আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়

ছোটদের আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র
খগেন্দ্রনাথ মিত্র
দে’জ পাবলিশিং
প্রথম দে’জ সংস্করণ -১৯৯৭ (পুনর্মুদ্রণ ২০১৮)
বিনিময় মুল্য-৫০ টাকা

“যে সত্য কেবলমাত্র বাক্যে নিবদ্ধ, তদপেক্ষা যে সত্য জীবনে পালিত হয় তাহা ঢের বেশি শক্তিশালী।”
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়

প্রথমেই লেখক খগেন্দ্রনাথ মিত্র ও দে’জ পাবলিশিং অনেক ধন্যবাদ দিই এ ধরনের একটি বই ছোটদের উপহার দেওয়ার জন্য। আজকের দিনের শৈশব হারানো ও বাংলা না বলতে পারা ও বাংলা না পড়তে পারা শিশুরা এবং তাদের সদাব্যস্ত ও সবপাওয়া বাবামারা হয়ত এই বই ছুঁয়েই দেখবে না। বাংলা বই! ছ্যা! শয়নে ও স্বপনে আমেরিকা ঘুরে ঘুরে আসছে, তাড়া করছে আমাদের মানিমেকিং ছেলেমেয়েদের ও তাদের স্বনামধন্য বাঙালি বাবামায়েদের। বাঙালি খেদাওয়ের দেশে বাঙালি পরিচয় মুছে ফেলে আমরা বাঙালিরা হিন্দু আর মুসলিম হয়েছি। সে বাংলায় এ বই অপাংক্তেয় তো হবেই।

যাইহোক, লেখকের নিজের কথায় বইয়ের কিছু কথা তুলে ধরতে চাইছি। প্রফুল্লচন্দ্র কী ধরনের মানুষ ছিলেন, বিজ্ঞানে কী তাঁর অবদান? সবই আপনারা জানেন। কিন্তু আমরা কজন তাঁকে মনে রেখেছি।

উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে যখন বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, কেশব চন্দ্র সে্ন, বঙ্কিমচন্দ্রের মতো মহাপুরুষগন বাংলা তথা ভারতবর্ষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যেতে সদা জাগ্রত ঠিক সেই সময় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় নামক অপর এক স্বনামধন্য মহামানবের কল্যাণ স্পর্শে বঙ্গভূমি ধন্য হয়েছিল। তিনি ছিলেন একজন ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি নিজেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন, “আমি বৈজ্ঞানিকের দলে বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী সমাজে ব্যবসায়ী, গ্রাম সেবকদের দলে গ্রাম সেবক আর অর্থনীতিবিদদের মহলে অর্থনীতিজ্ঞ।” সাহিত্যের প্রতিও ছিল তার প্রবল আগ্রহ।

প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জীবন দর্শন আমাদের অভিভূত করে, অনুপ্রাণিত করে। ভাবতে অবাক লাগে যে তিনি বনেদি পরিবারের সন্তান হওয়া সত্বেও অনাড়ম্বর সহজ সরল জীবন যাপন করতেন। শৈশবে কিন্তু তিনি ছিলেন ভারী দুরন্ত, লাগামহীন ছুটন্ত ঘোড়ার মত। তাকে আটকায় কার সাধ্য। তার দৌরাত্ম্যে, দস্যুপনায় পাড়াপড়শিরা সব সময় অস্থির হয়ে থাকতো। নালিশ শুনতে শুনতে তাঁর বাবার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতো। কিন্তু দুরন্ত হলে কি হবে বুদ্ধি ছিল চমৎকার। সব বিষয়ে অত্যন্ত তুখোড় ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব।

পড়াশোনার প্রতি ছিল তার গভীর ভালোবাসা। বিদ্যালয়ের পাঠ্যবই ছাড়াও অন্যান্য বই পড়েও তিনি আনন্দ পেতেন ।বিশেষ করে তাকে বেশি আকর্ষণ করত ইতিহাস ও চরিত্কথা। অতীতের ঘটনা বলি, মহাপুরুষদের জীবনী এসবের মধ্যেই তিনি ডুবে থাকতেন। মন ভেসে যেতো কোন সুদূর অতীতে। পড়াশোনার প্রতি নেশা কেড়ে নিয়েছিল তার চোখের ঘুম। রাত তিনটে কি চারটে মানুষ তখনও ঘুমের দেশে, চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজমান, তিনি তখন আলো জ্বেলে একা বসে এক মনে বই পড়ে চলেছেন, যেন কোন তাপস বালকের ভোরের তপস্যা। মনে জ্ঞান লাভের অদম্য পিপাসা। আরও গ্রন্থ চাই আরও জ্ঞান চাই।

