‘ওই লাশটা কার?’ বেগে সাইকেল চালিয়ে তাকে ছুঁয়ে ফেলে তেতোঢঙে জানতে চাইল লোকটা। পিচপথে রোদের প্রখরতায় ক্ষুধাতৃষ্ণায় যন্ত্রণাকাতর ভিভা বুঝতে পারল যে তার পা দুটো কাঁপছে। সাইকেলচালক মুখের মাস্ক খানিক নামিয়ে ভিভার শূন্য দৃষ্টির দিকে একভাবে তাকিয়ে বলল,’ এই লাশের মালিক কে?’ সে দ্বিতীয়বার জানতে চাইল।
‘কার…?’, হতবাক ভিভা পুনরুক্তি করল।
‘একই প্রশ্ন কোরো না। ওই লাশ কার, পেছনের ওই গাছের নিচে পড়ে?’
এরমধ্যেই আর এক সাইকেল – আরোহী এসে জুটল। তার মুখেও মাস্ক।’ মাস্ক নামিয়ে রেখেছ কেন?অ্যাক্ষুনি ওপরে তোলো।’ ভিভাকে তিরস্কার করে বলল সে।
এরপর প্রথম সাইকেল – চালকের কাছে জানতে চাইল, ‘এই লাশ সম্পর্কে ও কী বলছে?’
‘ও মনে হচ্ছে কিছু জানে না। ‘
‘কে জানে কখন মরেছে?আর কারা ওকে এখানে ফেলে কোথায় গেল তাও জানার উপায় নেই।’
লোকদুটো দূরে চোখ চালিয়ে খুঁজতে চেষ্টা করল কিন্তু ঠা ঠা রোদের তাপে অস্পষ্টভাবে চকচক করতে থাকা লম্বা পিচপথে কাউকে ঠাওর করতে পারল না।
‘গত সাত আটদিন যাবৎ মানুষের দল বাকসো-প্যাটরা, বোঁচকা- বুচকি নিয়ে এই পথ ধরে ভবঘুরের মতো হেঁটে চলেছে ‘, এক সাইকেল – আরোহী বলল।
‘গত সন্ধে অব্দি নজর রেখেছিলাম। অবশ্যই কেউ অধিক রাতে বা ভোরের দিকে এই লাশ ফেলে গেছে।’
‘জানি না, কেউ এই লাশ এখানে ধপ করে খালাস করে গেছে নাকি ও এখানেই মরেছে!’
‘কেন কেউ মূল সড়ক থেকে প্রায় কুড়ি ফুট দূরে গাছের নিচে এই লাশ খালাস করে যাবে?’
‘গতকাল এই রাস্তায় তো তোমার পাহারাদারি ছিল। রাতের বেলায় কেউ এসে তোমাকে না ছাড়া অব্দি অপেক্ষা করোনি কেন?’ যদি কেউ এ পথে বাইরে থেকে এসে কোনও প্রকারে ঢুকে থাকে, তাহলে? ‘
কোভিড-আক্রান্ত কেউ বাইরে থেকে এসে গ্রামে ঢুকতে পারে এই ভয়ে গ্রামবাসীরা অনিয়মিত পাহারাদারির ব্যবস্থা করেছিল যাতে করে পায়ে চলা ভবঘুরেদের ওপর নজর রাখা যায়। তা সত্ত্বেও আজ এ রকম একটা ঘটনা ঘটে গেল।
‘কেউ তো গ্রামে ঢুকেছে বলে মনে হয় না। কিন্তু যারা এই লাশ ফেলে গেছে তারা বেশিদূর যেতে পারেনি। হয়তো এই লোকটা জানবে…।’
‘ও তো কিছু জানে বলে মনে হচ্ছে না। এই মুহূর্তে আমাদের ঠিক করতে হবে, এই লাশ নিয়ে কী করা উচিত।’
‘পুলিশে খবর দেব? ‘
‘তারা কী করবে? একটা রিপোর্ট লিখবে। হয়তো এই লাশের বিস্তারিত বিবরণ খুঁজে বের করবে, তারপর আমাদেরই বলবে সদ্গতি করতে। আর আমাদের ঘাড়ে
এই কাজের বোঝা চেপে যাবে।’
‘ততক্ষণে দেহ পচে যাবে।’
‘আর যদি সে করোনায় মরে থাকে তাহলে তো গোটা গ্রাম বিপদে পড়ে যাবে।’
দুজনের একজন ভিভার দিকে ঘুরে তাকাল।
‘আমরা কেন এই লোকটাকে এই কাজটা করতে বলব না ‘, সে বলল।
‘এটা মন্দ নয়! ওর ঝাড়া হাত পা। চলো ওকে ওই গাছতলায় নিয়ে যাই। ‘ দুই সাইকেল -আরোহী জানত যে গ্রামের কেউ এই লাশ ছুঁতে রাজি হবে না।
