সাদাত হাসান মান্টো: এক নির্মম কথাশিল্পী

by Vinnokatha

আহমাদ ইশতিয়াক

জীবনটা ছিল তার স্রোতের প্রতিকূলে প্রবাহমান এক নদী। নদী বললে অবশ্য কমই বলা  হবে, বলা যায় সমুদ্র। সমুদ্রের চেয়ে অতল যার গভীরতা, প্রকাণ্ড শক্তিমান  জীবনবোধ। যিনি দেখিয়েছেন জীবনের আলোকোজ্জ্বল পথেও কতোখানি আঁধার থাকে, কতোখানি পূর্ণতার মাঝে পাওয়া যায় গভীরতম শূন্যতা।  চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলা যায় ইতিহাস আর বর্তমানের নিষ্ঠুরতম সত্য। নির্দ্বিধায় নির্ভয়ে দাঁড়ানো যায় কালের সমস্ত ভণ্ডামি আর সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে। সকালের স্নিগ্ধতার চেয়ে রাতের আঁধার গ্রাস করতো তাকে। সাম্প্রদায়িকতা, দাঙ্গা, বিভীষিকা, তার সাহিত্যের নিষিদ্ধ হওয়া, কোনটিই বাদ যায়নি। তার ওপর আঘাতের পর আঘাত এসেছে। তাকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল শাসকেরা। কিন্তু তিনি তো চিরকালের। নিজের মৃত্যুর এক বছর আগে যিনি লিখতে পারেন “এখানে সমাধিতলে শুয়ে আছে মান্টো। আর তার বুকে সমাহিত হয়ে আছে গল্প লেখার সমস্ত কৌশল।” তাইতো আঁধারের বুকে এক আলোর জীবনশিল্পী সাদত হাসান মান্টো।

সাদাত হাসান মান্টোর জন্ম ১৯১২ সালের ১১ মে ভারতের পাঞ্জাবের লুধিয়ানার পাপরউদি গ্রামের এক ব্যারিস্টার পরিবারে। মান্টোর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত। তার বাবা গুলাম হাসান মান্টো ছিলেন আদালতের বিচারক। পারিবারিক ঐতিহ্যের জন্য দারুণ গর্বিত ছিলেন মান্টো। ভাইবোনদের মধ্যে মান্টো ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত বলে দারুণ গর্ব বোধ করতেন তার পরিবার। কাশ্মীরি লোকজনের সাক্ষাৎ পেলে তার বাবা দারুণ সমাদর করতেন।

পারিবারিক কড়া শাসন আর শৃঙ্খলার মধ্যেই বেড়ে ওঠা মান্টোর। কিন্তু এতো অদ্ভুত শাসন, শৃঙ্খলার মধ্যেও শৈশব থেকেই বোহেমিয়ান হয়ে ওঠেন মান্টো। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার শুরু অমৃতসরের এক মুসলিম হাই স্কুলে। কিন্তু স্কুলের গন্ডিতে তার মন প্রাণ হাঁপিয়ে উঠতো। ছিলেন দুষ্টুর শিরোমণি। একবার স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে গুজব রটিয়ে দিয়েছিলেন আমেরিকা তাজমহল কিনে নেবে, নানা যন্ত্রপাতি ভারতে আসছে।   একটা সময় নাটকের ভূত চেপেছিল মান্টোর মধ্যে। নাট্যদল অব্দি গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু গুলাম হাসান মান্টো ছেলের এমন কীর্তির সংবাদ শুনে হারমোনিয়াম তবলা ভেঙে দিয়েছিলেন। তার মতে এসব নাপাক কাজ আর যাই হোক তার ছেলে করতে পারে না। স্কুলে পড়া অবস্থায় মান্টোর টেবিলে থাকতো ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক ভগত সিংহের মূর্তি। পড়ার সময়ও চুমু আঁকতেন তিনি সেই মূর্তিতে।  মান্টো স্বপ্ন দেখতেন তিনি ভগত সিংহের মতো ইংরেজ তাড়াচ্ছেন। অন্যদিকে দিনভর অমৃতসরের রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা আর দুচোখ জুড়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন,  মান্টোর পকেটে সিগারেট, রোদের মধ্যে এপার থেকে ওপাড়, বিরাম নেই তার। সিগারেট ফুঁকছেন তিনি আর বিপ্লবের স্বপ্নে কাতর।