প্রফুল্লচন্দ্র রায় মাত্র ৯ বছর বয়সে কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হলে তিনি মেট্রোপলিটন কলেজে ভর্তি হন। সেখানেই বাংলার গৌরবময় স্বদেশী যুগের “মুকুটহীন রাজা” অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহস্পর্শে ধন্য হয়েছিলেন। আমাদের এটা মনে হতেই পারে যেহেতু তিনি বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন তাই হয়তো ছোট থেকেই তার বিজ্ঞানের প্রতি ঝোঁক ছিল কিন্তু এমনটি নয়। তার মন ঘুরে বেড়াত প্রাচীনকালের লোকরাজ্যে। তিনি বলেছিলেন “আমি ভুল করে রসায়নবিদ হয়েছি।” তার ঐতিহাসিক হওয়ায় উচিত ছিল। ইতিহাস ভালো লাগতো বলেই হয়তো তিনি লিখেছিলেন “হিন্দু রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস।”‌‌ বিস্মৃতির অতল গহ্বর থেকে তিনি খুঁজে বার করলেন রসায়ন শাস্ত্রে প্রাচীন ভারতের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।

প্রেসিডেন্সি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলেকজান্ডার পেডলারের ক্লাসে মুগ্ধ হয়েই হয়তো তিনি ঝুঁকেছিলেন রসায়নের দিকে। বিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তিনি বিলেত যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। কিন্তু তখনকার দিনে ভারতবর্ষের সমাজ ব্যবস্থা ছিল বড় অন্তরায়, কুসংস্কারের পাঁকে নিমজ্জিত। “কালাপানি”পার হলেই জাত যেত। যদিও প্রফুল্লচন্দ্রের কাছে এটা খুব একটা বড় বাধা ছিল না। কারণ তাঁর মাতা পিতা ছিলেন উদার উচ্চ মননশীলতার অধিকারী। অতঃপর “গিলক্রাইস্ট বৃত্তি” ও দু চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি দিলেন বিদেশ।

প্রবল ইচ্ছা শক্তি, ভালোবাসা ও লেগে থাকা এগুলোই হচ্ছে অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার চালিকাশক্তি। তিনি বিলেতে ছিলেন ছয় বছর। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেন D.Sc (ডক্টর অব সায়েন্স) উপাধি।

প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের দেশ ভক্তি, দেশের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে ইউরোপ থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বাধ্য করেছিল। দেশে ফিরে প্রেসিডেন্সি মহাবিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপকের পদ লাভ করলেন। শুরু হলো জীবনের এক নতুন অধ্যায়। বিলেত ফেরত হলেও তিনি হাবে ভাবে সাহেব হয়ে ওঠেননি কোনদিনই। তিনি ছিলেন এক্কেবারে খাঁটি বাঙালি। ক্লাসে বাংলায় লেকচার দিতেন। বাংলা ভাষা তার অস্তিত্বের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। তার বাচনভঙ্গি ছিল অসাধারণ যার দ্বারা তিনি ছাত্রদের খুব সহজে মন জয় করে নিতেন।

তিনি প্রকৃতই ছিলেন স্নেহপরায়ণ ও মানব দরদী। বাঙালি জাতির অন্নকষ্ট, অন্নচিন্তা তাঁকে সারাজীবন বিচলিত করেছিল। বাঙালি বেকার যুবকদের নিয়ে তাঁর চিন্তার অন্ত ছিল না। কেড়েনিয়েছিল চোখের ঘুম, ব্যথিত করেছিল হৃদয়কে। সমস্যার সমাধান খুঁজেছিলেন তিনি নানাভাবে। ব্যবসা-বাণিজ্য করে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার উপদেশ দিয়েছিলেন। তিনি গড়ে তুললেন বিখ্যাত ওষুধের কারখানা “বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস।”

