আবদুল্লাহিল বাকি
বিগত দুই দশকে যে সমসাময়িক নব্য প্রাচ্যবাদের আবির্ভাব ঘটেছে, তা সাধারণভাবে আরব ও ইসলামী সংস্কৃতি সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক চিত্র তুলে ধরে। তবে প্রাচ্যবিদরাও স্বীকার করতে বাধ্য যে, স্পেন, ইতালি, ফ্রান্সে একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দির আরবি থেকে ব্যাপক অনুবাদ হয়েছিল ল্যাতিন ভাষায়। মধ্যযুগে ও রেনেসাঁর সময়ে ইউরোপে অ্যারিস্টটলীয় দর্শনের পুনঃপ্রবর্তনে প্রাথমিক উৎস হিসেবে তাদেরকে নির্ভর করতে হয়েছিল আরবি থেকে ল্যাটিন অনুবাদের উপর।
অষ্টম ও নবম শতকে প্রাচ্যে ছড়িয়ে গিয়েছিল ইসলাম। দশম শতাব্দিতে সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, মিশরের মাধ্যমে আরব ও ইউরোপের মাঝে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। স্পেনও ছিল মুসলমানদের হাতে নিয়ন্ত্রিত। ইউরোপীয় ক্রুসেডাররা একাদশ শতাব্দিতে যখন স্পেন দখল করে নেয়, তখন তারা সেখানে পেয়েছিল ইসলামী শিল্প, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান। এভাবেই ইতালি ও স্পেনের মাধ্যমে মধ্যযুগে ইউরোপে পৌঁছেছিল আরবীয় স্কলারশিপ ও বিভিন্ন মানবিক জ্ঞান।
এই প্রবন্ধে আলোচনা করব কয়েকটি বিষয়ে। পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল গবেষণা পদ্ধতিতে আরব প্রভাব, আরবি থেকে ল্যাতিন অনুবাদ, ইউরোপে ইসলামী সভ্যতার জ্ঞানগত অবদান। প্রাচ্য বনাম পাশ্চাত্য বিতর্কে, ‘আমরা বনাম তারা’ অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এই ধরনের পাঠ জরুরী।
ওয়েস্টার্ন স্কলারশিপের ক্ষেত্রে আরবি-ইসলামী সভ্যতার প্রভাব
অষ্টম থেকে একাদশ শতাব্দির মধ্যে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ইসলাম। মুসলমানদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয় মানব সভ্যতার তিন প্রধান কেন্দ্রস্থল এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে। ত্রয়োদশ শতাব্দির দিকে, এশিয়ায় মঙ্গোলদের উত্থানে বিভিন্ন মুসলিম রাজবংশের মধ্যে শুরু হয় অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতার লড়াই। এর মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে ইসলাম নতজানু হয়ে পড়ে। মুসলমানদের সাম্রাজ্যের অবসান মানেই কিন্তু ইসলামের বৈশ্বিক প্রভাবের সমাপ্তি ঘটেনি। ইসলামী সভ্যতার স্বর্ণযুগের দর্শন, চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতিষশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, অধিবিদ্যা, প্রকৌশল একটা স্থায়ী প্রভাব রেখে গিয়েছিল সমগ্র মানব সভ্যতায়। আধুনিক সমসাময়িক জ্ঞানের খুব কমই আছে, যা আরবি ও ইসলামী জ্ঞানীদের অগ্রণী কাজে প্রভাবিত হয়নি।