পড়াশোনার প্রতি প্রচণ্ড অমনোযোগিতা। শেষমেশ হিন্দু মহাসভা কলেজ থেকে   দুইবার এফএ পরীক্ষায় ফেল করলেন মান্টো। স্কুলের পাঠ্যসূচির বাইরের বই পড়ায় প্রচণ্ড আগ্রহ মান্টোর। বিশেষ করে গল্প আর উপন্যাস। এ দুটো যেন নেশা ধরিয়ে দিত তার মধ্যে। তাই তো গল্প আর উপন্যাস পড়ার প্রচণ্ড আগ্রহ আর নেশাই একটা সময় পাঞ্জাবের অমৃতসর রেল স্টেশনের হুইলার বুকস্টল থেকে বই চুরিতে প্রলুব্ধ করেছিলো তাকে। এদিকে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রচণ্ড বিরক্ত আর ক্ষুব্ধ তার পরিবার। এভাবে আর কদিন চলবে। একটা কিছু তো করতে হবে। শেষমেশ ভয়ংকর মানসিক চাপে পড়লেন মান্টো। এর মধ্যে তার বন্ধু আবু সাঈদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন   মান্টো। মজার বিষয় হলো আবু সাঈদ এফ এ পরীক্ষা তথা ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় দুবার ফেল করেছেন। দুজনে মিলে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন তারা এখান থেকে চলে যাবেন। ভর্তি হবেন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে মান্টোর পরিচয় হলো প্রগতিশীল কবি আলী সরদার জাফরির সঙ্গে। প্রথমদিন পরিচয় হওয়ার পর মান্টো নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন “কমান্ডার মান্টো” নামে।

১৯৩১ সালে কলেজে পড়ার সময় অবিভক্ত ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের অশান্ত পরিবেশে এসে মান্টোর পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটলো। এর পরের বছর মারা যান মান্টোর বাবা গুলাম হাসান মান্টো। ১৯৩২ সালে বাবার মৃত্যুর পর মান্টো যেন জীবনের চরম রূপ দেখলেন। অসহায় হয়ে পড়লেন মান্টো। সেই সময় বাধ্য হয়ে উপার্জনের পথ বেছে নিতে হলো মান্টোকে। সে সময় তার্কিক লেখক আবদুল বারি আলিগের সঙ্গে মান্টোর দেখা হলো।

সময়টা ১৯৩৩ সাল। বয়স তখন  মান্টোর ২২ বছর। আবদুল বারি আলিগের সঙ্গে  এই সাক্ষাৎই ছিল মান্টোর জীবনে এক অন্যতম  মাইলফলক।  আবদুল বারি আলিগ, একদিন বললেন, “মান্টো বিশ্বসাহিত্য জানতে চাও তো রুশ এবং ফরাসি ভাষা শিখে নাও। এটি ভীষণ কাজে দেবে তোমাকে। এই দুই ভাষাই বিশ্বসাহিত্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে আছে।” কয়েক মাসের মধ্যে রুশ ও ফরাসি ভাষা অনেকখানি আয়ত্বে চলে এলো মান্টোর। এরপর একটা সময়  মান্টো ভিক্টর হুগোর বিখ্যাত  “The last Day of a Condemned Man” এর উর্দু অনুবাদ করেছিলেন। যা পরবর্তীকালে “সারগুজাস্‌ত-ই-আসির”( এক বন্দীর গল্প) নামে উর্দুতে প্রকাশিত হয়েছিল।

এর মধ্যে মান্টোর হাতে রাশিয়ান গল্পের উর্দু অনুবাদ “রাশি আফ্‌সানে” প্রকাশিত হয়। বিদেশি সাহিত্য উর্দু ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে মান্টো যেন এক অন্য জগতের সন্ধান পেলেন। কিংবদন্তি সাহিত্যিক ভিক্টর হুগো, অস্কার ওয়াইল্ড, আন্তন চেখভ, মাক্সিম গোর্কির লেখার সঙ্গে আগে খানিক পরিচয় থাকলেও এই সময় তার বিস্তৃতি ঘটলো যেন পূর্ণমাত্রায়। তখন মান্টো যোগ দেন ইন্ডিয়ান প্রগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনে।

কিন্তু একটা সময় জীবনের প্রতি চরম অনিয়ন্ত্রণ চলে এলো মান্টোর। বিশেষ করে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন নিয়মকানুন প্রচণ্ড কড়া। শৃঙ্খলার জীবন। কিন্তু এতদিন ধরে নিয়মতান্ত্রিকতার বাইরে থাকা মান্টোর তা পোষায় নাকি!  মান্টোও স্বভাবতই তা মানলেন না। চললেন নিজের হালে। এদিকে তার চরম অনিয়মতান্ত্রিক স্বভাব আর বোহেমিয়ান জীবন তার স্বাস্থ্য ভেঙে দিলো। একটা সময় তার যক্ষ্মা ধরা পড়ল। যক্ষ্মা ধরার পর চিকিৎসা হলো। অতঃপর চিকিৎসক তার পূর্ণ সুস্থতার জন্য হাওয়া বদল করতে বললেন। মান্টো চলে গেলেন কাশ্মীরের বতুতে। কাশ্মীরে থাকা অবস্থাতেই ১৯৩৪ সালে মান্টোর জীবনে প্রথম প্রেম এলো। সেই প্রেমটাও ছিল অসম্ভব স্নিগ্ধ।  মান্টো কাশ্মীরের বতুতে থাকা অবস্থায় প্রায়ই পাহাড়ি উপত্যকায় ঘুরতে যেতেন। এভাবে ঘুরতে গিয়ে তার সঙ্গে পরিচয় হলো এক কাশ্মীরি মেষবালিকার সঙ্গে। যে কিনা মেষের পাল চরাতো। এই প্রেমটিকে মান্টো বলেছিলেন অপরিপক্ব প্রেম। তবে এই প্রেমের কথা জীবনেও কখনো মান্টো ভুলতে পারেননি। এই মেয়ের পরিচয় ও গল্প মান্টো তুলে এনেছিলেন তার এক টুকরো মিছরি গল্পে। যেখানে  মান্টো মেয়েটির নাম দিয়েছিলেন “বিত্ত”। 

