শঙ্খ ঘোষঃ আত্মজ্ঞানের পরিধি বিস্তারে মানবিক বিশ্বের সন্ধান 

by তৈমুর খান

 আমাদের রবীন্দ্রনাথ, আমাদের জীবনানন্দ, মাঝখানে যে রাস্তাটিতে আমরা দাড়াই—সেখানেই শঙ্খ ঘোষ অপেক্ষা করেন। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন: ‘মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাহি’ এবং জীবনানন্দ দাশ যখন বলেন: ‘মানুষ আমি—মানুষ আমার পাশে’ —এই উচ্চারণের পাশেই শঙ্খ ঘোষ বেজে ওঠেন:

 “এই উষ্ণ ধানখেতে শরীর প্রাসাদ হয়ে যায়

 প্রতিটি মুহূর্ত যেন লেগে থাকে প্রাচীন স্ফটিক

 সীমান্ত পেরিয়ে যেই পার হই প্রথম খিলান

 ঘর থেকে ঘর আর হাজার দুয়ার যায় খুলে।”

   আমরা জানি ঘরে তো মানুষ আছে। মানব আছে। দুয়ার খুলে দিচ্ছে মানুষ। হৃদয় খুলে দিচ্ছে মানব। উষ্ণ ধানখেত সভ্যতাবাহী জীবনের রসদে পূর্ণ। বহু জন্ম, বহু জীবনের প্রত্যয়নামা এভাবেই রচনা করলেন। জীবনকে আরও গভীরভাবে দেখার দীক্ষা দিলেন।

    শঙ্খ ঘোষ(১৯৩২-২০২১) জীবনের ভেতর ও বাহিরকে মিলিয়ে নেবার প্রয়াস এবং আত্মনির্মাণের খেলাটি প্রথম দেখালেন। আমাদের বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব, হাহাকার মানব অস্থিত্বের বাজনার বোলে একদা মিশে যেতে থাকে। তখনই পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ অনুভূত হয়। ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ আত্মবিশ্বাস আর মানব সঞ্চারের প্রজ্ঞাময় প্রবাহ। ভারতবর্ষে আদি জীবনচেতনা থেকে উঠে আসা সামগ্রিক সভ্যতার ছায়ায় লালিত জীবনবোধের ব্যাপ্তিকে অনুধাবন করেই তিনিও উত্থিত হলেন কাব্য সাহিত্যের আঙিনায়। মাটি আর মাতৃভূমি, স্বদেশ আর মানবচেতনার উপলব্ধিতেই জাগরণ টের পেলেন। মানুষময়, জীবনময় সভ্যতায় ঘোষণা করলেন:

 “মস্ত বড়ো অন্ধকারে স্বপ্ন দিল ডুব—

 বেঁচে থাকব সুখে থাকব সে কি কঠিন খুব?

 মিলাল সংশয়—

 শাদা ডানায় জল ভরে কে তুলল বরাভয়

 কঠিন নয় কঠিন নয় বাঁচা কঠিন নয়।”

     প্রথম কাব্য ‘দিনগুলি রাতগুলি’ (১৯৫৬)-তেই কবির মধ্যে যে সংশয় দেখা দিল তা জয় করার সাহসও জেগে উঠল। ‘কঠিন নয় কঠিন নয়’ এবং ‘কঠিন নয়’ তিনবার ব্যবহার করে মাঝখানে ‘বাঁচা’ শব্দটি ব্যবহার করলেন এবং তা বুঝিয়ে দিলেন। এখানেই কবির জোশ ও প্রত্যয় নিজ উত্থানকে সূচিত করল।

 তারপর?

