মুরোদ

বৌ ফুলমালা কথায় কথায় বলে, “বৌ ছেল্যেরে খাওয়ানির মুরোদ নাই তো বে ‘করছিলে ক্যান?”

   কথাটা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলেও কোনও উত্তর দেয় না সুফল। একরাশ মন খারাপি নিয়ে সে বসে থাকে দাওয়ায়। বসে বসে আকাশ দ্যাখে। আকাশের মেঘ, পাখি, রোদ্দুর দ্যাখে। আবার কখনো চোখ দুটো নামিয়ে গাছপালা দ্যাখে। গাছের পাতায় বাতাসের নড়াচড়া দ্যাখে। অনেক কিছুই সে দ্যাখে। কিন্তু ফুলমালার মুখটা দেখার সাহস হয় না। তাকানোর কথা ভাবলেই ভেতর থেকে কেউ যেন বলে ওঠে,” তাকাস নি সুফল। তোর বৌডার যা মেজাজ তাতে চোখ দে-ই তোরে গিল্যে খাবে।”

অথচ এমনটা ছিল না ফুলমালা। সে কত ভালবাসতো সুফলকে। কত ভালো ভালো কথা বলতো। কতসব ভালো ভালো স্বপ্ন দেখতো। নতুন একখানা ঘর। সাজানো গোছানো সংসার। ভালোভাবে খেয়ে পরে বেঁচে থাকা। অথচ ছেলেটা জন্মাতেই সব যেন কেমন একটা হয়ে গেল। কদিনেই কেমন পাল্টে গেল বৌটা। সারাদিন খিটখিট করে। একটু এদিক ওদিক হলে কথা শোনায়। শুনতে শুনতে এক এক সময় মেজাজটা বিগড়ে যায় সুফলের। তাও চেষ্টা করে চুপ করে থাকার। কিন্তু সব সময় পারে না। এক একটা সময় সুফলের অজান্তেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে,” যাও না, যার মুরোদ আছে তার কাছে যাও।”



কথাটা বলতে পেরে রাগটা কমে আসে খানিক। কিন্তু কথার যে ঝড় ওঠে তাতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয়না সুফলের। দাওয়ার এক কোণে দড়িতে ঝোলানো গামছাটা কাঁধের একপাশে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে কখনও হয়তো মাঠের দিকে চলে যায়। কখনও খালপাড়ে। কখনও আবার রাস্তা দিয়েই হেঁটে আসে কেবল।

   এক একটা সময় ফুলমালার কথায় রাগ হলেও কখনও সখনও মনে হয়, না, বৌটার কোনও দোষ নেই তার। এমন হলে যে কোনও মেয়ে মানুষই কথা শোনাবে। সব মেয়েই তো চায় সংসারের পুরুষ মানুষটা খেটেখুটে সংসারের হাল ধরে রাখুক। দুইবেলা পেট পুরে চাট্টি খেতে দিক। একটু ভালো পরতে দিক। এটা ফুলমালাও চায়। কিন্তু সংসারটা খেটেখুটে সেই তাকেই ঠিক করে রাখতে হয়। সে ঘু্ঁটে দেয়। গোরু, ছাগল, হাঁস- মুরগি পোষে। আবার সুযোগ পেলে এর ওর হাতের কাজটা করে দেয়। সংসারটা চলে বলতে গেলে তারই আয়ে। আজন্ম রোগাটে মানুষ সুফল। নিত্যদিন কাজ থাকে না তার। তার এমন শুটকো চেহারায় কাজে নিতে ভরসা পায় না কেউ। তাছাড়া সবাই মনে করে, ‘সুফল হলো জম্মের আলসে’। সুফলের নিজের অবশ্য তা মনে হয় না। সে চায় মানুষ তাকে কাজে নিক। কাজ সে করতেই চায়। কিন্তু  – 

