মৃণাল কান্তি মাহাত
‘জাহু জাহু করম রাজা
জাহু ছঅ মাস
আউঅ তঅ ভাদর মাস
আনব ঘুরাই’
দেখতে দেখতে আবারও ভাদ্র মাস এসে গেল।আবারও করম রাজাকে ঘুরিয়ে আনার পালা। প্রতিবার যখন করম ডাল বিসর্জন দিতে যাওয়া হয়, বাড়তিরা এই গীতটি গেয়ে করম ঠাকুরকে আশ্বস্ত করে, ছয়মাস পরে আবারও তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসব।
কুড়মালি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, আগে ছয়মাসে বছর হত। অর্থাৎ ষাট দিনে একমাস গণনা করা হত। সেজন্য প্রাচীন জাওয়া গীতে ছয়মাসের কথাই বলা হয়েছে। কুড়মী কিশোরীরা তাই তাদের আদরের করম রাজাকে ঘুরিয়ে আনার জন্য মুখিয়ে থাকে।
আকাশে পেঁজাতুলো মেঘ, কাশফুল দেখলে যখন আপামর বাঙালির ‘কাজে মন বসে না’। তারই কিছুদিন আগে থেকে সদ্যবিবাহিতা কুড়মী রমনীর মন বসে না কাজে। বাপের বাড়ির করম খেলার সঙ্গীদের জন্য মন বড় উতলা হয়ে ওঠে।কখন আসবে বাপ কিংবা দাদা তাকে নিয়ে যেতে! আপামর বাঙালি হয়তো খোঁজই রাখে না, প্রায় এই সময়ই দক্ষিণ -পশ্চিম সীমান্ত বাঙলা তথা বৃহত্তর ছোটনাগপুর মালভূমির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে জাওয়া গীতের সুর।
‘একঅ দিনকার হৈলদ বাঁটা
তিনঅ দিনকার বাসি লো।
মাঞ বাপকে ব’লে দিঅ
বড়োই সুখে আছি।’
জাওয়া -করম আসলে বৃহত্তর ছোটনাগপুর মালভূমি এলাকার জনজাতিদের কৃষি উৎসব। কুড়মী, কামার, কুমোর, মুণ্ডা, ভূমিজ সহ হিতামিতান জনগোষ্ঠীগুলির প্রাণের উৎসব।কোন রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা নেই, চাঁদার জুলুমবাজি নেই, সাউন্ড বক্সের শোষণ নেই। আছে কেবল গীত আর সুরের উন্মাদনা। করম পরব মানেই জাওয়া। আর জাওয়া তো সংগীতেরই সমার্থক। করম পরবের একসপ্তাহ আগে থেকে জাওয়া তোলা হয়ে গেলেই সারা ছোটনাগপুরের কুড়মী এবং অন্যান্য জনজাতিদের মহল্লা সন্ধ্যাবেলা গীতিময় হয়ে ওঠে জাওয়া গীতে।
‘আমপাতা চিরিচিরি নৌকা বনাব লো।
এতবড় কাঁসাই লদী হেলঅকে পাইরাব লো।’
এবছর ভালো চাষ হয়নি। কারো বাড়িতে প্রচণ্ড দারিদ্র্য। মাতাল স্বামীর জন্য সংসারে সুখ নেই। কাজের জন্য সন্তান কিংবা স্বামী বহুদূরে, ভিনরাজ্যে। সমস্ত দু:খ, কষ্ট, চাওয়া পাওয়া মিলিত হয় জাওয়া গীতের মোহনায়। কত সাম্প্রতিক বিষয়, কুড়মীদের আদিবাসী বঞ্চনা উঠে আসে জাওয়া গীতে।
করম মূলত কুমারী মেয়েদের উৎসব। আর জাওয়া হল করম পরবের সংগীত।কুড়মালি ভাষায় ‘জাওয়া’ কথার অর্থ হল অঙ্কুরিত করা। পাঁচ বা সাত রকমের বীজকে অঙ্কুরোদগম করার অর্থ হল জাওয়া দেওয়া।
কুড়মালি গবেষকদের দাবি, চাষবাসের প্রকৃত আবিষ্কর্তা মহিলারা। যখন মানুষ অরণ্য জীবনে শিকার করেই জীবিকা নির্বাহ করত, সেসময় মেয়েরা কুটিরেই থাকত শিশুদের দেখাশোনার জন্য। নদীতে স্নান করতে গিয়ে, তারাই প্রথম দেখেছিলেন নদীর বালিতে বীজ অঙ্কুরোদগম ও ফসলের কথা। তাই আপামর কুড়মী জনজাতির মানুষ এই করম ও জাওয়া উৎসব সম্পূর্ণভাবে মেয়েদেরই উৎসর্গ করেছেন। মেয়েরাই কৃষি আবিষ্কারের স্মৃতিতে প্রতীকীভাবে ‘জাওয়া’ দিয়ে থাকেন করম একাদশীর নয়, সাত কিংবা পাঁচদিন আগে থেকে। কার জাওয়া কত সুন্দর, চারাগুলো কত বেশি সবল এবং নীরোগ, এই নিয়ে মেয়েদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা থাকে।