ্জ্বল ছিল। মানবতাবাদী, ভাইচারা, নিজস্ব শক্তিতে ভরপুর সুমহান ‘চণ্ডাল’, ‘বরখ’ (মানুষ) ‘হড়-মিতান’, ‘পৌণ্ড্র’ সামাজিক জনপদ্গুলি ছিল স্বয়ংশাসিত ও আত্মনির্ভরশীল। কিন্তু ক্রমশ তাঁদের আর্যসভ্যতার ‘দাস’, ‘দস্যু’, ‘রাক্ষস’, ‘বানর’, ‘অসুর’, ‘কোল’, ‘ভীল’, ‘বুনো’ প্রভৃতি নামে হেয়ঞ্জান করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আদিবাসী মাতা-কন্যারাও লাঞ্ছিত-বঞ্ছিত।

অরণ্য ও প্রকৃতির সন্তানেরা কলকলমুখর প্রাগসর মানবগোষ্ঠীর চাপে আজ নির্বাক। তাঁরা নীরবে দেখছেন তাঁদের নির্ভরযোগ্য বাসভুমি-বনভূমি-মাতৃভূমি অপরের [পুঁজিবাদীদের] হাতে করায়ত্ত। নিজভূমে পরবাসীর বেদনা তাঁদের নিত্যসঙ্গী। তাঁরা অসহায়। গিরিকুমার অরণ্যসন্তান—সেই বৃহত্তর কৃষ্ণভারতকে বাদ দিয়ে, উপমহাদেশের সাহিত্যচর্চা কেন, কোন চর্চাই পূর্ণাঙ্গ নয়।

যখনই আদিমবাসীরা প্রতিবাদ করতে গেছে তখনই নির্দয়ভাবে তাঁদের ’পরে দমন-পীড়ন নেমে এসেছে।১৭৭০ ও ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দের চুয়াড় বিদ্রোহ, ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের খাসি বিদ্রোহ, ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দের জাঠ বিদ্রোহ, ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের ভীল বিদ্রোহ, ১৮৩১-৩২ খ্রিস্টাব্দের কোল বিদ্রোহ, ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দের ভূমিজ বিদ্রোহ, ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের নাগা বিদ্রোহ, ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দের খোন্দ বিদ্রোহ, ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ এবং ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের মুন্ডা বিদ্রোহ; সেই অত্যাচারের ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহন করছে।

অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক সাহিত্যের সিলেবাস নির্মাতারা হলেন উচ্চবর্ণের কিংবা জাতিসত্তার আত্মপরিচয় সম্পর্কে সচেতন নয়। সিলেবাস নির্ণায়কদের মধ্যে আদিমবাসীর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি নেই। থাকলেও তাঁরা সংখ্যালঘু। তাঁদের মতামত প্রতিফলিত হবার সুযোগ সম্ভাবনা খুব কম। এমনিতেই তথাকথিত উচ্চবর্ণের বুদ্ধিজীবীরা লোকসংস্কৃতিচর্চা বা আদিমজনগোষ্ঠীচর্চাকে নিয়ে উপহাস করেন। সেই সঙ্গে আছে সীমাহীন উন্নাসিকতা।

সংখ্যাগুরু প্রান্তজনদের বাদদিয়ে আধুনিক সাহিত্য-সাধনা অসম্ভব। বৃহত্তম বাংলার ভূমিপুত্র-ভূমিকন্যাদের ব্যথা-বেদনার অনুসন্ধান কতটুকু সম্ভব!আইনের চোখে সবাই সমান। [এক দেশ], এক মানুষ, এক মুল্যবান, এক ভোট যদি মান্যতা পায়, তবে কেন এত [বিষ] সামাজিক ঘৃণা ও বিদ্বেষ। রোহিত ভেমুলার মৃত্যু, চুনি কোটালের আত্মহত্যা ভারতবর্ষের বহুত্ববাদকে লজ্জিত করেছে।

You may also like