বিবিসির জনৈক উপস্থাপক বর্তমান বিশ্বের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিলাসবহুল নগরীর প্রতিষ্ঠাতা শেখ রাশিদ-আল- মাখতুমকে প্রশ্ন করেছিলেন,”দুবাই নগরীর ভবিষ্যৎ কী”?
এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন,”আমার পিতা উট চালাতেন, আমি মার্সিডিজ চালাই , আমার ছেলে ল্যান্ড রোভার চালায়, আমার নাতি বুগাতি ব্যারন চালায়, আমার পুতা হয়তো উট চালাবে”।
এই ধরনের উত্তর শুনে উপস্থাপক মহাশয় অবাক বিস্ময়ের সাথে আবার প্রশ্ন করেছিলেন, কেন এমন টি হবে?
এই দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে শেখ মাখতুম যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ এবং মানসিক জগতে আলোড়ন সৃষ্টি হতে পারে এরূপ এক মন্তব্য করেছিলেন। এই যুক্তিপূর্ণ মন্তব্যটি হলো, “দুঃসময় শক্তিশালী মানুষ তৈরি করে, আর শক্তিশালী মানুষ সুসময় তৈরি করে। অন্যদিকে সুসময় দুর্বল মানুষ তৈরি করে, দুর্বল মানুষ দুঃসময় তৈরি করে”।
বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের অন্যতম প্রধান প্রাণপুরুষ ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রচলিত ভ্রান্ত বিশ্বাস ও অচলাবস্থা নিরসনের ক্ষেত্রে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এই পথে চলতে গিয়ে সারাটা জীবনই তাকে দুঃসময়ের মধ্যে কাটাতে হয়েছে। এই দুঃসময়ের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে করতেই এক অসম সামাজিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি এক শক্তিশালী মানুষে পরিণত হয়েছিলেন যে শক্তির ভিত ছিল নৈতিকতা ও যুক্তিবাদের। জীবন নদীর সংগ্রামে তাঁকে সারাটা জীবন স্রোতের বিপরীতে চলতে হয়েছে। স্রোতের বিপরীতে চলেছিলেন বলেই তিনি এক অদৃশ্য শক্তিশালী ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন। এই ক্ষমতাবলে তিনি যুগ পরিবর্তনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পেরেছিলেন। বিদ্যাসাগর নিজেও একটা অত্যন্ত মূল্যবান কথা প্রায়ই বলতেন, স্রোতের বিপরীতে চলাটাই বিবেকবান মানুষের একান্ত কর্তব্য, কারণ স্রোতের সাথে তো খড়কুটো ও ভেসে যায়” । যুগে যুগে স্রোতের বিপরীতে চলা বেশ কিছু মানুষের সংগ্রামী চেতনা ও সংগ্রামী কার্যকলাপের মাধ্যমে সভ্যতার অগ্রগতি। সভ্যতার যা কিছু ভালো ফসল সবগুলোই হল এই স্রোতের বিপরীতে চলা মানুষের মেহনতের ফল। বর্তমানে বিজ্ঞানের চরমতম বিকাশের যুগে ও এই ধারা অব্যাহত আছে। হয়তো আগামী দিনেও থাকবে। বর্তমান সভ্যতা টিকে আছে বলা যেতে পারে স্রোতের বিপরীতে চলা মানুষের নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে।
আদিম সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা অতিক্রম করে মানুষ যখন দাস সমাজ ব্যবস্থা উপনীত হলো, তৎকালীন গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, নিত্য বিবাদ, চূড়ান্ত অনিশ্চিত ও অসহায় অবস্থা থেকে নিজেদের রক্ষা পাওয়ার জন্য স্রোতের বিপরীতে হেঁটে কিছু মানুষ শুভ বুদ্ধির দ্বারা চালিত হয়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। চিন্তাবিদ রুশো যাকে সাধারণের ইচ্ছা বলে অভিহিত করেছেন।