কালীপদ কেরানীর কথা

by হরি পদ দাস

কালীপদ বাবু কেরানীর চাকরি করেন কোচবিহারের কোন এক অফিসে। যত সামান্য বেতনে তার পরিবারের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে তারা সংসার। কালীপদ বাবুর স্ত্রী জটিল রোগে ভুগছেন। শরিরের অবস্থা খুবই খারাপ। জিন্ন কায় দেহ। তার হাড়গুলো সব বেরিয়ে আছে শুধু চামড়া দিয়ে ঢাকা। কালীপদ বাবু প্রতিদিন সকাল নয়টার অফিসে যাওয়ার সময় স্ত্রীর হাতে যত সামান্য খাবার খেয়ে ধুতি পাঞ্জাবি পরে বগলে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে যান ধুপগুড়ি রেল স্টেশনের দিকে ট্রেন ধরে কোচবিহার অফিসে যাওয়ার জন্য ।কালীপদ বাবুর অভাবের সংসার। এর মধ্য ছেলে মেয়েকে উচ্চ শিক্ষিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে, ছেলে ও বি, এ ফাইন্যাল দেবে।এরমধ্য দুজনের পরীক্ষা হয়ে গেছে।


কিছু দিনের মধ্য দুজনের পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। দুজনেই ভালো ভাবে পাস করেছে।এই সুখবর ছেলে মেয়ে দুজনেই প্রথমে মাকে জানায়।কলিপদ বাবুর অফিসের কাজ শেষ করে কোন কোন দিন বাড়িতে ফিরতে দেরি হয়ে যায়।নিউ কোচবিহার রেল স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে যখন ধুপগুড়ি স্টেশনে নামেন কখনো কখনো রাত বারোটা একটা হয়ে যায়। সেই সময় কোন রিকশা বা টুকটুকি পাওয়া যায়না।তাই পায়ে হেঁটে বাড়ির পথে ফিরতে হয়।গভীর রাতে রাস্তা দিয়ে চলার সময় পায়ের থপ থপ শব্দতে রাস্তার কুকুর গুলো জড়ো হয়ে চিৎকার করে ধেয়ে আসে তার দিকে। তবুও কালীপদ বাবু হেঁটে চলেছেন আপন মনে বাড়ির দিকে।বাড়িতে তার স্ত্রী চিন্তা করছে স্বামীর ফিরতে দেরি দেখে।দুয়ারে বসে থাকেন। চেয়ে থাকেন পথ পানে।এমন সময় কালীপদ বাবু দরজার কড়া নেড়ে স্ত্রীর নাম ধরে ডাকছে ।স্বামীর কণ্ঠস্বর শুনে দরজা খুলে স্বামীকে দেখে শান্তি পেলেন অন্তরে।একই বলে হৃদয়ের ভালোবাসার টান।স্ত্রী স্বামীকে বলেন খুশির খবর আছে।খুশির খবরটা কি বলবে ছেলে মেয়ে দুজনেই পরীক্ষায় পাস করেছে। অভাবের সংসারে কিছুটা হলেও খুশির হওয়া বয়ে নিয়ে এনেছে তারা।যাক ছেলেটা বিএ পাস করেছে এবার হয়তো একটা চাকরি জোগাড় করে সংসারের হাল ধরতে পারবে।মেয়েটি মাধ্যমিক পাস করেছে।মেয়েও বড়ো হয়েছে।ওকেও বিয়ে দিতে হবে। চিন্তা আরো বেড়ে গেল।কালীপদ বাবুর ছেলে চাকরির জন্য দফতরে দফতরে ঘুরে ঘুরে কোথাও চাকরির সন্ধ্যান পেলনা।



এদিকে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য দেখাশুনা চলছে। কিছু দিনের মধ্য মেয়ের বিবাহ ঠিক হয়ে গেলো। দিন তারিখও ঠিক হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে মেয়ের বিবাহ সম্পন্ন করলেন। এদিকে কালীপদ বাবুর যা জমানো অর্থ ছিল মেয়ের বিয়েতে সব খরচ হয়ে গেছে। সংসারের অবস্থা আরও খারাপ হলো। কালীপদ বাবুর
ছেলে মা বাবার কষ্ট দেখে চাকরি না পেয়ে সংসারের হাল ধরার জন্য ট্রেনে হকারি শুরু করলেন।কখনো নিউ জলপাইগুড়ি থেকে নিউ কোচবিহার।আবার কখনো নিউ কোচবিহার থেকে নিউ এন জি, পি পযন্ত। এর মধ্য ছেলের উপার্জনে সংসারের হাল অনেকটাই ভালো হয়েছে। আগের থেকে এখন খেয়ে পরে বেচেঁ আছেন।