সবার ‘জাওয়া ডালি’ সুন্দর হয় না। যে মেয়ে পরিশ্রমী, সংযমী, ধৈর্যশীল সেই মেয়েটিরই জাওয়া সুন্দর হয়। আর যে মেয়ে অলস, অসংযমী তাদের জাওয়া সুন্দর হয়না। আসলে বাঁশের ডালি বা টুপাতে বালির মধ্যে পঞ্চবীজ ফেলে ‘জাওয়া উঠানো’র দিন থেকেই মেয়েদের সেই জাওয়া ডালিটির প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে হয়, যাতে সব বীজ অঙ্কুরোদগম হয়, অঙ্কুরোদগম এর পর যাতে পোকায় নষ্ট করতে না পারে তারও বিশেষ প্রতিষেধকের ব্যবস্থা। ‘জাওয়া উঠানো’র দিন থেকেই মেয়েদের কঠোর সাত্ত্বিক জীবনযাপন করতে হয় করম পরব না পেরানো পর্যন্ত। একজন সদ্য প্রসূতি মা যেভাবে তার সন্তানের যত্ন নেয়, ঠিক সেভাবেই যত্ন নিতে হয় জাওয়ার। তাই এই অর্থে বাড়তি মেয়েদের ‘জাওয়ার মা’ও বলা হয়ে থাকে। জাওয়া ডালি মেয়েদের কাছে তাই বড় ভালবাসার ধন, বড় আদরের।
আসলে কুড়মী সমাজের প্রধান জীবিকা চাষবাস। চাষবাসের কাজে বীজ বা ‘বিহিন’ সংরক্ষণ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এবং এই কাজ কুড়মী সমাজের মহিলারাই দায়িত্ব নিয়ে করে থাকে। তাই প্রাচীন কাল থেকেই কুড়মী মেয়েদের বীজ সংরক্ষণের পাঠ দেওয়া হত জাওয়া -করম উৎসবের মাধ্যমে। শুধু বীজ সংরক্ষণ নয়, মেয়েরা যাতে সংসার জীবনে প্রবেশের পর মা হলে সঠিকভাবে সন্তান প্রতিপালন করতে অসুবিধা না হয়, তারও একটা অনুশীলন রাখা হয় কুমারী জীবনেই। কুমারীরা যে ব্রত রাখে তা শুধুমাত্র তার নিজের জন্য নয়, তার ভাইয়ের মঙ্গল কামনায়। এ ভাই হতে পারে তার নিজ সহোদর। হতে পারে দেশবাসী বা অন্য কোন সহনাগরিক। এই উৎসবের মূল কথাই হল-
‘হামার করম
ভাইয়ের ধরম’।
করম পরব আদ্যোপান্ত কর্মযোগের কথা বলে। করম পরবের দিন, যেদিন সন্ধ্যাবেলা পাড়ার ‘লায়াঘরে’ করম বৃক্ষের পূজা আয়োজন করা হয়, সেসময় লায়াঠাকুর একটা গল্প শোনান। আপাত দৃষ্টিতে সেটিকেই করম পরবের মন্ত্র বলা যেতে পারে। যেখানে অপকর্ম করার জন্য, কর্মুর জীবনে অভিশাপ নেমে আসে, কীভাবে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে করতে তাঁর আরাধ্য দেবতার খোঁজ পায়, সেটাই এই গল্পের মূল বিষয়। এই গল্পের মাধ্যমে ভারতীয় দর্শনের মূলসুরটিই উঠে আসে।বাচ্চারা খুব ছোটবেলা থেকেই শিক্ষা পেয়ে যায়, তোমরা যদি শুভকাজ, সৎকাজে নিযুক্ত থাকো, তাহলে জীবনে তোমার কোন সমস্যা আসবে না। একদিন না একদিন মঙ্গলময় ঈশ্বরের দেখা পাবে।আর অসৎ পথে নিযুক্ত থাকলে তোমার বিনাশ অনিবার্য। করম পরব ছোট থেকেই শিশুদের মনে ন্যায়, অন্যায়, শুভ- অশুভ বোধ জাগিয়ে তোলে।
ঈশ্বররূপে বৃক্ষপূজা একটি প্রাচীন আদিবাসী প্রথা।কুড়মীরা এমনিতে গরাম থানে গাছের পূজা করে থাকে। প্রতিটি গরাম থানে গাছ সাধারণত থাকেই।এছাড়াও কুড়মীদের বেশ কিছু গোষ্ঠীর টোটেম গাছ রয়েছে, যেমন – বঁশরিয়ার গোষ্ঠী বাঁশগাছ, ডুমুরিয়ার গোষ্ঠী ডুমুর গাছ, কাটিয়ার গোষ্ঠী তসর বৃক্ষকে শ্রদ্ধা করে, পূজা করে তাদের নিজ নিজ গোষ্ঠীর টোটেম হিসেবে।
করম পরব শুধুমাত্র একটা উৎসব নয়।সমগ্র ছোটনাগপুরের ভূমিপুত্রদের একটা জীবন দর্শন।যা মানুষকে সৎ পথে, সৎ কর্মের সঙ্গে, সৎ সঙ্গের মধ্যে বেঁচে থাকতে বলে।
‘আজ রে করম ঠাকুর ঘরে দুয়ারে
কাল রে করম ঠাকুর শাঁক লদীর পারে।