মান্টোর প্রথম গ্রন্থ ছিল গল্পগ্রন্থ “আতিশ পারে”। “আতিশ পারে” প্রকাশিত  হয়েছিলো ১৯৩৬ সালে। এই গ্রন্থে ছিল মোট ৮টি গল্প। নিজের প্রথম গ্রন্থটি মান্টো উৎসর্গ করেছিলেন তার বাবাকে। মূলত আবদুল বারি আলিগের পরামর্শেই ছাপা হয়েছিল এই গ্রন্থ। এর আগে সাপ্তাহিক সাহিত্য সাময়িকী খালাকে প্রকাশিত হয়েছিল এই গল্পগুলো। সে বছর  মান্টো অমৃতসর থেকে জীবিকার খোঁজে চলে এলেন বোম্বাইতে। এখানে এসে চাকরি নিলেন নাজির লুধিয়ানভির সাপ্তাহিক “মুসাব্বির” পত্রিকায়। বেতন মাত্র চল্লিশ টাকা। এই পত্রিকায় চার বছর চাকরি করেছিলেন   মান্টো।

একই বছর বিয়ে হয়েছিল মান্টোর। মূলত তখন তিনি খান হোটেলে। আর রাত জেগে লেখালেখি। তার মা অমৃতসর থেকে বোম্বাই এসে দেখেন ছেলের এই অবস্থা। তখন তিনি অমৃতসর ফিরে গিয়ে মেয়ে দেখতে লাগলেন। তারা কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত বলে কাশ্মীরি মেয়েই প্রাধান্য পেল। এক পর্যায়ে সাফিয়া বেগম নামে একটি মেয়ে পছন্দ হলো। বিয়ের কথা শুনে মাথায় যেন বাজ পড়লো মান্টোর। এই বিয়ে এই সময়ে তিনি কিছুতেই করতে পারবেন না। কিন্তু তার মায়ের সিদ্ধান্ত বিয়ে করতেই হবে। শেষে জটিল অবস্থায় অপারগ হয়ে সাফিয়ার চাচাকে গিয়ে ধরলেন মান্টো। বললেন, “আমার চাকরি অস্থায়ী, মাস শেষে ধার কর্জ হয় বিস্তর। আবার বিয়ার খেতে হয় প্রতিদিন।” তবুও রাজি হয়ে গেল সাফিয়ার চাচা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ব্যাপার কাজ করেছিল তাদের মাথায় সেটি হলো, মান্টোর তিন সৎ ভাই-ই ব্যারিস্টার। অথচ সেই ভাইরা পরবর্তীতে কখনো খোঁজ খবর নেননি মান্টোর। সাফিয়ার পরিবারের আপত্তি না থাকায় মুসাব্বির পত্রিকার সম্পাদক ও মালিক নাজির লুধিয়ানভির সঙ্গে আলাপ করলেন মান্টো। নাজির লুধিয়ানভি নববধূকে শাড়ি গয়না কিনে দিতে চাইলেন। আর সঙ্গে দিলেন কিছু টাকা। বিয়েতে মোট খরচ হয়েছিল ৫০০ টাকা। একটা সময় বেতন বাড়লে তবে দুই কামরার বাড়িতে স্ত্রীসহ উঠলেন মান্টো। সাফিয়াকে ঘরে তুলে আনতে মান্টোর সময় লেগেছিল প্রায় দুই বছর।

