সুফিদের দেশ এই বাংলা ৷ “সুফি ” শব্দটি আরবি ” সফা “( পবিত্রতা) থেকে উদ্ভূত৷ যিনি কায়মনোবাক্যে পবিত্র তিনিই সুফি৷ এই হিসেবে বাহ্যিক আচারানুষ্ঠান ব্যতিরেকে আন্তরিক পবিত্রতা ও অকপটতার সাধনা যাঁরা করেন, তাঁরাই সুফি৷ অনেকের মতে,হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর অতি নিকটবর্তী বিশিষ্ট সাহাবাদের বলা হত ” আহল-ই-সুফ্ফা “৷ বাঙালি সুফিগণ তাঁদের মন -মননে ও মস্তিষ্কে সাম্যবাদ , উদারতা, মানবপ্রেম ,ভ্রাতৃত্ববোধ ধারন করে চলেছেন কয়েক হাজার বছর ধরে৷ এই ঐতিহ্য ও মিলনেচ্ছা স্বতন্ত্র বাঙালি জাতিসত্তা গঠনে সাহায্য করেছে৷ স্বতন্ত্র বাঙালি জাতিসত্তা তৈরির অনেক পূর্বে বাংলার মাটিতে ইসলামী দর্শন , ঐতিহ্য , সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে খ্রীস্টিয় প্রথম শতাব্দীতে৷ ইসলামযুগে (৭ম শতকের পর থেকে) সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আরব বণিক ও আউলিয়াগণ এদেশের অভ্যন্তরে দুর্গম ও দুরতিক্রম্য স্থানে ছড়িয়ে পড়েন৷ শাহ মুহাম্মদ রুমী ১০৫৩খ্রি. ময়মনসিংহে,বাবা আজম মক্কীর বল্লাল সেনের আমলে (১১শ শতক ) বিক্রমপুরে আসেন ৷ চতুর্দশ শতকের প্রথমার্ধে শাহ জালালের সিলেট আগমনও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। অজস্র পীর -আউলিয়ার ঔদার্য ও সেবা মাহাত্ম্যে বহু বৌদ্ধ ও অন্ত্যজ বঙ্গজন ব্যাপকভাবে ইসলাম গ্ৰহন করে৷
বাংলায় ইসলামের প্রসার ঘটে কৃষিকাজের উপর নির্ভর করে৷ সুফিদের মাধ্যমে বাঙালির ধর্ম চেতনা ও দর্শন চিন্তায় এক নতুন রূপ পরিগ্রহ করে ৷ তখনও বাঙালি জাতিসত্তার নিজস্ব আইডেন্টিটি তৈরি হয়নি৷ পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো নজির নেই যেখানে সংস্কৃতির সাথে লড়াই করে ধর্ম বিজয়ী হয়েছে৷ ধর্মপ্রচারকগন তা জেনেই কখনো স্থানীয় নির্দোষ, সুসংস্কৃতির সাথে ধর্মের বিরোধ ঘোষণা করেনি৷ ইসলামের প্রগতিশীল ও আধুনিক চিন্তায় ইজমা ও কিয়াস বাংলা ও বাঙালির জীবনযাপন, ধর্মভাবনা ও সংস্কৃতিকে অনেক যুক্তিশীল ও সমৃদ্ধ করেছে৷
শিক্ষা-সংস্কৃতির ব্যাপকতা বিশ্বজনীন। এর কোনো সীমানা নেই। সংস্কৃতিহীন মানুষ অমানবিক ও অসভ্য হয়। সংস্কৃতিবান মানুষ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে তার সুকুমার বৃত্তির দ্বারা সভ্যতা বিনির্মাণে অবদান রাখে। বাঙালির নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসে পৌত্তলিক চিন্তার থেকেও প্রকৃতির চিন্তা -চেতনা বেশি প্রাচীন ৷ বাঙালি জাতীয়তাবাদের জনক ‘”শাহ -ই- বাঙ্গালাহ ” শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ এর আমলে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধি লাভ করে। বাঙ্গালাহ (আরবি বানজালাহ ) বা বাংলা নামে বাঙালির ভূ- রাজনৈতিক আত্মপরিচয়ও গড়ে ওঠে৷ গৌড়ের নবাব আলাউদ্দিন হুসেন শাহ বাংলা ভাষা কে রাজভাষা হিসাবে মর্যাদা দিয়েছিলেন ৷ তাঁর সময়কালকে স্বর্ণযুগ বলা হয়৷ এই যুগে ধর্ম ও সাহিত্যের মধ্যে সুনিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে ৷ একটি জাতির সংস্কৃতি ও সাহিত্য হচ্ছে তার জাতিসত্তার পরিচায়ক।