   বাড়িতে কতক্ষণ আর শুয়ে বসে থাকা যায়। সুফল তাই বেরিয়ে পড়ে মাঝেমধ্যে । এ পাড়া, ও পাড়া, মাঠ, খালপাড় ঘুরে আসে। কোনওদিন এমনিই যায়। কোনওদিন কাজের খোঁজে। তেমন সে আজও বেরিয়েছিল। কাঁধে গামছা, হাতে কাস্তে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোজা চলে গিয়েছিল দক্ষিণ পাড়ায় সাবু বিশ্বাসের বাড়ি। মানুষটার অনেক জমি-জমা। সারাবছর ক্ষেতে ফসল ফলে। তার জমিতে কাজ করে সংসার চালায় কতজন।

   ভোরের আলো তখন সবে ফুটি ফুটি। রাতের আঁধার সরে গিয়ে চারপাশে বেশ একটা ফর্সাটে ভাব। জন মুনিষ পথে বের হতে শুরু করেছে। চারদিকে দিন শুরুর ব্যস্ততা।

   সাবু বিশ্বাসের বয়স তিন কুড়ি পেরোতে চললো। মাথার চুল বেশিরভাগই তার পেকে গেছে। গায়ের চামড়াও মাংস থেকে ঝোলা ঝোলা ভাব। চোখদুটো আগের থেকে অনেক বেশি ঘোলাটে। সেই ঘোলাটে চোখে ঘুমের উপস্থিতি বড়ই কম। তার ওপর আবার ধান কাটার ভরা মরশুম। অন্ধকার থাকতেই জন মুনিষ আসতে শুরু করে দেয় বাড়িতে। বেলা ওঠার আগেই দিনের কাজ বুঝিয়ে দিতে হয় তাদের। এজন্যেই মোরগের ডাকে নিত্যদিন ঘুম থেকে ওঠেন তিনি। উঠে পায়খানায় যান। সেখান থেকে বেরিয়ে দাঁত ব্রাশ করে চোখ মুখ ধুয়ে প্লাস্টিকের পুরনো চেয়ারটা পেতে দাওয়ায় বসেন। বসতে না বসতেই একে একে নাদু, হারু, পরেশ, টেপা, রাজু, গানশারা আসতে শুরু করে। সবাই তারা সাবু বিশ্বাসের মুনিশ। বছর ভর এই বাড়িতেই কাজ করে।

   সাতসকালে সুফলকে দেখে একপ্রকার বুঝি অবাকই হয়েছিলেন সাবু বিশ্বাস। জিজ্ঞেস করেছিলেন,”সুফল দেখি যে। তা চললি কোথায়?”
   প্যাংলা মুখে দাঁত বের করে হেসেছিল সুফল,”  আর কুথায় যাবো। আপনের কাছেই আলাম।”

   “কেন রে? হঠাৎ আমার কাছে? ব্যাপার কি?”

   ” ব্যাপার তো এট্টাই। কাজ।”

   ” কাজ?”

   ” হঃ,আমারে যদি কাজে নেতেন।”

   খল খল করে হেসে উঠেছিলেন সাবু বিশ্বাস,”  তোর যা শরীর তা দেখে যে কাজে নিতে ভরসা পাই নে রে। কখন পাট কাঠির মত ‘মট’ করে ভেঙে যাস। তারপর যত দোষ তো সেই আমারই হবে। তোর যা বৌ। আর সবাই ছাড়লেও সেকি আমায় ছাড়বে?

    ততক্ষণে নাদু, হারু, টেপা রা জনাকয়েক এসে গেছে। বিশ্বাস মশাইয়ের কথায় শব্দ করে হেসে উঠেছিল তারা। আর বলেছিল, “বেশ কইছেন বাবু।”

   সাবু বিশ্বাসের কৌতুক করার ইচ্ছেটা বেড়ে গিয়েছিল খানিক। হাসতে হাসতে বলে উঠেছিলেন, “ঝড়-বাতাসের দিন। একটু সাবধানে চলাফেরা করিস। ঝাপটা দিলে কখন আবার উড়ে টুড়ে যাস।”

   তাকে নিয়ে এমন হাসাহাসি অনেকেই করে। প্রথম প্রথম বেজায় রাগ হতো। যাকে-তাকে সুফলও শুনিয়ে দিত দু’কথা। কিন্তু শুনতে শুনতে এখন গা সওয়া হয়ে গেছে তার। যে যাই বলুক তা শুনে আর রাগে না সুফল। কিন্তু সাবু বিশ্বাসের কথা শুনে আজ একটু রাগই হয়েছিল তার। একে তো কাজ দেবে না উল্টে কথা শোনাবে?

