বর্তমান ভারত ও সবকা সাথ, সবকা বিকাশ

ফ্যাসিস্ট শক্তি হল একটি রাজনৈতিক অভিব্যক্তি। ফ্যাসিস্ট রাজনীতি মানুষকে দৈনন্দিন রাজনীতির বাস্তবতা থেকে দূরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। “The Festival State : Celebration and commemoration in Fascist Italy” –নামক প্রবন্ধে ম্যাকেল বেরেজিন লিখেছেন কীভাবে বেনিতো ইতালির মানুষকে উৎসব মুখর রেখে প্রতিবাদের ইচ্ছাকেই পঙ্গু করেছেন। অথচ বিপ্লব হ’ল ইতিহাসের চালিকা শক্তি।বিপ্লব হ’ল নিপীড়িতের ও শোষিতের উৎসব। হিটলার, মুসোলিনি ফন্দি- ফিকির করে নতুন নতুন দিবস খুঁজে বার করতেন, এবং মানুষের মনে বিশ্বাস ধরিয়ে উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে নানা ভাবে সেই দিবসকে জাঁকজমক ভাবে পালন করে, মানুষকে ডুবিয়ে রাখতে পারলে, বলা ভালো নেশায় বুঁদ করে রাখতে পারলেই কেল্লা ফতে। মানুষ দৈনন্দিন জীবনের না পাওয়া জনিত হতাশা থেকে নিজেকে বিমুখ রাখতে পারবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে পোষ্যের মতো লেজ নাড়িয়ে প্রভূভক্তির নিদর্শন রেখে পায়ে পায়ে লেপ্টে থাকবে, বা নেতাদের চলন্ত গাড়ির উড়ন্ত ধোঁয়া-ধুলি গোগ্রাসে গিলবে অনাবিল আনন্দে।

তাই নোটবন্দির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি নি। অপরিকল্পিত লকডাউনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করে থালা-কাঁশর-শঙ্খ ধ্বনি করে, মোমবাতি-টর্চ – লণ্ঠন জ্বালিয়ে তবলীগ জামাতের ভেতর করোনা ভাইরাস খুঁজেছি ! ভারভারা রাও, উমর খালিদ, সফুরা জারগর, গৌতম নওলাখা, কাফিল খান, সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান, শারজিল ইমাম প্রমুখের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করতে পারি নি। নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবুর্গী, গৌরী লঙ্কেশদের কাতিলের বিরুদ্ধে আমরা গর্জন করতে ভুলে গেছি।

দিল্লী দাঙ্গার প্রেক্ষিতে পুলিশের চার্জসিটে সীতারাম ইয়েচুরি, বৃন্দা কারাত, সলমন খুরশিদ, অপূর্বানন্দ, হর্ষ মান্দারের নাম দেখেও আমরা প্রতিবাদের ভাষা ভুলে গেছি ! ১৫লক্ষ টাকা আমরা পাই নি। বছরে দুকোটি চাকরির একটিও আমরা না পেয়েও বলি না রাজা তোর কাপড় কোথায়?

অমুসলমানদের নাগরিকত্বের রক্ষা কবচ হিসাবে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী হয়েছে ; মুসলমানদের বেনাগরিক করার ফন্দি- ফিকিরে কোটি কোটি মানুষকে নিজভুমে পরবাসি করার চক্রান্ত হয়েছে। মুসলমান অধ্যুষিত কাশ্মীরকে টুঁটি টিপে ৩৭০ ধারার বিলোপ করে জম্মু কাশ্মীরকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিনত করে জাতিয় সংহতির প্রশ্নে জিজ্ঞাসা চিহ্ন বসাতেও পিছপা হয় নি। মুসলমান সাংসদকে দেশদ্রোহী, কাটুয়া, মুল্লা ভাষায় আক্রমনেও পিছপা নয়; আখলাখ, পেহলু খাঁনকে গরু গোমাতা রক্ষার নামে লিঞ্চিং করতেও পিছপা নয় গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে। দুঃখের হলেও এটাই সত্যি বিদ্বেষ ও ঘৃণায় জারিত সরকার কেবল ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষদেরই দেশদ্রোহী হিসাবে চিহ্নিত করে।

