পৌষ মাস। সূর্যের তেজ দুপুরেও মিঠা লাগে। সকাল সন্ধ্যা কুয়াশার অনাবিল আলিঙ্গনে আমি ক্লান্ত।আর গাছেরা ভূত সেজে সাদা শাড়ি জড়িয়ে দাঁত বের করে খিল খিল হাসে। চারিদিক থম থমে। একটি পাতা ঝরে পড়লে বুক দুরু দুরু।
এমনি এক বিকেলে নুড়ি বালি পাথর মেশানো সরু রাস্তায় একাকি হেঁটেছিলাম।দুদিকে ঘন আকাশচুম্বী বৃক্ষরাজি সব বোবা হয়ে অদ্ভুত চাহনি দিয়ে আমাকে পরখ করছিল।আজ কুয়াশা কম। তাই গাছেদের ফাঁক দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিলাম বাদামি সূর্যের ম্যাড়ম্যাড়ে আকাশের গলা বেয়ে ঢলে পড়া।
যতদূর দৃষ্টি পড়ে দেখি রাস্তার আঁকাবাঁকা ধূসর শরীর। গায়ে ফোঁড়ার এবড়ো খেবড়ো দাগ হাজার। এক সারে, আরেকটা হাজির নিজের অজান্তেই। ঘা সারলেও দাগ মেলে না।বেশ কিছুদুর গিয়ে সে ঝাঁপ দেয় টলটলে এক ছোট নদীতে।হাত পা ছুড়ে, জলে থাবা মেরে, বুদ বুদে কুলি করে আবার পাড়ি দেই ছায়াঘেরা শীতল অরণ্যের দেশে। এমনি করে হাজার বছর ধরে পথ হাঁটা। শেষ নেই। মুক্তিও সে চাই না।নিজের বন্ধনে নিজেকে খুঁজে ফেরে বারে বারে। পায় হয়তবা অমৃত সুধা। না হলে গা এলিয়ে দেয় কেন মানুষ-পশুদের বিনোদনের জন্যে।মোচড় তো দিতে পারে!
বড় গাছেদের তলে আরও দুই স্তর। একেবারে মাটির সাথে লেপ্টে আছে আগাছাদের সবুজ মোলায়েম বিছানা। আর তার উপরে লাফা লাফি করছে মাঝারি গোছের আরও বেশ কিছু গাছেদের পোলাপান ।এই ত্রিস্তরে বনভূমি সজ্জিত।প্রত্যেকের স্বকীয় রুপ, গন্ধ, ও মাধুরি আছে।বড়দের আছে অসীম উন্মুক্ত নীলাকাশের সাদর হাতছানি।সময় সময় মেঘেদের সাথে এদের খানিকের তরে সহবাস।তারপর আবার বিরহের দহন জ্বালা। এছাড়া ঝড় ঝঞ্জার সাথে পাঞ্জা লড়তে হয়। নিচের স্তরগুলির অত মাথা ব্যথা নেই। পিতা মাতার কোলের শিশুদের ন্যায় চোখে চোখে লালিত পালিত। ঝড়, বাদল, তাপ হতে মায়ের আঁচল ঘেরা ঘ্রাণে নিমজ্জিত।
বনে সেদিন মানুষের আনাগোনা ছিল না। যারা এসেছিল মধুপান করতে, ফিরে গেছে অনেক আগেই। তবু রিক্ত বলি কি করে? এক কাঠুরিয়া ও তার বউ গাছের গুড়ি খুঁড়তে মরিয়া। মাঝে মাঝে কুঠারের ঠক ঠক ছন্দের প্রতিধ্বনি আমাকে উতলা করে। আর এর সাথে আছে হাজার টিয়াপাখির এ গাছে ও গাছে উদোম লাফালাফি। আর তাদের কিচির মিচির যেন আজ অস্বাভাবিক ভাবে বেশি। কে জানে, আমাকে দেখে কিনা! বা কোন বিষধর সাপ গাছের গা বেয়ে তাদের দিকে ধাবিত!লঙ্গুরের দল দাঁত খিঁচিয়ে রাস্তা অতিক্রম করলো।অনধিকার প্রবেশ।হবে হয় তো। না হলে আমার প্রতি ওদের এত ঘৃণা কেন?
