মন্ত্র তন্ত্র সাধনা বহু প্রাচীন প্রথা। এই মন্ত্র তন্ত্র সাধনা ছিল অভয় ও মাঙ্গলিক কামনার আশ্রয় । রুষ্ট দেব দেবীকে শান্ত করার কৌশল। পরে মানুষ নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করা জন্য ব্যবহার করে এই মন্ত্র তন্ত্র সাধনা। মানুষের মাঙ্গলিক কামনার পরিবর্তে অপরের ক্ষতি সাধন করার জন্যই বেশিরভাগ ব্যবহার করেন সাধক জনেরা।মন্ত্রের একটা শক্তি আছে। এটা তন্ত্র সাধক মাত্রেই বোঝেন।জেমস জর্জ ফ্রেজার জাদুর বাস্তব কার্যকারিতার প্রতি অনাস্থা পোষণ করে একে ‘মেকি বিজ্ঞান’এবং ‘ব্যর্থ শিল্প’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেন-
” Magic is spurious system of natural law as well as a fallacious guide of conduct; it is false Science as well as an abhortive art”. ১.
এটি একটি লৌকিক বিশ্বাস। দৈব সন্তষ্টির বিশ্বাস হিসাবে কাজ করে। কিন্তু এই মন্ত্র সাধনা সামাজিক কুসংস্কারের মধ্যেই পড়ে। প্রগতিশীল বিজ্ঞান মনষ্ক মানুষজন এর উপর আস্তা রাখেন না। মন্ত্র সাধনার মাধ্যমে অপরের ক্ষতি সাধন করতে পারলেই মন্ত্রসাধক বেশ আনন্দ পায়। মন্ত্র কাজ করুক আর না করুক । কোন কিছু ক্ষতি সাধন হলেই ব্যাস! এটি লৌকিক প্রথা। গ্রামীণ বিশ্বাস। কারো সমূহ ক্ষতি হলে ধরে নেওয়া হয় শত্রুপক্ষ হয়তো কোন টোটকা করেছে বা মন্ত্র সাধনা করেছে। এই বিশ্বাসকে সামনে রেখে তার শত্রুপক্ষের দিকে আঙুল তোলেন । অনুমান বা আন্দাজ করে ফেলেন। অমুক তার মন্ত্র-তন্ত্র সাধনা করেছেন বা টোটকা করেছেন। এই ক্ষতির দায় তখন তার শত্রুপক্ষের দিকে চাপিয়ে দেন। যার ক্ষতি হয় কিছু করার থাকে না। নিজের হাত কামড়ানো ছাড়া। যে ক্ষতি করে সেই আনন্দ পায়। আবার প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে আর বড়ো মন্ত্র সাধকের কাছে হাজির হয় গোপনে। সাধকেরও বেশ পশরা জমে।
অবিভক্ত প্রাচীন বাংলা রেশম চাষের জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। দেশ ভাগের পর এপার বাংলার মালদা মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ অঞ্চল রেশম চাষে যথেস্ট সুনাম রেখেছে । এই বিস্তীর্ণ লোকসমাজ পোলু চাষ অর্থাৎ রেশম চাষের উপর নির্ভরশীল ছিল। রেশম ছিল তাদের একমাত্র সহায় সম্বল। রেশম চাষ কেন্দ্রিক লৌকিক জীবনের কিছু কুসংস্কার, লোক বিশ্বাস ও মন্ত্র সাধনার কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়।
“বোন নামাইতে চোখ বাইনা টানছি কলু
টোটকাতে টাইনা লিলে খোপের পলু।”
তুঁতচাষা মানুষ কে দুঃখ করে বলতে শোনা যায়। এবারের বনধ্টা গেল। কু মন্ত্রে। সব পোলু টেনে নিয়েছে। অমুক! এক্কেবারে ডালা খালি চোখের নিমেষে। দুই-এক দিনের মধ্যে পলু ঘর শূন্য। তখন বোসনির বড় আফসোস হয়। আঙুল তোলে পড়শি আত্মীয়, পড়শী শত্রুর দিকে। এক লৌকিক বিশ্বাস এর কোন যুক্তি প্রমাণ নেই। অনুমানের উপর ধরে নেওয়া হয়।শত্রু ছাড়া আর কে এই কাজ করবে। এর দায় কেউ নিতে চায় না। নাম বলেলেই পড়শির সাথে কলহ বিবাদ বাড়ে। কেউ বিবাদের ভয়ে চুপ করে থাকে। মনে মনে রাগ চেপে রাখে। ।
তবে পলু টানা মন্ত্র সাধন করা খুব সহজ নয়। কঠিন কাজ। লোক লজ্জার ভয় থাকে। সবার পক্ষে তা সম্ভব নয়। এই পলু টানা মন্ত্র সাধনা করা কতটা সম্ভব তা যাচাই করা ও অসম্ভব। তার ফল বা কার্যকারিতা কত দূর তা বোসনি জানেন।