   হাতের কাস্তে হাতে নিয়েই সাবু বিশ্বাসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল সুফল। তারপর আরও কয়েকটা জায়গায় গেছে। এ বাড়ি ও বাড়িতে কাজের খোঁজ করেছে। কিন্তু সবখানেই তাকে নিরাশ হতে হয়েছে। খালি হাতে ফিরতে ফিরতে ক্লান্ত হয়ে এক সময় ফিরে এসেছে বাড়ি। আর বাড়ি ফিরেই ক্লান্ত শরীরটাকে বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে পড়েছে দাওয়ায়।

   দাওয়ায় বসতেই ফুলমালার গলা, ” কি হলো ফিরে এল্যে যে?”

   মেজাজটা খিঁচড়ে ছিল সুফলের। সে গলা চড়ালো,” আসপো না তো কি করবো?”

    গলা চড়ালো ফুলমালাও, “কি করবা মানে?”

    মুখ ঘুরিয়ে আকাশের দিকে তাকালো সুফল। এই সকাল বেলাতেই সারা আকাশ গনগনে রোদে ভর্তি। আকাশ তো নয়, যেন রান্না চড়ানো উনুন। হা মুখ আগুনে মাখামাখি। আগুন এখন সুফলের মাথাতেও। বাইরেটা যেমন পুড়ছে, তেমনি ভেতরটাও পুড়ছে তার। পোড়ানোর ইচ্ছেয় দাঁতে দাঁত চাপছে বারবার।


   ফুলমালার কথার কোনও উত্তর দিল না সুফল। আর তাতে করে আরও ক্ষেপে গেল ফুলমালা। চেঁচিয়ে বুঝি বাড়ি মাথায় করে ফেললো সে। দাওয়ায় পিঠ দিয়ে বসে থাকা সুফলের দিকে আরও কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল,” কথা কতিও কি তুমার মুখ ব্যথা করে নেকি?”

   “ধুর শালা। ” বলে দাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লো সুফল। মাঝ বোশেখের রোদ উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। দুটো শালিক হিমসাগর আম গাছের ডাল থেকে নেমে এসেছে খাবারের আশায়। ‘ধপ’ করে দাওয়া থেকে সুফল লাফিয়ে উঠে উঠোনে নামতেই আচমকা ভয় পেয়ে কিচ কিচ করতে করতে উড়ে গিয়ে ফের গাছের ডালে বসলো তারা।

   তেড়ে-ফুঁড়ে উঠল ফুলমালাও,”গাল দিবা না কইয়ে দিলাম।”

   খিঁচিয়ে উঠলো সুফল, “দেবো। একশোবার দেবো। হাজারবার দেবো।”

    মেজাজটা খিঁচড়ে  একেবারে যা তা ফুলমালার। মুখ বিকৃত করে চেঁচিয়ে উঠলো সেও,” ভাত দেওয়ার মুরোদ নাই আবার মুহে বড়ো বড়ো কথা। বউডা র আয়ে বেশতো বস্যে বস্যে খাচ্ছো। যাও না, যাওগে, ট্যাকা নে আসো না দেহি ক্যামুন মুরোদ তুমার।”

   ‘আজ হয় শালা ট্যাকা আনবো, নয় তো বাড়িই ফেরবো না।’ মনে মনে বলতে বলতে টিঙটিঙে পা ফেলে উঠোন পেরিয়ে রাস্তায় গিয়ে উঠলো সুফল।

