‘…মুমকিন হ্যায়’। কখনও মুমমিন কি গ্যারান্টি, আবার নিজেই নিজের ট্রাম্প কার্ড। ঐতিহাসিক, ঐতিহ্যশালী বাবরি মসজিদকে শহিদ করে রাম মন্দিরে রামলালা প্রতিষ্ঠা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মন জয় করেছেন। কেউ কেউ তাঁকে বাপের ব্যাটা বলে উচ্ছাস প্রকাশ করছেন। আবার কেউ কেউ প্রকাশ্যে না হলেও মনে মনে খুশি। ব্রাহ্মণ্যবাদ ও মনুস্মৃতি জারিত হয়েও, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য -শুদ্র বিভাজনে লালিত হয়েও এবং শুদ্র কে ব্রহ্মার পদ দেশ থেকে জন্ম নেওয়া বলে, অস্পৃশ্য ভেবেও বর্ণহিন্দু ভোট, কর্পূরী ভোট ও চৌধুরী চরণ সিংকে ‘ভারতরত্ন’ দিয়ে ওবিসি ও কৃষক ভোটারদের আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করেছেন ‘ আমি তোমাদের লোক ‘।
ভগবানরূপে জনগণকে বোকা বানাতে অরাজনৈতিক রাষ্ট্রপতির জাতকে নির্বাচনী প্রচারের হাতিয়ার করেছেন (এই সময়, ১১ফেব্রু. ২০২৪)। কিন্তু সংসদ ভবন উদ্বোধন, রাম মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন এবং মন্দির উদ্বোধনে আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না। এটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি।
রাজনীতি বড়ো বিষম বস্তু। নাথুরাম দেশপ্রেমিকের সম্মান পায়। গুজরাতে বিলকিস বানু মামলায় অভিযুক্তরা রাজ্য সরকারের অনৈতিক প্রয়াসে মুক্তি পেলে তাদের ফুলের মালা দিয়ে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। আবার সন্দশখালীতে গ্রেপ্তার হওয়া দুই রাজনৈতিক দলের দুজন হাজত মুক্তি ঘটলে তাদেরও ফুলের মালা দিয়ে সম্মানীত করার প্রচেষ্টা দেখা যায়।
অসত্যই কেবল মিথ্যা নয়, সত্য গোপনও চরম মিথ্যাচার আজকের এই জলঘোলানো রাজনীতিতে। বেআইনি অনুপ্রবেশকারীরা –কেউ অনুপ্রবেশকারী ও কেউ শরণার্থী। সবটাই ধর্মীয় বিদ্বেষী বিভাজন। অনুপ্রবেশকারী তালিকায় কেবল মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা, যদিও এই বিভাজন ভারতীয় সংবিধানের ১৩, ১৪, ১৫, ১৬ ও২১ নম্বর ধারার বিরোধী। এদেশে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন চলে না। বহু পূর্বে আবদুল গণি’র ‘দামাল’ বলে একটা পত্রিকা ছিল, যেখানে প্রথম পাতায় লেখা থাকত ‘সত্য সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ’। বাংলাদেশ বা অন্য কোন রাষ্ট্র থেকে মুসলমান আসলে হয় অনুপ্রবেশকারীর তকমা, আর হিন্দুরা আসলে হয় শরনার্থী।
প্রধানমন্ত্রীর মহিমাবাচক ও গুণকীর্তন করা নাটিকা করতে হবে সরকার থেকে অনুদান নামক ‘খুড়োর কল’ প্রাপ্ত নাট্য দলকে। না হলে কেন্দ্রীয় ভর্তুকি বন্ধ হবে। এটাও একটা ভোটের তাস! সংস্কৃতি জগতেও গেরুয়াকরণ, স্ক্রিপ্টে লেপ্টে আছে সঙ্ঘের মতাদর্শ, মনুবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের জারণ ও আধিপত্য। নির্দেশিত নাটিকাটি ‘লে আয়ে ওয়াপস সোনে কি চিড়িয়া’ অর্থাৎ ‘সোনার পাখি ফিরিয়ে এনেছি’। ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস এবং সবকা প্রয়াস’ এবং সাথে ‘বিকশিত ভারত’ ও ‘অখণ্ডতা’-র মতো হিন্দুত্ব মতাদর্শেরও প্রতিফলন আছে এখানে ! (এই সময়, ১৪ফেব্রু. ২০২৪, পৃ: ১ ও ২)