ধর্মসত্তার সঙ্গে জাতি সত্তার প্রকৃত কোন বিরোধ নেই ৷ সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের মিলন ঘটায় সাহিত্য ও সমাজ ৷ সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় পরিচয় বহন করে সাহিত্য । সাহিত্যচর্চা সভ্যতার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে বড় ভূমিকা পালন করে ৷ হামদ, কাসীদা, গজল, নাত, কিয়াম, জারি, সারি, পীরের গীত, গাজীর গান ,কাওয়ালী, মারেফতি, মুর্শিদি গান, পুঁথি সাহিত্য, শোক গাঁথা বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং প্রাচীন ঐতিহ্য ৷ বাংলা ও বাঙালি সমাজের সংস্কৃতির ধারা বিভিন্ন ওয়াজ মহফিল, জুলুস ও মিছিল, আন্দোলন কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে উঠে আসে তা সাহিত্য চর্চার মধ্যে দিয়ে অনেক সময় প্রকাশ পায়৷ যখন সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ব্যহত হয় তখন দুনিয়া জুড়ে অপকর্ম ,পাপাচার, দ্বীন ও দুনিয়া নিয়ে অনাস্থা ,সংকীর্ণতা, বৈষম্য ,নিপীড়ন , আধুনিক দাসত্ব, অন্যায় , অত্যাচার, অশান্তি সৃষ্টি হয় । তখন বিশ্বনবীর পথ অনুসরণ একমাত্র মুক্তির উপায়৷ বাংলায় সুফিয়ানা তরিকা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে মহম্মদীয় দর্শন ফুটে উঠেছে একেশ্বরবাদী ধর্ম ভাবনায় ৷ বাংলার মাটিতে একেশ্বরবাদী আন্দোলন সুফির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গড়ে উঠেছে ।বাংলার সুলতানি আমলে সংস্কৃতি ও সাহিত্যের মাধ্যমে স্বতন্ত্র জাতিসত্তার পরিচয় ঘটে সামাজিক ভাবে৷ বাংলা ভাষা,সাহিত্য ও সংস্কৃতি জাতির প্রাণশক্তি ৷
সংস্কৃতি মানুষের উৎপাদন শীলতা ,সৃজনশীলতা ,গতিশীলতা ও জীবন ধর্মিতার ঐক্যাভিমুখী এক চালিকাশক্তি যার মূল সমাজ মনের গভীরে, যার শাখা প্রশাখা দিকে দিকে বিস্তারিত ৷যার ফলশ্রুতি সত্য সুন্দর সমাজ ৷ একটি জাতির ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন রকমের ধর্মীয় আচার আচরণ ,রীতিনীতি থাকে ৷ সংস্কৃতি পরিভাষার মধ্যে খাবার , পোশাক , শিক্ষা ,আচার -ব্যবহার , উৎসব -পালা -পার্বণ সবই চলে আসে। বাঙালি জাতির ধর্মীয় চিন্তা -চেতনার অন্যতম অংশ বিশ্বজনীন উৎসব পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী৷
