সামসুল হালসানা
“Journalism is what maintains democracy. It’s the force for progressive social change.”
—Andrew Vachss
একটি গণতান্ত্রিক দেশে যখন গণতন্ত্রের এক একটি স্তম্ভ ভেঙে যাওয়ার মুখে, তখন সেই স্তম্ভগুলোকে মজবুত করার কাজে সর্বাগ্রে যার আবির্ভাব হয় তা হল গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ অর্থাৎ সংবাদপত্র। সংবাদপত্র শুধু সংবাদ তৈরি করে এবং প্রচার করে তাই নয়, ইহা সুস্থ প্রগতিশীল এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক জনমত তৈরি করে। সংবাদপত্র বাস্তব তথ্যের উপর ভিত্তি করে তার খবর পরিবেশন করে যাতে করে মানুষ সত্য মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে এবং কল্পনাশ্রিত এবং ভুয়ো খবর কোন সংবাদপত্রই তুলে ধরতে সাহস না পায়। কিন্তু উত্তর সত্যযুগে (পোস্ট ট্রুথ এরা) বর্তমানে আমাদের দেশের রাজনৈতিক বাতাবরণে যে সত্য মিথ্যার জাল তৈরি হয়েছে তা দেখে আমাদের মনে পড়ে যায় ১৯৫১ সালে প্রকাশিত Hannah Arendt এর লেখা “The Origins of Totalitarianism” গ্রন্থের কথা । “The book analyzed the socio-cultural conditions that gave rise to totalitarianism in Nazi Germany… ” । তিনি তাঁর এই বিখ্যাত গ্রন্থে যেটা বলতে চেয়েছেন সেটা হল এই যে মতাদর্শ (ideology) ও সন্ত্রাসের (terrorism) মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আজকের ভারতের দিকে তাকিয়ে তাঁর সে কথার সত্যতা নতুন করে প্রমাণিত হচ্ছে। শাসক গোষ্ঠী তার নিজের মত করে একটি মিথ্যা মতাদর্শ তৈরি করে চলেছে এবং অন্যদিকে সন্ত্রাস ছড়িয়ে ওই মিথ্যা মতাদর্শকে প্রচার করে চলেছে তাদের কুক্ষিগত এবং কেনা কিছু সংবাদপত্রের মাধ্যমে এবং সেই সংবাদ গুলোকে ছড়িয়ে চলেছে বিভিন্ন কায়দা কৌশল অবলম্বন করে । এই মতাদর্শ ও সন্ত্রাসকে হাতিয়ার করে তারা একটি প্রপাগণ্ডা প্রচার করে চলেছে সংবাদমাধ্যমকে ( print , electronic and social media) কাজে লাগিয়ে।
বর্তমান পোস্ট -ট্রুথ যুগে যেকোনো বিচারে যা ডাহা মিথ্যা, প্রপাগান্ডার শক্তিতে তাও একমাত্র সত্য হয়ে ওঠে।দেশের সহজ সরল বেশিরভাগ নাগরিক গোষ্ঠীই এই প্রোপাগান্ডার যাঁতাকলে পা দিয়ে সত্য-মিথ্যার প্রভেদ নির্ণয়ের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রশক্তির বিভিন্ন যন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে ভেড়া বানিয়ে দেয়, যার ফলে অনেক মানুষ তাদের যুক্তিবোধ এবং বিচারবোধকে হারিয়ে ফেলে শাসকের তৈরি করা মিথ্যা আবেগে গা ভাসিয়ে । Arendt আরো বলেছেন যে স্বৈরাচার এক নতুন শাসনব্যবস্থা, যেখানে সব নিয়মনীতি ও রাজনৈতিক ঐতিহ্য ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলে এমন এক শাসনব্যবস্থার পত্তন করা হয়, যেখানে রাজনৈতিক দলের স্থান গ্রহণ করে গণ–আন্দোলন বা মাস মুভমেন্ট, শ্রেণির স্থান নেয় জনতা, সামরিক বাহিনী ও পুলিশ হয়ে ওঠে শক্তির উৎস। ‘সত্য ঘটনা নয়, এমনকি বানানো ঘটনাও নয়, জনতার জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো যে শাসনব্যবস্থার অংশ হিসেবে তারা নিজেকে বিবেচনা করে, তার দৃঢ়তা।’