আসলে সাধারণের ইচ্ছা হলো পবিত্র। রাষ্ট্রব্যবস্থা আর কিছুই নয়, এটা হল এই পবিত্র ইচ্ছার বাস্তব প্রতিফলন। রুশো তার গ্রন্থে লিখেছেন, মানুষের শুভবুদ্ধির ফসল রাষ্ট্র তা যদি রাষ্ট্রীয় কর্ণধারেরা সঠিকভাবে চালাতে না পারে, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কথা বলেছেন। প্রকৃত অর্থে এই মতবাদ ও স্রোতের বিপরীতে চলার একটি স্বতন্ত্র ধারা। শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের চিন্তা চেতনা ও পরিশ্রমের ফসল যখনই বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে, তখনই সেই ফসল রক্ষার প্রয়োজনে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে প্রতিবাদ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, প্রতিবাদ হচ্ছে মানুষের এক অন্যতম প্রধান ধর্ম। প্রতিবাদ এর মধ্য দিয়ে যুগে যুগে ন্যায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সত্যের উদঘাটন হয়েছে, মিথ্যা বিলুপ্তির পথ খুঁজে নিতে বাধ্য হয়েছে। বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগ বলে বিবেচিত। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার প্রবল স্রোতে মানুষের জীবনে অভূতপূর্ব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ছোঁয়া লেগেছে বটে, কিন্তু যন্ত্রণার বিষময় ফল ও মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
এমন একটা যুগ এলো, যে যুগে সামন্ততন্ত্র ভেঙে গেল। চিরাচরিত গ্রামীণ সমাজ মুখ থুবড়ে পড়ল। গ্রামের মানুষ শহরে এসে ভিড় করল। পেশী শক্তির পরিবর্তে যান্ত্রিক শক্তির ব্যবহার বেড়ে গেল। উৎপাদনের আধিক্য দেখা দিল। যার অন্তিম পরিণতি হিসেবে শিল্প বিপ্লবের প্ৰবল স্রোতে বিশ্ব জনজীবন অভূতপূর্বভাবে আন্দোলিত হল। উন্নয়নের স্রোত বইলো বটে, কিন্তু উন্নয়নের ফল সাধারণ মানুষ হাতে পেল না। এই তথাকথিত উন্নয়নের ফাটল দিয়ে সৃষ্টি হল শ্রমিক নামক সর্বহারা শ্রেণীর। তাই উন্নয়নের স্রোতের বিপরীতে গিয়েও কিছু মানুষ চিন্তা করতে শুরু করলো। তাদের মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবনার ফসল হলো সমাজতান্ত্রিক ধারণা। একটা সময় ধণতন্ত্র বনাম সমাজতন্ত্র_উভয়ের মধ্যে প্রবল দ্বন্দ্ব দেখা দিল। এই দ্বন্দ্বের তীব্র প্রতিযোগিতার প্রবল স্রোতে আন্দোলিত হয় আবির্ভাব হলো নয়া সাম্রাজ্যবাদের । নয়া সাম্রাজ্যবাদের অন্তিম পরিণতি হিসেবে পৃথিবী দু- দুটো বিশ্বযুদ্ধ উপহার পেল। রনউম্মাদনাই মত্ত সামরিক আস্ফালনের প্রবল স্রোতের বিপরীতে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের শান্তির বৈঠা হাতে ছোট্ট ছোট্ট তরী দেখা গেল। এর ফসল হলো সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ, রাষ্ট্রসংঘের মত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার অভূতপূর্ব সাফল্যের হাত ধরে সভ্যতা এগিয়ে চলল। চূড়ান্ত ভোগ-বিলাসের হাতছানি, অনাবিষ্কৃত বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যাবতীয় সম্পদকে কুক্ষিগত করার তীব্র প্রয়াস পরিলক্ষিত হল। এই প্রয়াস থেকেই শুরু হল ভৌগোলিক আবিষ্কারের তীব্র প্রতিযোগিতা। ভৌগোলিক আবিষ্কারের সামুদ্রিক স্রোতের দাপটে বিশ্বের প্রভাবশালী শক্তিবর্গের কাছে খুলে গেল সম্পদ আহরণের দরজা। ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রবর্গ তাদের ক্ষমতাকে আরো বাড়িয়ে নিল। তাদের সভ্যতা আরো বিকশিত হলেও পৃথিবীর বুক থেকে বহু প্রাচীন সভ্যতা তথা মায়া সভ্যতা অবলুপ্তির পথে পতিত হল। তাই, এর বিপরীতে গিয়ে নিজের দেশের সভ্যতা , সংস্কৃতি ও স্বাধীনতাকে রক্ষা অথবা পুনরুদ্ধারে র প্রয়োজনে আওয়াজ উঠল মুক্তি সংগ্রামের। এই মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাস মনুষ্য সমাজে এক নতুন সমীকরণের সূচনা করলো। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার তীব্র প্রচেষ্টা পক্ষান্তরে মানবতাবাদের জয় গান। অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগ, সত্যের পথে অবিচল আস্থা, ও অকৃত্রিম দেশাত্মবোধের চেতনা মানব সভ্যতায় নৈতিকতার জয়গান গাইল।