ইসলাম আগমনের দ্বিতীয় শতকের মধ্যেই ফিকহকেন্দ্রিক মাজহাবব্যবস্থা শুরু হয়ে গিয়েছিল। ইসলামী আইন ও ফিকহ চর্চার ক্ষেত্রে মাজহাবকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাই বর্তমানের উচ্চ শিক্ষা কাঠামোর ভিত্তি। এ বিষয়ে চমৎকার কাজ করেছেন জর্জ আব্রাহাম মাকদিসি। লিখেছেন ‘The Rise of Colleges. Institutions of Learning in Islam and the West’ (কলেজের উত্থান : ইসলামে ও পশ্চিমে শিক্ষার প্রতিষ্ঠান)। গ্রন্থটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, দুই ধারার তুলনামূলক শিক্ষাব্যবস্থা, এবং একটি থেকে অন্যটির উত্তরণের ইতিবৃত্ত বোঝার ক্ষেত্রে।
এই গ্রন্থে তিনি বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার অন্টোলজি ল্যাটিন ‘Docere’ শব্দের উপর। এর অর্থ হল শেখানো। এটি ছিল মধ্যযুগের জ্ঞানীদের ডক্টর উপাধী। এক্ষেত্রে ‘Licentia Docendi’ শব্দটিও ব্যবহৃত হত। উপাধিটি ছিল মর্যাদাপূর্ণ। এটি ছিল স্কলারশিপের একাডেমিক প্রমাণ। আধুনিক ডক্টর শব্দটি ল্যাটিন ‘Docere’ শব্দ থেকে আগত। আর ‘Licentia Docendi’ শব্দটি ছিল আরবির ‘ইযাযাতুত তাদরিস’ ধারণার ল্যাতিন ভার্সন। ইযাযাতুত তাদরিস ইসলামী ট্রাডিশনে শিক্ষকতা ও ফতোয়া প্রদানের অধিকারকে বোঝায়। ফতোয়া শব্দটি এসেছে আরবি ‘ইফতা’ (আইনি মতামত প্রদান) থেকে। ইসলামী সভ্যতায় ‘ইযাযাতুত তাদরিস’ ছিল ফিকহ গবেষণার ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষার এক ধরনের একাডেমিক ডিগ্রি। এই ডিগ্রি অর্জন করতে হলে উচ্চ শিক্ষার শিক্ষার্থীকে চার থেকে আট বছর কঠোর অধ্যয়ন ও অনুশীলন করে যেতে হত। এই ডিগ্রি অর্জন করতে হলে এক ধরনের ভাইভা পরীক্ষার প্রচলন ছিল। যা পরিচিত ছিল ‘খুতবা’ নামে। এই ডিগ্রি অর্জনের জন্য ইসলামী আইনশাস্ত্রের মূলনীতি ‘উসুলুল ফিকহ’-এ পারদর্শী হতে হত। তাকে বের করে আনতে হত বিভিন্ন ফিকহী প্রশ্ন, জটিলতা ও সমস্যার সমাধান। ছাত্রদের কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী তিন ধরণের ডিগ্রি তাদেরকে প্রদান করা হত। ১. ফকিহ, অর্থাৎ আইনশাস্ত্রের মাস্টার ডিগ্রিধারী। ২. মুফতী, অর্থাৎ আইনের ম্যাজিস্ট্রেট, ৩. মুআল্লিম, অর্থাৎ আইনের অধ্যাপক।
ইসলামী ডিগ্রিধারা পাশ্চাত্যের খ্রিস্টান আইন শিক্ষায় প্রাথমিকভাবে ‘ম্যাজিস্ট্রেট, প্রফেসর ও ডক্টর’ নামে গ্রহণ করা হয়। টলেডো, পাডুয়া, অক্সফোর্ড প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ডিগ্রিগুলোর উপর স্কলারশিপ প্রদান করা হত। ইসলামের ফিকহকেন্দ্রিক ডক্টরাল পদ্ধতি তারা গ্রহণ করেছিল বটে, কিন্তু পরবর্তীতে পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। ধর্ম পৃথক হয়ে পড়ে জ্ঞানের অন্যান্য শাখা থেকে।