টার্গেট ইয়ংস্টারস্। কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক ও সহযোগী সংস্থাগুলিকে গৈরিকীকরণের ফাঁসে মোদী-মাহাত্ম্য প্রচারে ও ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ অভিযানের লোগোকে লোকসভা ভোটের প্রচারে ব্যবহার করে নির্লজ্জতার প্রমান দিতেও কসুর করছে না ! ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও পড়ুয়াদের সংস্কৃতিবান, সাহসী এবং সর্বোপরি দেশপ্রেমী তৈরী করতে ৮টি বিভিন্ন থিমে ট্রেনিং দিয়ে স্বাভিমান, শৌর্য ও সাহস, পরিশ্রম ও সমর্পণ, করুণা ও সেবা, বৈচিত্র ও একতা, সত্যনিষ্ঠা ও সুচিন্তার ভিত্তিতে ভারতীয় নাগরিকদের একটি ধরাবাঁধা টেম্পলেটে ফেলতে চাইছেন। প্রোগ্রাম ডিজাইন করতে দায়িত্ব দিয়েছে গুজরাটেরই আইআইটি গান্ধীনগরকে। অনেকেই সন্ধিহান হয়ে বলছেন যে, স্কুল পড়ুয়াদের গুজরাটে নিয়ে গিয়ে একেবারে আর এস এসের ঢঙে ছেলেবেলা থেকেই স্কুল পড়ুয়াদের মাথায় ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিষবৃক্ষ রোপন করার কৌশলের নমুনা। এগুলো হচ্ছে পড়ূয়াদের হৃদয়ে একেবারে বাল্যকাল থেকেই মগজধোলাই করে আফিমের নেশায় বুঁদ করার আর এস এসের টেকনিক।(এই সময়, ১৩ই ফেব্রুয়ারি ২০২৪, পৃ: ১ ও ৭)
১৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে রাজস্থান সরকার প্রত্যেক পড়ুয়ার জন্য ‘সূর্য প্রনাম’ বাধ্যতামূলক করেছে (পুবের কলম, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪)।
একইভাবে ২০২১সালে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে সিন্ধু, গাজিপুর ও টিকরি সীমানা অবরোধ করে কৃষকেরা টানা এক বছর অবস্থান করেছিল। চাপের মুখে ভ্রষ্টাচারি ও স্বৈরাচারীর দল তিন অগণতান্ত্রিক কৃষি আইন প্রত্যাহার করে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এম এস পি-র আইনি গ্যারান্টির দাবি খতিয়ে দেখবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, দু’বছরেও কিছু করে নি ‘বিকশিত ভারত’-এর প্রবক্তারা। (আনন্দ বাজার ও এই সময় ,১৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪)
এখনকার বাজেট “জ্ঞান”-এর উপর কেন্দ্রীভূত পি এম য়ের সৃষ্টির একটি সংক্ষিপ্ত রূপ, যা ‘গরিব ( অবহেলিত), যুব (যুবক), অন্নদাতা (কৃষক) এবং নারী শক্তি (নারীর ক্ষমতায়ন)’-এর প্রতীক (এই সময়, ১৫ই ফেব্রু. ২০২৪)। এগুলি সবই বাহুবলী রাজনীতির জুমলা ভাষণ। নারী শক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন নয় বরং মুসলিম নারীর মৃতদেহকে কবর থেকে তুলে ধর্ষণের হুঙ্কার। এমনকি মহিলা কুস্তিগীরদের যৌনহেনস্থাকারী ব্রিজ ভূষণ শরণসিং, ধর্মগুরু আশারামবাপু, রাম-রহিম বাবার বিষয়ে সরকার নীরব দর্শকের ভূমিকায়। এটাই নারীর ক্ষমতায়নের অকৃত্রিম প্রকাশের একটা হিমশৈলের চুড়া মাত্র।
এমতাবস্থায় ‘সবুজ বিপ্লব’-এর জনক ও প্রখ্যাত কৃষিবিজ্ঞানী এবং সদ্য ভারতরত্নে সম্মানিত এম এস স্বামীনামের কন্যা মধুরা স্বামীনাথন বলেন, ‘দেশবাসীকে খাবারের জোগান দেন কৃষকেরা। তাই তাঁদের সঙ্গে কোনও ভাবেই অপরাধীদের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। বা তাঁদের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে, তাও করা যায় না।’ অথচ দেশের অন্নদাতাদের সঙ্গে ক্রিমিনালদের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে ! যে স্বামীনাথনকে ভারতরত্নে ভূষিত করা হলো, তাঁর সুপারিশই সরকার কার্যকর করছে না, এটা এক ধরনের ভণ্ডামি ছাড়া আর কী হতে পারে !
হিন্দু খাতরেমে হ্যায়… তাই মুসলমানদের তাড়াতে না পারো, হত্যা করতে না পারো , রাজনৈতিক ভাবে শূন্য করতে না পারো, সাংস্কৃতিক ভাবে হিন্দুত্ব করে তোলো। বাঁচতে হলে হিন্দুত্বের নিয়মাবলী মেনে বাঁচো।
তর্জন, গর্জন, সিবিআই, ইডি, পোডা, এসমার মতো দানবীর আইনের প্রয়োগ তো আছেই। এরপরেও এনকাউন্টার করে বা ‘আরবান নকশাল’ এর তকমা দিয়ে জেলে পচাতে ওস্তাদ সবকা সাথের কারবারিরা।