সমূহ অন্তরায় আর আবিলতায় আমাদের প্রস্তুতি যে ভেতর থেকে আসে কবি তা জানেন; আর জানেন বলেই এক অনন্তের মানবপ্রকৃতি মাটি ও আকাশের সীমানায় বিরাজ করে। ব্যক্তিও সমষ্টির ভেতর পৌঁছে যায়। কোনও শূ্ন্যই  শূন্য নয়। সেখানেও ঢেউ ওঠে। আমাদের নিঃশ্বাসের হাওয়া কাঁপে। রোদ্দুর নেচে ওঠে শরীরের ঘ্রাণ পেয়ে। এক অধিকতর পূর্ণতার সমারোহ সেখানে বিরাজ করে। ‘বাবরের প্রার্থনা কাব্যে'(১৯৭৬) সেই আশ্রয় এবং আশ্বাসেরই দেখা পাই যা আমাদের পরিণতির ভেতর জমা হতে থাকে। তা কি আমরা দেখতে পাই কখনও? হয়তো দেখতে পাই না সবটুকু, বলতেও পারি না, তখন কবিই বলে দেন:

 “সে কথা বলিনি? তবে কীভাবে তাকাল এতদিন

 জলের কিনারে নিচু জবা?”

      তারপর জীবনের সংরাগ আত্মপ্রত্যয়ের ‘দৃঢ়সম্ভব উপসংহার’ চিনিয়ে দেয়। তখন বোঝা যায় শূন্যতার বাজনাতেও আছে অবিরাম জীবনের মর্মরধ্বনি:

 “শূন্যতাই জানো শুধু? শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে

 সে কথা জানো না?”

    কবির জিজ্ঞাসাতেই উত্তর আছে। স্থবির শূন্যতায় স্পন্দন আছে। নিরর্থ অন্ধকারে জীবনের সেই শাশ্বত স্পন্দন আমরা শুনতে পাই। ভেতর-সত্তার অব্যর্থ জাগরণে অস্তিত্ব আবার মাটি ও দিগন্তব্যাপী তার নিজস্ব স্পর্ধায় দাঁড়াতে চায়। মহা বিস্তারে লীন হয়েও ঘোষণা করে:

“আমি আছি, এই শুধু। আমার কি কথা ছিল কোনো?

 যতদূর ফিরে চাই আদি থেকে উপান্ত অবধি

 কথা নয়, বাঁচা দিয়ে সমূহ প্রবাহ পাব ব’লে

 এই দুই অন্ধ চোখ ভিজিয়ে নিয়েছে অন্ধকার।”

                                      (পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ)

    অসম্ভব জীবনীশক্তি পরমায়ু রচনায় অক্লান্ত কবি সর্বদা এক গতির নিরিখে লক্ষ্যে ধাবমান। অন্ধ চোখ অন্ধকারে ভিজিয়ে নেবার মধ্যে নিরাশায় নিরালোকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চাননি। তারই আকুলতায় ‘বাঁচা’ দিয়ে সমূহ প্রবাহ বিস্তৃত করতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের মতো মানবের মাঝে মহানন্দময় মুক্তির স্বাদ লাভ করবার বাসনাটি তিনি কখনওই বিসর্জন দেননি। নিজেকে অন্বেষণ করা এবং মানবের মাঝে স্থাপন করার ক্রিয়াটি সযত্নে লালন করেছেন। তাই ধান-মাটির পৃথিবীতে জীবনের উৎসবেরও শেষ নেই। জীবনের উৎসবেও তো বিবেকের মৃত্যু ঘটে না; কবিকে এক দ্বান্দ্বিক বেদনাবহ সংশয়ে পতিত করে। কবি সে-কথা জানেন বলেই ‘মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়'(১৯৭৪) কাব্যে আত্মসচেতন হয়ে ওঠেন। নিজের কলুষ বীভৎসতাকে বিসর্জন দিয়ে মানবশরীর ধারণ করতে চান:

 “মনে হয় পিশাচ পোশাক খুলে পরে নিই

 মানব শরীর একবার?”

