বাংলার বামপন্থী রাজনীতির গণভিত্তি ও গতিধারা

গণমুক্তি আন্দোলনে বামপন্থী রাজনৈতিক চেতনা একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচিত। বিংশ শতকের সূচনা পর্বে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের আলোকে বামপন্থী রাজনৈতিক চেতনা জার শাসিত রাশিয়ায় শোষিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তি আন্দোলনে নয়া ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। তাই বলসেভিক বিপ্লবের সাফল্যের সূত্র ধরে সমগ্র বিশ্বে মেহনতী মানুষের অধিকার অর্জনের যে স্লোগান উঠেছিল, তার প্রভাব ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির লীলাভূমি বাংলাতে ও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সাম্রাজ্যবাদের করাল গ্রাসে আচ্ছন্ন ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের মুক্তি আন্দোলনে তথা কৃষক শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে বামপন্থী রাজনৈতিক চেতনা দিশা দেখিয়েছিল। বাংলার বামপন্থী রাজনীতির গণভিত্তির চরিত্র গবেষকদের মনে একটি কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। সূচনা পর্ব থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বাংলার বামপন্থী রাজনীতির গতিধারা বিশ্লেষণ করলে তার গণচরিত্রের স্বরূপ সহজেই উদঘাটিত হয়ে থাকে।

বাংলার বামপন্থী রাজনীতির একটি বড় দুর্বলতা হল, বাংলার চিরাচরিত গ্রামীণ সমাজ জীবনের মৌলিক বিষয়সমূহের সহিত কমিউনিস্ট রাজনীতির সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে গভীরভাবে সমাজতত্ত্বের ধারণাকে গুরুত্ব না দেওয়া। রুশ গ্রামীণ সমাজ -সংস্কৃতির সাথে বাংলার সমাজ সংস্কৃতির সুস্পষ্ট বেশ কিছু পার্থক্য বজায় ছিল। স্বয়ং কার্ল মার্কস বাংলাদেশের সমাজ জীবনের চিরাচরিত গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থাকে একটি ভিন্ন আঙ্গিকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। বাংলার তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতারা কার্ল মার্কসের এই ক্ষুরধার বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি ততটা গুরুত্ব আরোপ করেনি। বেশিরভাগ নেতারাই রুশ ধাঁচে বলসেভিক বৈপ্লবিক কর্মসূচিকেই অনুসরণ করে চলেছেন। অবশ্য এর ব্যতিক্রম যে ছিল না, তা নয়। তৎকালীন নেতৃবৃন্দের মধ্যে যারা সরল সমীকরণের পথ অতিক্রম করে ভিন্ন আঙ্গিকে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের মতামতের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। ফলে, প্রথম থেকেই বাংলার বামপন্থী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা প্রাধান্য পেয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলন পর্বে নানা ঘাত প্রতিঘাত এর মধ্য দিয়ে চলমান বাংলার বামপন্থী রাজনীতির খুব একটা মৌলিক পরিবর্তন চোখে পড়েনি।

একটা প্রশ্ন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই উঠে আসে, সেটা হল বাংলার কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বামপন্থী রাজনীতির গণভিত্তি কতটা মজবুত ছিল? ভারতবর্ষের মাটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টি আত্মপ্রকাশ করার আগে থেকেই শিক্ষিত সচেতন ও মানবতাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ বেশ কিছু চিন্তাবিদ বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জনিত উদ্ভূত জটিল সমস্যার সমাধান, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নগ্ন জনবিরোধী নীতি, খিলাফত আন্দোলনজনিত ভাবাবেগ প্রশ্নে অনেকেই কমিউনিস্ট আন্দোলনকে মজবুত করার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। কিন্তু, এই উদ্যোগ যে সীমিত ছিল, এবং সামান্য কিছু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। ব্যাপক কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে গণ আন্দোলন গড়ে তোলার পরিসর ছিল সীমিত। যতটা না ছিল নেতৃত্বের দুর্বলতা, তার চেয়ে অধিক ছিল গণ আন্দোলন গড়ে তোলার সামাজিক পশ্চাদপদতা।