গণতান্ত্রিক ও সামাজিক প্রগতিশীলতার মূল অস্ত্রই হলো সৎ ও বলিষ্ঠ সাংবাদিকতা। ফিলিপিনস এবং রাশিয়ায় স্বাধীন মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে “সাহসী লড়াই”-এ অবদানের জন্য রাখার সা আর দিমিত্রি মুরাতফকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়েছে।নোবেল কমিটি এই সাংবাদিক যুগলকে বর্ণনা করেছে “এই আদর্শের জন্য সংগ্রামরত সব সাংবাদিকদের প্রতিনিধি” হিসাবে তাদেরকে এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। যেখানে মানুষের স্বাধীন মত ব্যক্ত করার লড়াই জারি রাখার জন্য সাংবাদিকতার জগতের মানুষকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশে স্বাধীন মত ব্যক্ত করার ক্ষমতাকে প্রতিদিনই কেড়ে নেওয়া হচ্ছে ।
গণতন্ত্রে সংবাদমাধ্যম স্বাধীনভাবে বিচরণ করবে এবং সঠিক খবর পরিবেশন করবে এটাই কাম্য । সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করে সরকারকে আরো গণমুখী কাজে চালিত করাই সংবাদ মাধ্যমের প্রধান কাজ। কিন্তু বড় আক্ষেপের বিষয় এবং চিন্তার বিষয় ভারতের গণমাধ্যম গুলি আজ বিপন্ন, অধিকাংশ গণমাধ্যম হয় রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছে অথবা অর্থের কাছে বিকিয়ে গেছে। এটা খুব দুর্ভাগ্যের এবং দুশ্চিন্তার। বিকৃত খবর পরিবেশনের ফলে জনমানসে বাড়ছে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ , হিংসা উস্কানি এবং এমনকি দাঙ্গার মতো ঘটনা। এক জায়গার ঘটা খবর অন্য জায়গার খবর বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে সর্বদা। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ এইভাবে ভেঙে পড়লে মানুষ যাবে কোথায়।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম নজরদারি সংস্থা “রিপোর্টার্স সঁ ফ্রঁতিয়ে” বা “আরএসএফ” বলছে, নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বড়সড় হুমকির মুখে পড়েছে।গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিচারের যে আন্তর্জাতিক তালিকা তারা প্রকাশ করেছে, তাতে ভারতের অবস্থান ১৩৮-এ এসে দাঁড়িয়েছে। গত বছর ভারতের অবস্থান ছিল ১৩৬। ভারতের শত্রু চীন এবং পাকিস্তান যেখানে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব নেই বলে গলা ফাটানো হয় স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে সেই দেশের অবস্থান ভারতের অনেক উপরে।সরকারের সমালোচনামূলক অথবা তথাকথিত জাতীয়তাবাদ বিরোধী যে কোনও সংবাদ প্রকাশ করলেই সাংবাদিকদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে – যার সিংহভাগই করা হচ্ছে মোদীর ‘ট্রোলিং বাহিনী’র দ্বারা।
উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে ভারতের পরিচিত টেলিভিশন উপস্থাপিকা ও বর্তমানে টাইমস অফ ইন্ডিয়া গ্রুপের কনসাল্টিং এডিটর সাগরিকা ঘোষ এমন একজন মেরুদন্ড সোজা রাখা এবং বলিষ্ঠ সাংবাদিক, যাকে নিয়মিত হুমকি দেওয়া হয় অত্যন্ত কদর্য ভাষায়।তাঁকে যেমন প্রাণে মেরে ফেলা বা গণধর্ষণের হুমকি দিয়ে ফোন বা চিঠি আসে। বাদ যায় না তাঁর স্কুল পড়ুয়া কন্যার নাম করেও অপহরণ ও ধর্ষণের হুমকি। তিনি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আক্ষেপ করে বলেছেন:
“আমি জানি না কোন লেখা বা প্রতিবেদনের জন্য নিয়মিত হুমকি দেওয়া হয়। কিন্তু অশ্লীল ভাষায় গণধর্ষণ করার বা মেরে ফেলার হুমকিগুলো আসে। ছবি মর্ফ করে পর্ণোগ্রাফিক ভিডিও বানানো হয়। পুরুষ সাংবাদিকদেরও হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে, তবে আমার মতো কয়েকজন নারী সাংবাদিককে হুমকি দেওয়ার সময়ে একটা সেক্সুয়াল ওভারটোন থাকে।” শুধু মিসেস ঘোষ নন, ভারতের আরও অনেক সাংবাদিকই সম্প্রতি পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হুমকির মুখে পড়েছেন। এনডিটিভি বলিষ্ঠ সাংবাদিক তথা ভাষ্যকার রভিশ কুমার বা সিদ্ধার্থ বরদারাজনদের মতো প্রতিথযশা সাংবাদিকদেরও হুমকি দেওয়া হয় নিয়মিত।সরকার বা তার ঘনিষ্ঠদের সমালোচনা করে লেখা প্রতিবেদনের দায় নিয়ে চাকরি খোয়াতে হয় বর্ষীয়ান সম্পাদকদের।রিপোর্টার্স সঁ ফ্রঁতিয়ে তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে লিখেছে, কট্টর জাতীয়তাবাদীরা ক্রমবর্ধমান হারে সাংবাদিকদের টার্গেট করছে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে।
গত কয়েক বছরে রাষ্ট্রের হাতে হেনস্তার শিকার সাংবাদিকের তালিকাটা কিন্তু দীর্ঘ। সঙ্ঘ পরিবারের স্নেহধন্য কেউ গ্রেপ্তার হলে নজিরবিহীনভাবে দ্রুত সুপ্রিম কোর্টে মামলা ওঠে। খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ট্যুইট করেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা রে রে করে নেমে পড়েন। জামিনের সঙ্গে মেলে বীরের সম্মানও। বশংবদ না হলে ঝুলে থাকে মামলা, কেউ খোঁজও নেয় না। দিল্লির ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক প্রশান্ত কানোজিয়া একটা নিরীহ ট্যুইট করেছিলেন রামমন্দির নিয়ে। তাতেই রেগে গিয়ে গেরুয়া শিবির তাঁকে দিল্লি থেকে লখনউতে তুলে নিয়ে গিয়ে জেল খাটিয়েছে। বাড়ি অফিসে তল্লাশির নামে তাণ্ডব চলেছে। টিভি চ্যানেলের জনপ্রিয় অ্যাঙ্কর পুণ্যপ্রসূন বাজপেয়ি এক সময়ের অত্যন্ত পরিচিত নাম। হঠাৎ একটি নামকরা চ্যানেলের শীর্ষ পদ থেকে তাঁর সরে যাওয়া ঘিরে নানা অপ্রিয় প্রশ্ন সামনে এসেছে। কার চাপে ও অঙ্গুলিহেলনে এমনটা হয়েছে, সে রহস্যের এখনও পর্দাফাঁস হয়নি। কার্যত তাঁর কেরিয়ারই খতম করে দেওয়ার আয়োজন সম্পূর্ণ।
তালিকায় আছেন জনপ্রিয় মহিলা সাংবাদিক ও অ্যাঙ্কর বরখা দত্তও। ব্যক্তিগতভাবে প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানের চর বলে দেগে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। দেশীয় সংবাদমাধ্যমের কোথাও টিকতে দেওয়া হয়নি অকুতোভয় বরখাকে। আজকাল মাঝে মাঝে কিছু বিদেশি গণমাধ্যমে তাঁর কলাম দেখতে পাওয়া যায় বটে, তবে ওইটুকুই। টাইম ম্যাগাজিনে বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে লেখাটাও তাঁর। কাশ্মীর নিয়ে নিয়মিত খবর করে সরকারের কোপে পড়েছেন সাংবাদিক মুস্তাক আহমেদ গনাই। তাঁকে শুধু গ্রেপ্তার করেই ক্ষান্ত হয়নি প্রশাসন, চলেছে অকথ্য অত্যাচারও। সবমিলিয়ে শুধু ২০২০ সালেই রাষ্ট্রের হাতে নিপীড়িত সাংবাদিকের সংখ্যাটা অনেক, এবং প্রতিনিয়তই তা বাড়ছে। তথ্যের আদানপ্রদান, স্বাধীন চিন্তা ও মতামতকে ইতিহাসে কোথাও একনায়করা ভালো চোখে দেখেননি। আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে শুধু একজন হিটলারের কথা বলি, কিন্তু সমাজে সংসারে, দৈনন্দিন চারপাশে এবং অবশ্যই রাজনীতিতে ‘হিটলার’ কখনও কম পড়েনা!
