রমাযানঃ ‘এক বরকতময় মাস’

by Vinnokatha

ওয়াসিম রেজা

রমাযান মাস মুসলিম উম্মাহর কাছে নানাবিধ পুরষ্কারের ডালি নিয়ে হাজির হয় ফি বছর। রমাযান মাস মাগফিরাতের মাস। রমাযান মাস তনুমন শুদ্ধ করার মাস। এই মাস জং ধরা ভ্রাতৃত্বে শান দেয়ার মোক্ষম মৌকা। শ্রষ্ঠা ও সৃষ্টির মধ্যে বিরাজমান ভালোবাসার বন্ধন ‘সংযম’ অণুর বিভিন্ন পরমাণুর সক্রিয় অংশগ্রহণে আরও শক্তিশালী হয় এই মাসেই। পবিত্র কুরআন নাযিলের মাস হওয়ায় এই মাস এমনিতেই সম্মানিত। তবে রমাযান মাসে আল্লাহ কর্তৃক সিয়াম পালনের নির্দেশ এই মাসটিকে করে তুলেছে আরও মহীয়ান।   

সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্যঃ

পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মেই উপবাস ব্রত পালনের রেওয়াজ রয়েছে। যদিও বিভিন্ন ধর্মের উপবাস থাকার পদ্ধতি বিভিন্ন। মুসলিমরা অনেক সময় তাদের ধর্মীয় ভাবাবেগ থেকে নানাপ্রকার সামাজিক মাধ্যমগুলিতে সিয়ামের স্বাস্থ্যগতভাবে কল্যাণকর দিকগুলি প্রচার করে থাকে(হতে পারে নিজেদের এটা বুঝাতেই যে, তারা কত সুন্দর ও সুস্থ্য ধর্মীয় রীতির অনুসরণ করে)। কিন্ত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’আলা আমাদের উপর সিয়াম ফরজ করেছেন যাতে করে আমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারি। আল্লাহ্‌ সূরা বাকারা’র মধ্যে বলছেন, “হে ইমানদারগণ, তোমাদের প্রতি রোযা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের আগের লোকদের প্রতি ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার।’’(০২:১৮৩)এক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকা এই প্রশিক্ষণের অন্যতম উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে আরও একটি হচ্ছে যে, পরবর্তী এগারোটি মাস যেন শুধু মাত্র আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে জীবন অতিবাহিত করতে পারি। এবং এই চরাচরের আর অন্যান্য কাজগুলি রমাযান মাসের যে শিক্ষা, সেই শিক্ষা মোতাবেক সম্পাদন করতে পারি।

বাস্তব জীবনে সিয়াম সাধনাঃ

একজন সায়েম শুধু মাত্র আল্লাহ্‌কে খুশি করার জন্য সুবহে সাদিক থেকে নিয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকেন। খিদের জ্বালায় পেট চো চো করলেও রোজাদার ব্যক্তি লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে ক্ষুদা নিবারণ করেন না। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে পুড়তে থাকা কলিজায় একটুখানি শীতল পরশ দিতে আইস ক্রিমের কোন অথবা ঠাণ্ডা পানীয়ের ক্যান একের পর এক উজাড় করতে কার ইচ্ছে করে না? কিংবা শীতকালে হাড়হিম করা ঠাণ্ডার হাত থেকে রেহায় পেতে চা-কফির কাপে ওষ্ঠ যুগল ডুবিয়ে চুমুক দেয়ার লোভ সামালাতে পারে ক’জন?বলুন! অথচ এই দুই ঋতুতেও রমাযান মাসের শুভাগমন ঘটলে রোজাদাররা আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী আনায়াসেই সিয়াম সাধনা করে থাকেন – এ যেন এক বিশুদ্ধতম ইবাদতের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। রোজাদারগণ শুধু কি তবে পানাহার থেকেই বিরত থাকেন? প্রিয় পাঠক, উত্তরটি হল – না। কেননা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যাক্তি অশ্লীলতা, মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকে না এবং নিজের জিহ্বা, চোখ কানসহ অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সংযত করতে পারে না তার রোযা কোনো কাজেই আসবে না। আল্লাহ্‌ তা’আলার জন্য তার এই উপবাস থাকা এবং পিপাসার্ত থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ তার রোযা রাখা বেকার বলে গন্য হবে’। সুতুরাং, আমরা বুঝতে পারছি যে, কেবল পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই রোযা নয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, তাৎপর্যহীন উপবাস রেখে শুধু হরেক রকম স্বাদের ও সাধের প্লেটভর্তি পদের রসাস্বাদনই করা যায়, এই রোজা মানুষের পার্থিব ও অপার্থিব তেমন কোনো কাজে আর আসে না।   