পলু টানার মন্ত্রটা কি? তুঁত চাষীদের জিজ্ঞেস করলে কেউ বলতে পারেনা। বলে যে টানে সে জানে। যাদু টনা ভালো মানুষের কাজ নয়। নোংরা কাজ। তারাই জানে। যাদের ঈমান থাকে না। তাই এ মন্ত্র কেউ মুখস্ত রাখে না। যাদের দুষ্টু শয়তানি বুদ্ধি আছে, লোক লজ্জার ভয় নেই, তারাই সাধারণত এই কাজ করে থাকে। এই কাজ করার এক বিশেষ পদ্ধতি আছে। কাজটা সাধারণত স্বাভাবিক মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তুঁত চাষীদের মুখ থেকে তার বিবরণ শুনেছি। টোটকা বা পলুটানার পদ্ধতিটি এইরকম- যে এই মন্ত্র সাধনা করে যে পলু টানে তাকে গভীরে রাতে সম্পূর্ণ ন্যাংটো হয়ে যেতে হয়। তেমাথা মোড়ে। প্রকাশ্য রাস্তায়। সঙ্গে লাগবে একটি ভাঙা কুলো। একটি পুরানো ঝাঁটা। যার পোলু টানা হয় তার নাম করে মন্ত্র পাঠ করে। কুলোর উপরে ঝাটার বাড়ি মারলে ডালা থেকে পলু সরে যায় এরকম যতবার পলুর উপরে ঝাঁটার বাড়ি পড়বে, ততবারি পলু সরতেই থাকবে। মন্ত্র সাধক অপরের বাড়ি থেকে পলু সরিয়ে সমূহ ক্ষতি করেন। কেউ শত্রুতা হিসাবে করতেন। কেউ অপরকে টাকা দিয়ে এই কাজ করতে বলতেন। যাতে তার বিশেষ ক্ষতি হয়। ক্ষতি করার মধ্য দিয়ে ক্ষতিকারক আনন্দ পায়। আর যার ক্ষতি করে তার সারাবছরের মত বনধ মারা যায়। সে বোসনি অর্থনৈতিক ভাবে দুমড়ে যায়। কারণ তুঁত চাষীদের একমাত্র সহায় সম্বল হচ্ছে রেশম চাষ। তাতে যদি একটা বন্দয়ল মারা যায় তবে সেই পরিবারে অর্থনৈতিক অভাব দেখা দেয় অভাব দেখতেই কিছু মানুষ আনন্দ পায়।
বেশ কজন বোসনিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। এই পোলু টানার গল্পটা কি? তারা গল্পটা বলেছে। বলেছে এটি সত্য ঘটনা আগে মানুষ পলু টানতো। এক বোসনিকে জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল আমারই পোলু টেনেছে আমার চাচা। একই বাড়ি, একই ঘরে, একই জমি থেকে তুঁত পাতা সংগ্রহ করতাম। পলু৷ বড় হতো। দিনে পড়তো। দেখতাম আমার ডালা খালি।
“পোলু পোড়লো দিনে
হীরের উপরে তিন দিনে।
ডালা হইলো খালি
যোগীর বাপের হাত তালি।”
চাচার ফলন হতো বেশ ভালো। চাচা হাসত আর আমি মন খারাপ করে থাকতাম। চাচা জিজ্ঞেস করতো কি হয়েছে মন খারাপ? পোলু হয়নি। তাই তো দেখছি। আমার তো বেশ ফলন হচ্ছে প্রতিবার। হ্যাঁ রে বাবা তুই ওসব বুঝবি না এর মধ্যে কেরামতি আছে। কী কেরামতি কাকা? বলে দাও না । না না। ওসব বলা যাবে না। এটাকে কপাল বলে রে ধরে নে। তোর কপালে নেই। এসব কেরামতি সবার খাটে না।
জাদুমন্ত্রের এরূপ সামাজিক ভূমিকার কথা সিগমন্ড ফ্রয়েডও স্বীকার করেন। তাঁর উক্তি, “Magic has to serve the most varied propose- it must subject natural phenomena to the will of man, it must protect the individual from his Enemies and from dangers and it must give him power to injure his enemies. ” ২
বর্তমানে মালদা মুর্শিদাবাদের পোলু চাষ একেবারে লুপ্ত। লোকবিশ্বাস টোটকা মন্ত্র এই সব হারিয়েছ সময়ের বিবর্তনে। এখন আর এসবের চর্চা নেই। এসব গল্প কেউ বলতেও পারে না। এক দুই দশকের মধ্যে মালদা মুর্শিদাবাদের রেশম চাষ সম্পূর্ণভাবে লুপ্ত হয়ে যাবে। চাষীদের বিশ্বাস সংস্কার যা কিছু আছে তাও সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যাবে। গল্পকথা সংস্কারগুলি সংরক্ষণ করে না রাখলে আগামী প্রজন্ম হয়তো অতীত ইতিহাস সম্পর্কে বা তুঁতচাষা মানুষের জীবন সংস্কার চর্চার কথা জানতে পারবেনা ।
তথ্য সূত্র:
১।বাংলা লোকসাহিত্য মন্ত্র।
২।বাংলা লোকসাহিত্য মন্ত্র। (ওয়াকিল আহমদ। পৃষ্ঠা – ১২)
লোক সূত্র :
১। দ্বিজেন্দ্র নাথ মন্ডল। মধুঘাট, মালদা।
২। সাহনাওয়াজ। বামুন গ্রাম, মালদা।
৩। হাবিবুর রহমান । ব্রহ্মত্তর, মালদা।