কেন স্বাধীন সংবাদপত্রের গলা টিপে ধরা হচ্ছে? এর কারণ একটাই এদেশে গত সাত বছরে সংখ্যালঘু মুসলিমদের এবং দলিত দের উপর যে নির্মম এবং নিষ্ঠুর অত্যাচার করা হচ্ছে সেই সংবাদ বলিষ্ঠভাবে জন মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্যই বলিষ্ঠ স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের ওপর ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং দেশাত্মবোধের হাওয়া তোলা সরকারের পরিকল্পিত এই আঘাত। সংবাদমাধ্যমের ইতিহাস ঘাঁটলেই স্পষ্টত চোখে পড়ে যে টাইম ম্যাগাজিন বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় নরেন্দ্র মোদির নাম অর্ন্তভুক্ত করেও সংখ্যালঘু ও সাংবাদিকদের এই বিপন্নতার কথাই সবিস্তারে তুলে ধরেছে। সাংবাদিক ফরিদ জাকারিয়া লিখেছেন, ‘৭৪ বছরে স্বাধীন ভারত তিনজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে পেয়েছে। জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী ও নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ থেকে টেনে নামিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র করার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর আমলে সংখ্যালঘুদের অধিকার খর্ব হয়েছে এবং সাংবাদিকদের ঠাঁই হয়েছে জেলে।’ ডবল ইঞ্জিন রাজ্য উত্তরপ্রদেশ নিয়ে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই পরিস্থিতিটা পরিষ্কার হয়ে যায়। সেই রাজ্যের আদ্যন্ত ‘যোগী’ মুখ্যমন্ত্রী অজয় বিস্ত মহিলাদের সঙ্গে গোরু, মোষকে একাসনে বসিয়ে গোটা দেশকে চমকে দিয়েছেন। কট্টর গেরুয়া সংসারে নারীর স্থান কোথায় তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে তাঁর ওই একটা কথাতেই। এরাই আবার মাঠে ময়দানে ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলে ছদ্ম জাতীয়তাবাদের ধ্বজা তুলে ধরেন। আর বিরুদ্ধে বেফাঁস কেউ কিছু বললেই পাকিস্তানি সাজিয়ে আসর মাত করেন! আর তাতেও কাজ না হলে ইন্টারনেট পরিষেবাই বন্ধ করে দেয়। তথ্যের আদানপ্রদান যেখানে স্তব্ধ, মানুষে মানুষে যোগাযোগ যেখানে ক্ষীণ সেখানে প্রতিবাদ ভাষা খুঁজে পায় না। আজ থেকে দু’দশক বাদে তাঁর শাসনকালও সাংবাদিকদের কাছে জরুরি অবস্থার কলঙ্কের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। নোট বাতিল, কাশ্মীরকে সবক শেখানো, অযোধ্যার রামমন্দির নির্মাণ আর হিন্দু রাষ্ট্রের গৌরব সেই কালি মুছে দিতে পারবে তো!