এর মধ্যে হঠাৎ একদিন কালীপদ বাবুর মাথায় বাজ পড়লো। মেয়ের শশুর বাড়ি থেকে খবর এলো তার মেয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে।খবর পেয়ে কালীপদ বাবু পাগলের মতো ছুটলেন মেয়ের শশুর বাড়িতে। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন শশুর বাড়ির শশুর শাশুড়ির স্বামীর অত্যাচারে আত্নহত্যা করেছেন।

কালীপদ বাবু এমনি একজন অসহায় গরীব মানুষ।তার টাকা পয়সা খরচ করার মতন সামর্থ্য নেই।থানা পুলিশ ও আদালতে যাওয়ার ক্ষমতা নেই।তাই তিনি মনকে বুঝ দিলেন যে মেয়েকে আর ফিরে পাবনা কোন দিন কোন কালে।তাই ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দিলাম। এর বিচার তুমি করো।মেয়ের মৃত্যুর শোক ভুলতে না ভুলতে।ছেলে রেলে হকারি করতে গিয়ে ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে রেলে কাটা পড়ে মারা যায়।পুত্রের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে বলছেন আমার এক মাত্রা পুত্র সেও আমাদের ছেড়ে চলে গেলো।হে ঈশ্বর এই দৃশ্য দেখার আগে আমাকে কেনও নিয়ে গেলে না।কেন আমায় বাঁচিয়ে রাখলে? এই কি তোমার বিচার!

এই ভাবে কেটে গেলো অনেক গুলো মাস। ধীরে ধীরে পুত্র শোক ভুলে তিনি কর্ম স্থলে ও অফিসে যাওয়া শুরু করলেন ।কালীপদ বাবুর স্ত্রীও পুত্র কণ্যার শোকে তার শারিরিক অবস্থা অবনতি হতে লাগলো।কালীপদ বাবু তার স্ত্রীকে নিয়ে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।সেখানে ডাক্তার দেখানোর জন্য।ডাক্তার বাবু তার স্ত্রীকে ভালো করে দেখে অনেক গুলো পরীক্ষা করতে বলেন।রিপোর্ট দেখার পর ডাক্তার বলবেন তার কি হয়েছে।কালীপদ বাবু তার স্ত্রীকে নিয়ে আসেন একটি ল্যাবে। তার সব পরীক্ষা করানো হয়।সব রিপোর্ট নিয়ে কয়েক দিনের মধ্যে ডাক্তার বাবুর কাছে ছুটে আসেন।ডাক্তার বাবু রিপোর্ট দেখে কালীপদ বাবুকে ডেকে নিয়ে আসেন।ডাক্তার বাবু বলেন আপনার স্ত্রীর ক্যান্সার ধরা পড়েছে। আরো অনেকে আগে আনা প্রয়োজন ছিলো। এখন আমার কিছু করার নেই।আপনার স্ত্রীকে এ বিষয়ে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। যত দিন বেচেঁ থাকবে তাকে কোন ভাবে মানসিক আঘাত দেবেনা।আর যা খেতে চায় খাওয়াবেন।সব সময় হাসি খুশি আনন্দতে রাখবেন।



যে কদিন বেচেঁ থাকবে যা খেতে চায় তাই খাওয়াবেন আর সব সময় আনন্দের মধ্য রাখবেন।আর যা ঔষধ লিখে দিলাম সময় মতো খাওয়াবেন। কালীপদ বাবু স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলেন।

এই ভাবে কেটে গেলো কয়েক মাস।আরও অবনতির দিকে চলে যাচ্ছে তার স্ত্রী। হঠাৎ করে একদিন যন্ত্রণায় ছট ফট করতে থাকে আর মাঝে মধ্যে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।এই ভাবে চলতে থাকে অনেকক্ষণ।কিছু সময়ের মধ্যে আমাদের মায়া মমতা ত্যাগ করে পৃথিবী ছেড়ে অজানা দেশে পাড়ি দিলেন।

কালীপদ বাবু স্ত্রীকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন আর বলছেন হারিয়ে ফেলেছি আমার জীবন সঙ্গীকে। আর তো ফিরে পাবনা কোন দিনও কোন কালে। কালীপদ বাবু কেঁদে কেঁদে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে হাত দুখানি উপরে তুলে বিধাতাকে বলছে, এ তোমার কেমন বিচার। স্ত্রী,পুত্র কন্যাকে নিয়ে গেলে।শুধু বাঁচিয়ে রাখলে আমায়।এই যদি তোমার বিচার হয়, কেনো পাঠিয়ে ছিলে আমায় এই পৃথিবীতে!

You may also like