    এই মানব শরীর আর মানবজন্মের বহুমুখী প্রত্যয়েই তাঁর কাব্যচেতনা আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে ব্যক্তিত্বের বিবর্তনে প্রতিফলিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এসেছে প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ। অসাম্য, কুশ্রিতা ও ভন্ডামির বিরুদ্ধে তিনি গর্জন করেছেন। মানবিক পৃথিবীর অনুসন্ধানে চেতনায় মশাল জ্বালিয়ে তুলে ধরতে চেয়েছেন। যখন বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে গেছে, নিজেকেই আর চেনা যাচ্ছে না, তখন মুখোশও একসময় ক্লান্ত হয়ে খসে পড়েছে। যার প্রাণচেতনা নেই, আত্মা নেই, কৃত্রিমতার অন্ধকার শুধু। তাই জীবন যে তার পাশেই জেগে উঠবে কবি তা জানেন। তখন প্রত্যক্ষবাস্তব থেকে চলমান জীবনস্রোতকে সদর্থক এক রূপান্তরী প্রত্যয়ে নিয়ে যান, যেখানে কবি আলোর কথা বলতেই ব্যস্ত। ‘ধুম লেগেছে হৃদকমলে'(১৯৮৭) কাব্যে তাই ‘আগুন’ ও ‘আলো’ দুই-ই সমার্থক পথে উঠে আসে:

 “চিতা যখন জ্বলছে, আমার হৃদকমলে

 ধুম লেগেছে, ঘুম লেগেছে চরাচরে, পাপড়ি জ্বলে

 এইতো আমার”

  কবি আগুনের সন্তান হয়ে ওঠেন। জরাজীর্ণ সমাজ আর রাজনীতির দেয়াল ধ্বংস করে আত্মঅন্ধকারকেও জ্বালিয়ে দেন। আর বহমান গঙ্গাকে স্রোতের স্ফুরণে নতুন ভোরের ঠিকানায় যেতে দেখেন। সেখানে  যেমন অন্তঃস্থিত নৌকা ভাসমান হয়, তেমনি সত্তার নিগূঢ় জাগরণ ঘটে। এই জাগরণেই অবগাহন করে আমরা মৃত্যু বইতে পারি জন্মের নতুনতর টানে।

          যদিও কবি দেখেছেন ঘরহারা মানুষ। দেশহারা মানুষ। সীমান্ত পার হওয়া মানুষ। ইতিহাসে পাল্টে যাওয়া মানুষ। ধর্ষিতা নারী ও নারীর লাশ। বুকে গুলি খাওয়া মানুষ। সর্বহারা মানুষ। পরিচয়হারা মানুষ। কবি তখন বুঝেছেন:

 “পৃথিবী তো এ-রকমই।

 এরই মধ্যে বেঁচে থাকতে হবে, ভাবি।”

  ‘জলই পাষাণ হয়ে আছে'(২০০৪) কাব্যে সেই হিসেব লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রতিবাদে অভিমানে ফেটে পড়েছেন। বুকে যেন পাথর জমা ভার অনুভব করেছেন। চোখেও জল নেই। জল জমে পাষাণ হয়ে গেছে। এক স্তব্ধতা অথবা এক নীরবতায় কণ্ঠ রুদ্ধ। তখন কখনও বুদ্ধের কথা, কখনও উপনিষদের বাণী কবিকে জারিত করেছে। প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে কথিত শান্তি ও ত্যাগের মহিমান্বিত ধ্বনিতে জীবনের প্রজ্ঞা পারমিতাকে স্মরণ করেছেন, যা এক সময় টি এস এলিয়টকেও অবরুদ্ধ রুগ্ন পাপপূর্ণ পৃথিবীতে একঝলক শান্তিবারির বোধ এনে দিয়েছিল। উপনিষদের সেই ওঁ শান্তিঃ, ওঁ শান্তিঃ ,ওঁ শান্তিঃ তিনিও উচ্চারণ করেছিলেন:

“Datta. Dayadhvam. Damyata.

Shantih shantih shantih”

তিনি লিখেছিলেন:

“Only a cock stood on the rooftree

Co co rico co co rico

In a flash of lightning. Then a damp gust

Bringing rain.”