দেশের স্বাধীনতার পর থেকে গত ছ’-সাত বছরে যে পরিমাণ অর্থনৈতিক, সামাজিক অবনমন ঘটেছে তা এক কথায় অকল্পনীয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই দেশের সংবাদ সংস্থার, সাংবাদিকদের এই পরিস্থিতিতে একমাত্র কাজ প্রকৃত চিত্রটি উপস্থাপন করা। কোনওভাবেই যাতে সত্য গোপন না হয় বা তাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থেকে কাজ করা। কিন্তু সেই ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থাকালীন সময় থেকেই এটা স্পষ্ট যে দেশে একনায়কতন্ত্র না থাকলেও রাষ্ট্র তার সবটুকু ক্ষমতা প্রয়োগ করে ও আইনের ফাঁক গলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া থেকে খর্ব করা কোনওটাতেই পিছিয়ে থাকে না। আর বর্তমানের অঘোষিত জরুরি অবস্থার সময়েও তারই পুনরাবৃত্তি ঘটছে। সিএএ-এনআরসি বিরোধী দেশব্যাপী যে আন্দোলন তাকে কোনওভাবেই সামলাতে না পারা এবং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সে সংবাদের উপস্থাপনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়ায় তারা তাদের দ্বারা সম্পূর্ণ প্রভাবিত জাতীয় সংবাদমাধ্যমে এর বিপরীত উপস্থাপনা শুরু করে। এই সময়ে ‘রিপাবলিক টিভি’, ‘টাইমস্ নাও’, ‘আজ তক’-এর মতো টেলিভিশন সংবাদ চ্যানেল-এর কথা বলা যেতে পারে, যারা সংবাদের নামে সরাসরিই কেন্দ্রীয় সরকারের সংখ্যালঘু বিরোধী হিন্দুত্ববাদী, উগ্র জাতীয়তাবাদী ‘অ্যাজেন্ডা’ ধারাবাহিকভাবে প্রচার করে চলেছে। যদিও অনেক সংবাদপত্রের ভূমিকা এক্ষেত্রে অনেকটাই সদর্থক ছিল। ‘এনডিটিভি’, ‘ইন্ডিয়া টুডে’-এর মতো টেলিভিশন নিউজ চ্যানেল নাগরিক সমাজ, ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনকে যতই নিরপেক্ষভাবে সামনে নিয়ে এসেছে ততই ‘গোদী মিডিয়া’ তাদের ‘দেশদ্রোহী’ হিসাবে দেগে দিয়েছে। দেশের শাসনব্যবস্থার শীর্ষ নেতারা বিরোধী মতপ্রকাশকারী নাগরিকদের ‘দেশদ্রোহী’ বলছে ও এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যম তাকেই স্বীকৃতি দিচ্ছে নিজেদের পিঠ বাঁচাতে, এমনটা দুর্ভাগ্যজনক।
এখন প্রশ্ন হলো কেন এমনটা হচ্ছে? আসলে এর উত্তরে বলা যেতে পারে অর্থনৈতিক মুনাফা। আসলে কেন্দ্রে যে সরকার আছে তারা ভুয়ো দেশপ্রেমের জিগির তুলে ও উগ্র জাতীয়তাবাদের হাওয়া তুলে মানুষকে তাদের দৈনন্দিন সমস্যা থেকে মুখ ঘুরিয়ে দিয়ে দেশটাকে লোভী কর্পোরেটদের হাতে বিক্রি করে দিতে চাইছে। অনেক সরকারী লাভজনক সংস্থা ইতিমধ্যেই বেসরকারি হাতে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।কর্পোরেটই তো চালায় মিডিয়াকে৷ ভারতে অবশ্য কর্পোরেটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক নেতারা৷ তারাও প্রচুর চ্যানেল বা কাগজের মালিক৷ সংবাদপত্র, নিউজ চ্যানেল, পত্রিকা, ডিজিটাল নিউজ প্ল্যাটফর্ম সবই হলো ব্যবসা, নিখাদ ব্যবসা৷ আর পাঁচটা ব্যবসার মতো এখানেও মন্ত্র একটাই, প্রডাক্ট বেচতে হবে৷ বিজ্ঞাপন পেতে হবে৷ লাভের কড়ি ঘরে আনতে হবে৷ ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর জন্য কেউ বড় আকারে খবরের কাগজ করেন না৷ সাংবাদিকতাও নয়৷ তবে অন্য ব্যবসার সঙ্গে ফারাকটা হলো, মিডিয়া জনমত গঠন করতে পারে, কোনো একদিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে, যেটা আর পাঁচটা ব্যবসা পারে না৷ আর তাই কর্পোরেট, রাজনৈতিক নেতাদের নজর পড়েছে মিডিয়ার উপর৷ এই সব কর্পোরেটের কাছে মিডিয়া প্রধান ব্যবসা নয়, এটা হলো সহায়ক ব্যবসা৷