   দিনটা গড়াতে গড়াতে সন্ধের দোরগোড়ায় এসে ঠেকেছে। খোলসের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে আনতে শুরু করেছে রোদ।  গাছের ছায়া দীর্ঘ হতে হতে ছাড়িয়ে গিয়েছে নিজের আয়তনকেও। আকাশ ভর্তি একটা ঘোলাটে রঙের আঁচ।একটা বড়ো রকমের মন খারাপি নিয়ে বসে আছে সুফল। তার পেছনে ঝিনাইখালির হাট। সামনে নদী। নদী পাড়ের গা ঘেঁষে এক চাঙর দুব্বোঘাসের ওপর গামছা পেতে বসে আছে সে। বসে বসে দেখছে নদীপথে নৌকো নিয়ে হাঁটুরেদের ফিরে যাওয়া।

হ্যাঁ ভাঙা হাট এখন। সারাদিনের বেচাকেনা শেষ করে হাটটাও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ঝিমিয়ে আসছে তার শরীর। ভরদুপুরের সেই হাকডাক কোলাহল আর নেই। নেই তেমন ভিড়। দূর-দুরান্ত থেকে হাট করতে আসা মানুষগুলো ফিরে গেছে অনেকেই। অনেকেই ফেরার জন্য ভিড় করেছে নদীর ঘাটে। এখন হাটে মানুষ বলতে স্থানীয় হাটুরে মানুষজন, বড়ো বড়ো বেপারী, তাদের কর্মচারীরা, আর হাটের স্থায়ী দোকানদার। সুফল অবশ্য এদের কেউ নয়। তবুও সে বসে আছে। সে না কিছু কিনতে এসেছে, না কিছু বেচতে। এসেছিল কোনও একটা কাজের আশায়। কিন্তু অচেনা অজানা মানুষ সুফলকে কেউ কাজ দেয়নি। অগত্যা একরাশ মন খারাপি নিয়ে সে বসে আছে। সামনে নদী। নদীর জলে ছড়িয়ে পড়েছে দিনশেষের বিষণ্নতা। দু’টো কুঁচবক উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দিকে তাকালো সুফল। ফের আবার চোখ নামিয়ে তাকিয়ে রইলো নদীর দিকে।

   সুফলের এখন পেট ভর্তি একরাশ খিদে। সেই যে কাল সন্ধে উতরোনো রাতে পাট শাকের ঝোল দিয়ে চাট্টি ভাত খেয়েছিল তার পর থেকে বারকয়েক কলের জল ছাড়া আর কিছুই পড়েনি পেটে। রাক্ষুসী খিদে তার পেট ভরাতে এখন সুফলের নাড়িভুঁড়ি নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে। এদিকে পেটভর্তি খিদে আর ওদিকে খানিক তফাতে নদীপাড়ের গা ঘেঁষে ‘নরসুন্দর ভাতের হোটেল’। এমন হোটেল আরও গোটা কতক আছে সারা হাটে।

   সবগুলো হোটেলেই এখন ভিড়। এই ভিড় থাকবে সন্ধে উতরেও।  দূর-দূরান্তের বেপারী আর তাদের কর্মচারীরা সব কাজ শেষ করে খানিক জিরিয়ে নিয়ে এসে ঢুকবে এসব হোটেলে। রুই মাছের ঝোল দিয়ে পেট ভরে খেয়ে নিয়ে তবেই নৌকা ছাড়বে। ঝিনাইখলির হাটটা আকার আয়তনে বেশ বড়ো। সপ্তাহের ছয়দিন হাট বসে এখানে। আশপাশের বিশ পঁচিশটা গাঁয়ের মানুষ তাদের ফসল বেচতে আসে এখানে। এই হাটে যেমন ধান,তিল,পাট,সরষে, কলাই  বিক্রি হয় তেমনি আলু, বেগুন, পেঁয়াজ, রসুনও বিক্রি হয়। সন্ধের আগেই শেষ হয়ে যায় বেচাকেনা। সন্ধের পর শুরু হয় গোছানো। যে সব ব্যাপারীরা নৌকা নিয়ে আসে তারা কেনা মাল নৌকায় সাজায়। অনেকেই আবার আসে গাড়ি নিয়ে। ছোট-বড়ো কত রকমের গাড়ি। সেসব গাড়ি বোঝাই হয়ে মাল চলে যায় শহরের বাজারে।

