ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা

by Vinnokatha
মোঃ সামমসুল হালসানা

ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি পাশ্চাত্য ধারণা থেকে এসেছে যার ইংরেজি হলো “Secularism”। ধর্মনিরপেক্ষ কথাটির বিস্তার এবং অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যাপক। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি সাধারণত ব্যাবহৃত হয়েছে রাষ্ট্র ধর্ম প্রভাব মুক্ত হবে এই অর্থে। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে সাধারণভাবে যা বোঝানো হয় তা হলো রাষ্ট্র আর ধর্মকে পৃথকরূপে প্রকাশ করা বা রাষ্ট্র এবং ধর্মের মধ্যে কোন যোগ সাধন না থাকা। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে ধর্ম বা ধর্মীয় রীতিনীতির বাইরে থেকে পরিচালনা করাকে বোঝানো হয়।এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আইন কোন নির্দিষ্ট ধর্মের উপর নির্ভরশীল থাকেনা। এছাড়া ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।রাষ্ট্র কোনো ধর্মকেই পক্ষপাত করে না। এই মতবাদ অনুযায়ী, সরকার কোনরূপ ধর্মীয় হস্তক্ষেপ করবে না, কোন ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবে না এবং কোন ধর্মকে কোন প্রকার অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করবে না।কাউকে ধর্ম পালনে বাধ্য করা হবে না।সকল ধর্মের মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে।ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো, তথ্য এবং প্রমাণের উপর নির্ভর করবে, কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর নয়। অর্থাৎ বলা যায়, “ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার”।তবে এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের সংবিধানে উল্লেখ্য এই ধর্মনিরপেক্ষতা কিন্তু প্রচলিত পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষতার থেকে অনেকাংশেই আলাদা। কেমন ভাবে আলাদা, একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা অনুযায়ী তাদের রাষ্ট্র যেকোনো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান থেকে পৃথক থাকে, কিন্তু আমাদের ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতা অনুযায়ী রাষ্ট্র সকল ধর্মকে সমান নজরে দেখে, একটির জন্য অন্যটিকে বৈষম্যের শিকার হতে হয় না। এবং তাই ভারত সরকার ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষদের কে এতকাল তাঁদের পবিত্র হজ যাত্রার জন্য ভর্তুকি দিয়ে এসেছে ,কখনো আবার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অমরনাথ বা মানস সরোবর তীর্থ যাত্রার জন্য ভর্তুকি দিয়ে এসেছে আবার কখনো শিখ ধর্মাবলম্বীদের “লঙ্গার” প্রথা(মানে ক্ষুধার্ত কে খাওয়ানোর মত পবিত্র কাজ) কে জি এস টি বা ইন্ডিরেক্ট ট্যাক্সের বাইরে রাখা হয়েছে।পার্সি জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে বলে ভারত সরকার জিও পার্সি নামক প্রকল্পও চালু করেছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার
ভারত তীর্থ কবিতায় ভারত আত্মার প্রকৃত সুর বেধে দিয়ে বলেছিলেন:
“হেথায় আর্য, হেথা অনার্য
হেথায় দ্রাবিড়, চীন–
শক-হুন-দল পাঠান
মোগল
এক দেহে হল লীন”
কবি সমন্বয়ের লক্ষেই উপরোক্ত অমর কথাগুলো মন থেকে গেয়েছিলেন । তার প্রধান লক্ষ্যই ছিল ভবিষ্যতে সকল ভারতীয়র মন থেকে বিদ্বেষ নাশ হয়ে সকলে মিলে মিশে একাকার হয়ে এবং সৌভ্রাতৃত্ব বোধ বজায় রেখে বসবাস করতে পারবে। কিন্তু কবির মৃত্যু হয় ৭ই আগষ্ট ১৯৪১। ভারত স্বাধীন হয় ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট,কবির মৃত্যুর ছবছর পর। আজ শক ,হুন ,দ্রাবিড় দের অস্তিত্ব আমরা দেখতে পায়না, কিন্তু মোগল এবং পাঠান অর্থাৎ মুসলমানরা এক দেহে লীন হতে পারেনি বা তাদেরকে এক দেহে লীন হতে দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করা হয়নি। এক দেহে লীন হওয়ার জন্য রাষ্ট্রকে যে প্রকৃত ধর্মিরপেক্ষতার চর্চা ,তার কাজে কর্মে প্রমাণ করে দেখাতে হতো, সেটা হয়ত কবি বেচেঁ থাকলে বলে যেতেন।”নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান,এর এই দেশে “বিবিধের মাঝে মিলন মহান” দেখতে হলে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা ও প্রসারের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিজের কাঁধে তুলে নিতে হবে।

কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ কথাটি সংবিধানে স্পষ্ট করে লেখা থাকলেও,স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমরা এক দেহে লীন হতে পেরেছি কি? তাহলে কেন বিষবাষ্পের প্রাচীর তৈরি হলো দেশের আনাচে কানাচে?চলুন এবার দেখা যাক কি লক্ষ্য নিয়ে দেশের সংবিধান রচিত হয়েছিল।ভারতীয় সংবিধানে ভারতীয় রাজ্য সংসদকে একটি সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ ,গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে পূর্ণ স্বরাজের সংকল্প গৃহীত ও ঘোষিত হয়েছিল। সেই দিনটিকে স্মরণে রেখে ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি দিনটিতে সংবিধান কার্যকর করা হয়। সংবিধানে সরকারের গঠন ও কার্যপদ্ধতি, ক্ষমতা ও কর্তব্য নির্ধারণ, মৌলিক অধিকার, রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতি ও নাগরিকদের কর্তব্য নির্ধারণের মাধ্যমে দেশের মৌলিক রাজনৈতিক আদর্শের রূপরেখাটি নির্দিষ্ট করা হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী এ দেশের নাগরিকদের জন্য ন্যায় বিচার, সাম্য ও স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা হয়েছে এবং জাতীয় সংহতি রক্ষার জন্য নাগরিকদের পারস্পরিক ভাতৃভাব জাগরিত করার জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়েছে।যদিও সংবিধানে ‘সেকুলার’ শব্দটি যোগ হয়েছে অনেক পরে, ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৪২তম সংশোধনীতে। কেবল মাত্র,ধর্মনিরপেক্ষ কথাটিই নয় ‘সমাজতান্ত্রিক’ও ‘সংহতি’ এবং সকল নাগরিকের মধ্যে ‘ভাতৃভাব’—এই শব্দগুলি ১৯৭৬ সালে সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত করা হয়।ভারতীয় সংবিধানের রূপকার বি আর অম্বেঢকর অনুভব করেছিলেন, দেশের অনুন্নত শ্রেণির, বিশেষত তফসিলি জাতি ও জনজাতির অন্তর্ভুক্ত মানুষজনের উন্নতি না হলে দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতির বৈচিত্রের দরুন দেশের সত্যিকারের সাম্য আনতে গেলে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির উন্নয়ন সর্বাগ্রে প্রয়োজন। এ জন্য সংবিধান চালু হওয়ার প্রথম দশ বছর তফসিলি জাতি ও জনজাতিভুক্ত মানুষদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হোক।তবে দশ বছর কেন, প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা লাভের ৭৫ বছর পার হয়ে গেলেও এখনও সংরক্ষণের প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। বাস্তবিক অর্থে চরম আর্থিক বৈষম্যের কারণে কেবলমাত্র আলোকপ্রাপ্ত বা স্বজ্জ্বল সংরক্ষিত পরিবারের সন্তানেরাই এই সংরক্ষণের সুবিধা নিতে পারছেন। বাকি ব্যাপক অংশ ( সংখ্যালঘু মুসলমান , ওবিসি ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়) প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মধ্যে বাস করছেন।

 কোনো বিশেষ ধর্মকে ভারতের রাষ্ট্রীয়ধর্ম (State Religion) হিসেবে স্বীকার করা হয়নি । ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী জাতি, ধর্ম ও ভাষার পার্থক্যের জন্য রাষ্ট্র কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না । প্রত্যেক নাগরিকই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম আচরণ করতে পারবে । সকল নাগরিক সংবিধান প্রদত্ত অধিকার সমান ভাবে ভোগ করতে পারবে এবং রাষ্ট্র নিজে জনগণের মানবাধিকার বজায় রাখতে সচেষ্ট হবে। কিন্তু ভারত রাষ্ট্র কি তার এই দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে? সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মই রাষ্ট্রের ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমানে। এতে কি কোন সন্দেহ আছে? রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোটি চুরমার করে দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে মুসলিম বিদ্বেষের বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট ব্যাংককে এক জায়গায় করার জন্য।ভারত রাষ্ট্র কোনদিনই প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা করেনি। বিদ্যালয়ে শিশুমনে ধর্মনিরপেক্ষতার মনোভাব গড়ে তোলার জন্য বস্তুনির্ভর ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে ইতিহাস চর্চা হয়নি কখনো।।রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন স্থানে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরস্বতী পুজো ,ধর্মসভা ,মন্দির, মসজিদ প্রভৃতি স্থাপন করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের যোগ সাধন করার প্রয়াস চলে এসেছে প্রথম থেকেই। ধর্মকে একান্তভাবে ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়নি। যার ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকেই সব সময় রাষ্ট্র প্রাধান্য দিয়েছে। ফলস্বরূপ হিসেবে, ভারতের বিশেষ দুই সম্প্রদায় হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে সাংস্কৃতিক সমন্বয় ,মানসিক সমন্বয় তো হয়ইনি বরং পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব থেকেই গেছে। রাষ্ট্রীয় নেতারা ধর্মের কাজে নিজেকে যুক্ত করেছেন ।ধর্ম দিয়ে কখনই সমন্বয় বা সম্প্রীতি তৈরি করা যায় না।যার ভয়ঙ্কর পরিনতি আমরা বর্তমান সময়ে দেখতে পাচ্ছি। অন্যান্য দলের নেতারাও নিজের পৈতে দেখিয়ে বলতে হচ্ছে তিনি শিব ভক্ত এবং নিজেকে পুজো উদ্বোধনের মাধ্যমে বা ঈদে মুসলিম সমাজের কাছে গিয়ে মাথায় কাপড় দিয়ে মোনাজাত করে ভোট চাইতে হচ্ছে। সাভারকাররা এইরকম ভারতবর্ষই চেয়েছিল।সুতরাং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা উগ্র হিন্দুত্ববাদী সাভারকারদের আদর্শ দ্বারা পুষ্ট বিজেপির মতাদর্শ ছড়াচ্ছে এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কোন রাজনৈতিক দলই বিকল্প বাস্তবমুখী ও প্রগতির পথ দেখাতে জনগণকে ব্যর্থ হচ্ছে।।

 ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভারতবর্ষকে নিজের পদানত রেখে শোষণ করার জন্য “Divide and Rule” পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল। ফলে হিন্দু-মুসলমান, যাকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম “একই বৃন্তে দুটি কুসুম”হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন, সেই দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মনে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায় যার করুন পরিণতি হিসেবে ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র তৈরী হয়, সেই সাথে দেশভাগের মর্মান্তিক স্মৃতিও মনের কোণে গেঁথে যায়। তাই ইতিহাস থেকে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করে এবং সমন্বয় ও সংহতির কথা মাথায় রেখেই ভারতের সংবিধান প্রণেতারা অনেক বিচক্ষণতার সাথেই ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকারের তালিকায় সকল নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার কে মান্যতা দিয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রের নিজস্ব কোন ধর্ম থাকবে না বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে কি সেটা ঘটেছে?

 শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্টের ধর্মের ভাবাবেগকে গুরুত্ব দিয়ে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদকে ভেঙে সেই স্থানে রাম মন্দির তৈরীর রায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট দিয়েছে। এটা কি বাস্তব সম্মত? ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার কফিনের উপর শেষ পেরেক পুঁতে দেওয়া হল।ধর্মনিরপেক্ষতা শুধুমাত্র সংবিধানের একটি কথা হিসাবে থেকে গেল যা বাস্তবে রূপায়িত কখনোই হলো না।ভারতীয় ‘সেকুলারিজম’ আসলে সংবিধানের কাঠামো নির্মাণে উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া কোনো সিদ্ধান্ত নয়, এ হল সেই দর্শন যা সংবিধানের চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং বহু মত-বহু পথের সম্মিলন ও সহাবস্থানের ঐতিহ্যকে সম্মানের সঙ্গে অক্ষুণ্ন রাখে। আর এই সংবিধান হল বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য কে দিল রাখার একমাত্র উপায়। তাই সরকার যতই সিএএ ও এনআরসি প্রতিষ্ঠার পাঁয়তারা করছে, ততই সংবিধানের প্রতি মানুষের আনুগত্য প্রবল হচ্ছে এবং নাগরিকত্ব হরণের মতো অপতৎপরতার বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র হচ্ছে। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান যে সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, জনগণই সেই বার্তা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছে। এ মহার্ঘ আবহ তৈরির কুশীলব ভারতের জনগণ। এ সেই জনগণ, যারা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নিজেদের শুধু ভারতীয় বলেই জেনে এসেছে এতকাল। এবং কোনোদিন অবচেতনেও ভাবেনি এই ভারতীয় পরিচয়ের বাইরে তাদের ধর্মের ভিত্তিতে নতুন করে কেউ নাগরিকত্ব দেয়ার ব্রত পালনে এগিয়ে আসবে। কারণ জীবনভর তারা জেনে এসেছে নাগরিকত্ব আসলে একটা অনুশীলন, একটা বোধের চর্চা। আর সেই চর্চায় ইতিমধ্যেই তারা সসম্মানে উত্তীর্ণ। সে উত্তরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলার ধৃষ্টতা কেউ কোনোদিন দেখায়নি, দেখাবে বলেও তারা ভাবেনি। কিন্তু হায়! এমন কঠিন সময় স্বাধীন ভারতে কখনও আসেনি। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে কাশ্মীরকে বিশেষ অধিকারসমৃদ্ধ রাজ্য থেকে বিভক্ত করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করেছে, তেমনি তথাকথিত অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়নের পথও প্রশস্ত করতে সহায়তা করবে বলা যেতে পারে। হিন্দুরাষ্ট্র বিনির্মাণের পথে নিশ্চিতভাবে অগ্রসর হচ্ছে ভারত। ধর্মীয় আগ্রাসন একটা দেশকে কতটা পিছিয়ে দেয়, দেশের মানুষকে কতটা নিরাপত্তাহীনতায় ঠেলে দেয়, এ সময়ের ভারত তার উদাহরণ।নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন আনা এবং সারা দেশের জন্য এনআরসি তৈরির অঙ্গীকার ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার ভারতকে ঠেলে দিয়েছে অনেক পেছনে, অন্ধকারের কাছাকাছি।এ অঞ্চলের প্রগতিশীল ব্যক্তিরা এক সময় ভারতকে প্রগতির ধারক-বাহক হিসেবে অন্তরে ঠাঁই দিয়েছিল। কালের পরিক্রমায় সেই ভারতই এখন তার ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক চেতনা হারিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদের বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে।