ভাষার নিরিখে ইসলাম ধর্মাবলম্বী বাঙালি জাতির স্থান দুনিয়ায় দুনম্বরে ,আরবদের পরেই৷ বিশ্ব বাংলায় বাঙালিদের মধ্যে ইসলামধর্মালম্বী বাঙালি প্রায় শতকরা সত্তর শতাংশ ৷ সংস্কৃতির প্রসারণ সাধারণত ভৌগোলিক হয়ে থাকে কিন্তু কিছু কিছু সংস্কৃতির ব্যাপকতা বিশ্বজনীন । যেমন ইসলামের সমম্বয় সাধন ও সমানাধিকার আধুনিকতার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেছেন -” মুহাম্মদকে সৃষ্টি না করলে আমি পৃথিবী সৃষ্টি করতাম না”৷ মানবজাতির মুক্তির দিশারী হজরত মুহাম্মদ (সা:)ছিলেন সভ্যতার অগ্ৰদূত,সম্প্রীতির প্রতীক ৷ সকল ভাষাভাষী, সকল গোষ্ঠী, সকল গোত্র, সকল জাতির, সকল দেশের, সকল সংস্কৃতির, সকল ইতিহাস, সকল ঐতিহ্যের কাছে ইসলামের সাম্যবাদ পৌঁছে গেছে ৷সুফি বাংলায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলামী উৎসব -পরব বিভিন্ন নামে বিভিন্ন জায়গায় উদযাপিত হতো৷ তার আগে স্মরণ হতো ইসলামের পঞ্চস্তম্ভ ইমান ,নামাজ (সালাত), রোজা (সাওম) ,হজ্জ ,যাকাত ইত্যাদি৷ এর মাধ্যমে বোঝা যায় এই চর্চা পুরোনো এবং অলিখিত৷
টেক্সটাইল ইতিহাসের আলোকে আমরা দেখছি – ঈদে মিলাদুন্নবী পালিত হচ্ছে ১৬০০সাল থেকেই-৪০০ বছর হয়ে গেলো৷” মিলাদুন্নবী ” পরিভাষাটি আরবি ৷ মিলাদ অর্থ জন্মগ্রহণ ,আগমন ৷ পবিত্র মিলাদুন্নবীর ইতিহাস অতি প্রাচীন । মিলাদুন্নবীর সূচনা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন। রোজে আজলে সমস্ত আম্বিয়ায়ে কিরামকে নিয়ে আল্লাহ্ এই মিলাদের আয়োজন করেছিলেন । নবীগণের মহাসম্মেলন ডেকে মিলাদুন্নবী মাহফিলের আয়োজন করেন স্বয়ং আল্লাহ্। ঐ মজলিশে একলক্ষ চব্বিশ হাজার বা মতান্তরে দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গাম্বর (আঃ) উপস্থিত ছিলেন । ঐ মজলিশের উদ্দেশ্য ছিল হযরত মুহাম্মদ (সা) এর বেলাদাত, শান, মান ও অন্যান্য নবীগণের সামনে তুলে ধরা এবং তাঁদের থেকে তাঁর উপর ইমান আনয়ন ও সাহায্য সমর্থনের প্রতিশ্রুতি আদায় করা । নবীজীর সম্মানে এটাই ছিলো প্রথম মিলাদ মাহফিল । এটি হচ্ছে হচ্ছে আল্লাহ্র তরিকা। ঐ মজলিশে সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরামও উপস্থিত ছিলেন। ঐ মজলিশে স্বয়ং আল্লাহ্ নবীজীর শুভ আবির্ভাব বা মিলাদের উপরই গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। সমস্ত নবীগন খোদার দরবারে দাঁড়িয়ে থেকে মিলাদ শুনেছিলেন এবং কিয়াম করেছিলেন। কেননা, খোদার দরবারে বসার কোন অবকাশ নেই। পরিবেশটি ছিলো আদবের। মিলাদ পাঠকারী ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ্ এবং কেয়ামকারীগণ ছিলেন আম্বিয়ায়ে কেরাম ৷