   দক্ষিণ পুবদিকের থেকে একটা ঝাপটা হাওয়া দিতেই ‘নরসুন্দর ভাতের হোটেল’ থেকে তেলঝোলে রান্নার একটা ঘ্রাণ এসে জোর ধাক্কা মারলো নাকে। আর অমনি খিদেটা যেন বেড়ে গেল আরো কয়েকগুণ। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার এদিক ওদিক তাকালো সুফল। কি জন্যে তাকালো তা সে নিজেও জানে না। আর তাই এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে ফের নদীর দিকে মন দিল।

   বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছিল সুফল তখন রাগ আর রোদের তাপে মাথার চাঁদি ফাটার উপক্রম। উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে-হাঁটতে উত্তরপাড়ার সীমানা ছাড়িয়ে চাঁপাতলা মোড়ের কাছে এসে থমকে দাঁড়িয়েছিল একবার। মনে হয়েছিল, কি দরকার এমন দুপুর রোদে পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর। তারচেয়ে ঘরের দাওয়ায় খেঁজুর পাতার মাদুর পেতে শুয়ে থাকলেই তো বেশ হয়। ভাবতে যতক্ষণ। ততক্ষণে মনে পড়ে গিয়েছিল ফুলমালার মুখখানা। যা মুখরা হয়ে উঠছে দিন দিন তাতে এখনই বাড়ি ফিরলে না জানি আরো কত কথা শুনিয়ে দেবে। হয়তো সুফলকে ফিরতে দেখেই তেড়ে উঠবে। বলবে,”  জানি তো, মুরোদ তো এই এইটুকুনই। প্যাটে খিদে লাগছে আর অমনি সুর সুর কইরে  –  “

   এটুকু বলেই ক্ষান্ত হবেনা ফুলমালা। বলে যাবে খানিক্ষখণ ধরে। যতক্ষণ না নিজেই হাঁপিয়ে ওঠে। মুখ খুললেই বিপদ সুফলের। না খুললেও। খুললে মা শ্মশানকালীর রূপ ধরবে সে।আর না খুললেও বলবে, “কি হল, মুহে অহন কথা ফোটে না ক্যান? ভারী তো রাগ দেহায়ে চল্যে গেলে। অহন আবার ক্যান  আইছো?”

   এসব মনে পড়তেই বাড়িমুখো না ঘুরে সামনের দিকেই ফের হাঁটতে শুরু করেছিল সুফল। চাঁপাতলার মোড় পেরিয়ে গোটাতিনেক বাড়ি ছেড়ে বাড়ি তারক পালের। সেই প্রাইমারি স্কুলে পড়া থেকেই তারকের সঙ্গে ভাব সুফলের। দুজনের কেউই প্রাইমারি স্কুলের গন্ডী না পেরোলেও তাদের ভাব ভালোবাসা আজ এই বয়সে এসেও দিব্যি রয়ে গেছে। মাঝেমধ্যেই দেখা হয় দুজনের। দেখা হলেই কথা হয়। ছোটবেলার কথা। বড়োবেলার কথা।

   সুফলকে দেখেই হাত ধরে টেনে বাড়িতে নিয়ে বসিয়েছিল তারক। জিজ্ঞেস করেছিল, ” ব্যাপার কি বল দেহি? এই অসুমায় যাস কুথা?”