মাড়োয়ারি ও ভাটিয়ারা কিভাবে বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য করে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করছেন অথচ বাঙালি যুবক বেকার, ঘরে ঘরে অন্ন কষ্ট -যা তার হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে তুলেছিল। দেশ ও জাতির কথা চিন্তা করে তিনি লিখেছিলেন “বাঙালির মস্তিষ্ক ও তার অপব্যবহার।” তাঁর অপর একটি গ্রন্থের নাম “বাঙালির অন্নসমস্যা।” তাঁর উপলব্ধিতে ধরা পড়েছে বাংলার এক করুণ দৃশ্য-মাড়োয়ারি ও ভাটিয়ারা বাংলা থেকে প্রচুর ঐশ্বর্য সঞ্চয় করছেন কিন্তু তাদের দ্বারা বাংলার কোন উপকার হয় না। এ প্রসঙ্গে তিনি অভিমান করে বলেছেন যে ব্রিটিশরা যতদিন বাংলায় থাকে ততদিন খানসামা, বাবুর্চি, আয়া প্রভৃতির বেতন এবং মুরগি, ডিম, মাছ প্রভৃতি কিনিয়া কিছু টাকা বাংলায় দেয় অথচ মাড়োয়ারিরা এদিক থেকেও বাংলাকে এক পয়সা দেয় না। সে তাহার খাদ্য, আটা, ডাল, ঘি প্রভৃতি নিজের দেশ হইতে লইয়া আসে। তাহার ভৃত্যেরাও হিন্দুস্থানী ও নিরামিষভোজী।” এ কথায় তাঁর প্রাদেশিকতার গন্ধ অনেকেই পেতে পারেন। কিন্তু বাঙালির পরাজয়ের ছবি এর থেকে ভালভাবে আর কে দেখাতে পেরেছেন!

তিনি প্রকৃত ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক। জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা, কুসংস্কার দূরীকরণে সারা জীবন তিনি অন্তহীন প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। জাতিভেদ প্রথা হলো এমন একটি সমস্যা যার অভিশাপ থেকে আজও ভারতবর্ষ মুক্ত নয়। জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা একটি জাতির প্রগতির পথে বড় বাধা, বড় অন্তরায়। আমরা এই একবিংশ শতাব্দীতে পারিনি এসবের উর্ধ্বে উঠতে, পারিনি কুসংস্কার ও হিংসা মুক্ত উচ্চ মননশীলনের অধিকারী হতে। এখানে প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের একটি উক্তি না টানলেই নয়। তিনি আক্ষেপ করে লিখেছেন, “আমি ক্লাসে এত করিয়া ছাত্রদের পড়াইলাম, যে পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপরে পড়িয়া চন্দ্রগ্রহণ হয়। তাহারা তা পড়িল, লিখিল, নম্বর পাইল, পাস করিল কিন্তু মজার ব্যাপার হইল যখন আবার সত্যি সত্যি চন্দ্রগ্রহণ হইল তখন চন্দ্রকে রাহু গ্রাস করিয়াছে বলিয়া তাহারা ঢোল, করতাল, শঙ্খ লইয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল ইহা এক আশ্চর্য ভারতবর্ষ।”

মানুষ আজ তার মনুষ্যত্ববোধ হারিয়ে ফেলেছে। চারিদিকে নৈতিকতার অধঃপতন, আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর মানুষ হয়ে উঠেছে ‘আমি’ সর্বস্ব। জাতপাতের ভেদাভেদ, হিংসা ও হানাহানি এগুলো যত দিন যাচ্ছে ততই আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে। এই দুর্যোগময় দিনে মানবজাতির ভাগ্যাকাশে যে অশনি সংকেত দেখা দিয়েছে তা থেকে মুক্তি পেতে এইসব মহান মনীষীদের জীবনী আমাদের অনুপ্রাণিত করবে। সঠিক পথের সন্ধান দেবে।

শেষে বলি বইটি ছোটদের জন্য লেখা হলেও বড়দের কাছেও এটি সুখপাঠ্য হতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।

You may also like

Vinnokatha
Prothom Khondo
Price: Rs.260/-
www.vinnokatha.in
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে। সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে।সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
Vinnokatha
Prothom Khondo