ভারতীয় উপমহাদেশে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে বাঙালির কাছে আজকের দিনটা ঈদে মিলাদুন্নবী নামে পরিচিত ৷ সেই ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে বাঙালির এই উৎসব বা পরব উদযাপনের লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়৷ অলিখিত ভাবে সুফিরা এই উৎসব করতেন,সুফি দর্শন তাই বলে ৷ নবী (সা.) এর সময়, খোলাফায়ে রাশেদিনের সময় এবং উমাইয়া খলিফাদের সময়ে ঈদে মিলাদুন্নবী উৎসব ছিল না। আব্বাসীয় খলিফাদের যুগে বাদশা হারুনুর রশীদের মাতা খায়জুরান বিবি (১৭৩ হিজরী) মদীনা শরীফে নবী (সা.) এর রওজা মোবারক জিয়ারত করার ও সেখানে দরূদ ও দু’আ পাঠ করার যে ব্যবস্থা করেন ।নবী (সা.) মক্কায় যে ঘরে ভূমিষ্ট হয়েছিলেন, সেই ঘরটির জিয়ারত ও সেখানে দু’আ করার প্রথা সর্ব প্রথম চালু করেন আব্বাসীয় খলিফাদের যুগে বাদশা হারুনুর রশীদের মাতা খায়জুরান বিবি (১৭৩ হিজরী)৷ ইসলামী সভ্যতার অনত্যম কেন্দ্র মিশরে ফাতেমী খলীফা আল-মুয়িজ্জু লি-দীনিল্লাহ সর্বপ্রথম ঈদে মীলাদুন্নবী ও অন্যান্য জন্মদিন পালন এবং সে উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের শুরু করেন।মুসলিম দুনিয়াকে সাংস্কৃতিক ভাবে একত্রিত করতে ইদে মিলাদুন্নবী পালন করেন যাতে মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ হয় ৷ ইরবিলের শাসক আবু সাঈদ কুকবরীর মাধ্যমেই এই উৎসবকে সুন্নী জগতে এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বে জনপ্রিয় উৎসবে পরিণত করেন । ৬০৪ হিজরীতে ইরবীলের শাসক আবু সাইদ মুজাফফর উদ্দীন কুকবরী আবার মিলাদুন্নবী প্রথা চালু করেন। তার এই মাহফিলে ফজর হতে জোহর পর্যন্ত সুফী নামধারী ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকত ৷
বাংলায় সুফিবাদের আবির্ভাবকাল সঠিকভাবে বলা কঠিন । তবে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত এদেশে সুফিবাদের সর্বাধিক প্রচার ও প্রসার হয়েছে বলে জানা যায়।এর থেকে বোঝা যায় সুফি ঘরানায় এই রকম উৎসব পালন হত৷ কিন্তু লিখিত ইতিহাসে কমপক্ষে ৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্য , বাহারীস্থানে গায়াবীতে ,যা মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের অধীনস্থ মীর্জা নাথান কেবল বাঙলা এবং তার আশেপাশের তৎকালীন ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন৷ দুই ঈদ ,মহরম ,শবে ররাত ,ফতেহা ইয়াজ দাহাম , ফতেহা দোয়াজদাহাম, উদযাপনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তো বেশ পুরোনো বাংলায় ৷ বাংলার নবাবী আমলে মুর্শিদাবাদের সুলতানরাও এই দিবসকে কেন্দ্র করে বেশ ধুমধাম উৎসবের আয়োজন করতেন ৷ স্মৃতিকথায় মিলাদুন্নবী ,ঐতিহাসিক কে,পি সেন তাঁর বাংলার ইতিহাস (নবাবী আমল) কিতাবে লিখেছেন :” নবাব সেই দিনটি একটি বিরাট উৎসব আনন্দের দিনে পরিণত করতেন৷ তিনি রবিউল আউয়াল মাসে প্রথম বারো দিন