স্ট্যান স্বামী: জনজাতি অধিকার আন্দোলনের আপোষহীন যোদ্ধা

by দীপক সাহা

দীপক সাহা

জন্ম ২৬ এপ্রিল ১৯৩৭। জনজাতি অধিকার আন্দোলনের আপোষহীন যোদ্ধা, আদিবাসী মানুষদের অকৃত্রিম বন্ধু, প্রান্তজনের স্বার্থরক্ষায় সতত সরব জেসুইট পাদ্রী ফাদার স্ট্যান স্বামী আজ বেঁচে থাকলে বয়স হতো ৮৬ বছর। তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তাঁর আদর্শ, তাঁর আপোষহীন লড়াই আমাদের কাছে শিক্ষনীয়। পেরিয়ে এলাম তাঁর জন্মদিন।

৮৪ বছর বয়সী মানুষটিকে ২০২০ সালে ভীমা কোঁরেগাও মামলায় মাওবাদী সংযোগের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। বারংবার জামিনের আবেদন করা সত্বেও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার পক্ষে বিপদজনক — এই দোহাই দিয়ে অতিমারীর সময়েও তাঁর জামিন মঞ্জুর করা হয় নি। সীমাহীন নিষ্ঠুরতা প্রশাসন দেখিয়েছে এই বন্দীর প্রতি। তাঁর পার্কিন্সনস ডিজিজ ছিল, জল খাবার জন্য একটা গ্লাস আর স্ট্র চেয়েছিলেন, আবেদন মঞ্জুর হতে লেগেছিলো পাক্কা ২০ দিন। এমনকি তাঁকে চশমাও ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি। লাম্বার স্পনডিলাইটিসের তীব্র ব্যথা ছিল শরীরে, দুবার হার্ণিয়া অপারেশন হয়েছিল। জীর্ণ শরীর, তবু জামিন যাতে না হয় তার জন্য সচেষ্ট ছিল সরকার ও এনআইএ। মৃত্যুই চেয়েছিল তারা, তাই কোভিডের বিরুদ্ধে কোনও সুরক্ষা দেওয়া হয়নি তাঁকে, না ভ্যাক্সিন, না কোভিড টেস্ট। একেবারে শেষে, ২০২১ সালের ২৮ শে মে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাবার পর তার কোভিড টেস্ট হয়। দীর্ঘ একমাস যমে-মানুষে টানাটানির পর অবশেষে ৫ জুলাই চিরনিদ্রার কোলে ঢোলে পড়েন দেশের আদিবাসী অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের অন্যতম প্রধান মুখ স্ট্যান স্বামী।

স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু নিয়ে উত্তাল হয়েছিল দেশ-বিদেশ। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিন্দা ও প্রতিবাদ উগরে দিয়েছেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষের পাশাপাশি তাঁর সহযোদ্ধা, রাজনৈতিক নেতা এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার প্রতিনিধিরাও। অবশ্য সরকারের বিশেষ হেলদোল ছিল না।

ভীমা কোরেগাঁও মামলায় গ্রেপ্তারের দুই দিন আগে প্রচারিত একটি ভিডিওতে স্বামী বলেছিলেন, তাঁর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরকারের নীতিমালা বিরোধী মতবিরোধ জড়িত। তাঁর বক্তব্য ছিল, “আমার সঙ্গে যা ঘটছে তা আমার একার পক্ষে অনন্য কিছু নয়। এটি একটি বিস্তৃত প্রক্রিয়া যা সারা দেশে চলছে। আমরা সকলেই অবগত যে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী লেখক, কবি, কর্মী, ছাত্র, নেত্রী, তাদের অনেককে কারাগারে বন্দী করা হয়েছে কারণ তাঁরা ভারতের ক্ষমতাসীন শক্তি সম্পর্কে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে বা প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। আমি এই প্রক্রিয়ার অংশীদার হতে পেরে খুশি। আমি নীরব দর্শক নই, তবে এরজন্য যেকোনও মূল্য দিতে আমি প্রস্তুত।