রমাযান মাসে যা করনীয়ঃ

ইতিমধ্যে আমরা সিয়াম পালনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত হয়েছি। রমাযান মাসে প্রশিক্ষন যত ভালো হবে পরবর্তী এগারোটি মাসে এই প্রশিক্ষণের ফল ততই নজরকাড়া  হবে। আপনি হয়তো এতক্ষনে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন-কী পদ্ধতি অবলম্বন করলে প্রশিক্ষণ ভালো হবে এবং যার দরুন পরবর্তী মাসগুলির ঈমানী-পরীক্ষার ফলও চমকপ্রদ  হবে। আপনি এইসবই ভাবছেন, তাই তো? আচ্ছা চলুন, আপনার মনের গহীনে বেড়ে উঠা এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা যাকঃ

আল্লাহর সাথে সম্পর্কঃ

মনিবের সঙ্গে আব্দের অর্থাৎ আল্লহর সাথে আমাদের এক পবিত্র প্রেমময় বন্ধন গঠন করার জন্য সরবান্তকরণ চেষ্টা করতে হবে। নিম্নে কিছু উপায় বর্ণীত হলঃ

কুরআন তিলাওয়াতঃ রমাযান মাসেই কুরআন নাজিল হয়েছিল। তাই খুব স্বাভাবিকভাবে এই মাসের সম্মানও বেশি। সুতুরাং, আমাদের প্রাত্যহিক কুরআন তিলাওয়াতের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এবং রমাযান মাসে কমপক্ষে একবার হলেও কুরআন পাঠ/অধ্যায়ন শেষ করতে হবে।

তর্জমা ও তাফসিরসহ কুরআন অধ্যয়নঃ যেহেতু কুরান আরবি ভাষায় নাযিলকৃত এক মহা গ্রন্থ সেহেতু আমাদের নিজ মাতৃভাষায় কুরানের অনুবাদ পড়া এক মহান কর্তব্য। এছাড়াও বিভিন্ন তাফসির গ্রন্থগুলির জ্ঞান-সমুদ্রে একজন মুমিনের ডুব দেয়া বাঞ্ছনীয়।

ফরজ ইবাদতসমূহ পালনঃ ফরজ ইবাদতগুলি পালন করার সময় আমাদের ইবাদতে পুরোপুরি মশগুল হয়ে যেতে হবে এবং সেই সঙ্গে নির্দিষ্ট ইবাদতটি সম্পর্কে আগে থেকেই জ্ঞানাহরণ করে রাখতে হবে। ইবাদতের নিয়ম কানুন  সম্পর্কেও যত্নশীল হতে হবেরাসুলুল্লাহর(সাঃ)সাথে সম্পর্কঃ আমরা জানি নাবী(সাঃ)-এঁর প্রসঙ্গ ব্যাতিত ইসলাম অসম্পূর্ণ। তাই, নাবী মুহাম্মদের(সাঃ) সাথেও আমাদের সম্পর্ক সুন্দর, সুদৃঢ় ও সহি হওয়া উচিত।

সম্পর্ক সুন্দর করার কতোগুলিপন্থাঃ 

সুন্নাত ইবাদত পালনঃ রাসুলুল্লাহ(সাঃ)-এঁর সুন্নাহকে যত বেশি সম্ভব জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি আঁকে-বাঁকে, উত্থানে-পতনে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যেতে হবে।

হাদিস পাঠঃ আমাদের যেমন হাদিস পাঠ করতে হবে ঠিক তেমনি সমান্তরালভাবে হাদিসসমূহের মূল বার্তাকেও হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টায় নিজের মনন ও মেধার সবটুকু উজাড় করে দিতে হবে।

