বইকথাঃ বাংলার মুসলমান

by আনওয়ারুল হক

বাংলার মুসলমান
আবু সিদ্দিক
প্রকাশকঃ সোপান, কলকাতা
প্রকাশ কালঃ ২০১৮
হার্ডকভার
বিনিময় মূল্যঃ ৩০০

পড়ছিলাম আবু সিদ্দিক স্যরের বাংলার মুসলমান নামক তথ্যানুসন্ধানী বই। বাংলার মুসলমানদের সংস্কৃতি, দৈনন্দিন চাওয়া-পাওয়া, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় লেখক সুনিপুণ ভাবে তুলে ধরেছেন। ইতিহাসবিদ ম্যাক্সমুলার, সমাজ সংস্কারক জ্যোতিবা ফুলে সহ নানান ঐতিহাসিকের প্রমাণ দিয়ে ইউরোপ ও ইরান দেশ থেকে আগত যাযাবর আর্যদের (আজকের ব্রাম্মন) আক্রমণে মুলনিবাসী আদিবাসী ও শুদ্রদের পরাজিত করে আধিপত্যের ভারতীয় ইতিহাস তুলে ধরেছেন। অনেক তথ্যসূত্রের মাধ্যমে লেখক তুলে ধরেছেন ‘এই কাস্ট হিন্দুদের পূর্বপুরুষ বাংলার বাসিন্দা ছিলো না, বাঙালি মুসলমান (দাস বা শুদ্রদের থেকে ধর্মান্তরিত) ভারতের আদি বাসিন্দা।তাঁদের জন্মমৃত্যু আশা আকাঙ্ক্ষা ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গকে ঘিরেই।’

লেখক বাঙালির পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে লিখেছেন- ‘পশ্চিমবঙ্গে প্রতি চারজন একজন বাঙালি মুসলমান,এই বিপুল জনগোষ্ঠী মূলত গ্রামকেন্দ্রিক ও কৃষিনির্ভর’ কিন্তু কৃষিতে যেভাবে দিন দিন অবনতি নেমে আসছে তাই এদের বিশাল অংশই শ্রমিকের কাজে ছুটে বেড়ায় কেরল, বেঙ্গালুরু, মহারাষ্ট্র সহ নানান রাজ্যে।অভাব এদের নিত্যসঙ্গী।’

‘আপনি বাঙালি না মুসলমান ‘? এই প্রশ্নের শিকার এই জাতীর প্রায় লোককেই হতে হয়।এ প্রসঙ্গে লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখার অংশ তুলে ধরেছেন “বাংলাভাষীদের মধ্যে মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, সুলতানি আমলেই প্রথম বাংলা ভাষা দানা বেঁধে ওঠে।ব্রিটিশ আমলেও যখন শিক্ষিত হিন্দু বাঙালিরা ইংরেজিতে তুবড়ি ফাটাতেন, তখন বিধানসভায় মুসলমান সদস্যরাই প্রথম বাংলা ভাষায় ভাষণ দেবার দাবি তোলেন”।

লেখকের প্রশ্ন ‘পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু-মুসলমান দীর্ঘদিন পাশাপাশি বাস করেও প্রতিবেশী কি আজও হতে পেরেছে? বরং মুসলমানদের পরিচয় গোমাংস ভক্ষণকারী, অশিক্ষিত, বর্বর, দেশদ্রোহী, উগ্রপন্থী… আরও কত জানা-অজানা বিশেষণ।এর সাথেই এদেরকে ভোটব্যাংক ও সংখ্যালঘু হিসাবে তুলে ধরে শিক্ষা,স্বাস্থ্য,চাকুরী,পরিবহন ইত্যাদির ক্ষেত্রে কৌশলে চেপে রেখে এদের শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়া হয়েছে।’