মুসাব্বির পত্রিকায়  থাকাকালীন চার বছর অসম্ভব পরিশ্রম করেছেন মান্টো। মূলত এই পত্রিকায় থাকাকালীন সময় চলচ্চিত্র সমালোচনা লিখতেন মান্টো। এই পত্রিকায় থাকা অবস্থায়ই ফের সাহিত্যের প্রতি অসম্ভব এক টান অনুভব করলেন মান্টো। ১৯৪০ সালে মান্টো যোগ দিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে। ১৫০ টাকা বেতনে দিল্লিতে চাকরি। এটি ছিল মান্টোর জন্য দারুণ এক সুযোগ। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে থাকা অবস্থাতেই ১৯৪১ সালে প্রকাশিত মান্টোর দ্বিতীয় গল্প গ্রন্থ “মান্টো কে আফসানে”।   এখানে থাকা অবস্থায় দারুণ পরিচিত হয়ে উঠেন তিনি। বিশেষ করে প্রখ্যাত উর্দু লেখক কৃষণ চন্দর, দেবেন্দ্র সত্যার্থী ও উপেন্দ্রনাথ আশকের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে মান্টোর। কিন্তু সেখানে বেশিদিন থাকলেন না মান্টো। কারণ তখন তার সামনে আরও লোভনীয় অফার। ফিল্মিস্তান স্টুডিওতে ৩০০ টাকা বেতনে সংলাপ রচয়িতা ও চলচ্চিত্রের কাহিনীকার হিসেবে যাত্রা শুরু হলো। এখানে থাকাকালীন তার কাহিনীতে গড়ে উঠেছিল দারুণ কয়েকটি চলচ্চিত্র। এর  মধ্যে “গালিব” চলচ্চিত্রের কথা বলতেই হয়। যদিও এই চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিলো অনেক পরে। সুপারহিট হয়েছিল চলচ্চিত্রটি। পেয়েছিলো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও।      

ফিল্মিস্তানে থাকা অবস্থাতেই প্রকাশিত হয়েছিল মান্টোর “আফসানে আওর” নাটক, “ধুঁয়া” গল্পগ্রন্থ। বোম্বাই চলচ্চিত্রের জগৎ নিয়ে নিজের আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ “গাঞ্জে ফেরেশতে”। যেখানে উঠে এসেছে বোম্বের চলচ্চিত্র জগতের অজস্র স্মৃতিকথা ও বয়ান। বোম্বে  চলচ্চিত্র জগতে স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে প্রচণ্ড কদর তখন মান্টোর। একদিকে টাকা আসছে, অন্যদিকে টাকা উড়াচ্ছেন। এসময় তার পরিচয় হলো অশোক কুমারের সঙ্গে। মূলত ফিল্মিস্তানের জন্ম হয়েছিল বোম্বে টকিজ ভেঙেই। বোম্বে টকিজের একটি দল বের হয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন ফিল্মিস্তানের। এখানে যেমন ছিলেন অশোক কুমার, তেমনি জ্ঞান মুখোপাধ্যায় ও রায় বাহাদুর চুনিলাল এবং শশধর মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরেই যাত্রা শুরু হয়েছিলো ফিল্মিস্তানের। অশোক কুমারকে সবাই তখন ডাকতো দাদামণি বলে। প্রথম প্রথম অবশ্য অশোক কুমারকে অশোক বলেই ডাকতেন মান্টো। অশোক কুমার বিব্রত হয়েছিলেন বোধহয়। তাই সরাসরি মান্টোকে বললেন, তাকে দাদামণি বলে ডাকতে। এদিকে অনড় মান্টো, কিছুতেই ডাকবেন না। তার জবাব, “তোমাকে দাদামণি ডাকতে যাবো কেন? তুমি কি আমার চেয়ে বড়?”  কিন্তু তবু একটা সময় অশোক ছেড়ে দাদামণিই ঠাঁই পেল মান্টোর গলায়।

মজার বিষয় হলো মান্টো অভিনয় করেছিলেন অশোক কুমার অভিনীত চলচ্চিত্রেও। সালটা ১৯৪৬, ফিল্মিস্তান স্টুডিওতে নতুন এক চলচ্চিত্রের কাজ শুরু হলো। আট দিন নামের সেই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য সাদত হাসান মান্টোরই। চলচ্চিত্রে অশোক কুমার শামসের সিং চরিত্রে। অশোক কুমারের বিপরীতে নবাগতা অভিনেত্রী ভিরা। এই চলচ্চিত্রের পরিচালনাও অশোক কুমারের হাতে। চলচ্চিত্রে পরিচালনা যেন নতুন করে দেখলেন মান্টো। কারণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাথরুমে কাটান অশোক কুমার। ওটাই যেন তার চিন্তার ক্ষেত্র।

চলচ্চিত্রের এক পর্যায়ে একটি চরিত্র ছিল কৃপারাম। এটি মূলত এক ফ্লাইট অফিসারের চরিত্র, খানিক পাগলাটে ধরনের। ঠিক হলো এই চরিত্রে অভিনয় করবেন শশধর মুখোপাধ্যায়। কিন্তু লাইট ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতেই ভোল পাল্টে গেল। ঘেমে একাকার। কিছুতেই মিলছে না, এমনিতে সব স্বাভাবিক, স্ক্রিপ্টও মুখস্ত শশধর মুখোপাধ্যায়ের। কিন্তু ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেই প্রচণ্ড বিপর্যস্ত। মুখ দিয়ে কোনো সংলাপই বের হয় না। শেষে শশধর মুখোপাধ্যায় বললেন, “না এ আমার দ্বারা সম্ভব না। অন্য কাউকে দেখুন।” 