ইউরোপীয় নবজাগরণের স্রোতে যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান চেতনা, ও মানবতাবাদের জোয়ার বইল বটে কিন্তু এর বিপরীতে মানুষের স্বার্থান্বেষী চিন্তা ধারার ফাটল দিয়ে কখন যে মনুষ্যত্বের চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে, সেটা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে গেল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নবজাগরণের পালতোলা জাহাজের পাশাপাশি আধিপত্যবাদের স্টিম ইঞ্জিন সারা বিশ্বে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে। প্রচলিত রীতিনীতির আবিল স্রোতে গা না ভাসিয়ে বরং এর বিপরীতে গিয়ে কিছু মানবতাবাদি চেতনায় উদ্ভুদ্ধ মানুষ এই সত্য তুলে ধরেছেন। যখনই সমাজে নৈতিকতার বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তখনই এই মহামানবেরা সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য হাল ধরেছেন। যুগ থেকে যুগান্তরের পথ পরিক্রমা করে তাঁরা মনুষ্যত্বের চাষবাস করেছেন। মূসা, ইশা, ইব্রাহিম, মোহাম্মদ, মহাবীর, গৌতম বুদ্ধ সকলেই প্রচলিত যুগ ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে মনুষ্যত্বের ধারণাকেই প্রতিষ্ঠা করেছেন। স্রোতের বিপরীতে যদি তাঁরা না চলতেন, তাহলে সমগ্র বিশ্ব তাদের মুখ নিঃসৃত বাণী গুলো উপহার হিসাবে পাওয়া সম্ভব হতো না। এই বাণী গুলি হল মনুষ্য সমাজের চলার পথে দিশা। আবার এই চিরন্তন, শাশ্বত, বাণী উপেক্ষা করে যুগে যুগে বেশকিছু বিপথগামী মানুষ ক্ষমতাবলে মানবকল্যাণের প্রতিকূলে আধিপত্যের স্রোত বইয়ে দেওয়ার প্রবল চেষ্টা করেছে। এই স্রোতের বিপরীতে গিয়ে অনেক মানবতাবাদী মানুষ,যারা সত্যের পূজারী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন। ইরাসমাস, জন হাস, জন ওয়াইক্লিফ, মার্টিন লুথার, চৈতন্যদেব, কবীর, নানক, লালন প্রত্যেকেই যুগ ধর্মের বিপরীতে পথ চলেছে বলেই আমরা আধ্যাত্মিক জগতের মরুদ্দ্যান লাভ করেছি।
স্রোতের বিপরীতে চলার ইচ্ছা ও ক্ষমতা সকলের থাকে না। স্রোতের বিপরীতে চলার পথ কোনদিনই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। এখনো নয়। তা সত্ত্বেও কিছু মানুষ তীব্র ইচ্ছা শক্তির উপর ভর করে, এবং অন্তরের তাগিদে স্রোতের বিপরীতে চলে থাকেন। পদে পদে বাধা, লাঞ্ছনা, অত্যাচার, অপমান সবকিছু সহ্য করে তাঁরা এগিয়ে চলেন। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যাবে, সত্য প্রতিষ্ঠার তাগিদে স্রোতের বিপরীতে চলতে গিয়ে মুসাকে নিজ ভূমে পরবাসে থাকতে হয়েছে। মোহাম্মদ কে হিজরত করতে হয়েছে। বুদ্ধদেবকে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করতে হয়েছে। নেতাজি সুভাষ কে দেশত্যাগ করতে হয়েছে। সক্রেটিসকে বিষপানে হত্যা করা হয়েছে। গ্যালিলিওকে অন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবুও তাঁরা প্রচলিত অসাড় যুগ ধর্মের স্রোতে ভেসে যেতে চাননি।
ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে সাম্রাজ্যবাদের করালগ্রাসে ভারতবর্ষের অধিকাংশ মানুষ যখন নিজ জাতীয় সত্তা কে ভুলতে বসেছিল, নিজ জাতির গৌরব, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে অন্ধ পাশ্চাত্যবাদ কে গ্রহণের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল, ঠিক তখনই স্রোতের বিপরীতে হেঁটে বেশকিছু ভারতীয় মনীষী দেশাত্মবোধের উজ্জ্বল ধারা প্রতিষ্ঠা করে ভারতীয় নবজাগৃতি র পটভূমিকা রচনা করেছেন। স্রোতের বিপরীতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ জাতীয়তাবাদের নতুন মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা র বেড়াজাল অতিক্রম করে মুচি মেথর,চন্ডাল আপামর সকল মানুষের মধ্যে ভাতৃত্ববোধ জাগিয়ে নতুন ভারত গড়ার দিশা দেখিয়েছেন। ভারতীয় নব জাগৃতির জনক রাজা রামমোহন , তিনিও তৎকালীন যুগ ধর্মের বৈশিষ্ট্য অতিক্রম করে স্রোতের বিপরীতে গিয়েই নবজাগরণের বীজ বপন করেছিলেন। ডিরোজিও, বিদ্যাসাগর, জ্যোতিবা ফুলে রাও, স্যার সৈয়দ আহমদ খান, আম্বেদকর সকলেই স্রোতের বিপরীতে পদচারণা করে নিজ নিজ লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন।
বর্তমান বিশ্বে উন্নয়নের স্রোতে যখন প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে,বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর এর মানুষ অস্তিত্বহীনতায় ভুগছে, আমাদের এই সাধের পৃথিবী তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, অভূতপূর্ব এই সংকট মোকাবেলায় স্রোতের বিপরীতে গিয়ে পৃথিবীকে রক্ষা করার একটি তাগিদ অনুভব হচ্ছে। সকলে না হলেও একশ্রেণীর সচেতন মানুষ এই সত্যকে উপলব্ধি করছেন যে আমাদের সাধের এই বসুন্ধরা কে টিকিয়ে রাখতে গেলে উন্নয়নের স্রোতে ভেসে গেলে চলবেনা। স্রোতের বিপরীতে যুক্তিগ্রাহ্য প্রয়োজনীয় কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। 1992 সালে রিওডিজেনিরোতে অনুষ্ঠিত বসুন্ধরা সম্মেলনে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেনটের ধারণা , 2001 সালে কিয়োটো সম্মেলন, পরিবেশ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা আইপিসিসি (Intergovernmental Panel for Climate Change), পারমাণবিক অস্ত্র প্রসার রোধ করতে গঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থা সিটিবিটি (Comprehensive Test Ban Treaty) এই ধরনের উদ্যোগ গুলো কিন্তু যুগ ধর্মের স্রোতের বিপরীতে চলা কিছু মানুষের দুঃসাহসিক কর্মতৎপরতার ফসল। এই ধরনের উদ্যোগ গৃহীত না হলে বিশ্বে ক্ষমতাশালীদের স্বেচ্ছাচারিতার পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পেত। স্বেচ্ছাচারিতার পথ একেবারে বন্ধ করা না গেলেও কিছুটা লাগাম দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
বর্তমান বিশ্বে ক্রমবর্ধমান ভোগ সর্বস্বতা ও সীমাহীন চাহিদার আলেয়ার পিছনে লাগামহীনভাবে ছুটতে গিয়ে বর্তমান মানব সভ্যতা এক অভূতপূর্ব সংকটের মুখে পতিত হয়েছে। মানুষের জীবনে সুখ স্বাচ্ছন্দ এনে দেওয়ার অলীক স্বপ্ন দেখিয়ে বিশ্ব দরবারে হাজির হয়েছে বিশ্বায়ন। তথাকথিত উদারনীতি ও মুক্তদ্বার নীতির সুনামীর স্রোতে সারাবিশ্ব আজ আন্দোলিত। বিশ্বায়নের প্রবল স্রোতে খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে অনেক জাতি গোত্রের যুগ যুগ ধরে গড়ে তোলা নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবন ধারা। ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে অবাধ স্বেচ্ছাচারিতা, আধুনিকতার নামে প্রকৃত অর্থে পশ্চাদপদতা, সংযম হীনতা, নিষ্ঠুরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা,_সভ্যতার প্রগতির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করছে। মানবসমাজের সামাজিক বন্ধনকে শিথিল করে দিচ্ছে। সহাবস্থান এর নীতি ব্যাহত হচ্ছে। সহনশীলতার পথ রুদ্ধ হচ্ছে, প্রসারিত হচ্ছে আধিপত্যবাদের। বিশ্ব সৌভ্রাতৃত্বের আদর্শ আজকে গালভরা কথায় পরিণত হচ্ছে। জোর যার মুলুক তারএই আস্ফালন আকাশ বাতাসকে দূষিত করে তুলছে।সভ্যতা বিনাশকারী এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এবং সভ্যতার চাকাকে গতিশীল রাখতে দরকার স্রোতের বিপরীতে চলা কিছু বেপরোয়া মানুষের। স্রোতের বিপরীতে চলা এই মানুষগুলো সব সময় যে পুরস্কার পায়, সামাজিক স্বীকৃতি পায় তা নয়। বরং তাদের জীবনে নেমে আসে অপমান, লাঞ্ছনা, তিরস্কার, এমনকি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের খড়গ হস্ত। তাই গৌরী লঙ্কেশ এর মত মানুষকে খুন হতে হয়। ভার ভারা রাওকে, সঞ্জীব ভট্ট কে, কাফিল খান কে, ওমর খালিদ কে জেল খাটতে হয়। কিন্তু একথা সত্য যে, স্রোতের বিপরীতে চলার মানুষের গতিকে থামানো যায়নি। মানবতাবাদি চেতনায় উদ্বুদ্ধ, মুক্ত মনের অধিকারী অমর্ত্য সেন কলম চালিয়ে যাচ্ছেন, চমস্কি সারাবিশ্বের বিবেক জাগানো র কাজে ব্যস্ত আছেন। গ্রেটা থুনবার্গ এর মত সাহসী নারী বিশ্বায়ন পন্থীদের মনে কম্পন সৃষ্টি করেছে।
মারণাস্ত্রের দাপটে কম্পমান, দূষণের ভারে ন্যুব্জ, অপসংস্কৃতি করাল গ্রাসে আচ্ছন্ন, আধিপত্যবাদের দাপটে লজ্জিত বসুন্ধরা কে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে মানবতাবাদি এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুশীলন একান্ত প্রয়োজন। চিরাচরিত মাঙ্গলিক সংস্কৃতি, শান্তিকামী মানুষের সযত্নে লালিত নির্মল আধ্যাত্মিকতা, ও পবিত্র সহাবস্থান নীতি কি প্রতিষ্ঠিত করার একমাত্র রাস্তায় হলো স্রোতের বিপরীতে চলা। যুগে যুগে স্রোতের বিপরীতে চলা এমন কিছু মানুষের মধ্যে জনৈক পন্ডিত আবু হানিফার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ছোট্ট ঘটনা টি প্রাসঙ্গিক বলেই উল্লেখ করতে চাই, 146 হিজরীতে তার জীবনে একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল। স্বৈরাচারী খলিফা মনসুর স্বৈরাচারী রাষ্ট্রীয় নীতি র কঠোর সমালোচক ইমাম আবু হানিফাকে বাগদাদের রাজদরবারের তলব করা হয়। তাঁকে প্রধান বিচারপতির পদ অলংকৃত করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। আবু হানিফা সহজে অনুমান করেন যে, এই সিদ্ধান্তের মধ্যে নিহিত আছে এক গভীর ষড়যন্ত্র। তিনি মনে করেন, এই পদ অলংকৃত করার অর্থ হবে ন্যায়, ইনসাফ ও ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে জালেম শাসকের পূজারী হত্তয়া । তাই ইমাম সাহেব খলিফা কে নম্রতা ও বিনয়ের সাথে বললেন, “আমি প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণ করার যোগ্য নই” এতে খলিফা রাগান্বিত হয়ে বললেন, আপনি মিথ্যাবাদী।
প্রত্যুত্তরে ইমাম সাহেব বললেন,”আপনার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে আমার কথাই সঠিক। কারণ একজন মিথ্যাবাদী রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতির পদ-এর যোগ্য নয়” । স্রোতের বিপরীতে গিয়ে মানুষ সহযোগীতা নামক এক অনন্য সৃজনশীল মানবিক গুণাবলীর সন্ধান পেতে পারে। প্রতিযোগীতা যেমন উৎকর্ষতা বৃদ্ধির সহায়ক হয়,তেমনি অসম প্রতিযোগিতা অবক্ষয়ের সৃষ্টি করে।তবে এটা ঠিক যে,সুস্থ্য প্রতিযোগিতা সহাবস্থানের ও মূল্যবোধের শিক্ষার জাগরণ ঘটায়।সুস্থ্য প্রতিযোগিতার পটভূমিকা তৈরী করে স্রোতের বিপরীতে চলার প্রবণতা।