লেখক ‘বাঙালি মুসলমান ও শিক্ষা’ অধ্যায়ে খানিক আত্মসমালোচনা শেষে মুসলমানদের শিক্ষার যে করুণ দুর্দশা তুলে ধরেছেন তা তা দেখতেই যেন গা শিউরে উঠে! সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে প্রাথমিক,মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, বিজ্ঞান বিভাগের হাইস্কুল ও কলেজ না হওয়া(মুর্শিদাবাদের মতো জেলায় আজও একখান বিশ্ববিদ্যালয় না হওয়া) এবং দারিদ্র্যতার কারণে শিক্ষার্জন থেকে বঞ্চিত থেকে যাওয়া জাতীর কাছে লেখকের স্পষ্ট বার্তা- ‘মুসলমানদেরকে বাংলার বুকে মাথা উঁচু করে চলতে হলে শিক্ষাকে আলিঙ্গন করতেই হবে’….শিক্ষা জাতি ও গোষ্ঠীর জীবনে আবশ্যিক এ বিষয়ে দ্বিমত থাকতে পারে না’।
ভালো লাগার মতো আরেকটা বিষয় লেখক বাঙালি মুসলমানের শিক্ষা-দীক্ষা,ও রাজনৈতিক অবস্থান বিষয়ে খানিক আত্মসমালোচনাই করেছেন, যা থেকে শিক্ষা নেওয়া ও সচেতন হওয়া সময়ের দাবী বলে মনে করি, ‘বাঙালি মুসলমানের কর্তব্য’ অধ্যায়ে তার একাংশ লক্ষ্য করেছি।

বাঙালি হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মালম্বীদের একাত্ম করতে চেয়ে আত্ম-ধ্বংসকারী গুণাবলী যেমন কর্মবিমুখতা,পরনিন্দা,পরহিংসা,পরচর্চা বিষয়গুলো থেকে বেরিয়ে এসে সম্প্রীতির এক নতুন বাংলার সম্ভাবনার কথা লেখক সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন যা সত্যিই বেশ প্রশংসার।

ধর্ম নিয়ে একে অপরের কাদা ছোঁড়াছুড়ি বিষয়ে লেখক হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই সমালোচনার সুরে লিখেছেন ”ধর্মের সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্রয়দাতারা আর যাই হোক এদের ধার্মিক বলা যাবে না”…..’সব ধর্মীয় পুস্তকগুলির উদ্দেশ্য একটিই-জীবনের আদর্শ পথের দিশারী’ ধর্মগ্রন্থগুলি কুকাজের অনুমতি দেয় না।” তাই রাজনীতিকদের খপ্পরে পা না দিয়ে সম্প্রীতি ও মিলনের জয়গান গেয়েছেন যা বইটির পড়তে পড়তে বুঝেছি।

”বাংলার মুসলমানদের যে কথা জোর দিয়ে বলতে চাই” অধ্যায়ে লেখক যে দৈন্যদশা তুলে ধরেছেন তা সত্যিই ভাবিয়ে তুলে -“বাংলার মুসলমানদের কিছুই নাই-শিক্ষা, অর্থ, বাসস্থান, শিল্প,সম্পদ, সম্মান, সাহিত্য, সংস্কৃতি, এত নাই তবুও কি স্থবির হয়ে দিনযাপনের গ্লানি বহন করে চলবে?…তারা কোনো ফুটবল নয় যে, যে যেমন করে পারবে লাথি মেরে গোল করে আখের গোছাবে, আর সে শুধু লাথি খেয়েই যাবে” এসব থেকে বের হওয়ার জন্য শিক্ষা – স্বাস্থ্য ও সামাজিক -অর্থনৈতিক সহ কিছু গঠনমূলক প্রাত্যহিক অভ্যস ও বিভিন্ন উপায় বাতলেছেন।লেখক লিখেছেন “বাংলার শিক্ষিত মুসলমান আগামী প্রজন্মের কাছে একটি সুন্দর গঠনমূলক সমাজ তুলে দিতে দায়বদ্ধ। এ কাজে ফাঁকি দিলে আগামী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।”

পাঠপ্রতিক্রিয়ায় অনেক তথ্যই তুলে ধরতে পারলাম না লেখার কলেবরের কথা মাথায় রেখে। তবে আপনাকে পড়তেই হবে বিস্তারিত জানতে। শেষে বলি যে “যে জাতি নিজের ইতিহাস জানে না, সে দূর্বল এবং অন্যের গোলাম হয়ে কালাতিপাত করে”। তথ্যানুসন্ধানী এই বই বাঙালির মননকে জাগিয়ে তুলে এক নতুন সকালের দিশা দেখাবে বলে বিশ্বাস, একে অপরের ধর্ম-সংস্কৃতি, সচেতনতা ও সম্প্রীতি ছড়িয়ে দিতে এই বই এক অনন্য নিদর্শন হয়ে থাকবে বলে বিশ্বাস।জানুন নিজেকে, নিজের সমাজ, ধর্ম ও দেশকে।বইটি পড়ার আবেদন রইলো সবাকার প্রতি।

You may also like