রিপা সর্দার
কেনিয়া ভয়ংকর (রহস্য উপন্যাস)
সোনিয়া তাসনিম খান
মলাট মূল্য- ৩৫০ টাকা
প্রকাশনী- শিখা প্রকাশনী
প্রকাশকাল- অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২
নামটার সাথে এক গা শিরশিরে অনুভূতি জড়ানো। উপন্যাসটি মূলত একটি রহস্য উপন্যাস। গল্পের পটভূমি কেনিয়ার মাসাই অধূস্যিত ছোট্ট একটি প্রত্যন্ত গ্রাম কগেলো-র ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। নিরিবিলি, নিপাট এই গ্রামের কোল ঘেঁষে থাকা সবুজ অরণ্য আলোকিত করে থাকা বন্য পশুদের মাঝে কিছু পশু হঠাৎ রহস্যজনক ভাবে মারা পড়তে শুরু করে। তবে ওদের মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্নয় করা যাচ্ছিলো না কোনমতে। ব্যাপারটা আদৌ পশু চোরাচালান কিনা সেটা খুঁজে বের করতে হিমশিম খেতে হচ্ছিলো স্থানীয় আইন রক্ষী বাহিনীদের। আর ঠিক সেই সময়টাতে কেনিয়ায় আগমন ঘটে ভ্রমণ পিপাসু রহস্য অনুসন্ধানকারী “ব্রেভার্স” খ্যাত জুটি অ্যারেন এবং ঊষার। আর সঙ্গত কারণেই এই ডিটেকটিভ যুগল জড়িয়ে পড়ে এই দুর্বোধ্য কেসের সাথে।
তবে রহস্যের মেঘ যেন ক্রমেই আরো ঘনীভূত হয়ে পড়ে কগেলোর নির্মল আকাশে। রহস্যজনক ভাবে পশুমৃত্যুর সাথে এবার যুক্ত হয় গরু চুরির মতো ভয়ানক ঘটনা। রহস্যের তীর তার দিক পরিবর্তন করে নিতে শুরু করে ক্ষণে ক্ষণে। আর এসব বিচিত্র সমস্যা থেকে সমাধানের পথটা কী করে বের করে নেয় এই “ব্রেভার্স” জুটি সেটাই দেখানো হয়েছে গোটা উপন্যাস জুড়ে।
বইটি সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন সত্যি করে বলতে গেলে, এক কথায় অসাধারণ। শুরুতে বলতে চাই, নামকরণের ব্যাপারটা৷ আর এখানে স্বীকার করতেই হয় যে, কাহিনীর সাথে “কেনিয়া ভয়ংকর” নামটা একদম জব্বর ভাবে মিলে গিয়েছি৷ বিশেষ করে “ব্রেভার্স” আর “ভয়ংকর” এই দুই বিপরীত শব্দের মাঝে যে এত অনন্য মিশ্রণ ঘটানো সম্ভব তা সত্যি বইটি পড়বার পর বোধগম্য হলো।
আর উপন্যাস বিশ্লেষণে যে ব্যাপারটা আমার চমৎকার লেগেছে, তা হলো, বইটা ধরতে গেলে একটা মিনি ভ্রমণ গাইড হিসেবেও বিবেচনা করা যায়। কেনিয়া দেশটি সম্পর্কে এত খুঁটিনাটি এবং বিস্তারিত সাবলীল আলোচনা যে এখানে রয়েছে তা এক কথায় অসাধারণ। বলতে দ্বিধা নেই যে, কেনিয়া ভ্রমণের সুযোগ যদি ভবিষ্যতে আমার কখনও মিলে যায় তবে এই বইটি যে যোগ্য সহযোগী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করে নিতে পারবে সে বিষয়ে আমি শতভাগ নিশ্চিত।