এদিকে এমন অবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়লেন অশোক কুমার। বুঝে উঠতে পারছিলেন না কি করবেন তিনি। শেষে ভাবলেন যদি মান্টোকে বলে চিত্রনাট্যে কিছু পরিবর্তন আনা যায়। সোজা গাড়ি নিয়ে তিনি চলে গেলেন মান্টোর বাড়ি। মান্টোর বাড়ি গিয়ে সবকিছু খুলে বললেন। হঠাৎ অশোক কুমারের কি হলো কে জানে। চুপিচুপি কি ধারণা এঁকে প্রস্তাবটা দিয়েই বসলেন মান্টোকে। বললেন, “কৃপারামের রোলটা তুমিই করো। এছাড়া যে হচ্ছেই না।” মান্টো প্রথমত আকাশ থেকে পড়লেন, তিনি করবেন অভিনয়! কিন্তু অশোক কুমারের সাফ কথা, রোলটা তোমাকেই করতে হবে। নয়তো সিনেমাটার কাজ বন্ধ হয়ে যাবে।” শেষমেশ দ্বিধা সরিয়ে কৃপারাম চরিত্রে অভিনয় করলেন সাদত হাসান মান্টো। এটিই ছিলো মান্টোর প্রথম এবং একমাত্র চলচ্চিত্র। মজার বিষয় হলো “আট দিন” চলচ্চিত্রের মুক্তির দিনে চলচ্চিত্রের শুরুর আগে মান্টোর নাম প্রদর্শিত হচ্ছে কিন্তু ডিরেক্টর তথা পরিচালকের স্থানে অশোক কুমারের বদলে ডি এন পাইয়ের নাম। অশোক কুমার কি তবে পরিচালক ছিলেন না এই চলচ্চিত্রের? 

এর ব্যাখ্যা মান্টো নিজেই দিয়েছেন। তিনি লিখেছিলেন ডি এন পাই ছিলেন দক্ষ এডিটর। আর ফিল্মিস্তানের অদ্ভুত নিয়ম হলো কোন পরিচালক নির্দিষ্ট থাকে না। মূলত সবাই চলচ্চিত্র নির্মাণের শেষে একত্রিত হয়ে পরিচালকের নাম ঠিক করেন।

এর মধ্যে নিজের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধুকে যেন পেয়ে গেলেন মান্টো। এক খ্যাপাটে জীবন, মাতাল, পাগল, বারবনিতা, ভবঘুরে, টোকাই সিনেমার ফ্লোরম্যান এসবই ছিল তার গল্পের রসদ।

প্রখ্যাত উর্দু লেখিকা ইসমত চুগতাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো মান্টোর। পরিচয় হলো অভিনেত্রী নাসিম বানু, শ্যাম, সুরসম্রাজ্ঞী নূরজাহানসহ অনেকের সঙ্গে। ইসমত চুগতাইয়ের সঙ্গে মান্টোর পরিচয় কিন্তু আলীগড়ে হয়নি। যদিও দুজনেই আলীগড়ে পড়েছিলেন। ইসমত চুগতাইয়ের বিয়ে হয়েছিল বোম্বে চলচ্চিত্রের চলচ্চিত্রকার শাহেদ লতিফের সঙ্গে। মূলত শাহেদ লতিফের সঙ্গে বিয়ের পরই ইসমত চুগতাই চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্রের কাহিনী লেখা শুরু করেন। এইসময় প্রকাশিত হলো ইসমত চুগতাইয়ের ক্ষুরধার শক্তিমান সব গল্প। ইসমতের বাবা মির্জা কাশিম বেগ ছিলেন প্রখ্যাত বিচারপতি। আর ভাই উর্দু সাহিত্যের প্রখ্যাত সাহিত্যিক আজিম বেগ। এতো উচ্চ বংশ হওয়া সত্ত্বেও নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা করেছিলেন ইসমত চুগতাই। ইসমত চুগতাই ছিলেন প্রচণ্ড বাস্তববাদী লেখক। সব ছাপিয়ে দুজনের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। মান্টো লিখেছিলেন, ‘ইসমতের নারী সত্ত্বা এবং পুরুষ প্রকৃতির মাঝে আজব ধরনের জেদ ও অসঙ্গতি বিদ্যমান। হয়তো প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন কিন্তু প্রকাশ্যে অনীহা প্রকাশ করে চলেছেন। চুমোর জন্য হয়তো মন আকুতি জানাচ্ছে কিন্তু চুমোর বদলে সে গালে সুঁই চালিয়ে দিয়ে মজা দেখবেন।’