লোকদের আদর অভ্যর্থনা করতেন এবং ব্যক্তিগতভাবে আতিথেয়তায় উপস্থিত হতেন৷ বিশেষ করে তিনি গরীবদেরকে অভ্যর্থনা করতে ভালোবাসতেন ৷ এই উপলক্ষে সমস্ত মুর্শিদাবাদ শহর ভাগিরথী নদীর তীর পর্যন্ত আলোক সজ্জিত করে রাখতেন ৷ আলোকসজ্জার স্থানগুলোতে কুরআন শরীফের আয়াত সমূহ এবং মসজিদ ,বৃক্ষ ,লতাপাতা ও ফলসমূহ প্রদর্শিত হতো ৷ সেনাপতি নাজির আহমেদের অধীনে এক লক্ষ লোক আলোকসজ্জার কাজে নিয়োজিত হতো ৷ একটি নির্দিষ্ট সময়ে কামান গর্জন করত ৷
আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগে ঢাকায় সার্বজনীন ভাবে মিলাদুন্নবী উদযাপন করা হতো ৷ উৎসবের ঢাকা গ্ৰন্থে জনাব সাদ উর রহমান তথ্য দিচ্ছেন “১৭৯০ সালের দিকে আরমানিটোলা তারা মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মির্জা গোলাম পিরের পিতামহ আবু সাঈদ প্রতিবছর ঈদে মিলাদুন্নবী উৎসবে নিজ ব্যয়ে তবারক হিসেবে পোলাও বিতরণ করতেন”৷ ঢাকার বিখ্যাত ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন জানাচ্ছেন খুবই গুরুত্ববহ ঘটনা :” গত শতকের শেষ দশকে নবাব সলিমুল্লাহ মুসলমানদের আরেকটি উৎসব হিসেবে ফাতেহা ইয়াজ দাহাম কে তুলে ধরেন৷ এ উপলক্ষ্যে ঢাকা শহরের প্রতিটি পঞ্চায়েতকে তিনি টাকা দেন ৷ এই টাকা ব্যয় হতো দুটি খাতে ৷ প্রথমত মহল্লা সাজানো ,দ্বিতীয়ত মিলাদ পড়ানো ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্ৰন্থাগার বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ সিদ্দিক খান – মুনতাসীর মামুন ও সাদ উর রহমানের বহু আগেই -1966 সালে লিখেছেন ” ফাতেহা -ই- দোয়াজ দাহাম উপলক্ষ্যে চক মসজিদের আশেপাশে চারদিক আলোকময় সাজানো হতো ৷ মসজিদে পড়ানো হতো ” মিলাদ শরীফ”৷ এই মিলাদও পড়া হত সমবেত কন্ঠে ৷ সৈয়দ মুজতবা আলীর বড় ভাই গবেষক ও ঐতিহাসিক সৈয়দ মুর্তজা আলী( ১৯২০-১৯৮১) যখন সিলেট গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে পড়তেন তখন তাঁর স্কুলে আড়ম্বরের সঙ্গে মিলাদ উৎসব হত বলে জানা যায় ৷( আমাদের কালের কথা ,পৃষ্ঠা ৯১) । সুফিয়া কামাল জানাচ্ছেন, ঈদ-ই- মিলাদুন্নবী দিবস বড়ই সমারোহের সাথে সম্পন্ন হত ,মিলাদ মহফিল ও ১২ দিন ধরে ধনী ও দরিদ্রদের জেয়াফত খাওয়ানো হত৷ ধার্মিক ও বিদ্বান ব্যক্তিদেরকে উপহার প্রদান এবং রোজা রাখা হতো (একালে আমাদের কাল : সুফিয়া কামাল ,সুফিয়া কামাল রচনা সংগ্ৰহ সংগ্ৰহ,বাংলা একাডেমি পৃষ্ঠা ৫৫৭) কুষ্টিয়া হাই স্কুলে হযরত মুহাম্মাদের জন্মোৎসব পালনের সময় প্রধান অতিথি ছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায় , তিনি তখন কুষ্টিয়ার মুহাকুমা হাকিম ছিলেন৷( আমার এই ছোট ভুবন ,আবুল হোসেন, পৃষ্ঠা ৮৮) মিলাদ হতো স্কুলে ৷ সেই উপলক্ষে হযরতের জীবনের উপর রচনা প্রতিযোগিতা হতো ( আমি সরদার বলছি ,পৃষ্ঠা – ১২০)।