সংসদে মহিলা বিল পাশ হলেও বিল কার্যকর করার প্রশ্নে দু’টি ‘জড়িবুটি’র টিকা জুড়ে দিয়েছে সরকার : এক) সেনসাস, দুই) ডিলিমিটেশনের পর। সত্যিটা হল সংবিধানের ৮২ তম সংশোধনী যেটি অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকার করেছিল সেখানে পরিস্কার বলা আছে ২০২৬ সালের পর যে সেনসাস হবে তার ভিত্তিতে ডিলিমিটেশন হবে। এখানে দু’টি শর্ত জুড়ে দেওয়ার কারণ বহু পুরুষ সাংসদ এর ফলে প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারবে না, দলের ভিতর বিশৃঙ্খলা শুরু হবে –তাই এই কূট কৌশলী পন্থা।

ইউ এ পি ধারায় অঘোষিত জরুরী অবস্থা- ম্যাকার্থি যুগ, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। গরিব মানুষের কণ্ঠস্বর, গরিব মানুষের লড়াই, শ্রমজীবী মানুষের কথা যারা বলে তাদের গ্রেপ্তার করে গণতন্ত্রের শ্বাসরোধ করে মারার পরিকল্পনা। স্বার্বভৌমত্বকে গলা টিপে দিল্লী, গাজিয়াবাদ, গুরগাও, নয়দা,মুম্বাইয়ে একের পর এক –৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০২৩-এ সাংবাদিক পরজ্ঞয় গুহঠাকুরতা, জনবিজ্ঞানকর্মী ডি.রঘুনন্দন, সাংবাদিক অভিসার শর্মা, ভাষা সিং, উর্মিলেশ, সুবোধ ভার্মা, আনন্দ চক্রবর্তী, লেখিকা গীতা হরিহরণ, কার্টুনিস্ট ইরফান, সমাজ কর্মী সোহেল হাসমী, অনুরাধা রমন, সত্যম তিওয়ারি, অদিতি নিগম, সুমেধা পাল, কৌতুকশিল্পী সজ্ঞয় রাজাউরাকে কোন এফ আই আর-এর কপি ছাড়ায় তল্লাশি করা হয়, কেড়ে নেওয়া হয় তাদের সমস্থ ডিভাইস, ল্যাপটপ, কম্পিউটর, মোবাইল ফোন। এটা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের উপর জুলুম –এক ধরণের কর্তৃত্ববাদ। বিবিসি, নিউজ লন্ড্রি, দৈনিক ভাস্কর, ভারত সমাচার, দ্য কাশ্মীরওয়ালা, দ্য ওয়্যার- এর মতো নির্ভীক পত্র পত্রিকার উপর একনায়কতান্ত্রিক, ফ্যাসিস্ট কায়দায় ব্রাহ্মণ্যবাদ ও মনুস্মৃতি জারিত হয়ে স্বাধীন মত প্রকাশের মতো মৌলিক অধিকারের উপর র্নিলজ্জ আক্রমন। আইনি জালে বেঁধে পরিকল্পনা মতো চক্রান্ত করা যাতে বস্তুনিষ্ট সংবাদ তুলে ধরতে না পারে।অথচ যে সংবাদ মাধ্যমগুলি বিভাজন, ঘৃণা-বিদ্বেষের বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে তাদের কেশাগ্র স্পর্শ না করা, – এটা খুবই দৃষ্টিকটূ ও দুর্ভাগ্যজনক। সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতাসূচকে (আন্তর্জাতিক) ভারত এখন ১৮০টি দেশের তালিকায় ১৬১ তম স্থানে।পাকিস্থান ১৫০ স্থানে, শ্রীলঙ্কা ১৩৫ স্থানে। এই পরিসংখ্যান সূচকে ভারত নয় বছরে নীচে নেমেছে একুশ ধাপ।