 ত্রিকালজ্ঞ পুরুষ যখন বুঝলেন বিশ্বের শোচনীয় অবস্থা, অনাবৃষ্টির ফলে নিদারুণ নিদাঘ প্রবাহ; কোথাও জল নেই ‘Here is no water but only rock’ তখন আকাশের অবিরাম বারিধারার জন্য মানুষের আকুতি জেগে উঠল। ভিতরে-বাহিরে শুষ্কতায় মরু জীবনের সূচনায় সকলেই ব্যাকুল হয়ে উঠল। কিন্তু ধরণী শীতল করার, ঊষর মরুকে ঊর্বর করার এবং পিপাসার প্রশমন করার কোনও পথ দেখতে পেল না। এই  পাপপৃথিবী থেকে বাঁচার জন্যই প্রার্থনা। এলিয়ট নিঃসন্দেহে ঋকবেদের সন্ধ্যা বন্দনার কথা স্মরণ করেই শ্রাবণের ঘন কালো মেঘের কাছে আর্জি জানিয়েছেন। এই পটভূমিই লক্ষ করলেন কবি শঙ্খ ঘোষও। পৃথিবী এবং প্রজন্মকে রক্ষার জন্যই আর্তি  জানালেন ‘দ’ নামক কবিতায়:

 “সেই মুহূর্তে ভেঙে পড়ে বাজ

 সেই মুহূর্তে ঘূর্ণিত হতে থাকে সমস্ত পৃথিবী

 সেই মুহূর্তে ঘুঙুরের শব্দ তুলে নেচে ওঠে এক অক্ষর দ

আমার বুকের উপর নেচে ওঠে যেন ওই তিন জোড়া পা

 দ—দ—দ—

 দাম্যত দত্ত দয়ধ্বম্, দাম্যত দত্ত দয়ধ্বম্

 শব্দ হয়ে যায় শিশু, শিশুরাও শব্দ হয়ে যায়:

দাম্যত দত্ত দয়ধ্বম্।”

 আকাশের কালো মেঘে বাজ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধবাজ পাশ্চাত্য সভ্যতা শুধু মৃত মানুষের হাড়ের স্তূপ সৃষ্টি করেছে। সঞ্জীবনী মন্ত্র শেখাতে পারেনি। উপনিষদ কিন্তু সেই মন্ত্র দিতে সমর্থ হয়েছে। আকাশের মেঘ আধ্যাত্মিকতার বোধ জাগিয়ে তুলেছে। বিদ্যুৎ চাবুক হেনেছে। সাবধান করেছে আমাদেরও। কবি তিনটি শব্দেই খুঁজে পেয়েছেন মানবিক পৃথিবীর চাবি। শিশুদের আনন্দের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে এই শিহরন। যে শিশুরা বিকলাঙ্গ হয়েও হার মানেনি। এই শব্দ তো তারাই। তাই কবি বলেছেন: ‘শিশুরাও শব্দ হয়ে যায়’।

     এই ঐতিহ্য মহিমার জাগরণ রবীন্দ্রনাথ থেকে টি এস এলিয়ট সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে। শঙ্খ ঘোষের বোধেও তা তীব্র হয়ে উঠল। যে মানুষ এখনও দেশ পায়নি, ঘর পায়নি, ছিন্নমূল জীবনে রাজনীতির শিকার, বিভেদ ও সংঘাতে পীড়িত, ধর্মের অন্ধকারে দিশেহারা, শোষণে নিষ্পেষণে জর্জরিত—হয়তো এদের কথা ভেবেই জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন:

“সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে—এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;”(সুচেতনা)

 শঙ্খ ঘোষ লিখলেন:

 “ক্রমমুক্তি? এভাবেই হবে।

 সারি সারি সেলাই করা মানুষ

 প্রতীক্ষায় আছে।”(দায়)

   এরা সেই ‘সেলাই করা মানুষ’— যাদের জীবন ছেঁড়াখোঁড়া—প্রেম নেই, নারী নেই, ঘর নেই, অন্নবস্ত্র নেই। সেই হাহাকারের অবিন্যস্ত কদর্যতায় তারা নিরন্তর ভূলুণ্ঠিত। তার জন্য দায় কার? কবিরও প্রশ্ন। প্রশ্নের উত্তর কবি পাননি। তাই নিজের অবস্থানও জানিয়ে দিয়েছেন:

 “আমি কি তোমার দৃষ্টি চেয়েছি?