বাংলার কমিউনিস্ট তথা বামপন্থী আন্দোলন অনেকটাই ছিল শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা পরিচালিত। প্রাথমিক পর্যায়ে পত্র-পত্রিকা প্রকাশ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গণ সংগঠন, সভা, সমাবেশ পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে গুটিগুটি পায়ে আন্দোলন বিকাশের পথে গিয়েছিল। চলার পথ মোটেই সহজ ছিল না। একদিকে শাসকগোষ্ঠীর চোখ রাঙানি, ধরপাকড়, জুলুম নির্যাতন অন্যদিকে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বাঁকা চাহনি এবং অন্তরঘাত–এই দুই ধরনের প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে চলতে হয়েছে। শত বাধা অতিক্রম করেও শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের অধিকার অর্জনে বামপন্থী আন্দোলন আশার প্রদীপ হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল। অসহযোগ আন্দোলন ও তার পরবর্তী সময়ে জাতীয় কংগ্রেস পরিচালিত একাধিক কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনে বামপন্থী রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটেছিল অনেক ক্ষেত্রেই।

এ কথা নির্মম হলেও সত্য যে সরকার বিরোধী প্রকৃত অর্থে গণআন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে গান্ধীজীর ছিল যথেষ্ট অনীহা। যে কারণে, যে কোন ও জায়গায় কৃষক আন্দোলন গণ আন্দোলনের চরিত্র লাভ করলে জাতীয় কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গণ আন্দোলনের পরিবেশকে দমিয়ে দিয়েছে। জাতীয় জীবনে গান্ধীজীর প্রবল জনপ্রিয়তাকে অতিক্রম করে বামপন্থী আন্দোলন বাস্তবে কৃষকের লাঙ্গলের ফলার কাছে অথবা শ্রমিকদের কলকারখানার অন্দরে প্রবেশ করতে পারেনি। এই ক্ষেত্রে বামপন্থী নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতা, নাকি দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদদের অসহযোগিতা, কোন বিষয় দায়ী সেটা যথেষ্ট বিতর্কের বিষয়।

প্রকৃত ঘটনা এই, জাতীয় কংগ্রেস তার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আদর্শ ও সংসদীয় ব্যবস্থা পরিত্যাগ করে বৃহত্তর পর্যায়ে জাতীয় স্বার্থে বামপন্থীদের হাত ধরে চলতে চাইনি। বরং দূরত্ব বজায় রেখেই চলেছে। তাতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার পথ সহজ হয়েছে। যদিও বেশকিছু দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ বামপন্থী আন্দোলনের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিলেন। জাতীয় কংগ্রেসের মধ্য থেকে অনেকেই কংগ্রেস সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করেছিলেন। পরিতাপের বিষয়, তাঁরা যতটা না কমিউনিস্ট তার চেয়ে অধিক ছিলেন সমাজতান্ত্রিক। এই দোটানার মধ্যে বামপন্থী রাজনীতির মূল শর্তই যেন মাঝ পথে পথ হারায়।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত রাজনৈতিক আন্দোলনের উর্বর ভূমি হিসেবে পরিচিত বাংলায় বামপন্থী আন্দোলন যথেষ্ট মজবুত না হওয়ার একটি অন্যতম প্রধান কারণ হল, ধর্মীয় বিষয় তথা সাধারণ মানুষের আধ্যাত্মিক রীতিনীতি বিষয়ে বামপন্থী নেতৃবৃন্দের সুস্পষ্ট কোন দিকনির্দেশনাকে অনুসরণ না করা। প্রকৃত অর্থে বাঙালি জাতি একটি মিশ্র জাতি এবং মিশ্র সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক। ধর্মীয় তথা আধ্যাত্মিক চেতনার দ্বারা পরিচালিত বাঙালির সযত্নে লালিত সাংস্কৃতিক জীবনশৈলীকে বামপন্থীরা মর্যাদা দান করে চলার চেষ্টা করেনি। নাস্তিকতার প্রকট এবং প্রচ্ছন্ন অনুশীলন চিরাচরিত গ্রামীণ সমাজে অভ্যস্ত বাঙ্গালীর মানসিক জগতে একটা অদৃশ্য প্রাচীর তুলে দিয়েছে। বামপন্থী রাজনৈতিক আদর্শ নাস্তিকতাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারেনি, আবার আস্তিকতার অনুসারীদের সহিত ঘর করতেও পারেনি। ধর্ম নয়, ধর্ম মোহ যে আফিমের মত নেশা স্বরূপ। সেই ব্যাখ্যা তারা জনমানসে জনপ্রিয় করে তুলতে পারেনি।