সবকা সাথ, সবকা বিকাশের মতো বিশ্বক্ষুধা সূচক (গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স ২০২২) -১২১টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৭তম। ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আদানি-আম্বানিদের ১৫ লক্ষ ৩২হাজার কোটি টাকা ঋন মকুব হয়েছে আর গরিব মেহনতী খেটে খাওয়া কৃষক ঋন পরিশোধ করতে না পারলে তার জমি কেড়ে নেওয়া হয় অথবা তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়।

‘দেশ কী গাদ্দারন কো, গুলী মারো সালো কো’ , ‘জয়শ্রীরাম’ হুঙ্কারে মানুষকে বাধ্য করে সারাভারত জুড়ে মুসলমান ধর্ম পরিচয়ে মানুষকে আক্রমনের নজির কম নেই। সংখ্যাগরিষ্টের বাহুবলী দাপাদাপি সংখ্যালঘুকে সহ্য করতে হয়। আবার ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’ বলে গণতন্ত্রকামী মানুষকে বুলডোজার জিহাদে বলি করতে ছাড়ে না; আগুনখেকো ভ্রষ্টাচারি রাষ্ট্রনেতারা অসহিষ্ণুতার আঁচে বাংলার বহুত্ববাদের আদর্শকে ধ্বংস করতেও পিছপা নয়। জেএন ইউ শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নিকেশ করতে রাতের অন্ধকারে আলো নিভিয়ে গণতন্ত্রের টুঁটি টিপতে দেখেছি , মুসলিম নারীদের নিলামে তোলার এবং কবর থেকে তুলে ধর্ষণের নিদান দেয় ফ্যাসিস্ট শক্তি। থাংজাম, মনোরমা বা মাইরি পাইরিসরা রুখে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের মুখে থাপ্পড় মারলেও নির্লজ্জরা এখনো দুঃসাহস দেখায় বুক ফুলিয়ে, তারপরও হাথরাস বা আসিফার ঘটনাকে রাষ্ট্রীয় বুলডোজারে পিষে অট্টহাসি হাসে!

ধর্মীয় কারণে নির্দোষ মানুষকে সন্দেহের বশে ‘জঙ্গী’ বানানোয় নয় ‘আরবান নকশালে’র তকমা দিয়ে জেলে পচিয়ে মারতেও দেখি! ক্ষমতার অলিন্দে থেকে “খাঁচায় বন্দি তোতা “-কে বিরোধীদের পেছনে লেলিয়ে দিতেও কম দেখি নি ! CAA-এর বিরোধে গ্রেপ্তার মিরান হায়দার, গুলকিশা ফতিমা, সাফুরা জায়গার, আসিফ ইকবাল তানহা, অখিল গগৈ, শারজিল ইনাম, দেবাঙ্গনা, কলিকা, নাতাশা নরওয়াল, ডা.কাফিল খান, খালিদ, শিফা-উর-রহমান, তিহার জেলে বন্দিআবদুল্লাহ বাসিথ এবং তার স্ত্রী হিনা কাটিজাহ প্রমুখ।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বলিয়াণ হয়ে সর্ব্বোচ ন্যয়ালয়কেও কুক্ষিগত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে ফ্যাসিস্ট ভ্রষ্টাচারি শক্তি। এমনকি প্রধান বিচারপতিকে প্যাঁচে ফেলে সংখ্যাগুরুর বিশ্বাসের উপর বাবরি মসজিদের বিচার পর্ব শেষ করে রাজ্যসভার সম্মাণীয় পদ অলঙ্করণ করতে দেখেছি (সম্মানীয় বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ও সম্মান রেখে)। গম্ভীর মন্থনে শিকার ‘হার্ড’ হিন্দুত্বের মগজ ধোলাইয়ে ধর্মান্ধ মানুষ আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে ‘হিন্দুত্বের রাজনীতিকরণ ও রাজনীতির সামরিকীকরণ’-এ ব্যস্ত। রেল স্টেশন, বিমান বন্দর, স্টেডিয়াম প্রভৃতির নাম বদলের হিড়িকে আমরা ভিরমি খাচ্ছি। এলাহাবাদ, আলিগড় প্রভৃতি ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থানের নামেও এদের বিষাক্ত তীক্ষ্ণ নখের আঁচড়ে ছিন্ন ভিন্ন। লালকেল্লা, কুতুব মিনার, তাজ মহল, আদিনা মসজিদ, মোঘল দরবারেও অশুভ আস্ফালনের দাপাদাপি। শিক্ষাতেও রবীন্দ্রনাথ বাতিল, ডারউইন বাতিল। বিশ্বভারতীর ইউনেস্কো শংসাপত্রে রবীন্দ্রনাথের নাম মুছে গেছে (নানান সমালোচনায় পরে পরিবর্তন হয়েছে)। এখন শুধু ফিসফিসানি ২৪-এর জানুয়ারীতে বাবরি মসজিদ স্থলে আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে রাম মন্দিরের উদ্বোধনের অপেক্ষা। এপ্রিলে পূর্ব মেদিনীপুরের দীঘায় পূরীর আদলে জগৎন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধন। ডাক্তারির মতো বৈজ্ঞানিক কারিকুরিতে চরক শপথ; বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইটির মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানে রামায়ণ ও মহাভারতের মাহাত্ম্য আলোচনা !

