জাতপাতের নিষিদ্ধ কথা

by Abu Siddik

ভারতের শাসনকাঠামোয় জাতপাত
ড. দেবেশ দাস
পথ সংকেত (২০২৩)
পেপারব্যাক
পাতা ১৪৪
মূল্য ১২০/-

ভারতে ‘জাতপাত’ শব্দটি শুনেই অনেকে উপহাস করে, অনেকে রেগে যায়। জাতপাত শব্দটি সবসময় নির্যাতন ও বৈষম্যের সাথে যুক্ত।কেউ যদি জাতপাত নিয়ে কোন সদর্থক কথা বলে, তবুও তাকে আধুনিকতার বিরোধী ধরে নেওয়া হয়। শিক্ষিত সকলেই ভারতীয় সমাজে জাতপাত আছে বলে মানতে চাই না। কিন্তু সরকারি চাকরি, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও বিয়ের সময় জাতপাত কে সামজিক সম্পদ হিসাবে ভাঙিয়ে নিতে আমরা অভ্যস্ত। জাতপাত তাই ভারতে একটি জটিল জায়গা জুড়ে আছে।
আর বৈদ্যনাথন, কাস্ট এ্যজ সোশ্যাল ক্যাপিটাল, ২০১৯

চিন্তা যেমন বস্তুগত অবস্থানের উপর নির্ভর করে, তেমনি বস্তুগত অবস্থার পরিবর্তনে চিন্তার অনুশীলন অপরিহার্য। মানুষের অগ্রগতির শর্ত তার মুক্তি, আর সেই মুক্তি নিহিত এমন সমাজে যেখানে “ব্যক্তি মানুষ আর শ্রমবিভাজনের আজ্ঞানুবর্তী থাকবে না, এবং তার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক শ্রম ও দৈহিক শ্রমের মধ্যে বৈপরীত্যের ধারণাটা অবলুপ্ত হয়ে যাবে”। এমন একটি সমাজ গড়ার পক্ষে অনেক বাধার মধ্যে অন্যতম প্রধান বাধা জাতপাতের সমস্যা। ভারতীয় সমাজে এই কুৎসিত বিভাজন নিয়ে নিরন্তর প্রশ্ন তোলা, তার স্বরূপ ও প্রকৃতিগুলোকে জনসমক্ষে তুলে ধরা দরকার। কিন্তু সেটা খুব কম হয়। জাতপাতের সমস্যাকে একদিকে বিদ্যাচর্চার বিষয় এবং অন্যদিকে রাজনৈতিক অনুশীলনের বিষয় করে তোলা দরকার।

ভারত বর্ষ এবং বিশেষ করে আমাদের এই রাজ্যে জাত বিভাজন ও তার দূর করার উপায় নিয়ে আলোচনা খুব খুব একটা হয় না। আর যেটুকু হয় সেটুকু প্রধানত ইংরেজি ভাষায় ও বিদ্যাচর্চার বিশেষ এক কাঠামো মেনে হয়। এতে করে আপামর জনগণের কাছে জাতপাতের সমস্যা বেশি বেশি করে উঠে আসে না। একটি নির্দিষ্ট বলয়ে এবং সেমিনার কক্ষে এই আলোচনাগুলো আবদ্ধ থাকে। এই জাতপাতের সমস্যাকে ভাঙ্গিয়ে অনেক বড় বড় বই লেখা হয় অনেক মনোরম এবং আকর্ষণীয় প্রবন্ধ বেরোই। কিন্তু সমস্যা সমস্যাই থেকে যায়। বিষয়টিকে লোকচর্চার স্তরে নামে আনা দরকার, আর সেই কাজটিকে লেখক দেবেশ দাস করেছেন। তার এই বই একটি জরুরী রাজনৈতিক পদক্ষেপ একটি বুদ্ধি চর্চা গত অবদান, এবং এটি আমাদের এক সামাজিক সম্পদ। তথ্য ও তত্ত্বের মিলিত প্রয়াসে এটি একটি মূল্যবান দলিল গবেষক ও সাধারণ পাঠকের কাছে। বইয়ের মুখবন্ধে লিখেছেন কথাগুলো কুমার রাণা।