অন্যদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শক্তির সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি বামপন্থী রাজনৈতিক গতি ধারাকে দুর্বল করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হল, ধর্মের সাথে রাজনীতির মেলবন্ধন। ফলে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের কালো ধোঁয়া অতিক্রম করে বামপন্থী রাজনীতি রাজনীতির ময়দান কে দূষণমুক্ত করতে পারেনি। আমরা আর ওরা –এই বিভাজন নিরসন করে বামপন্থীরা গণআন্দোলকে তৃণমূল পর্যায় থেকে মজবুত করতে পারেনি।
চতুর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সুকৌশলে বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মসূচিকে সমূলে উৎপাটন করার জন্য বিপ্লবিক, সন্ত্রাসী তথা নাশকতামূলক কার্যাবলীর দায় কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে এবং জনমানসে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করে। এর ফলে বামপন্থী রাজনীতির গণভিত্তিক যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়ে, যদি ও বেশ কিছু শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী এবং তরুণ ছাত্র সমাজের একটি আন্তরিক সমর্থন বামপন্থীদের প্রতি বজায় ছিল।

1935 এর ভারত শাসন আইন অনুযায়ী সংসদীয় ব্যবস্থা ভারতবর্ষে যখন একটি বলিষ্ঠ বিধি হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করার পটভূমিকা তৈরি হল, বামপন্থী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে তারা দূরে অবস্থান করাকেই প্রাধান্য দিল। ফলে, বাংলার বামপন্থী রাজনীতি সংশোধনের রাস্তার পথ পরিহার করে কমিউনিস্ট রাজনীতির মৌলিক নীতিকেই পাথেয় হিসেবে আঁকড়ে ধরল। ইতিহাস সৃষ্টি করতে গিয়ে তারা ইতিহাসের পাঠ নিতেই ভুলে গেল। রুশ বিপ্লবের নেতা লেনিন অনুসৃত নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা (NEP), প্রয়োজন ভিত্তিক সাম্যবাদ, মিশ্র অর্থনীতি কেন গ্রহণ করেছিলেন, সেটা নিয়ে চর্চায় করল না। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা এ কে ফজলুল হক দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সমান্তরালে মূলত বামপন্থী চেতনার আলোকেই কৃষক শ্রমিকদের সঙ্ঘবদ্ধ করে প্রজা কৃষক পার্টির নেতৃত্বে বাংলার রাজনীতিতে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, তিনি মুসলিম লীগ অনুসৃত বিচ্ছিন্নতাকামি রাজনীতি ও জাতীয় কংগ্রেস পরিচালিত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক চেতনার অসরতাকে প্রমাণ করেছিলেন। বামপন্থীরা এই পথ পরিহার করাকেই বাঞ্ছনীয় মনে করেছিলেন। অবশ্য তেভাগা আন্দোলনের সময় লাঙ্গল যার জমি তার, এই স্লোগান বামপন্থীদের গণভিত্তিকে যথেষ্ট মজবুত করেছিল। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস, জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদ, ব্যাপক ভূমি সংস্কার নীতি গ্রহণ করে শ্রমিক কৃষক শ্রেণীর স্বার্থের অনুকূলে জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ কোন রাজনৈতিক দল যে আন্তরিক নন, এই বাস্তব সত্যকে বামপন্থীরা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভ তথা ক্ষমতা হস্তান্তরের পরে ভারতীয় বামপন্থী রাজনীতি এক নতুন সমীকরণের পথ ধরে চলার চেষ্টা করে। সংসদীয় ব্যবস্থায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ অথবা কমিউনিস্ট আদর্শে ব্যাপক কৃষক শ্রমিক সঙ্ঘবদ্ধভাবে গণ আন্দোলন গড়ে তুলবে, এই প্রশ্নে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ল। বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন একই ছাদের তলায় ঘর করতে ব্যর্থ হল, তৈরি হল তথাকথিত বেশ কয়েকটি কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল। বামপন্থী কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক শক্তি হল দুর্বল।

নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে, একটা পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রাদেশিক সরকার গঠন করতে সক্ষম হয় বামপন্থী রাজনৈতিক দল। নানা ধরনের সংস্কার নীতি গ্রহণ করে বিগত দিনের আধা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে ভেঙে দিতে সক্ষম হলেও বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের খোলশ ত্যাগ করতে ব্যর্থ হয় বামপন্থী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। সামন্ততন্ত্রের অনুসারীরা, দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ধারক এবং বাহকেরা সুযোগ বুঝে বামপন্থী রাজনীতিতে আশ্রয় নেয়, যার ফলে কৃষক শ্রমিক স্বার্থ অনেকটাই ব্যাহত হয়। দুর্নীতি, সজন-পোষণ, পদ লোভ অনেক নেতৃবৃন্দকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। কমিউনিস্ট রাজনীতির স্বচ্ছতা হারিয়ে যায়। আমলাতন্ত্র ও প্রশাসনের অনেক স্তর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কুক্ষিগত হয়। নন পলিটিসাইজেশন ডেভলপমেন্ট এবং ইকুয়্যাল ডিস্ট্রিবিউশন, যা হল কমিউনিস্ট রাজনীতির অন্যতম প্রধান দিক নির্দেশনা, সেই নীতিকে তারা সদর্পে বিসর্জন দেয়।

কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি তথা বামপন্থী রাজনৈতিক চেতনা যে একটি নির্মল আদর্শ, সামাজিক বৈষম্য নিরসনের দিশা, মেহনতী মানুষের অধিকার অর্জনের দিকনির্দেশনা–এই চেতনা জনমানসে একটি আলোর সৃষ্টি করলেও তার সফল রূপায়ণে স্বার্থান্বেষী দৃষ্টিভঙ্গি অন্তরায় সৃষ্টি করে। স্বার্থ সংঘাত, ক্ষমতার আস্ফালন,আর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস বামপন্থী রাজনৈতিক চেতনার নির্মলতাকে বিসর্জন দেয়। এক শ্রেণীর নেতৃবৃন্দ বামপন্থী চেতনাকে একটি উজ্জ্বল আদর্শ হিসেবে জনজীবনে প্রতিষ্ঠা করার মহান লক্ষ্যে নিরলস প্রয়াস চালাতে থাকে। কিন্তু, এটাই শেষ কথা নয়। এর সমান্তরালে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বামপন্থী রাজনীতিকে তাঁদের আখের গোছানোর একটি রাজনৈতিক মঞ্চে পরিণত করে।

অধিকাংশ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রাজনীতির ময়দানে মৌমাছির জীবনশৈলী অনুসরণ না করে মাছির জীবনশৈলীকে অনুসরণ করতে থাকে। এর অন্তিম পরিণতি হিসাবে, ক্ষমতার আস্ফালন তাদের ক্ষমতাচ্যুত করার পটভূমিকা রচনা করে। আমজনতা বামপন্থী রাজনীতি ও দক্ষিণপন্থী রাজনীতির মধ্যে আদর্শগত তেমন বড় পার্থক্য লক্ষ্য করেনা। একটি সরল সমীকরণের সুস্পষ্ট মেলবন্ধন প্রত্যক্ষ করে, রাজনৈতিক ক্ষমতা যেন দুর্নীতির আখড়া।

মোটের ওপর রাজনৈতিকভাবে সচেতন মানুষ, যাদের মধ্যে মানবতার প্রতি চেতনার প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়, ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য করতে পারে, সমাজের মাঙ্গলিক চিন্তার চর্চা করে তারা কিন্তু বামপন্থী রাজনৈতিক চেতনার প্রতি আস্থা রেখে আগামী দিনের সুখী সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে। ব্রিটিশ শাসনাধীন উপনিবেশিক সময় কাল থেকে অধুনা পুঁজিবাদের আশ্রয় পুষ্ট বিশ্বায়নের যুগেও সেই ধারা বহাল আছে। সমস্যা হল, বামপন্থী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির নিবিড় পাঠ, পরিকল্পিত অনুশীলন আর স্বচ্ছ প্রয়োগ নীতির যে ব্যাপক চর্চার পরিবেশ দরকার, সেটাই গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দের চেতনার জগতে নিঃসন্দেহে সেটা আলোড়ন সৃষ্টি করে থাকে । তাঁদের নিরলস প্রয়াস, আদর্শ ও কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠা, আত্মত্যাগ, ধৈর্য ও সহনশীলতার অন্তরালে সাফল্যের বীজ মাটি চাপা পড়ে আছে।

You may also like