মান্টো ততোদিনে হয়ে উঠেছেন উর্দু সাহিত্যের জনপ্রিয় ছোট গল্পকার। ১৯৪৭ সালের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতে তার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগে মামলা হয়ে গেছে তিন বার। কালো সেলোয়ার, ধোঁয়া, বুঁ  অশ্লীলতার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হলো। ৪৭ এ দেশভাগ হয়ে গেল। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলো। যার শিকার হলেন মান্টো। অশোক কুমারের আশ্চর্য নীরবতা প্রচণ্ড আঘাত করলো মান্টোকে। সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় চরম আঘাত পেয়েছিলেন মান্টো। চিরচেনা মানুষগুলো অচেনা হয়ে দাঁড়ালো। তার নামে অশ্লীলতার অভিযোগে মামলা প্রত্যাহার করলো না ভারত সরকার। কী করবেন তিনি! কী করা উচিৎ! এমন সময় সিয়াহ হাশিয়ে লিখছেন মান্টো। যেখানে তিনি তুলে ধরলেন কোথায় আছেন তিনি, কেমন আছেন! তখন সদ্য গুছিয়ে উঠছে পাকিস্তানের লাহোরের  চলচ্চিত্র জগত। শেষমেশ বাধ্য হয়ে বোম্বে ছেড়ে লাহোর চলে গেলেন মান্টো। যাওয়ার সময় কেবল তাকে বিদায় জানিয়েছিল বন্ধু অভিনেতা শ্যাম।

লাহোরে আসার পর তিনি দেখলেন  এতদিনের চিরচেনা মাতৃভূমি ছেড়ে এক অচেনা জায়গায় উপস্থিত তিনি। এক নতুন দেশ, নতুন জগত। কিন্তু এখানে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারলেন না। অচেনা দেশ, অচেনা ভূমি। এদিকে তখন পাকিস্তানে এসে আরো অসহায়র্ত হয়ে পড়লেন তিনি।    মদের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল আগেও। এই পরবাসে এসে বন্ধু আর সহায়হীন হয়ে তা হয়ে গেল নেশা। অথচ তখন সুবিধাবাদী লেখকেরা সরকারের কাছ থেকে বাড়ি, ব্যবসা বরাদ্দ নিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু মান্টো চিরকালই স্রোতের প্রতিকূলে চলা লোক।  চাকরি নেই তার। উপার্জনের একমাত্র উপায় পত্রিকায় লেখা। বিকেল হলেই বেরিয়ে পড়তেন মান্টো। পত্রিকার অফিসে গিয়ে বলতেন টাকা দিন, লিখে শোধ করে দেবো। এসময় মান্টোর সঙ্গে পরিচয় হলো কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, নাসির কাজমি, আহমেফ রহির সঙ্গে পরিচয় হলো তার। মদ আর বাজার খরচের টাকার জন্য চিন্তিত লেখক সদ্য দেখা দাঙ্গার গল্প লিখে দেন কাঁপা কাঁপা হাতে। সেই গল্প কখনো কেবল এক লাইন, বেশি হলে পৃষ্ঠা দেড়েক। এভাবে লেখা ৩২টা গল্প নিয়ে ১৯৪৮ সালে বের হয় সিয়াহ হাশিয়ে, মানে কালো সীমানা। এই নাম দ্ব্যর্থবোধক। এক অর্থে কালো সীমান্ত, নতুন দেশের বর্ডার, মান্টো যাকে কালোই বলতেন, আরেক অর্থ হলো, পত্রিকায় কোনো শোক সংবাদ বা দুঃখের সংবাদ যে কালো বর্ডারে ছাপা হয়, সেই কালো সীমানা। তার প্রগতিশীলতা কাল হয়ে দাঁড়ালো তার জন্য। তিনি তখন সবার চোখের বালি। অশ্লীলতার অভিযোগে নিষিদ্ধ হলো মান্টোর ঠাণ্ডা গোশত, খোল দো, আউর দরমিয়ান।

খোল দো গল্প প্রকাশের দায়ে উর্দু মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘নাকুশ’-এর প্রকাশনা ছয় মাসের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হলো। তখন এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আহমদ নাদিম কাজমি। আর ‘ঠান্ডা গোস্ত’ প্রকাশের জন্য জরিমানা করা হলো ‘জাবেদ সাময়িকী’কে। ‘আউর দরমিয়ান’-এর ছাপা নিষিদ্ধ করা হলে কোনো পত্রিকাই তার  পরবর্তী কিস্তিগুলো ছাপতে রাজি হয়নি। ১৯৫০ সালের আগস্টে তো বিটার ফ্রুট গল্পের জন্যে অশ্লীলতার অভিযোগে তাকে লাহোর আদালতে অভিযুক্ত হয়ে আসতে হলো।