প্রকাশক নারায়ণ বিশ্বাস বলেছেন স্বাধীনতার এত বছর পরে সামাজিক ও শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে পড়া দলিত ও আদিবাসীদের প্রকৃত অবস্থান এখন কেমন? অন্যান্য অনগ্রসরদের অবস্থাই বা কেমন? দলিত আদিবাসীদের সঙ্গে অন্যান্যদের ফারাক কমেছে না বৃদ্ধি পেয়েছে? লেখক এসবের উত্তর খুঁজেছেন সরকারি পরিসংখ্যান ও বিভিন্ন গবেষণালব্ধ তথ্যের উপর ভিত্তি করেই। উঠে এসেছে দলিত ও আদিবাসীদের অবস্থান নিয়ে কথা। আইনসভা বিচার ব্যবস্থা আমলাতন্ত্র ও মিডিয়ায় দলিত আদিবাসীদের উপস্থিতির কথা। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে তাদের করুন অবস্থান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন লেখক। উঠে এসেছে দলিত ও আদিবাসীদের সংরক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি। এটিকে অনেকেই সেনসিটিভ ইস্যু হিসাবে তুলে ধরে। সে কারণে লেখক যথাযথ গুরুত্ব দিয়েই সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও তার বিরুদ্ধে ওঠা নানা বিভ্রান্তিকর প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আন্তরিক চেষ্টা করেছেন।

মুখবন্ধ বাদ দিয়ে মোট ১৬ টি অধ্যায়ে ১৪৪ পাতার এই বইটিতে দলিত আদিবাসীদের বহুমাত্রিক বঞ্চনার কথা উঠে এসেছে। অধ্যায়গুলির নামকরণ লেখকের সুচিন্তার বহিঃপ্রকাশ। যেমন দলিত আদিবাসীরা কতটা পিছিয়ে আছে? কেন পিছিয়ে পড়েছে? মেধার অভাব? জাত, জাতপাতের উৎস, জাতপাতের পরম্পরা জাত ব্যবস্থায় ক্ষতি, দেশের সংরক্ষণে সমাধানের প্রয়াস, সংরক্ষণ নিয়ে নানা আপত্তি বনাম অন্য কথা, কিপথে এগুনো যায়? কবে শেষ হবে জাতপাত? ইত্যাদি ইত্যাদি।

জাতপাতের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও বর্ণ ব্যবস্থার বিলোপের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাওয়া সমাজতান্ত্রিক শক্তির সদর্থক ইঙ্গিত বহন করে। কিন্তু লেখক কিছুটা আশাহত, “পৃথিবীর অনেক দেশেই দেখা গেছে যে সমাজতান্ত্রিক শক্তির বিজয়ের মাধ্যমে বিপ্লব হয়ে গেলেও সেখানে ধর্ম উঠে যায়নি। আমাদের দেশে যেখানে জাতপাতের উৎস হচ্ছে ধর্ম সেখানে ধর্ম থাকবে, অথচ জাতপাত থাকবে না, এখনই এটা ভাবা যাচ্ছে না”।

প্রশ্ন হল জাতপাত থাকলে কি করে একটি আদর্শ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে। লেখক আশা করেছেন যে মার্কস ও এঙ্গেলস বর্ণিত সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটলে অনেকটাই লাভবান হবে দলিত আদিবাসী প্রান্তিক মানুষরা। তাই দলিত আদিবাসীদের স্বার্থ যারা দেখেন দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাদেরকে বলতে হবে l আর অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই আসলে দেশের শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই। শাসক শ্রেণীর এই শাসনকে না হটিয়ে জাতপাত ব্যবস্থাকে হটানো যাবে না।

দেশের আর সব কিছু বাদ দিয়ে এখন যদি কোন ব্যক্তি বিচ্ছিন্নভাবে শুধুমাত্র জাতপাত ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই আন্তরিক লড়াই করতে চাই তাকে এই শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। তাই জাতপাত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়তে গেলে শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে যারা লড়ছে তাদের সমর্থন করতে হবে। লেখকের কথায় শ্রেণী সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গেই জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াইটাও জরুরী। কেউ ভাবতে পারেন যে সেই যখন শ্রেণী সংগ্রামে আসতে হলো তাহলে শুধু শ্রেণীর সংগ্রামের কথাই ভাবা হবে না কেন? যদি জাতপাতের সমস্যা কি এড়িয়ে শুধু শ্রেণী সংগ্রামের কথা ভাবি তাহলে সমস্যা আছে। কারণ তাতে জাতপাতের সমস্যা থেকেই যাবে আর তা পদে পদে বাধা দেবে শ্রেণী সংগ্রামকেই।