এখন ভারতের মিডিয়া সংস্থার মালিক হয় কর্পোরেট বা রাজনৈতিক নেতা৷ ভারতে নিউজ টেলিভিশনের সব চেয়ে বড় চেইন হলো টিভি১৮৷ প্রায় প্রতিটি প্রধান ভাষায় টিভি১৮-র নিউজ চ্যানেল আছে৷ তার মালিক মুকেশ আম্বানির গোষ্ঠী রিলায়েন্স৷ নিজেদের টিভি চ্যানেল ছাড়াও প্রচুর মিডিয়া গোষ্ঠীর শেয়ার কিনে রেখেছে আম্বানির রিলায়েন্স৷দিল্লির অন্যতম প্রধান ইংরাজি সংবাদপত্র হিন্দুস্তান টাইমস, যার মালিক বিড়লা শিল্পগোষ্ঠীর শোভনা ভারতীয়া৷ উত্তর প্রদেশে তাদের বড় কারখানা আছে৷ তার ও তার স্বামী অনেক শিল্প সংস্থার মালিক৷দেশের অন্তত ছয়টি ভাষায় খবরের কাগজ, পত্রিকা, নিউজ টেলিভিশন চ্যানেল, পডকাস্ট, ডিজিটাল নিউজ, অনলাইন গানের প্ল্যাটফর্ম, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট মিলিয়ে বিশাল ব্যবসা বেনেট কোলম্যান অ্যান্ড কোম্পানির, যার মালিক জৈন পরিবার৷ তারা এখন সংবাদপত্র জগতের সব চেয়ে বড় কর্পোরেট সংস্থা৷ তবে তাদের কাছে সংবাদপত্রের ব্যবসাই প্রধান৷ এছাড়া তারা শিক্ষা সংস্থার মালিক৷হিন্দি সংবাদপত্রের জগতে অন্যতম বড় নাম দৈনিক জাগরণ, যার মালিক বিজেপি-র সাংসদ ছিলেন৷ তাদেরও সুগার মিল সহ অন্য নানা ধরনের ব্যবসা আছে৷ পাইয়োনিয়ারের সাবেক সম্পাদক ও সাবেক মালিক চন্দন মিত্র বিজেপি-র সাংসদ ছিলেন, পরে অবশ্য তিনি তৃণমূলে যোগ দেন৷ ওড়িশায় সাবেক মুখ্যমন্ত্রী নন্দিনী শতপথির ছেলে তথাগত শতপথি কিছুদিন আগে পর্যন্ত বিজেডি-র সাংসদ ছিলেন৷ তিনি একটি সংবাদপত্র চালান৷ দক্ষিণ ভারতের এক মুখ্যমন্ত্রীর পরিবার একটি বড় সংবাদপত্র গোষ্ঠীর মালিক৷তামিলনাড়ুতে ডিএমকে নেতা মুরোসলি মারান রাজ্যের প্রধান টিভি নেটওয়ার্কের মালিক৷ সাবেক কংগ্রেস সাংসদ রাজীব শুক্লার স্ত্রী অনুরাধা প্রসাদ নিউজ ২৪-এর মালিক৷ তিনি আবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের বোন৷ ইন্ডিয়া নিউজের মালিক আবার কংগ্রেস নেতার ছেলে৷ মহারাষ্ট্রের লোকমতের মালিক কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত৷কর্পোরেটের হাতে, রাজনৈতিক নেতার হাতে মিডিয়ার মালিকানা থাকা মানে, ক্ষমতায় যে দল থাকবে, সেই দলের হয়েই সেই সব মিডিয়া কথা বলবে৷ কর্পোরেটের পক্ষে অসুবিধাজনক কোনো খবর দেখানো বা ছাপা হবে না, হলেও গুরুত্বহীনভাবে হবে৷