“ছোট থেকেই ভেদাভেদহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতেন সমাজকর্মী ফাদার স্ট্যান স্বামী। আর ঠিক সেই কারণেই কখনও মাওবাদী যোগের অভিযোগ, আবার কখনও দেশদ্রোহীতার অভিযোগে হয়েছেন জেলবন্দি। উল্লেখ্য এই জেলেই তাঁর সঙ্গে এলগার পরিষদ মামলায় বন্দি ছিলেন বিশিষ্ট কবি ভারাভারা রাও। কিন্তু এতকিছুর পরেও মাথা ঝোঁকাননি স্বামী। তাঁর বিরুদ্ধে ইউএপিএ আইনে অভিযোগ আনা হয়। দেওয়া হয় দেশদ্রোহীর তকমা। তা নিয়েও একবার এক বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের বিশেষ সাক্ষাতকারে স্ট্যান স্বামী কোনও রাখঢাক না রেথেই সাংবাদিকের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “আপনি এই মুহুর্তে একজন দেশদ্রোহীর সঙ্গে কথা বলছেন। সরকার আমাকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু, আমি সরকারের ভুল নীতির বিরুদ্ধে জনসংঘর্ষে সামিল। মানুষকে জাগিয়ে তুলছি। তাই আমাকে অপরাধী বলে দেওয়া হয়েছে।”

স্বামীর এই একরোখা মনোভাই তাঁকে বরাবর আদিবাসীদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। সেই সঙ্গে জল-জঙ্গল-জমি থেকে ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলন, বিনা বিচারে আটক, আদিবাসীদের জন্য আইনি লড়াই তাঁকে ক্রমেই দেশের জনজাতির ঘরের ছেলে করে দেয়। ছাত্র জীবনেই আদিবাসীদের সঙ্গে প্রথম আত্মীয়তা গড়ে ওঠে স্ট্যানের। ১৯৩৭ সালের ২৬ এপ্রিল স্ট্যানিসালাস লৌরদু স্বামী জন্মগ্রহণ করেছিলেন তামিলনাড়ুর ত্রিচিতে। ছাত্রাবস্থায় ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন এবং ফিলিপাইনে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন, যেখানে প্রশাসনের বিরুদ্ধে তিনি একাধিক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মুখোমুখি হন। পরে আরও পড়াশোনার সময়, তিনি ব্রাজিলিয়ান ক্যাথলিক আর্চবিশপ হল্ডার চামার সাথে বন্ধুত্ব করেছিলেন, যার দরিদ্র মানুষের সাথে কাজ তাকে প্রভাবিত করেছিল।

পরবর্তীতে বেঙ্গালুরুর ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সের দিনগুলি থেকেই আদিবাসী মানুষদের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি সম্বন্ধে আগ্রহ জন্মায় স্ট্যানের মনে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। মিশে গেলেন আদিবাসীদের সঙ্গে। শিখলেন হো ভাষা। ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী অধ্যুষিত প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে ঘুরে সাপ্তাহিক হাটের বেচাকেনা দেখে বুঝলেন অর্থনৈতিক, সামাজিক বঞ্চনা, শোষণ কাকে বলে। তারপর থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ। একটানা তিন দশক ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করে গিয়েছেন স্ট্যান।

১৯৯৬ সালে ঝাড়খণ্ড অর্গানাইজেশন এগেইনস্ট ইউরেনিয়াম রেডিয়েশন বা জোয়ার আন্দোলনে যোগ দেন স্ট্যান স্বামী। সেই সময় চাইবাসায় রেডিও অ্যাক্টিভ আকরিক বর্জ্য ফেলার একটি ড্যাম তৈরির বিরুদ্ধে লাগাতার সংগ্রাম চালাচ্ছিলেন আদিবাসীরা। সেই আন্দোলনে জয়ী হন তারা। পরবর্তীতে বোকারো, সাঁওতাল পরগনা, কোডারমা সহ বিভিন্ন জায়গায় আদিবাসী অধিকার রক্ষার প্রশ্নে একের পর আন্দোলন গড়ে তুলেছেন এই সংগ্রামী মানুষটি।