পুরো কথাবার্তাই ভিভার সামনে হচ্ছিল। সে তো ভয়ে আঁকড়ে গেল। এ এক মহা দুর্যোগ। গত তেরো চোদ্দদিন ধরে নাকি পনেরো ষোলো দিন? – একের পর এক আকস্মিক দুর্বিপাকের সামনে পড়েছে সব।
সে ভেবেছিল সূর্য মাথার ওপর থেকে কামড়ে ধরার আগে অনেকটা পথই পেরিয়ে যেতে পারবে, কিন্তু তারা তাকে আটকে দিয়েছে, আর এখন ওদের মুখে হুঙ্কারের ভাষা।
‘এ লাশ কার, জেনে কাজ নেই। এর সদ্গতি না করে তুমি যেতে পারবে না ‘, তারা বলল।
ভিভার পা কাঁপতে লাগল; আবার এক নতুন উৎপাত তাকে গিলে খেতে চাইছে। তার দুর্দশা দেখে লোকদুটোর হয়তো মায়া হল। তাই একজন জানতে চাইল,’ তোমার কি খুব খিদে পেয়েছে?’
সে অনাহারেই ছিল যদিও তার খাওয়ার কোনও ইচ্ছাই ছিল না আর তার গলা শুকিয়ে কাঠ। ‘ জল…আমার কাছে কোনও টাকাপয়সা নেই ‘, মকমক শব্দে বলল সে।
‘তুমি সব পাবে, এস।’
ওরা দুজন সাইকেল ঘুরিয়ে নিল। একজন দ্রুত সাইকেল চালিয়ে সবকিছু রেডি করতে ছুটল যখন ভিভা বহুকষ্টে অন্য সাইকেল – আরোহীর পেছপেছ হাঁটতে লাগল। লোকটা তাকে ক্যারিয়ারে বসতে বলতে পারত কিন্তু সে আক্রান্ত কি না সে ব্যাপারে আরোহী নিশ্চিত হবে কীভাবে! যদি এভাবেই গ্রামে করোনার মড়ক ঢোকে তাহলে কী হবে?
গোয়া ছেড়ে আসার পর থেকে ভিভার সামনে অসংখ্য মানুষ পড়েছে, কিছু মানুষ সামনে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে চলেছে, কিছু তার পেছন পেছন, কিন্তু কীভাবে তাদের সঙ্গী ভাবত সে? প্রত্যেকেরই ঘরে ফেরার তাড়াহুড়ো। ভিভা বেশ কয়েকবার পথচলতি ট্রাকে চেপে অনেকটা পথ পেরিয়েছে এই আশায় যে আরও বাড়ির কাছাকাছি এগোল ; ভাড়া যা চেয়েছে তাই দিয়েছে। এভাবে গোয়া ছাড়ার পর কোলাপুর থেকে শোলাপুর পর্যন্ত যে দূরত্ব সে পেরিয়েছে তাতে তার মনে হয়েছে সে তার গ্রামের অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে কিন্তু এখন তার পকেট ফাঁকা। রাস্তার পাশে একটা ট্রাক এসে থামল। যারা পয়সাকড়ি দিয়ে কষ্ট করে তাতে চাপতে পারল তাদের নিয়ে ট্রাকটা দূর পথে মিলিয়ে গেল। তার গ্রাম নান্দেদ অনেকটা দূরে। সে কি আদৌ গ্রামে ফিরতে পারবে, নিশ্চিত নয় সে।
লাশটা যেখানে পড়ে ছিল তা প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে যখন তারা দেখল একদল পরিযায়ী মানুষ ব্যাগপত্র, বোঁচকা – বুচকি নিয়ে সেদিকেই এগিয়ে আসছে। ভিভা ভয় পেল, হয়তো ওদের মধ্যে কেউ তাকে চিনে ফেলবে! তারা তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেও সে কিছু বলার অবস্থায় নেই। তাই সে কায়দা করে সেই দঙ্গল আর সাইকেল -আরোহীর মাঝে দাঁড়িয়ে হাঁটতে থাকল এবং কাছাকাছি এলে মুখ ঘুরিয়ে এগোতে লাগল।