আর্থিক দুরবস্থার কারণে ভালো আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেননি মান্টো। একটা সময় তরুণ আইনজীবী শেখ খুরশিদ আলম এগিয়ে এলেন। তিনিসহ তিন জন তরুণ  উকিল মান্টোর পক্ষে দাঁড়ালেন। সিয়াহ হাশিয়ে বইয়ের ভূমিকা লিখতে হাসান আসকারিকে বললেন। হাসান আসকারিও লিখলেন। তখন আসকারি সদ্য দায়িত্ব পেয়েছিলেন পাকিস্তানের পরিচয় কেমন হবে এমন উপদেষ্টা হিসেবে। কিন্তু হাসান আসকারি ছিলেন লেখক সংঘের বিরুদ্ধে। আহমদ নাদিম কাজমি ও সরদার জাফরি মান্টোকে বললেন হাসান আসকারিকে দিয়ে যেন ভূমিকা না লেখান। কিন্তু কোন জবাব দিলেন না মান্টো। তাই প্রগতিশীল লেখকদের সঙ্গে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ হয়ে গেল তার।মান্টো হয়ে পড়লেন  বন্ধুহীন। প্রিয় বন্ধু ইসমত চুগতাইকে চিঠিতে লিখেছিলেন তিনি ফিরে যেতে চান বোম্বাইতে। কিন্তু ততোক্ষণে তার ফেরার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। এদিকে ঘরে টাকা নেই। তখন তার একমাত্র বন্ধু মদ।

একদিন মান্টো অধৈর্য হয়ে লিখেছিলেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে। ‘এক দিন হয়তো পাকিস্তানের সরকার আমার কফিনে একটা মেডেলও পরিয়ে দেবে। সেটাই হবে আমার চরম অপমান।’ মৃত্যুর কিছুদিন আগে কবর জিয়ারত করে ফিরে আসছেন মান্টো ও তার স্ত্রী সাফিয়া। কবরস্থান থেকে বেরুতে বেরুতে একটি পুরাতন কবরের সামনে দাঁড়িয়ে মান্টো বললেন, ‘এখানে শুয়ে আছেন সাদত হাসান মান্টো। সে জানতো গল্প লেখার সমস্ত কলাকৌশল। কিন্তু মাটির নিচে শুয়ে সে এটাই ভাবছে, সবচেয়ে সেরা গল্প লেখকটি আসলে কে? সে নিজে নাকি খোদা!”

একটা সময় সস্তা বাজে মদপানের জন্য লিভার সিরোসিসের আক্রান্ত হলেন মান্টো। তখনো বেপরোয়া জীবন চলছে তার। সেই ভঙ্গুর শরীরেই একের পর এক গল্প, রাজনৈতিক সমালোচনা লিখেই যাচ্ছেন তিনি। একদিকে অভাব, একদিকে আর্থিক অনটন, একদিকে ভঙ্গুর স্বাস্থ্য আর প্রচণ্ড মদের নেশা তাকে শারীরিকভাবে নিঃশেষ করে দিলো যেন। লিখেছিলেন মান্টো রাত দিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে সংসারের জন্য। “কিন্তু আমার প্রচণ্ড ভয় হয়। আজ যদি চিরকালের জন্য চোখ বুঁজি তবে  আমার স্ত্রী ও তিন কন্যার দেখাশোনার দায়িত্ব কে নেবে?” মৃত্যু তখন নিকটে তার।

মান্টোর ভাগ্নে হামিদ জালাল লিখেছিলেন মান্টোর অন্তিম অবস্থা নিয়ে। হামিদ জালাল লিখেছিলেন, ‘মৃত্যুর প্রাক্কালে নাটকীয়ভাবে মান্টো মামা মদ পানের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। রক্তবমি হচ্ছে, পেটে প্রচণ্ড ব্যথা। তিনি জানতেন, মদ তার জন্য বিষ। তিনি মৃত্যুকেও সাহসের সাথে মোকাবিলা করেছেন। হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য সংবাদ দেওয়া হয়েছে। তিনি বললেন, “কোটের পকেটে সাড়ে তিন টাকা আছে, দুই প্যাক হুইস্কি আনাও।” তার শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য হুইস্কি আনা হলো। এক চামচ হুইস্কি তার মুখে দেওয়া হলো। কয়েক ফোঁটা গলায় ঢুকল আর অবশিষ্টটুকু মুখ থেকে বাইরে গড়িয়ে পড়ল। এর মাঝে সারা দেহে খিঁচুনি শুরু হয়েছে। তখন তিনি অজ্ঞান, অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মান্টো শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন সেদিন ছিল ১৮ জানুয়ারি, ১৯৫৫ সাল।’

যে সাদত হাসান মান্টোকে বলা হয় উর্দু সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক, সে মান্টো ক্লাসের পরীক্ষায় উর্দুতে কখনো পাশ করতে পারেন নি। যে মান্টোকে বলা হয় উপমহাদেশের সবচেয়ে নির্মম গল্পকার, সে মান্টোর উপর এসেছিলো ভয়ঙ্কর নির্মমতা। যে মান্টো লিখে গেছেন ধর্মান্ধতা, বাস্তবতা, অনাচার অবিচারের বিরুদ্ধে, সেই মান্টোর জীবন অতিষ্ঠ করা হলো একই প্রকারের শাস্তিতে। কিন্তু দমেননি মান্টো।