আরবি থেকে ল্যাতিন অনুবাদের মাধ্যমে যেসকল মানবিক জ্ঞানের স্থানান্তর ঘটেছিল, তা ইতালীয় নবজাগরণের সময় ইউরোপে শিকড় গেড়েছিল। ইতালিতে এগারো শতকে মানবিক জ্ঞানের আবির্ভাব ঘটে ‘Ars Dictaminis’ (শ্রুতিলিপি শিল্প)-এর মধ্য দিয়ে। এটি ছিল সপ্তম শতাব্দির আরবি ‘ইমলা’ ধারণার অনুবাদ। ইমলা হল, ক্লাসিক্যাল আরবি প্রামাণিক বক্তা বা পণ্ডিতের কথাগুলো শোনার সাথে সাথে কাগজে লিপিবদ্ধ করে রাখা। ‘ইমলা’ শব্দের বহুবচন হল ‘আমালী’। সেখান থেকেই এসেছে ইউরোপীয় মানবিক জ্ঞানের সংকলনের ক্ষেত্রে ‘Florilegia’ টার্মটি।
আরবি থেকে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ আন্দোলন
ডাগ নিকোলাস হ্যাসে একটা গ্রন্থ লিখেছেন ‘The Social Conditions of the Arabic-(Hebrew-)Latin Translation Movements in Medieval Spain and in the Renaissance’ নামে। সেখানে তিনি তুলে ধরেছেন —
আরবি থেকে ল্যাটিন অনুবাদের প্রথম দিকের কাজগুলো ১১ শতকের ইতালিতে কনস্টানটাইন আফ্রিকানদের দ্বারা হয়েছিল। ১২ শতকে স্পেনে জনপ্রিয় হয়ে উঠে আরবী জ্যোতির্বিজ্ঞানের গ্রন্থাবলি। জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে মুসলিম গণিতবিদ ও বিজ্ঞানী আবু মাশার বালখী (১৭১ – ২৭১ হি.) লিখেছিলেন ‘আল-মাদখালুল কাবীর: মুকাদ্দামুন ফি ইলমিত তানজিম’ (The Great Introduction to Astrology)। বইটি অনূদিত হওয়ার পর খ্রিস্টান চার্চের ধর্মতাত্ত্বিক মতবাদের সাথে সংঘর্ষের সৃষ্টি করে। অ্যারিস্টটলের উপর লেখা আল-কিন্দীর ‘কিতাবুল ইদাহ লি-আরাস্ততালিস ফিল খাইরিল মাহদ’ (The book of Aristotle’s explanation of the pure good) বইটি ল্যাতিন ভাষায় অনূদিত হয় ‘Liber de Causis’ নামে। অনুবাদ করেছিলেন ক্রেমোনার জেরার্ডো। আল-ফারাবির ‘ইহসাউল উলূম’ (Enumeration of the Sciences) গ্রন্থটিও অনূদিত হয়। আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের অনুবাদ হয়েছিল দ্বাদশ শতকে। ইহুদি আরবি-ল্যাতিন জ্ঞানী ইবনে দাউদ অনুবাদ করেছিলেন ইবনে সিনার ‘কিতাবুন নাফস’ De Anima নামে।
ক্রুসেডাররা প্রচুর পরিমাণে আরবি লিটারেচারের ভাণ্ডার নিয়ে এসেছিল, এসবের প্রচুর চাহিদা ছিল ফ্রান্স ও টলেডোতে। পাশ্চাত্যের ধর্মতত্ত্বের ছাত্ররা পাঠ ও অধ্যয়ন শুরু করে জাবির বিন হাইয়ান, ইবনে সিনা, আল-ফারাবির গ্রন্থাবলি।
১১ শতকে ক্রুসেডারদের কাছে মুসলিম সিসিলির পতন হয়। আরবি লিটারেচারের পথ উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল পাশ্চাত্যের জন্য। অ্যারিস্টটলের উপর ইবনে রূশদ যত ব্যাখ্যা রচনা করেছিলেন সেগুলো অনূদিত হয়ে গিয়েছিল উইলিয়াম অফ লুনারের হাতে। ১২ শতকে টলেডোর শিক্ষার্থীদের জন্য গ্রন্থগুলো অবশ্যপাঠ্য ছিল। ১৩ থেকে ১৭ শতকে ইবনে রূশদ আবির্ভূত হন ইউরোপের সবচে প্রভাবশালী দার্শনিক হিসেবে। এছাড়াও তখন অনূদিত হয়েছিল গাযালীর গুরুত্বপূর্ণ বইপত্র।
ইতালীয় রেনেসাঁ এবং ইউরোপীয় রাজনৈতিক চিন্তাধারা
