“ঘুমের ট্যাবলেট তো খেতে পারো।” আমি কিছু গায়ে না মেখে প্রস্তাব দিলাম।
“ধুস! আমাদের আবার ঘুমের বড়ি! জ্বরের বড়িই যোগাড় করতে কালঘাম ছোটে, আবার ঘুমের বড়ি! হুস !” মুখে একরাশ বিরক্ত নিয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে আজাদ ভাই আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো।
আমি কথা না পেয়ে এদিক ওদিক দেখছি।দু জনেই। কিছুক্ষণ চুপ।
বিরাট পাকুড় গাছের তলে বাঁশের মাচা। খালি গায়ে গ্রামের মানুষ, মুনিশ এই মাচায় সুযোগ পেলেই একটু জিরিয়ে নেয়।নগ্ন শরীরের ঘন ঘন আলিঙ্গনে মাচার গা একেবারে তেল তেলে। মাছি বসলে পিছলে পড়ার উপক্রম।বেলা বেশি হয় নি। পাকুড়গাছতলা পাড়ার মরূদ্যান। ক্লান্ত কৃষক এর তলে বসে তার ক্লান্তি ভোলে। কেউ বিড়ি টানে একমনে। কেউ শুয়ে শুয়ে পাকুড় পাতার ভেতর দিয়ে ফালি ফালি রোদের আনাগোনা পরখ করে নিবিড় মনে। কেউ অঘোরে ঘুমায়। কেউ কেউ চাদর গায়ে বসে থাকে এই দুপুরেও। জ্বর ছাড়ছেই না। হুকুমের ওষুধ আর ধরছে না। জ্বর ছাড়ছে, আবার আসছে। এখন শুনছে কলকাতা থেকে এক ডাক্তার দত্ত মেডিক্যালে বসছে মাসের প্রথম রবিবারে।ভিজিট পাঁচশো। তা কী করা যাবে? অগ থাকলে তো দেখাতেই হবে। আর বেশিদিন পুষে রাখলে খই, বাতাসা জোগাড় করে রাখতে হবে। আর আমের মরা ডালপালা কিছু।
গাছের’পরে হাজার পাখির কলতান। পাশে শান্ত দিঘির গা হিম করা ফুরফুরে বাতাস। কচিকাচাদের হৈ হুল্লোড়। আর পাড়ার মা বোনেদের অভাব, অভিযোগ, আর লাগামহীন পরনিন্দা, পরহিংসার এ এক আনন্দঘন চর্চাকেন্দ্র।
“আব্বা বাড়ি যাও, মকছেদ এসেছে বাঁশ কিনতে।” হ্যাবল বলতে বলতে মাঠের দিকে দ্রুত পা বাড়ালো।মাঠের শেষে মরা নদিতে নেপাল কাকার পাটের জাগ আছে, সে পাট ছাড়ানোর মুনিশের কাজ করছে কদিন ধরে ।তাই এত তাড়া। দিনের শেষে দু পয়সা ঘরে আসবে। বসে থাকলে কি আর চলে। এমনি গ্রামে সেরকম কাজ নেই।ছেলে পিলে সব বাইরে, ‘বেঙ্গল’ গেছে। বেশিরভাগ দিন মুনিশের কাজও জোটে না। এদিকে মুদির দোকানে দিনের পর দিন তেল নুনের পয়সা ধার। গোপাল বেনি দেখা হলেই খ্যাচ খ্যাচ করে।
আজাদ ভাই দু হাঁটুতে খুব কষ্টে ভর দিয়ে মুখে বেশ লম্বা ‘আ’ শব্দ করে, খাড়া হলো। শুষ্ক দু হাতে মুখের রুক্ষ ত্বক ঘষে বললে, “আসিরে ভাই। বেশ বেলা হয়েছে। দেখি মকছেদ আবার কি ধান্দায় বাড়িতে হানা দিয়েছে। শ্যালার ব্যাটা শ্যালা বহুত পাঁজি। এক পয়সার মা বাপ। গতবার বাঁশ বেচে আমি ঠকেছি। এবার শ্যালা আবার কোন ফন্দি দেখাবে কে জানে! আল্লা, আল্লাই সব।”