ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
স্বপন মুখোপাধ্যায়
গ্রন্থতীর্থ (২০১১)
হার্ডকভার
পাতা-১৫৬
ISBN-9 788 175 721 715
বিনিময়-৪৮ টাকা
উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থা নানা কুসংস্কারের বেড়াজালে আচ্ছন্ন ছিল। এ সময় যে সব মহামানব আলোক বর্তিকা হাতে নিয়ে ক্ষয়িষ্ণু, অধঃপতিত, অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে বিদ্যাসাগরের নাম বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।
স্বপন মুখোপাধ্যায় তাঁর ১৫৬ পাতার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (২০১১ এডিশন)-এ বিদ্যাসাগরের জীবনের হাজার প্রতিকূলতাকে সে কিভাবে পেছনে ফেলে জীবন সংগ্রামে ব্রতী হয়ে সামনে এগিয়ে গেছেন—তার একটি পরিষ্কার চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। বিদ্যাসাগরের ছেলেবেলা থেকে শুরু করে তাঁর শিক্ষা জীবন, কিভাবে তিনি অভাবের সঙ্গে লড়াই করেছেন, তাঁর কর্মজীবনের নানা বাধা বিপত্তিকে কিভাবে তিনি সামলেছেন, এবং পরে তিনি কিভাবে একজন সফল ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন—ইত্যাদি কথা খুব সহজ সরল ভাষায় লেখক পরিবেশন করেছেন।
লেখক নিজেই তাঁর এই বই লেখার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, ‘বহু প্রথিতযশা প্রাবন্ধিক ও মনস্বী ব্যক্তি সে কাজ [বিদ্যাসাগরের জীবনকথা লেখা] ইতিপূর্বে করেছেন। কোনো তাত্ত্বিক বিতর্কের জটিলতার মধ্যে না গিয়ে আমি সহজসরলভাবে এই ঋজু মানুষটির চরিত্রমহিমা বলার চেষ্টা করেছি…আজকের দিনের প্রতিনিয়ত স্খলন ও পতনের মধ্যে যখন ব্যক্তির মেরুদণ্ড ক্রমশই নানা আঘাতে ও প্রলোভনে বাঁকা হতে থাকে তখন এই বিদ্যাসাগরে চরিত্রের রত্নস্পর্শে মেরুদণ্ড সোজা করে চলবার শক্তি পাওয়া যায়।’
লেখক বিদ্যাসাগরের জীবনকে ১৪ টি অধ্যায়ে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। অধ্যায়গুলো পরপর সাজিয়েছেন এভাবেঃ ছেলেবেলা, মেধাবীছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র, শিক্ষক জীবন, শিক্ষা সংস্কার ও বাংলা গদ্য, মেট্রোপলিটান ইন্সটিটিউশন, হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড, বিধবা বিবাহ, বহুবিবাহ ও কুলীনপ্রথা, স্ত্রীশিক্ষা, বাংলা সাহিত্য ও বিদ্যাসাগর, মন্বন্তরে বিদ্যাসাগর, তেজস্বীপুরুষ বিদ্যাসাগর, দেশান্তরী বিদ্যাসাগর ও বিদ্যাসাগর-যুগের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও বিদ্যাসাগর জীবনপঞ্জি।
তিনি বজ্রমুষ্টির আঘাত হেনেছিলেন তৎকালীন ঘুন ধরা, জরাজীর্ণ সমাজ ব্যবস্থার বুকে। অশিক্ষার অন্ধকার দূর করে দেশবাসীকে শিক্ষিত ও জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে তিনি সনাতন শিক্ষার সঙ্গে যুক্তিবাদী পাশ্চাত্য শিক্ষার মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন। তাঁর অদম্য প্রচেষ্টার ফলে বিধবা বিবাহ, বাল্যবিবাহ কৌলীন্যপ্রথা ইত্যাদির বিরুদ্ধে তিনি আজীবন লড়ে গেছেন। স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে তাঁর অবদান আমরা কেউই ভুলতে পারিনা। তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন শিক্ষা ছাড়া দুঃখ দুর্দশা থেকে নারী জাতির মুক্তি সম্ভব নয়।
অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও অসম্ভব জেদ থাকলে যে কোন বাধাকে অতিক্রম করা যায়—এই বিশ্বাসকে তিনি তাঁর জীবনের প্রতি পদে পদে পালন করে দেখিয়েছেন।
স্বপন মুখোপাধ্যায় এই বইটিতে অল্প পরিসরে খুব সুন্দরভাবে বিদ্যাসাগরের বিচিত্র ও বহুবিধ কর্মময় সংগ্রামী জীবনের নানা ঘটনা আমাদের সামনে মেলে ধরেছেন। আর এসব তথ্য আমাদেরকে এই মহাপুরুষ সম্পর্কে সামগ্রিক এক স্বচ্ছ ধারনা লাভে সাহায্য করে।
আমি শুধু বিদ্যাসাগরের শেষের দিনগুলোর একদিনের একটি ছোট্ট ছবি তুলে ধরে ইতি টানব। কার্মাটারে একদিন ভোরবেলায় একজন সাঁওতাল গোটা পাঁচ-ছয় ভুট্টা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। সে ওই ভুট্টাগুলোকে দিয়ে বলল, ‘বিদ্যাসাগর, আমার পাঁচ গন্ডা পয়সা না হলে ছেলেদের চিকিৎসা হবে না। তুই আমার ওই কটা ভুট্টা নিয়ে পাঁচ গণ্ডা পয়সা দে। বিদ্যাসাগর তখনই পাঁচ আনা পয়সা ভুট্টা কটা কিনে নিলেন। তারপর আর একজন সাঁওতাল এল। সে নিয়ে এল অনেক ভুট্টা। তার দরকার আট গন্ডা পয়সা। বিদ্যাসাগর তার ভুট্টাগুলো নিয়ে নিলেন আর তাকে দিয়ে দিলেন আট আনা পয়সা।এভাবে আরও অনেক সাঁওতাল এল ভুট্টা নিয়ে। যে যেমন পয়সা চাইল তাকে সে পয়সা মিটিয়ে বিদ্যাসাগর ভুট্টাগুলো সারি সারি তাকে সাজিয়ে রাখলেন।একটু পরেই অনেক সাঁওতাল বিদ্যাসাগরের বাংলোর সামনে ভিড় করল। বিদ্যাসাগরকে দেখেই তারা বলে উঠল, ‘বিদ্যেসাগর, আমাদের খেতে দে।’ বিদ্যাসাগর সব ভুট্টা ওদের দিয়ে দিলেন (পৃষ্ঠা ১৪৫-৪৬)।
পাঠকদের অনুরোধ, আজকের ভোগবাদী, হানাহানির, অবিশ্বাসের বিষাক্ত দিনে আপনারা নিজে কিনে এ বই পড়ুন এবং আপনাদের সোনার সন্তানদের পড়ান যাতে তারা ‘রোবট’ না হয়, শিক্ষিত অমানুষ না হয়।