ভারতীয় রাজনীতি শিল্পপতি আম্বানি, আদানী, হিরানন্দানি, জিন্দল, গোয়েঙ্কা, চৌধুরী, নেওটিয়া, এফ মার্শাল, লর্ড- ডেভিস, মিত্তল প্রমুখের কালোটাকাতে শ্বাসরুদ্ধ, বুর্জোয়া ব্যুরোকেসির ফাঁসে বাকরুদ্ধ। ফ্যাসিস্ট শক্তি ‘জিহাদি সহিংসতা কোর্স’, শিক্ষায় গৈরিকীকরণ, মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও বুলডোজারের গৈরিক আস্ফালনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটিয়ে ২০২৪ সালের লোকসভার নির্বাচন বৈতরণী সহজে উতরে নিতে নানান ছল চাতুরির কূটকৌশলে ব্যস্ত। ‘গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ’ ও ‘কম্যুইনিটি অব ডেমোক্রেসি’ – ত্রিশূলে শান দিয়ে ভ্রষ্টাচারি ফ্যাসিস্ট শক্তি চায় ধর্ম নিরপেক্ষতা বিরোধী হিন্দুরাষ্ট্র। দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা আজ মৃত্যুমুখে, প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা একদম কাগুজে, প্রকৃত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র নীতি অনুসরণ করা দূরে থাক –এদের শুধুমাত্র ‘অপর’ কে নিধন, নরসংহার করাকেই মনে করে ধর্মনিরপেক্ষতা।

Bunch of Thoughts- এর ভারতে তিন শত্রুদের ‘হিংস্র চিন্তনে’ ধ্বংস করাই লক্ষ্য। নগ্ন ফ্যাসিজমের মাধ্যমে বড় মাপের গণহত্যা সংঘটিত না করে ছোট ছোট কিন্তু নিয়মিত হিংসা ও হত্যা করে রোজকার সাম্প্রদায়িকতার বাস্তবায়ণ ঘটানোয় এদের লক্ষ্য। এরা দেশদ্রোহী, টুকরে টুকরে গ্যাং, শহুরে নকশাল, আ্যন্টি-ন্যাশনাল‌, খান মার্কেট গ্যাং, সেকুলাররিস্ট ইত্যাদি নামে দেগে দিয়ে M S Golwalkar-এর We or Our Nationhood বইয়ের ভাষায় হিন্দুস্তানে বসবাসকারী সকলকে হিন্দুত্বের সংস্কৃতি ও ভাষাকে গ্রহণ করে হিন্দুত্বের আদর্শকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করে নিজেদের ভিন্ন জাতিসত্ত্বাকে ভুলে কোন রকম সুযোগ সুবিধা না চেয়ে, নাগরিকত্বের কোন দাবি না করে, হিন্দুরাষ্ট্রের দ্বারা কোনঠাসা হয়ে এই দেশে থেকে যেতে হবে।

You may also like