জঙ্গলের পূব পাশ দিয়ে সারি সারি টিনের কুঁড়েঘর কলা গাছ দিয়ে ঢাকা।শুনেছি হাতির ভয়ে রাতে এরা ঘুমায় না। গজধর এসে বছরের ফসল খেয়ে নেয়। সেই আশঙ্কায় চাষিরা পটকা, মশাল, টিনের প্যাঁটরা ইত্যাদির সাহায্য নেয়। কি রোমান্টিক? ভেবেছিলাম আমিও কয়েক রাত কাটাবো প্যাঁটরা বাজিয়ে। হয়ে ওঠে নি। তাছাড়া গনেশ ঠাকুরের মর্জি কে মাপে ? কবে জঞ্জলের কোন পাশে হানা দেবে কেউ জানে না। তাই প্রথমের লাফালাফির উন্মাদতা কিছুক্ষণের মধ্যেই স্থিমিত, আগুন নেভা ছাই ।
শুনেছি সব সুন্দর গল্প শুঁকরা ওরায়ের কাছে। ঠাকুর গ্রামে ঢু মেরে মানুষ খুঁজে শুঁড় দিয়ে প্রথমে আকাশে ছোড়ে, নিচে নেমে এলে পা দিয়ে টিপে দেয়। মানুষটি পিঁপড়ের ন্যায় ফটাস।সকলকে নয়। যে তার আগের বা অন্য কোন রাতে গাছ চুরি বা গণ্ডার, হরিণ মারতে গিয়ে তার বাচ্চার ল্যাজ মুড়েছিল। ফলে সে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মা বা বাবাকে অভিযোগ করে।তারপর দেখে কে? চলে রাতের পর রাত অভিযান। শেষে একদিন পা দিয়ে থেঁতলে অন্তিম যাত্রার পথ সুগম।
কুয়াশার অত্যাচার আজ কম। কেন জানি না! গাছেদের জড়িয়ে বাদল দিনের ফির ফিরে বৃষ্টি নেমেছে বোধ হয়।আকাশের রুপ ঠাউর করা কঠিন। মুখ তুলে তাকালে পাতার ও ডালের জটিল বুনন চোখেদের বাঁধা দেয়। ঘোলাটে সর্বত্র। গাছেরা ঝিম ধরেছে। টিয়ার ঝাঁক দুরুন্ত শিশুর মতো এ গাছ থেকে ও গাছ ঝুলে পড়ছে। আরে ডাল যে ভেঙ্গে পড়বে মাথার ‘পরে! ভারি মুশকিল! কই নুড়ি কোথায়! দুই একটা ছুড়ি! হায়, নুড়ি নেই। আছে ধূলার শিশির ভেজা আস্তরণ আর শুকনো পাতার গালিচা। এ সব ছুড়ে কি হবে। সব তো মাথার ‘পরে নেমে আসবে, যেমন করে নেমে আসছে কুয়াশার ঝর্না।তাই সব আশা ছেড়ে ওদের কিচির মিচির শুনতে শুনতে মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম।
বনের এক কোনে কারা যেন আগুন জ্বেলেছে।কিছু কথা বার্তা আর কিসের যেন ফট ফট শব্দ হচ্ছে। পাতা পুড়লে তো এ শব্দ হয়না। তাহলে কি শুকনো বাঁশের গিট ফাটছে। খেজুরের রস থেকে গুঁড় করা বা ধান সেদ্ধ করতে চাষি গিন্নিরা এ সবের সাহায্য নেয় জানি। এখানে মানুষ আগুনে হাত পা সেঁকতে এই ঠাণ্ডায় হয়তবা বনে থেকে কুড়িয়ে এদের কাজে লাগিয়েছে।মানুষ দেখা যাচ্ছে না।শুনতে পাই ফিস ফিস শব্দ, শুকনো কাশির, গলা ঝাড়ার শব্দ, আর মাঝে মাঝে একটি শিশুর কান্না। বায়না ধরেছে বাড়ি যাবে।বড়রা কান করছে না। আর সে তো শিশু, কি করে আবছা আবছা, ছোপ ছোপ কুয়াশার নদী সাঁতার দেবে। তাছাড়া আছে, সাপের, হাতির,ভূতের ভয়।
সূর্য কি এরকম তুলতুলে হয় কখনো? ধরে মনে হয় আটা সানা করতে। আর না হলে, কুচকুচে শিশুর ফুলো ফুলো গালের মতো করে চটকাতে। আহা!হাত নিশ পিশ করছে। কি যে করি। উপায় কি? তাই মনকে ধী করলাম এই ভেবে, যে জগতে আমাদের চাওয়া ঢের বেশি। পূরণ কম। তবুও দুঃখ কাতর করে সময় সময় এই ভেবে যে আমি তো অস্তমিত সূর্যের রক্তিম আভা গালে মাখতে চেয়েছিলাম। তাও আবার কয়েক মুহূর্তের জন্য। সেটাও পূরণ হবার নয়!