জনা পাঁচ ছয় গ্রামবাসী নিরাপদ দূরত্বে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়েছিল ; লাশ নিয়ে কথাচার করছিল, কিন্তু কেউই লাশের পরিচয় সম্পর্কে কোনও হদিশ দিতে পারল না। একজন যে জানত সে চুপ মেরে থাকল।
লাশ কি কারও আপন হতে পারে! কোনওভাবেই? জিবিতকালে এই মহিলা হয় কারও মা, নয়তো বউ… কিন্তু মারা যাওয়ার পর সে কার? এ সব আলোচনা অযৌক্তিক। মহিলার লাশ যদি কথা বলতে পারত তাহলে হয়তো বলত, তিনদিন আগে রাস্তার ধারে সে তার সন্তানকে মাটিচাপা দিয়ে এসেছে যদিও তার স্বামী
পীড়াপীড়ি করেছিল যে সন্তানের লাশ সেখানেই ফেলে রেখে তারা এগিয়ে যাবে।
ভিভা লাশের দিকে এগিয়ে চোখ ঘুরিয়ে অনিশ্চিতভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল। সাইকেল -আরোহী গ্রামবাসীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য জড়ো হল আর ভিভা শুনল যে তারা মৃত মহিলার জাত-ধর্ম নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে। এই লাশ কি তারা দাহ করবে নাকি কবর দেবে… দাহ করতে গেলে তো খরচ অনেক, তার চেয়ে পুঁতে দেওয়াই ভালো। কিন্তু পুঁতবে কোথায়? গ্রামে কোথাও পুঁতে ফেলতে চাইছে না তারা, তাই গ্রাম-সীমানার বাইরে কোনও নিচু জায়গায় লাশ পুঁতে দেওয়া যেতে পারে, যেখানে পড়ে আছে তার থেকে কিছুটা দূরে। যে লোক এই কাজটা করবে তাকে কিছু টাকা ধরিয়ে দিলেই হবে, এই ভেবে প্রত্যেক উপস্থিত গ্রামবাসী দশ টাকা করে বের করল এবং বাকিটা আর একজন দিয়ে সাকুল্যে একশো টাকা তুলল। যে সাইকেল -আরোহী খাবার আর জল আনতে গ্রামে গিয়েছিল সে তখনও ফেরেনি। এদিকে গ্রামবাসীরাও আর সময় নষ্ট করতে রাজি নয় ; তাই তারা ভিভাকে ডাকল যদিও দশ ফুট দূরত্বে সে দাঁড়াচ্ছে কি না সে ব্যাপারে সচেতন হয়ে নিল।
রাস্তার ধারে নিচু জমি অব্দি ভিভাকে লাশ টেনে নিয়ে যেতে হবে, গ্রামের লোকজন যে লাশ ছোঁবে সে আশায় জল।
ভিভার না খেতে পেয়ে ক্লান্ত, সে ঠিক করেছে লাশের দিকে তাকাবে না, কিন্তু এখন আর তার এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই ; তাই সে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল।সে থামল, নিচু হয়ে দু হাতে লাশটা আঁকড়ে ধরে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় তুলতে লাগল। খুবই ভারী চেহারা। অথবা প্রাণবায়ু বেরিয়ে গিয়েছে বলে ভারী হয়েছে! লাশ কোনওমতে টেনে রাস্তায় তুলে সে আবেগতাড়িত হয়ে পড়ল। এরপর নিচু হয়ে একটা হাত লাশের ঘাড়ের পেছনে বাঁকিয়ে ঢোকাল আর একটা হাত হাঁটুর নিচে রাখল। তারপর দেহের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে লাশটা চাগিয়ে তুলে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