মধ্যযুগীয় এবং ক্লাসিক্যাল রাজনৈতিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে একজন একাডেমিক গবেষকের জন্য সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলোর সাথে তাদের অধ্যয়ন ক্ষেত্রের প্রাসঙ্গিকতার জন্য একটি সুস্থ ইতিবাচকতা বজায় রাখা সবসময়ই একটি চ্যালেঞ্জ। এখানে পরস্পরবিরোধী এবং প্রায়ই জটিল ঐতিহাসিক বর্ণনা রয়েছে যা অস্পষ্ট করে তোলে সত্যকে। ইতালীয় রেনেসাঁ ও ইউরোপীয় রাজনৈতিক চিন্তার পাঠ এই সংকটে জর্জরিত। রাজনৈতিক তত্ত্ব বোঝার ক্ষেত্রে আইন-কানুনের পাঠ উপযোগী কিনা — এর পক্ষে বিপক্ষে মত আছে। তবে এটা অবিসংবাদিত যে, রাজনৈতিক চিন্তাধারার মানবিক বিবর্তন অনুধাবন ও সংজ্ঞায়িত করার সর্বোত্তম উপায় রাজনৈতিক আইন-কানুনের অধ্যয়ন। ইউরোপীয় রাজনীতির উৎস অনুধাবন করতে হলে গ্রীক রাজনৈতিক চিন্তাধারা গভীরভাবে গাঠ করতে হয়। আর এজন্য সহায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয় গ্রীক পাঠ্যের আরবি অনুবাদ অথবা সেটার উপর ভিত্তি করে তৈরি মুসলিম দার্শনিক ইবনে সিনা, ফারাবি ও ইবনে রূশদের লেখালেখি। এই বিষয়ে ক্যাথরিন এইচ. বুলক একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘Re-Telling the History of Political Thought’ (রাজনৈতিক চিন্তা ইতিহাসের পুনরুল্লেখ) নামে।
তিনি এখানে বলেছেন, গ্রিক চিন্তা দ্বারা ইউরোপের রাজনীতি প্রভাবিত হয়েছে — কোনও সন্দেহ নেই। এবং এক্ষেত্রে অবদান রেখেছে আরবীয় দার্শনিক, ব্যাখ্যাকার ও অনুবাদকগণ। কিন্তু গ্রিক দর্শনকে পাশ্চাত্য রাজনীতির একমাত্র ভিত্তি মনে করা অতি সরলীকৃত একটি ধারণা। এর পক্ষে ঐতিহাসিক সমর্থন কম। পাশ্চাত্যের রাজনীতি প্রভাবিত হয়েছিল গ্রিক চিন্তার পাশাপাশি ভারত, চীন ও আরব রাজনৈতিক তত্ত্ব থেকে। বিশেষত আরবে কানুনের বিকাশ ঘটেছিল ফিকহ নামে ও এর উপর প্রচুর লেখালেখি হয়েছিল। ইউরোপের বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক কানুন তৈরিতে এর প্রভাবক ভূমিকা ছিল। তাই দৃঢ়ভাবে বলতে হয়, প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের সময় থেকে ইউরোপীয় রেনেসাঁ পর্যন্ত রাজনৈতিক চিন্তার অগ্রগতির বাস্তববাদী ফলাফলে পৌঁছতে হলে অবশ্যই পূর্ব-পশ্চিম বিভাজনের বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে। তাহলেই ইউরোপের রাজনৈতিক ধারার বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ সম্ভব হবে।
ইউরোপীয় সাহিত্যে আরবি সাহিত্যের প্রভাব
