আজও তিনি এসেছেন। এর আগেও বেশ কয়েকবার এসেছিলেন। নামাজ শেষে মুসল্লিদের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর আবেদন রাখছেন। যেমনটা আগেও রাখতেন। তিনি স্বনামধন্য আলেম মাহফুজুর রহমান। জ্ঞানী মানুষ।
একসময় সমগ্র জেলা জুড়ে এমনকি জেলার বাইরেও বক্তৃতা করে বেড়াতেন। ভাষাজ্ঞান অত্যন্ত ভালো। সুমিষ্ট গলার স্বরও। শামীম তাঁর বক্তৃতা শুনেছে বেশ কয়েকবার। ব্যক্তিগতভাবে আলাপও হয়েছে।
শামীম যে স্কুলের শিক্ষক সে স্কুলেই তিনি একবার এসেছিলেন বক্তব্য রাখতে। মিলাদ অনুষ্ঠান ছিল সেটা। বহু পুরাতন স্কুল। স্কুলের মিলাদ অনুষ্ঠানও বহু পুরোনো ঐতিহ্য। একেক বছর একেকজন বক্তাকে নিয়ে আসা হয়। সেবার স্কুলেই মাহফুজুর রহমান সাহেবের সঙ্গে আলাপ হয়।
বর্তমানে তিনি অসুস্থ। প্যারালাইসিস হয়েছিল বেশ কয়েকবছর আগে। তার জের রয়ে গেছে এখনো। শরীরের একদিকটা প্রায় অকেজো। বক্তৃতা করে বেড়াতে পারেন না আর। তার থেকে যে রোজগার হত সেটা পুরোপুরি বন্ধ। দায় হয়ে পড়েছে সংসার চালানো। অগত্যা মুসল্লিদের দ্বারস্থ হন। নামাজ শেষে আবেদন করলে কিছু না কিছু জুটেই যায়। একেকদিন একেক গ্রাম। একেক ওয়াক্তে একেক মসজিদ।
তাঁর কাতর আবেদন শুনে মনটা ভারাক্রান্ত হল শামীমের। এর আগেও সে আর্থিক সহায়তা করেছে মাহফুজুর সাহেবকে। আজও করবে। তাঁর আবেদন জানিয়ে তিনি মসজিদের বারান্দায় এসে বসেন। নামাজ শেষে মুসল্লিগণ বের হলে যে যার মত সাহায্য করে যাবেন। করেনও। অনেকেই পাঁচ-দশ হাতে গুঁজে দিলেন। বরাবরই দেন। সাহায্যপ্রার্থীরা মাঝেমধ্যেই আসেন।
মুসল্লিগণ সকলে চলে গেলে শামীম তাঁর নিকটবর্তী হন। কুশল জানতে চান। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বের হয়ে আসেন মসজিদ থেকে। আজ হাটবার। রাস্তা পার হলেই হাট। তিনি হাটের দিকে এগোতে লাগলেন মাহফুজুর রহমান সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে। হাতে টাকা দেবেন না। বাড়ির জন্য কিছু ফলমূল কিনে দেবেন। তিনি নিজে খেতে পারবেন। সন্তানদেরও দিতে পারবেন।
এসে উপস্থিত হলেন হাটে। ফলের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কাজু, কিসমিস, খেজুর ইত্যাদি দিতে বললেন দোকানদারকে। দোকানদার একটা একটা করে জিনিস মাপতে থাকেন। তার হাত কাঁপছে। মাপতে দেরি হচ্ছে। দোকানদারেরও কয়েকবছর আগে প্যারালাইসিস হয়েছিল। ভালো হয়ে গেছে। তবে, মৌলানা সাহেবের মতো একদিকটা এখনো ঠিকমতো কাজ করছে না। তারও সংসার আছে। সবাইকে নিয়ে তো আর না খেয়ে থাকা যায় না। বাধ্য হয়ে হাটে এসে বসেন কিছু ফলমূল নিয়ে।
ফলগুলো যত্ন করে মাহফুজুর রহমান সাহেবের ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়ে শামীম আবেদন করে,”আমার জন্য দোয়া করবেন।”
অন্যদিন দোয়া করার কথা বললে তিনি বলতেন, “অবশ্যই করবো। কেন করবো না!” বলেই তিনি দু’একটা দোয়া তৎক্ষণাৎই করে দিতেন। কিন্তু আজ তিনি কিছুই বললেন না। শুধু শামীমের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। চেয়ে রইল শামীমও।