এরপর ২০০১ সালে রাঁচি চলে আসেন। বাগাইচায় জেসুইট চার্চের ক্যাম্পাসে তৈরি করেন ট্রেনিং সেন্টার। অন্যায়, অত্যাচার, উচ্ছেদের বিরোধিতায় শিক্ষার পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক ও অর্থনৈতিক শিক্ষার হাতে কলমে পাঠ দিতে থাকেন আদিবাসী ছেলেমেয়েদের। পাশাপাশি পরবর্তী দেশজুড়ে যত বেড়েছে আদিবাসী নিপীড়ন ততই বেড়েছে স্ট্যান স্বামীর জেদ। ক্রমেই গোটা ভারতে সমসাময়িক জনজাতি আন্দোলনের পুরোধা হয়ে ওঠেন স্ট্যান। বেজে ওঠে সরকারি বিরোধী, প্রতিষ্ঠান বিরোধী একের পর এক আন্দোলনের দামামা। বিনিময়ে আরবান নকশাল, মাওবাদী, উগ্রপন্থী তকমা দিয়ে একাধিকবার তাঁকে জেলে পুড়েছে রাষ্ট্রযন্ত্র।

জামিন না দিয়ে, বিলম্বিত চিকিৎসার মধ্য দিয়ে, ন্যায় বিচারের আড়ালে অশীতিপর অসুস্থ স্ট্যান স্বামীকে ভারতীয় রাষ্ট্র হত্যা করলো। গ্রেপ্তার থেকে প্রলম্বিত বিচার প্রক্রিয়াটাই শাস্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ ; এর জন্য দায়ী এই অমানবিক নিষ্ঠুর প্রশাসন এবং বিচার ব্যবস্থার যুগলবন্দী নীতি — ন্যায়, সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়া তে এনারা বেকসুর নির্দোষ প্রমাণিত হবেন। অতএব, ছেড়ো না, জেলেই পচিয়ে মার। স্ট্যান স্বামী তার সর্বশেষ শিকার। এই সমস্ত ইউএপিএ, এনআইএ যতদিন এই ঔপনিবেশিক আইন থাকবে, ততদিন রাষ্ট্র নির্বিচারে হত্যা করে যাবে আর আমরা নীরব দর্শকের ভুমিকায় থেকে যাব।

স্বামীর মৃত্যুর জন্য আমরাও দায়ী। কারণ আমরা প্রশ্ন করাকে এড়িয়ে গিয়েছি অথবা আমরা যথেষ্ট প্রশ্ন করিনি , তুলিনি সঠিক আওয়াজ যতটা তুললে এই হত্যা গুলো বন্ধ হতে পারত। ফাদার স্ট্যান স্বামী রাঁচির একটি মিশনারী আবাসিক স্কুলের প্রধান ছিলেন। সম্ভবত সেই প্রথম খ্রীস্টান মিশনারী যেখানে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল যীশু নয়, বীরসা মুন্ডার মূর্তি । কিন্তু বীরসার লড়াইয়ের ইতিহাস তো রাষ্ট্র আমাদের ভোলাতে চায়। রাষ্ট্র তো মুছে দিতে চায় আদিবাসী জনজাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি, সমাজকে। তাহলে স্ট্যান স্বামীর এই কাজ রাষ্ট্রের পছন্দ হবে কেন? হবেনা বলেই দেশদ্রোহীর তকমা লাগিয়ে আদিবাসী জনজাতি আন্দোলনের কণ্ঠস্বর স্ট্যান স্বামীকে ভারতীয় রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছিল। অভাগা দেশের ‘স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স’ এর নবতম উদাহরণ।

তালোজা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকাকালীন, তাঁর জেসুইট সহকর্মীর উদ্দেশ্যে একটি চিঠিতে স্বামী বন্দীদের দুর্দশার কথা তুলে ধরেছিলেন। তিনি চিঠিটির শেষ পংক্তিতে লিখেছিলেন, “তবে আমরা এখনও কোরাস গাইব। একটি খাঁচা পাখি এখনও গান করতে পারে।” স্ট্যান স্বামীর দৈহিক বিদায় হলেও তাঁর আদর্শের মৃত্যু নেই। রাষ্ট্র যতই নিপীড়নের শৃঙ্খল কঠোর করুক না কেন স্ট্যান স্বামীরা ততদিন মানবাধিকারের পক্ষে কোরাস গাইবেন যতদিন শোষণহীন ভেদাভেদহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত না হবে।

You may also like

Vinnokatha
Prothom Khondo
Price: Rs.260/-
www.vinnokatha.in
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে। সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে।সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
Vinnokatha
Prothom Khondo