তবে আশার কথা গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের শিরদাঁড়া সোজা করে সংবাদ পরিবেশন করে চলেছে ক্ষুদ্র সংবাদপত্র বা পাক্ষিক বা সাময়িক পত্রিকা গুলো। প্রত্যেক অঞ্চলের এই ক্ষুদ্র সাময়িক পত্র বা সংবাদপত্র গুলো বাস্তব তত্ত্বের ভিত্তিতে এবং নির্ভীকভাবে মানুষের সামনে খবর পরিবেশন করে থাকে। অধিকাংশ এই ক্ষুদ্র সংবাদপত্রগুলো আঞ্চলিক খবর এবং অনেক ক্ষেত্রে অনেক জাতীয় খবর মানুষের সামনে তুলে ধরে সংবাদপত্রের গৌরব এবং বলিষ্ঠ সাংবাদিকতার নিদর্শন হিসাবে কাজ করে চলেছে। এই সংবাদপত্রগুলো এখনো ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে পরিণত হয়নি এবং আমি আশা করি এই সংবাদপত্রগুলি গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও দেশের সম্প্রীতি এবং সংহতির পক্ষে সংবাদ পরিবেশন করে যাবে।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও আইনের সুযোগ নিয়ে সাময়িক কোনও সাংবাদিক ও সংবাদপত্রগোষ্ঠীকে দমিয়ে রাখা গেলেও সত্য তো আর দীর্ঘদিন চাপা থাকে না। ইন্দিরা গান্ধী কালা কানুন মিসা ব্যবহার করেও প্রবাদপ্রতিম বরুণ সেনগুপ্ত, গৌরকিশোর ঘোষকে দমাতে পারেননি। রুখতে পারেননি সাতাত্তরের ঐতিহাসিক পালাবদল। আশা করি, সময় এলে দোর্দণ্ডপ্রতাপ নরেন্দ্র মোদিও পারবেন না। সত্যি, আজ নয় কাল প্রতিষ্ঠিত হবেই। যেভাবেই হোক। সমাজের বিভিন্ন স্তরে কৃষক শ্রমিক খেটে খাওয়া মানুষের বিক্ষোভ ও অশান্তির টুকরো টুকরো ছবির মধ্যে দিয়ে তা ইতিমধ্যেই জানান দিতেও শুরু করেছে। গুজরাতের ক্ষেত্রেও যা অনিবার্য ছিল তাই ঘটে গিয়েছে। বড় আশার কথা দেশের নাগরিকেরা এখন এই নিরপেক্ষ ও মেরুকরণ ঘটে যাওয়া সংবাদ মাধ্যমের মধ্যে তফাৎটা করতে পারছেন সহজেই। ফেক নিউজ কীভাবে দেশে ইচ্ছাকৃতভাবে হিংসা ছড়াতে পারে সে বিষয়েও সম্যক ধারণা তৈরি হয়েছে। সেই কারণেই শাহিনবাগের মতো আন্দোলন মঞ্চে রিপাবলিক টিভি-র অর্ণব গোস্বামী বা জি নিউজ-এর সুধীর চৌধুরীরা সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের সামনেই আটকে পড়েন, ঢুকতে পারেন না। নিরপেক্ষ, সৎ, সাহসী সাংবাদিকতা এখন এতটাই বিরল ও কোণঠাসা হয়ে পড়ছে যে একমাত্র রভিশ কুমার, যিনি আসলেই সাংবাদিক হিসাবে নিজের পেশাদারিত্বের প্রমাণ দিচ্ছেন এবং অত্যন্ত সফলভাবে, একমাত্র তাঁকেই এসময়ের ‘আইকন’ ধরে নিতে হচ্ছে, অন্য কাউকে তেমন চোখেই পড়ছে না। এই যে সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ এবং কতিপয় সাংবাদিকের, সংবাদমাধ্যমের পেশাদারীভাবে সাংবাদিকতার প্রচেষ্টা তাই সম্ভবত ভয় পাইয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্রকে। সেইজন্যই যেকোনওরকম সুযোগ পেলেই এই সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকদের উপরে আইন ব্যবহার করে রাষ্ট্র যেন প্রতিশোধ নেওয়ার খেলায় মেতেছে।
প্রতিবাদের ভাষা সবসময়ই সংখ্যায় কম হয়।১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, স্টেটসম্যান সেই সময়ে সাদা সম্পাদকীয় পাতা ছেপেছিল। আর এই সময় কাশ্মীরের সাংবাদিক ও সম্পাদক সুজাত বুখারিকে হত্যা করা হল তখন সেখানেও সংবাদপত্রগুলিতে সাদা সম্পাদকীয় পৃষ্ঠা চোখে পড়ল হত্যার চরমতম প্রতিবাদ হিসাবে। কাশ্মীরে ৩৭০ রদ করাকে কেন্দ্র করে সেখানে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ জারি হওয়া ও বিশেষ করে সংবাদমাধ্যমগুলিকে সম্পূর্ণভাবে স্তব্ধ করে দেওয়ার যে নিরবচ্ছিন্ন ঘটনা এখনও পর্যন্ত ঘটে চলেছে তা স্বাধীন ভারতের অন্যতম লজ্জাজনক ঘটনাগুলির মধ্যে একটি।