রেনেসাঁর যুগে ইউরোপে যে বৈজ্ঞানিক প্রবণতা ছড়িয়ে পড়েছিল, তার উৎপত্তি হয়েছিল খুবই সাধারণরূপে আরবদের হাতে। আরবরা বেস ধাতুকে সোনায় রূপান্তর করার পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিল। সেসব পরীক্ষায় বিরাট কোনও ফলাফল বেরিয়ে আসেনি সত্য, কিন্তু সেগুলোই ছিল আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বীজ।এজন্য ইউরোপীয়রা মনে করে, আধুনিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আরবদের বেশ অবদান আছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠে, পাশ্চাত্যের সাহিত্যের ক্ষেত্রেও কি আরবদের অবদান আছে? সাধারণভাবে পাশ্চাত্যে প্রচলিত মত হল, আরবি সাহিত্য থেকে পাশ্চাত্যের সাহিত্যের ধারা যোজন যোজন দূরে অবস্থিত। কারো মনে এটা আসেই না যে, এর সাথে আরবি সাহিত্যের সংযোগ আছে। তারা মনে করে, ইউরোপীয় সাহিত্যের মূল উৎস কেবল ল্যাতিন ও গ্রিক সাহিত্য।
অল্প কয়েকজন গবেষক ও প্রাচ্যবিদ স্বীকার করেছেন যে, আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যের অন্যতম একটি উৎস হল আরবি সাহিত্য। তাদের মধ্যে আছেন স্যার হ্যামিল্টন আলেকজান্ডার রসকিন গিব। তিনি ‘Arabic Literature – An Introduction’ (আরবি সাহিত্যের ভূমিকা) গ্রন্থে বলেছেন, ‘এগারো শতকের শেষের দিকে, দক্ষিণ ফ্রান্সে এক নতুন শৈলীর প্রেম কাব্য আবির্ভূত হয়। শব্দ, মর্ম, বিষয় ও শৈলীতে ছিল এটি অনবদ্য। প্রাচীন ফরাসী সাহিত্যে এই ধরণের কবিতার কোনও নিদর্শন পাওয়া যায় না। তবে এই ধারার কবিতা অনেকটা আন্দালুসিয়ান কবিতার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আন্দালুসের গীতিমূলক কবিতা মুওয়াশশাহাত ও আজজালের সাথে ফরাসীর এই কবিতাধারার মিল ছিল। এই কাব্যের বিষয় কামহীন কুমারী প্রেম। ফলে এই নতুন ধরনের ফরাসি কবিতাকে আন্দালুসীয় আরবী কবিতা দ্বারা প্রভাবিত বলাই যুক্তিযুক্ত। কারণ, দক্ষিণ ফরাসি কবিতায় যে ‘কামহীন কুমারী প্রেম’ তত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছিল, ল্যাতিন ও গ্রীক সাহিত্যে তার দেখা মিলে না।’
উল্লিখিত বইতে এই মতটি তিনি জোরালো প্রমাণের মাধ্যমে সাব্যস্ত করেছেন। এটি কেবল ফরাসি কবিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, ইতালীয় কবিতাও সিসিলির আরবি কবিতা দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, বিশেষ করে জার্মানির দ্বিতীয় ফ্রেডরিকের রাজত্বকালে।পাশ্চাত্য কবিতা কতটুকু প্রভাবিত হয়েছে আরবি কবিতা দ্বারা — তা নিয়ে প্রশ্ন বা সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে, তবে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, ইউরোপের মধ্যযুগীয় গদ্য আরবি দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়েছিল। ইউরোপের মধ্যযুগীয় ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য ছিল কঠোর, অনমনীয় ও স্থবির। রচিত হত সেগুলো অভিজাত শ্রেণীর জন্য, জনসাধারণের কোনও অংশগ্রহণ ছিল না তাতে। ফলে যুক্তি ও বুদ্ধিকেন্দ্রিক সাহিত্যের পাশাপাশি ইন্দ্রিয়কেন্দ্রিক সাহিত্যেরও প্রয়োজন ছিল। এরই মধ্যে ইউরোপে অনূদিত হল কিছু অর্থপূর্ণ কাহিনী ও সিন্দাবাদের নাবিকের গল্পের মত কিছু রূপকথা। এখানে জনসাধারণ তাদের কাঙ্খিত প্রয়োজন খুঁজে পেয়েছিল। এসব গল্প বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এগুলো ছিল পাশ্চাত্যের কল্পনাকেন্দ্রিক সাহিত্যের মৌলিক বীজ। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সাহিত্যের সাথে দ্বন্দ্বে এগুলো স্থান করে নিয়েছিল মানুষের মনে। তখন থেকে পাশ্চাত্যে রোমান্টিক রূপকথাগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এসব গল্পের গভীরে গেলে দেখা যায়, এগুলো অনেকটাই আরব উৎস দ্বারা প্রভাবিত। তখনকার একটা উপন্যাসের নাম ছিল ‘কাসিম’। আর কাসিম শব্দটা একটা আরবি নাম।
বোঝা যায়, মধ্যযুগে ইউরোপীয় সাহিত্যের জনপ্রিয় স্রোতগুলো ল্যাতিন ও গ্রীক সাহিত্যের তুলনায় প্রাচ্য সাহিত্য চেতনার কাছাকাছি ছিল। ল্যাতিন ও গ্রীক সাহিত্যে ছিল এক ধরণের অভিজাততন্ত্র। অন্যদিকে প্রাচ্য সাহিত্যে ছিল কল্পনা, বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক রঙ। ইউরোপ যখন প্রাচ্যের সাহিত্য পাঠ করে, তখন ধারণ করে তার প্রাণ। প্রভাবিত হয় তার প্রকাশধারায়। নতুন কল্পনাকেন্দ্রিক সাহিত্য ইউরোপে শিকড় গেড়ে বসে। স্থানচ্যুত হয়ে যায় ঐতিহ্যগত সাহিত্য।
এটি ছিল মধ্যযুগের ফেনোমেনন। যখন বৈজ্ঞানিক নবজাগরণ শুরু হয়, তখন কিছুকাল প্রাচ্যকে অবহেলা করে ইউরোপ ঝুঁকে গিয়েছিল গ্রীক সভ্যতার অধ্যয়নে। প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যের মান ও সমালোচনাধারা ইউরোপে প্রচলিত হয়। এ সময় আবার ফিরে আসে পুরোনো ঐতিহ্যগত অভিজাততান্ত্রিক সাহিত্য-প্রবণতা। তবে কল্পনাপ্রবণ, ফ্যান্টাসি সাহিত্য একেবারে মুছে যায়নি। এটি প্রকাশিত হয়েছিল কিছু গৌণ মাধ্যমে। যেমন, ফরাসি রোমান্স, জার্মান লোককাহিনী ও ইংরেজি নাটক। মধ্যযুগের কল্পনাকেন্দ্রিক সাহিত্যের ধারাকে বৈজ্ঞানিক নবজাগরণ পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেনি। পরবর্তীতে অষ্টাদশ শতকে কল্পনাকেন্দ্রিক সাহিত্যেরই বিজয় আমরা দেখতে পাই।
এই বিজয়ের পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছিল ১৭০৪ সালে আরবি আলিফ লায়লার (সহস্র এক রজনী) অনুবাদ। জনসাধারণ খুবই আগ্রহের সাথে এসব গল্প গুলো পড়তে থাকে। লেখকরা অনুসরণ করতে থাকে এসব গল্পের প্যাটার্ন। এই গ্রন্থটি সাফল্য লাভ করেছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরেজি সাহিত্য ও ফরাসি সাহিত্যের বিশেষ অবস্থার দরুন। বইপত্রের বিস্তারের দরুন পাঠকদের এক নতুন শ্রেণী তৈরি হয়েছিল, যারা একাডেমিকভাবে ততটা শিক্ষিত ছিল না বটে, তবে পপুলিস্ট ও জনপ্রিয় সাহিত্যের প্রতি তাদের আগ্রহ ছিল। সাহিত্যিক ও লেখকগণ এদের কথা বিবেচনায় রেখে ছিলেন। এদের উপযোগী সাহিত্য তৈরি করতে চাচ্ছিলেন।