আর হ্যাঁ। একটা ব্যাপার তো না বললেই নয়। উপন্যাসটিতে কেনিয়ার কিছু লোকাল ভাষা এখানে লেখক অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দারুণ ভাবে প্রয়োগ করেছেন যা সত্যি লেখনীতে একটা বাড়তি মাত্রা জুড়ে দিয়েছে। এছাড়াও পুরো বইয়ে কেনিয়া নামক এই ক্ষুদ্র দেশটির কৃষ্টি, সংস্কৃতি, খাদ্যাভাস, পোশাক পরিচ্ছদ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রাঞ্জল বর্ণণা সত্যি মুগ্ধ করবার মতো।
এখন আসি, রহস্য বিষয়ে আলোকপাত করে নিতে। বলাবাহুল্য, উপন্যাসটি যেহেতু রহস্য নির্ভর সুতরাং পাঠক হিসেবে এটির কাছ থেকে চাহিদা ছিলো অনেক বেশি। আর সেক্ষেত্রে লেখক আমাকে নিরাশ করেনি এতটুকু। বরং আমি মনে করি, লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ বিষয়ে সফল হয়েছেন। কাহিনীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ ঘটনার প্রারাম্ভ, কাহিনী বিন্যাস এবং এদের মাঝে সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে অত্যন্ত সুচারুভাবে এবং এক্ষেত্রেও লেখক তার মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন শতভাগ। পাশাপাশি ঘটনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আরো অনেক অজানা তথ্য এখানে জানানো হয়েছে সুনিপুন ভাবে৷
এরপর যে বিষয়টা আলোচনার দাবীদার তা হলো, গল্পের কেন্দ্রীয় দুই চরিত্রের মাঝে রসায়ন তৈরীর বিষয়টা। গল্পের প্রধাণ দুই চরিত্রের একজন ইউরোপীয় এবং একজন এশিয়ান। খুব সাধারণ বিষয়। এমন নয় যে এমনটা অন্য কোন বইয়ে দেখা যায় না। অবশ্যই যায়। কিন্তু এই কাহিনীর মাঝে এই দুয়ের ভেতর চমক সৃষ্টি করা হয়েছে অত্যন্ত আদরে আর যত্নে। সীমানা পার করে নিয়ে ভিন্ন দুই জাতীয়তার মাঝে যে এক নিটোল অনুভূতির গল্প লেখক তার কলমে ফুটিয়ে তুলেছেন সেটি বাস্তবিকই হৃদয় ছুঁয়েছে প্রবল ভাবে৷ বিশেষ করে অ্যারেনের লাজুক ব্যক্তিত্ব এবং ঊষার চঞ্চলতা এই দুই ভিন্ন স্বভাবের মধ্যে লেখক এক অনন্য আবেগ স্পর্শ তার কলমে ছুঁয়ে দিয়েছেন একদম রঙতুলির মতোই।
পরিশেষে বলতে চাই, লেখকের লেখনীর বিশেষত্ব নিয়ে কিছু কথা। উপন্যাসটির আকর্ষণীয় বাক্য বিন্যাস পড়বার আগ্রহকে দ্বিগুণ করে তুলেছে। সাথে শব্দ চয়নের ব্যাপারটা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য৷ প্রতি বাক্যে লেখক শব্দ বৈচিত্রের যে বিপুল সমাহার ঘটিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার।
আর বইটির ভাষাগত মানের সাথে গুণগত মানটাও দুর্দান্ত। বইটি প্রকাশিত হয়েছে স্বনামধন্য প্রকাশনী শিখা প্রকাশনী থেকে। বইটির মুদ্রণ থেকে শুরু করে এর অনিন্দ্য সুন্দর প্রচ্ছদ পাঠকের কাছে এটির আবেদন বাড়িয়ে তুলেছে আরো বলিষ্ঠ ভাবে। এজন্য প্রকাশনীকেও বাহবা দিতে হয় বৈকি।
রহস্যরসে টইটম্বুর এই চমৎকার বইটি এবং এই প্রিয় নবীন লেখক সোনিয়া তাসনিম খানের জন্য রইলো অবিরাম শুভেচ্ছা এবং শুভকামনা।