মান্টো তো কেবল একজন গল্প লেখকই নয়, ছিলেন প্রচণ্ড সমাজ সচেতন। তার লেখার ধরন কাল্পনিক নয়। সমস্তই চরম বাস্তবিক। মান্টো যখন নতুন গল্প লেখার কথা ভাবতেন, সারারাত ধরে ভাবতেন কীভাবে শুরু হবে। ভোর পাঁচ টায় ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজ নিয়ে বসতেন যদি মিলে গল্পের রসদ। তার প্রতিটি গল্পই চরম সত্য এবং বাস্তবিক। হয়তো কোনো গল্পের প্লট এলো না পত্রিকা থেকে, তখন বাথরুমে চলে যেতেন, ভাবতেন, কীভাবে শুরু করা যায়। হয়তো সেখানেও বৃথা। অতঃপর স্ত্রীর সঙ্গে বিনা কারণে ঝগড়া করে গল্পের প্লট খুঁজতে যাওয়া, সেখানেও না পেলে রাস্তায় নেমে প্রথমে একটি পান কিনে চোখ বোজা তারপর জীবন দেখতে দেখতে গল্প লেখার রসদ খোঁজা। অবশ্য মান্টোর জীবনে গল্পের রসদের তো অভাব হয়নি। তিনি চাইলে কেবল ফিল্মিস্তানের থাকাকালীন সময়ে, অভিনেতা অভিনেত্রী প্রযোজকদের নিয়ে শয়ে শয়ে গল্প ফাঁদতে পারতেন। কিন্তু সচেতনভাবেই মান্টো তা করেননি। তিনি জীবনকে পূর্ণ বাস্তবতায় তুলে এনেছেন গল্পের ভাষায়। তাইতো টোবা টেক সিং গল্পে দেখা যায় বিষান সিং নামের এক অমুসলিম পাগলের চিত্র। দেশভাগের দুই তিন বছর পরে দুই দেশের সরকার সিদ্ধান্ত নিলো পাগলদেরও ভাগাভাগি হবে। অর্থাৎ হিন্দু পাগলদের ভারত এবং মুসলিম পাগলদের পাকিস্তানে পাঠানো হবে। লাহোরের মানসিক হাসপাতালে থাকা পাগল বিষান সিং বাকি সহবন্দীদের সাথে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে কী করে নিজ গ্রামে ফেরা যায়। যেহেতু সে হিন্দু তাই ভারতে চলে যেতে হবে তাকে। কিন্তু বিষান সিং ফিরে যেতে চায় পাকিস্তানে তার প্রিয় গ্রাম টোবা টেক সিং এ।

“উর্দু সাহিত্যে অনেক ভালো গল্পকারের জন্ম হয়েছে, কিন্তু মান্টো দ্বিতীয়বার জন্ম নেবে না, আর তার স্থান কেউ পূরণ করতে পারবে না। মান্টোর বিদ্রোহ আধুনিক সভ্যতার পাপের বিরুদ্ধে। তার এই প্রচ্ছন্ন বিদ্রোহের মাঝে আমরা খুঁজে পাই মান্টোর ক্ষোভ, ঘৃণা আর ভালোবাসা।” বলেছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক কৃষণ চন্দর।

মান্টো বলে গিয়েছিলেন, “আমি থাকবো না, কিন্তু আমার ভাষ্য থেকে যাবে, আমার গল্পই আমার কথা বারবার বলবে।” তাইতো সালমান রুশদির ভাষায় সাদত হাসান মান্টো হলেন “Undisputed master of modern Indian short story.”

মৃত্যুর কিছুদিন আগে মান্টোর লেখা এপিটাফের সাক্ষ্যেই ফিরে যাই ফের। “কে বেশি ভালো গল্প লিখতে পারে? খোদা নাকি মান্টো?’

১১ মে ছিল উপমহাদেশের প্রখ্যাত গল্পকার সাদত হাসান মান্টোর জন্মদিন। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই এই কিংবদন্তি সাহিত্যিকের প্রতি।

তথ্যসূত্র:

১। আদালতে একদিন: সাদাত হাসান মান্টো সংখ্যা/ দিবা রাত্রির কাব্য

২। গাঞ্জে ফেরেশতে/ সাদত হাসান মান্টো

৩। Manto Naama/ Jagdish Chander Wadhawan

৪। The Life and Works of Saadat Hasan Manto/ Tahira Naqvi.

৫। Naked Voices: Stories and Sketches by Manto/ Rakhshanda Jalil.                                      

৬। The Pity of Partition: Manto’s Life, Times, and Work across the India-Pakistan Divide/ Ayesha Jalal.

৭। Stars from Another Sky: The Bombay Film World of the 1940s/ Khalid Hasan.

(লেখাটি দ্যা ডেইলি স্টার বাংলা-য় প্রকাশিত)

You may also like