তথ্যভিত্তিক আলোচনা অল্পপরিসরে করা কঠিন ও তা সবসময় লাভজনক নাও হতে পারে, কারণ জ্ঞানীদের জ্ঞানদান অপাত্রে দানের স্বরূপ। অর্থাৎ দলিত এবং আদিবাসীদের করুণ হাল সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রেই। এটি কম-বেশি সকলেরই জানা। তাছাড়া উৎসাহী পাঠকেরা এই তথ্যগুলি একটু চেষ্টা করলে পেতে পারেন। এখন ইন্টারনেটের যুগ। আর্টিকেলের ছড়াছড়ি। ইংরেজি ভাষায় বইপত্র আছে অনেক। এবং দলিত আদিবাসীদের উপর নির্যাতন অত্যাচার বৈষম্য, অপবাদ ইত্যাদির কথা শিক্ষিত ভারতবাসীর কাছে অধরা নয়। তাই আমলাতন্ত্রে প্রশাসনে বিচার ব্যবস্থায় আইন বিভাগে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আরো নানারকম সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক কাঠামোয় এমনকি বিভিন্ন জনকল্যাণকর পার্টির সাংগঠনিক কমিটি গুলোতে, পাড়ার ক্লাবে, সর্বহারার দলগুলোতে, তাদের সংখ্যা কত আছে সেটা অনেকেই জানেন।

নমুনা হিসাবে একটি তালিকা দেওয়া হল। এরকম অসংখ্য তথ্য লেখক খুব যত্নসহকারে পেশ করেছেন উনার বক্তব্যের স্বপক্ষে।

                    ২০১১ সালে সম্পদের বিভিন্ন সূচকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শতাংশ

সম্প্রদায়দরিদ্রতমধনীতম
সব মিলিয়ে২০.৬৩২০.০৯
তপশিলি জনজাতি৫১৫.৬
তপশিলি জাতি২৮.৪৭৯.৪৬
ওবিসি১৮.৮৭১৫.৮৩
উচ্চবর্-ব্রাহ্মন ৪.৬২৪৯.৯১
উচ্চবর্ণ – রাজপুত৭.২৭৩১.১৫
উচ্চবর্ণ – বানিয়া৫.৮৪৩.৬৬
উচ্চবর্ণ – কায়স্থ২.১৭৫৭.০২
উচ্চবর্ণ – অন্যান্য৯.৭৫৩৫.২৬
মুসলিম২০.৯১১৬.৯৯

আর আমরা যখন বৃহৎ পুঁজির অংশমাত্র, এবং যেখানে কর্পোরেশনস এত ক্ষমতাশালী, দলিত ও আদিবাসীদের, যারা দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার জন্য লড়াই করে তাদের সাথে আর বড় বড় কথা বলে বিশ্বাসঘাতকতা না করাই ঠিক। তাই শুধুমাত্র জাতি ব্যবস্থার ফলেই যে আদিবাসী এবং দলিত ভাই-বোনেরা পিছিয়ে আছে, একথা বলতে আমার দ্বিধাবোধ হয়। তাছাড়া অনেকে বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে বহু দলিত আদিবাসীরা নিজেদেরকে হিন্দু ধর্মের অংশ বলেই মেনে নেয়। তো সেখানে চার বর্ণের যে শোষণ, সেটি থাকা খুবই স্বাভাবিক।

শেষে বলি লেখক অনেক পরিশ্রমসাধ্য কাজটি করেছেন। জাত পাতের বিষয়টিকে তিনি শুধু একাডেমিক স্তরেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। এর বাস্তবিক অভিঘাতগুলো আমাদের সমাজকে কিভাবে পেছনে টেনে রেখেছে তার ভুরি ভুরি উদাহরণ তথ্য সহকারে দিয়েছেন। খুব ভালো লাগে যখন তিনি সংরক্ষণ নিয়ে নানা আপত্তিগুলোকে যুক্তি নির্ভর “অন্য কথা” দিয়ে একের পর এক সাজিয়েছেন।

বইটি প্রগতিশীলদের কাছে এবং তপশিলি জাতি ও তপশিলি জনজাতি ছেলেমেয়েদের কাছে এক বিশেষ মাত্রা বহন করে। এই বই তাদের চিন্তা ও চেতনাকে নানা দিক থেকে সমৃদ্ধ করবে। বেশি বেশি করে আমাদের ছেলেমেয়েরা ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের সমাজ ব্যবস্থায় জাত পাতের বিষয়টিকে নিয়ে আসুক এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে তারা নতুন নতুন রাস্তার সন্ধান করুক যাতে সব ধরনের বৈষম্যহীন সমাজ তারা দেখতে ও দেখাতে পারে ।

লেখক দেবেশ দাশকে আরো একবার কুর্নিশ এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বই বাংলা ভাষায় লেখার জন্য।

You may also like