একসময় কলকাতা রেডিওতে ‘ফাতেহা দোয়াজ দহম’এর উপর এক জীবন্তিকা প্রচারিত হবে ৷হযরতের জন্মবৃত্তান্ত , কোরেশের অত্যাচার , ওহোদের যুদ্ধ ইত্যাদি নানা ঘটনা শুধু কথা ,বক্তৃতা এবং গানের মাধ্যমে রূপায়িত করা হবে ৷ স্ক্রিপ্ট এর ওপর মাওলানা আকরম খাঁর সই । এইধরনের জীবন্তিকা দেখে মহাখুশি ছিলেন নৃপেন মজুমদার ৷ মুসলমানদের পরবের জন্য লেখা বিশেষ বিশেষ প্রোগ্রাম হতো৷( আমার শিল্পী জীবন কথা,- প্রথম গান রেকর্ড করা প্রথম বাঙালি মুসলিম- আব্বাসউদ্দীন আহমেদ,৭১ পৃষ্ঠা )। অমিতাভ চৌধুরীর লেখা থেকে জানা যায়, ফতেহা দোয়াজ দহম উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,“কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো।” মূলত সূফী ভাবধারায় রচিত এই সঙ্গীত শান্তিনিকেতনে নবীদিবস উপলক্ষ্যে গাওয়া হতো। রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর ভাবনায় ও ব্যক্তিজীবনে সুফিবাদের প্রভাব লক্ষ্য করার মতো।
সামাজিক সংস্কৃতির একটা রূপ উঠে আসে সাহিত্যে কারণ সমাজকে আঁকড়ে ধরেই মূলত সাহিত্যের টিকে থাকা, বেড়ে ওঠা৷ আর সাহিত্যের প্রবীনতম শাখা কবিতা ৷ ১৯৪৭ সালের পূর্বে রচিত তৎকালীন বাঙালি সমাজে কবি ও প্রাবন্ধিক নবী দিবস নিয়ে বিভিন্ন কবিতা ও প্রবন্ধ লিখেছেন তার মধ্যে চিন্তাবিদ ও প্রাবন্ধিক এস ওয়াজেদ আলি লিখেছেন তার কিছু অংশ উদ্ধৃতি হিসেবে তুলে ধরছি ” সেদিন ( ১২ রবিউল আউয়াল) আমি এক নবী দিবসের উৎসবে সভাপতিত্ব করতে গিয়েছিলাম৷ হিন্দু ,মুসলিম উভয় ধর্মের লোকই এসেছিলেন উৎসবে যোগ দিতে আর বক্তৃতা শুনতে ৷ হজরত মোহাম্মদের জন্মতিথির অনুষ্ঠান৷ সুতরাং ধর্ম জাতি নির্বিশেষে সকলেই তাতে অংশ নিয়ে বিশ্ববরেণ্য মহাপুরুষের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চেয়েছিলেন৷”
অধ্যাপক আলী আহমদ লিখেছেন”কোন জাতিকে প্রকৃষ্টরূপে জানিতে হইলে সেই জাতির গ্ৰন্থরাজিই সুন্দর উপাদান ৷গ্ৰন্থপঞ্জী হইল জাতির -দর্পণ স্বরূপ ৷১৮৫০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত স্বতন্ত্রভাবে মিলাদ নিয়ে রচিত কিছু ঐতিহাসিক ২০টি কিতাব সংগ্রহ আছে ,তারমধ্যে কিছু তুলে ধরলাম:- (গুলিস্তাঁ, ১৯৮৮)
মৌলুদ শরীফ (মীর মশাররফ আহমদ -১৮৯৮), মৌলুদ শরীফ ( মৌলভী মুহম্মদ নইমুদ্দীন -১৮৯৫), মৌলুদ শরীফ (নওয়াব বাহাদুর নওয়াব আলী চৌধুরী -১৯০৫ ),বাংলা মউলুদ শরীফ ( সৈয়দ আবুল হোসেন -১৯২৫) ইত্যাদি৷
১৯৭৩ সালে অক্টোবরে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ “এক জাতি গঠন” প্রবন্ধে “একজাতি হইতে গেলে জাতির সাধারণ পর্বদিন চাই” উল্লেখ করে মুসলমানদের তরফ থেকে মিলাদুন্নবীর উদযাপনকে “জাতীয় উৎসব ” হিসেবে প্রস্তাব করেছিলেন।