কিন্তু এক্ষেত্রে একটা সংকট ছিল। পপুলার সাহিত্যের নমুনা ইউরোপে সাধারণত পূর্বে দেখা যায়নি। ফলে জনসাধারণের চাহিদা তারা বুঝতে পারছিলেন কিন্তু পূরণ করার উপায় বুঝতে পারছিলেন না। আলিফ-লায়লার অনুবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর জনসাধারণ এর উপর হুমরি খেয়ে পড়ে। এটা ছিল একদমই নতুন ফেনোমেনন। সাহিত্যিকগণ অধ্যায়ন করতে থাকেন মনোযোগ সহকারে আলিফ লায়লা। এর ভিতর এর সাহিত্য উপাদান, গল্প ধরন, আঙ্গিক, কল্পনাপ্রবনতা, অ্যাডভেঞ্চার, রূপকথা আত্তীকরণ করেন তারা। এই ধারার গল্প রচনা করতে থাকেন। এই ধারায় আমরা দেখতে পাই পাশ্চাত্যে রবিনসন ক্রুসো, গালিভার্স ট্রাভেলস ইত্যাদি গল্প— যা আরবি সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জার্মান সাহিত্য প্রভাবিত হয়েছিল ব্যাপকভাবে আরবি ফারসি ও ভারতের সাহিত্য দ্বারা। গ্যেটে তার অনেক গল্পে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন প্রাচ্যের চেতনায়। সিমাস হিনি যদিও প্রাচ্যের সাহিত্যকে বেশ উপহাস করেছেন, কিন্তু নিজের সাহিত্যকে এর প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে পারেননি।
শোপেনহাওয়ার ছিলেন প্রাচ্য সাহিত্যের প্রতি বেশ আগ্রহী। তিনি কামনা করতেন যেন জার্মানি থেকে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে প্রাচ্য সাহিত্যের প্রভাবের সম্প্রসারণ ঘটে। কিন্তু তার প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। ধীরে ধীরে পাশ্চাত্যে নতুন দার্শনিকদের আবির্ভাব হয়েছে। সামনে এসেছে নতুন রাজনৈতিক ধারণা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও বিকাশ ঘটেছে শিল্পের। এসব ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে প্রাচ্যের দিকে ছুটে যাওয়ার আর কোনো অবকাশ ছিল না পাশ্চাত্য সাহিত্যের।
জার্মান সাহিত্যকে বৈশ্বিক মানব সাহিত্যে পরিণত করার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন গ্যেটে, তা ভেস্তে যায় জাতীয় আন্দোলনের উত্থান ও জাতীয় দ্বন্দ্বের তীব্রতায়। তবে আধুনিক যুগের বিভিন্ন সময়ে প্রাচ্যের সাহিত্য যে প্রভাব ফেলেছিল পাশ্চাত্যে— তা উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। প্রাথমিক দর্শনে মনে হতে পারে, পাশ্চাত্যের বিশাল সাহিত্য সীমানায় প্রাচ্যের বুঝি কিছুই নেই অথবা খুবই অল্প। কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে আমরা বুঝতে পারি ইউরোপের নতুন সাহিত্য প্রবণতার বীজ লুকিয়ে আছে প্রাচ্যের সাহিত্যে। পাশ্চাত্য সাহিত্যের অভিযোজন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে এর গভীর প্রভাব ছিল। পুরনো ঐতিহ্যবাহী সাহিত্যে দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্ত করে তাকে কল্পনার বিস্তৃত আকাশ দেখিয়েছে প্রাচ্য সাহিত্য।
(সৌজন্যঃ fateh24.com)