সীরাত পাঠঃ জ্ঞানীজনবিদিত যে, মহা গ্রন্থ আল কুরআন এক ধাপে এই ধরা ধামে নাযিল হয়নি, নাযিল হয়েছিল নবী মুহাম্মদের(সাঃ)জীবন চক্রের বিভিন্ন লগ্নে। তাঁর জীবনাকাশের ঘন কালো মেঘে ঢাকা দিনে কিংবা আনন্দমুখর ক্ষণে – এই গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়। সুতরাং, এ কথা বলাই বাহুল্য যে, কুরআনের আহ্বান সম্পূর্ণ রুপে আহরণ করতে হলে নবী (সাঃ)জীবনের সঙ্গে নিজেদের পরিচিতি লাভ করা আবশ্যিক। আর এর জন্য চাই এক বা একাধিক সীরাত পাঠ/ পুনঃপাঠ।

বিশেষ দিন উদযাপনঃ

রমাযান মাসে নির্দিষ্ট কিছু দিন ও রাত আছে যেগুলি বিশেষভাবে উদযাপনের দাবি রাখে। আমারা সেই দিনগুলি গুরুত্বসহকারে যাপন করতে পারি। যেমনঃ য়াওমুল ফুরকান অর্থাৎ বদর যুদ্ধের দিন(১৭ই রমাযান)। রমাযান মাসের শেষ দশকের মহিমান্বিত রজনীসমূহ(লাইলাতুল ক্বাদর)।

ব্যায়ঃ আল্লাহর নৈকট্য লাভের শ্রেষ্ঠ উপাইগুলির মধ্যে অন্যতম হল আল্লাহর নির্দেশিত পথে নিজ মাল ও প্রয়োজনে জানের ব্যায়। যেসমস্ত দানগুলি আমাদের করা উচিৎঃ সাদাকাহ। ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ। সামর্থ্য থাকলে যাকাত দান। এবং ঈদের দিনে গরিব দুঃস্থ মানুষদের মুখে হাসি ফুটাতে ফিতরা দান।

নফল ইবাদতঃ ফরজ ও সুন্নাত ইবাদতসমূহ একজন মুসলিম ব্যাক্তির মুসলিমত্বের  বুনিয়াদ গঠন করে। এবং নফল ইবাদত সেই ব্যক্তির ফরজ ও সুন্নাত ইবাদতগুলিকে সুন্দর, শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করে তুলে। বেশি বেশি নফল ইবাদতও আল্লহর অনুগ্রহ লাভের উল্লেখযোগ্য মাধ্যম। সুতরাং, রহমত, বরকত ও নাজাতের এই মাসে নফল ইবাদতের উপর আমাদের গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।

সিয়াম গোটা একটি মাস ধরে যে সমস্ত শিক্ষা দেই সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল – সহনশীলতার শিক্ষা।আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সহনশীল ব্যাক্তদের অনেক পছন্দ করেন। বিশ্ব মানবতার বন্ধু হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবদ্দশাই গোটা বিশ্বের জন্য  সহনশীলতার অনুপম ও অনুকরণীয় অনেক দৃষ্টান্ত পেশ করে গেছেন। জানতে হলে পড়তে হবে তাঁর জিবনেতিহাস। ইসলাম চিরকাল সহনশীল ও দয়াপরবশ হওয়ার শিক্ষা দিয়ে এসেছে। রমাযান মাসের এই প্রশিক্ষণ পর্ব থেকে যেমন আমাদের সহনশীল হওয়ার গুন অর্জন করতে হবে তেমনি ‘উসওয়াতুন হাসানা’র পাঠও নিতে হবে। সহনশীল হতে হবে নিজের প্রতি, নিজের পরিবারের প্রতি, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শী, ও জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে নিপীড়িত মজলুমদের প্রতি।

আজ বিশ্ব মোড়লদের অপদার্থতায় প্রতিনিয়ত যুদ্ধের সাইরেনে বিশ্ববাসীর কান যখন ঝালাপালা করছে, পৃথিবী থেকে মায়া-মমতা, সহনশীলতা ও সংযমবোধ প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে যাচ্ছে তখন সিয়ামের শিক্ষা প্রশ্নাতীতভাবে খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।

অতএব, আসুন রাসূলের নির্দেশিত পদ্ধতিতে সিয়াম সাধনা করি এবং সিয়ামের বরকতময় শিক্ষাকে সোপান করে আগামী জীবনে সমৃদ্ধি লাভ করি; সর্বোপরি আখেরাতের প্রস্তুতি গ্রহন করি। আল্লাহ্‌ আমাদের তাওফিক দিন।    

You may also like