যে নিচু জায়গায় লাশটা পোঁতা হবে সে পর্যন্ত নিয়ে যেতে ভিভা হাঁপিয়ে -ধুকিয়ে একাকার। গ্রামবাসীরা আগেই সেখানে গর্ত খুঁড়ে রেখেছিল দেখে সে অবাক হল। তাদের আশঙ্কা ভিভার করোনা হয়ে থাকতে পারে তাই সে তাদের কোদালে হাত দিক, তা চায়নি।
‘লাশটা এই গর্তে ধপ করে ফেলে দাও ‘, তারা দূর থেকে চেঁচিয়ে বলল। কিন্তু ভিভা তা করল না। সে সাবধানে লাশটি গর্তের মধ্যে নামাল। তার মেয়ে যখন মারা যায় তার চোখের জল সবটা শুকিয়ে গিয়েছিল। এরপর হয়তো আমার পালা, সে যখন এমনটা ভাবছে গলায় কিছু একটা দলা পাকাচ্ছে কিন্তু মুখ শুকিয়ে কাঠ হওয়ায় এই অস্বস্তি দূর করতে খানিক লালাও গিলে উঠতে পারছে না।
‘এবার মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করে দাও ‘, গ্রামবাসীরা ডাক পেড়ে বলল।
ভিভা সেইমতো কাজ করতে লাগল। ঠেলে ঠেলে মাটি গর্তে ফেলতে লাগল যতক্ষণ না তারা থামতে বলে।
‘ওতেই হবে। আমাদের দায়িত্ব শেষ, এখন আমরা যেতে পারি।’ তারা বলল।
তারা দুটো মোটা ভাকরি (গোলাকার রুটি জাতীয় খাবার) কাগজে মুড়ে, সঙ্গে এক প্লাস্টিক বোতলের জল আর কিছু টাকা কাছাকাছি আল-মতো উঁচু জায়গায় রাখল। টাকা যাতে হাওয়ায় উড়ে না যায় তার জন্য ওপরে পাথরের টুকরো চাপা দিল আর বলল,’ ওখানে একশো টাকা আছে। ‘তারপর মুখে মাস্ক ঠিকঠাক টাঙিয়ে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ভালোভাবে কাজটা হল বলে সন্তুষ্টিতে নিজেদের সেঁকে নিয়ে গ্রামের পথে ফিরে গেল।
উঁচু আলপথে খানিক থিতু হয়ে বসে ভিভা ঢকঢক করে খানিকটা জল খেলো। কাগজের মোড়ক খুলে দেখল সেখানে দুটো ভাকরি আর সামান্য রসুনের চাটনি আছে। ভাকরির টুকরোয় কামড় দেবার সময় রসুনের ঝাঁঝ নাকপথে ঢুকে তাকে অভিভূত করল কিন্তু তার খিদে উবে গেছে যেন। সে খাবারটা মুড়ে প্যান্টের একটা পকেটে ঠুসে দিল। তারপর টাকাগুলি গুনে জামার পকেটে রাখল।
লাশটি যেখানে শোয়ানো হয়েছে তার ওপরের নতুন মাটির ঢিবিপানে তার নজর গেল আর সে কোনওমতে পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল। ভাবল, আমার যদি এমন মরণদশা হয় তাহলে গ্রামে মা ও ভাই কখনোই জানবে না যে আমাদের তিনজনের পরিবারের একজন পথের পাশে মরে পড়ে আছে! আমার কপালে যদি মরণই থাকে, আমি যেন আমার গ্রামের বাড়িতেই মরি, সে ভাবল।
জলের বোতল হাতে করে সে বড় রাস্তায় উঠল। রোদে গা পুড়ে যাচ্ছে। সে দ্রুত হাঁটতে লাগল এই আশায় যে তার পকেটে যে একশো টাকা আছে তাতে নিশ্চয়ই কোনও ট্রাক ড্রাইভার তাকে তার ঘর অব্দি পৌঁছে দেবে।
(অনূদিত গল্প (‘Konkani’) মূল—’Whose Corpse is That’ by Damodar Mauza/ Eng.Translation by Vidya Pai / বাংলা তরজমা – ‘কার লাশ?’/ বিপ্লব বিশ্বাস।)