 চেয়েছি কি কোনো জীবনছবি?

 তোমার কাছে যা চেয়েছি সে শুধু

 হও স্লোগানের জোগানদাতা।

 তা যদি না হও আমিও নাচার

 কোনো পথ নেই তোমার বাঁচার—

 তাকে আজ আর কীভাবে নামাব

 ঘাড়ে চেপে আছে যে-মান্ধাতা।” (কবি)

  নিজ কবিসত্তার কাছেই প্রশ্ন আর অভিমান। অথচ কবিতাকে ত্যাগ করতে পারেন না। শব্দেই কবিতাতেই প্রতিবাদ লিখতে থাকেন।

       যে মানবসত্যের কাছে দায়বদ্ধ কবি, সেই মানবসত্যকে নিজের মধ্যে দিয়েই অন্বেষণ করেছেন। মানুষের পরিচয় মানুষ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে একটি পরিচয় মানবজাতি। এই মানবজাতির বাঁচার অধিকার, স্বপ্ন দেখার অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না। আধুনিকতা বলতে কবি মানবিকতাকেই বোঝেন। ব্যক্তি মানুষই বিশ্ব মানবচেতনার অংশ। নিজেকে উৎসর্গ করার মধ্য দিয়েই এই মানবিক পৃথিবীর আবেদন:

 “মানুষ হবার জন্য যখন যজ্ঞ হবে, আমার হাড়ে

 অস্ত্র গোড়ো, আমায় কোরো ক্ষমা।”

 কবিও দধীচি হতে চান। মাটির সঙ্গে মিশে মাটি হতে চান। ‘দিনগুলি রাতগুলি’ কাব্যে কবির এই যন্ত্রণা ফিরে ফিরে এসেছে। নিজেকে মাটির কাছাকাছি পৌঁছে দিয়েও শান্তি ও সৌজন্যের ভেতর আত্মস্থিত সংশয়কে নেভাতে চেয়েছেন।  যে ধর্ম বিভেদের বাতাবরণ তৈরি করেছে, যে সংস্কৃতি সংঘাত ও হিংসার প্রশ্রয় দিয়েছে তাকে কবি কখনওই সহ্য করতে পারেননি। ধর্মের জবরজং আটুনিকে মানবমহিমার বিস্তৃত আকাশে মেলাতে চেয়েছেন:

 “বলো যে এই শূন্য আমার বুকের উপর দাঁড়াক

 খুলুক তার গুলফ-ছোঁয়া চুল

 মুকুট ভরা জ্বলে উঠুক তারা। ওরা পালাক

 আর, নাম-না-জানা মুণ্ডমালা থেকে

 ঝরে পড়ুক,ধর্ম ঝরে পড়ুক

 ঠান্ডা মুখে, আমার ঠান্ডা বুকে, ঠান্ডা!” (ধর্ম)

 আমরা জানি মানুষের শালীনতা ধর্ম থেকে উদ্ভূত হয় না। এটা এর আগে থেকেই থাকে। ব্রিটিশ প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও সমাজ সমালোচক ক্রিস্টোফার হিচেন্স (১৯৪৯-২০১১) বলেছেন:”Human decency is not derived from religion. It precedes it.”

(Christopher Hitchens, God Is Not Great: How Religion Poisons Everything)

 কবি ধর্মের ট্রেডমার্কার ধুম একেবারেই পছন্দ করেননি বলেই নিছক মানুষরূপে মানুষকে দেখতে চেয়েছেন। মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ কেন থাকবে? ধনী-গরীব, উঁচু-নিচু,  জাত-ধর্ম ইত্যাদি কোনকিছুই কাম্য নয়। তাই ধর্মের সব বিধান, সাজ পোশাক খসে খসে পড়ুক। কবি ঠান্ডা বুকে শুধু মনুষ্যত্বকেই ধারণ করতে চান। সমাজ বিজ্ঞানী দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল(১৮৭২-১৯৭০) বলেছেন:”Remember your humanity, and forget the rest.”(Bertrand Russell)