    তো দোনোমনা করতে করতে তার এভাবে পথে বেরোনোর কথাটা বলেই ফেলেছিল সুফল। আর তা শুনে তারক বলেছিল,”অনেক তো দেকলি। তা ইবার এট্টু অন্য পথ দ্যাখ না।”

   অবাক হয়েছিল সুফল, “অন্যপথ? সিডা ক্যামুন?”

   “তুই ঝিনাইখালির হাটে যা। সিখানে অনেক কাজ। এট্টু চেষ্টা কইরে দ্যাখ। আমার মনে কয় এট্টা না এট্টা কাজ তুই ঠিকই পাইয়ে যাবি।”

    তারকের কথা শুনেই এই ঝিনাইখালিতে এসেছে সুফল। কিন্তু এসে কোন লাভ হয়নি তার। চারপাশে এত কাজ। এত মানুষের ভিড়। কিন্তু কেউই কোনো কাজ দেয়নি সুফলকে। যার কাছেই গেছে সেই বলেছে,”  না গো, তুমি অন্য কোথাও দ্যাখো।”

   তা এই দেখতে দেখতেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামার উপক্রম। ফুরিয়ে আসা বিকেলের সারা গায়ে এখন সন্ধেবেলার ইশারা। দ্রুতই রং পাল্টাচ্ছে আকাশ। একটু একটু করে অতীত হয়ে আসছে আরও একটা দিন। চারদিকে দিনশেষের বিষণ্নতা। একটা ভীষণ রকমের মনখারাপি নিয়ে বসে আছে সুফল। সামনে নদী। পেছনে হাট। চারপাশে হাটুরে মানুষের ভিড়। কিসের একটা ঘোর যেন পেয়ে বসেছিল সুফলকে। আর তখনই পেছনে কারও গলা,” বলি শুনছো?”

   ঈষৎ চমকে উঠে ঘাড় ঘোরালো সুফল। প্যান্ট জামা পরা একজন লোক সুফলের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ।” আমারে কচ্ছেন?” জিজ্ঞেস করলো সুফল।

   “হ্যাঁ তোমাকেই। তা সেই কখন থেকে দেখছি তুমি বসে আছো। কেন বলো তো?”

   ” এমনিই।”

   “এমনিই কেউ এভাবে বসে থাকে নাকি?”

   “তাহলি কি করবো কন?”

   “কাজ করবে?”

   “কাজ!”

   চমকে উঠল সুফল। একটা কাজের খোঁজেই তো এখানে আসা তার। বসে না থেকে এবার উঠে দাঁড়ালো সে।

   “হ্যাঁ কাজ। আসলে আমি একজন ব্যবসায়ী। আলু, পটল, ঝিঙে, উচ্ছে, আদা- রসুনের ব্যবসা আমার। প্রতিদিন এখান থেকে মাল কিনে আমি শহরে চালান দিই। এই হাটে আমার জনাদশেক কর্মচারী আছে। কিন্তু কাজ যা তা ওরা আর করে পারছে না। আরো জনা দুই তিন দরকার। তা তুমি যদি কাজ করো  – “

    মানুষটাকে শেষ করতে দিল না সুফল। বলল,” ইজ্ঞে কাজ তো আমি কত্তিই চাই। তা আপনে যদি দ্যান  – “

   মানুষটা যেন খুশি হলো সুফলের কথায়। বলল,”  তাহলে কাল থেকেই শুরু করো। ওই বেলা দশটার দিকে আসবে,আর রাত আটটার দিকে ছুটি। কি? পারবে না?”

   সুফলের চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক,” বেশ পারবো।”

   “তাহলে এক কাজ করো ” বলতে বলতে জামার পকেট থেকে একখানা পাঁচশো টাকার নোট বের করে সুফলের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল,” এটা রাখো। এ্যাডভান্স। পরে সুবিধামতো শোধ করে দিও।”

    কাঁপা কাঁপা হাত নোটটার দিকে বাড়িয়ে দিল সুফল। তার মনে হলো, টাকা নয়, যেন স্বপ্নকেই সে ছুঁতে চলেছে এবার।।

You may also like