কেন এমন হল! ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে সহজেই অনুভব করতে পারা যাবে আমাদের দেশে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চাও প্রসার তেমন ভাবে হয়েছে কি? পাঠক্রম বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে তৈরি না করে অবৈজ্ঞানিক ও পুঁজিবাদী ধারা ও ভাববাদ আশ্রিত ধারায় তৈরি করা হয়েছে যা ভবিষ্যৎ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ার পথে এবং দর্শনে এক বড় অন্তরায়। যে কোন উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মাশ্রিত শক্তি এই ভাবেই শিশুমন তৈরি করতে চাই। তাহলে কি আমাদের সকল রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে? তা বোধহয় মোটেই নয়।যে উগ্র ধর্মাশ্রিত জাতীয়তাবাদী দল ক্ষমতায় এসেছে তারা সমস্ত জনগণের মাত্র ৩৮ শতাংশ ভোট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। সুতরাং বাকি ৬২ শতাংশ ভোটই তাদের বিরুদ্ধে। ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতবাসীর মধ্যে আছে বলে আমি বিশ্বাস করি।সেই চেতনাকে সঙ্ঘবদ্ধ করার দায়িত্ব আমাদের যারা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করি । এমন ভাবাবেগ সৃষ্টি করা হয়েছে , আর্য, অনার্য, দ্রাবিড়, চীন শক-হুন তারা যেন এক দেহে লীন হতে পারলেও ,পাঠান মোগলরা পারলো না, তারা মুসলমান রূপেই থেকে গেলো ,তারা ভারত আত্মার সঙ্গে এক দেহে লীন হতে পারলো না। এটা আসলে একটা ভাবাবেগ এবং মিথ তৈরি করা হয়েছে। ভারত আত্মার কি একটা রূপ ?বিচিত্র তার রূপ।সবাই তার নিজস্ব বৈচিত্র এবং নিজস্ব সত্ত্বা বজায় রেখে এই বৈচিত্রময় বা বিচিত্ররুপী ভারত আত্মার রূপ তৈরি করবে এটাই হলো প্রকৃত ভারত আত্মার রূপ। আর এই বৈচিত্র্যময় সত্তাকে বজায় রাখতে পারে এবং সকলকে এক বন্ধনে বেঁধে রাখতে পারে এবং এক দেহে লীন করতে পারে একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা ও প্রসার।রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানে ,স্কুল-কলেজ , বিশ্ববদ্যালয়, গবেষণা কেন্দ্র সহ শিক্ষার সর্বস্থানে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে এবং যুক্তিনির্ভর পাঠক্রম তৈরি করতে হবে। তাহলেই নিজস্ব জাতিসত্তা, ভাষা সত্তা, ধর্ম সত্ত্বা বজায় রেখেও সকল ভারতবাসী এক দেহে লীন হতে পারবে।

 সুতরাং “নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান , বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান” এর এই ধারাকে বজায় রাখতে হলে এবং প্রকৃত ভারত আত্মার বৈচিত্রের মধ্যে ,নিজস্ব জাতিসত্তা ও ধর্ম সত্তাকে বজায় রেখে এক দেহে লীন হতে গেলে “ধর্মনিরপেক্ষতার” চর্চা ও প্রসারই একমাত্র হাতিয়ার বলে আমি মনে করি।

 

 

You may also like