 অর্থাৎ আপনার মানবতার কথা স্মরণ করুন এবং বাকি সব ভুলে যান। এই মানবিকতাই সভ্যতা ও মানুষকে রক্ষা করবে। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও ঐক্যবোধ জাগ্রত করবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবে। মুখের মুখোশও খসে পড়বে। ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ'(১৯৯৪) জীবন ও জন্মান্তর, মানুষ ও সভ্যতা, ইতিহাস ও যুগান্তরের চক্রবিন্যাসকে তুলে ধরেছেন। ধ্বংস ও সৃষ্টির দ্বৈরথ থেকে তুলে ধরেছেন মহাকালের সৃষ্টিকেই। কবি স্বপ্নে এনেছেন:

 “শূন্যের পূর্ণতা নিয়ে ভরে আছে ইবাদতখানা—

 এই রাত্রে মনে হয় স্বপ্ন দেখলে দোষ নেই কোনো।”

 তারপর আবার বলেছেন:

 “চন্দ্রগরিমার দিকে বাড়াবে অশোক হাতগুলি

 তারা কেউ এরা নয়—হিন্দুও না,মুসলমানও নয়,

 জৈন বৌদ্ধ খ্রিষ্টানও না, জরথুষ্ট্রি নয়, কিন্তু সবই

 একাকার কোনো দীন ইলাহির গোলাপবাগানে

 উৎসের আতর ছুঁয়ে প্রাচী-র প্রান্তর ভরে দেবে।

 আর এই ফতেপুর—ফতেপুর সিক্রি যার নাম

 তারই মর্মমূল থেকে এ জাহান পেয়ে যাবে নূর—

 তখন কোথায় আমি, কোথায়-বা ক্ষত্রবংশী তুমি

 মানুষই তখন গান, মানুষই তখন ত্রুবাদুর।”

    এই মানুষই তখন গান, মানুষই ত্রুবাদুর হয়ে ওঠাতে কবিরও সার্থকতা। সব পরিচয় লুপ্ত হলে শুধু মানব পরিচয়ই বৃহৎ হয়ে উঠবে।

    শঙ্খ ঘোষ প্রতিটি কবিতায় যেমন কষ্টকে দেখেছেন, তেমনি কষ্টের উৎস থেকেই কবিতার নির্মাণ করেছেন এবং পরিণতিতে স্বপ্নকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছেন। তাঁর কবিতায় এই স্বপ্নাকাঙ্ক্ষারই অমরত্ব প্রাপ্তি। ছন্দের ভেতর অন্ধকার থাকলেও, কিংবা মূর্খ বড়ো, সামাজিক না হলেও, কিংবা শূন্যের ভেতর ঢেউয়ের উপস্থিতি উপলব্ধি করলেও জীবনের সংরাগে বারবার তা উচ্ছল হয়ে উঠেছে। বাস্তব পৃথিবীর হাহাকার, ক্লেশ, সংঘাত, বিবর্ণতা কবিকে অস্থির করলেও আত্মজ্ঞানের পরিধিতে কবি সমাহিত সংহত স্রষ্টা হিসেবেই বহুমুখী পর্যটনে তাকে ধারণ করেছেন । তাই কবিতার শিল্পনৈপুণ্যের সিদ্ধিতে কোনও ঘাটতি দেখা দেয়নি। আমাদের বাহ্যিক দৃষ্টি এবং অন্তর্দৃষ্টির আলোয় এক প্রসন্নতার ঘোর সৌজন্য এসে উপস্থিত হয়েছে। কবিতার প্রতিটি মুকুলিত দীর্ঘশ্বাসের পাশেই মুকুলিত আরোগ্যের ঘ্রাণমঞ্জরিও উদ্দীপনা জাগিয়েছে। এমন কবির এমন কবিতায় বাঙালি পাঠক মুগ্ধতা না জানিয়ে কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারবে না।

You may also like