আর এস এস কি গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় আস্থা রাখে?

by Abu Siddik

শামসুল ইসলাম

ধর্মনিরপেক্ষতার বিপক্ষে

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ রাষ্ট্রের প্রতি সংখ্যালঘুদের পূর্ণ আনুগত্য দাবি করে।সংখ্যালঘুদের শুধুমাত্র  ভারতীয় সংবিধান ও আইন ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য থাকলেই হবে না। আর এস এসের শাখাগুলিতে যেভাবে প্রার্থনা ও প্রতিজ্ঞার পাঠ করানো হয় তা থেকেই স্পষ্ট হয় যে হিন্দুত্ব ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।এরকমভাবেই মুসলিম লিগও ইসলামের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের ইস্যুটিকে একত্রিত করেছিল। খুব তাৎপর্যপূর্ণ কথা এই যে আর এস এসের প্রার্থনা ও শপথ পাঠের বক্তব্যগুলি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে প্রকাশ্যে লঙ্ঘন করে। আর আমরা সবাই স্বীকার করি ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মূল বৈশিষ্ট্য।এখানে একটি কথা খুব  তাৎপর্যপূর্ণ। সংবিধান বিরোধী কাজের জন্য অন্য সব দলের সদস্য সদস্যাদের হয় জেলের ঘানি টানতে হচ্ছে আর না হয় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারাতে হচ্ছে, সেখানে আর এস এসের লোকেরা প্রকাশ্যে দেশের সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েও পার পেয়ে যাচ্ছে। তাদের দেশব্যাপি শাখার কাজকর্মও সমানতালে চলছে।  

দুঃখজনকভাবে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যারা সংবিধানে স্বীকৃত ভারতীয় গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার শপথ নিয়ে দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন তাঁরা প্রতেকেই আর এস এসের সক্রিয় ক্যাডার এবং তাঁরা হিন্দু রাষ্ট্র গঠন করতে বদ্ধপরিকর। কারণ তাঁরা বাধ্য আর এস এসের প্রার্থনা ও প্রতিজ্ঞার বইগুলির বানী অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে। আর এস এসের প্রার্থনা ও প্রতিজ্ঞা গুলি নিম্নরূপঃ

প্রার্থনা:   

প্রিয় মাতৃভূমি আমি চিরন্তন মাথা নত করছি তোমার নিকট

হে হিন্দুর দেশ, তুমি আমাকে পালন করেছ আরামে

হে পবিত্রভূমি, মঙ্গলময় মহান সৃষ্টিকর্তা, আমার শরীর তোমাতে সমর্পিত

আমি পুনঃ পুনঃ তোমার নিকট মাথা নত করবো

হে সর্বশক্তিশালী ভগবান, আমরা যারা হিন্দু রাষ্ট্রের অবিছেদ্দ অংশ,

তারা পরম শ্রদ্ধায় তোমাকে স্যালুট করছি

তোমার জন্য আমরা আমাদের কোমর শক্ত করে বেঁধেছি

আশীর্বাদ কর আমরা যেন আমাদের কাজ সিদ্ধ করতে পারি।

প্রতিজ্ঞা:

 আমি সর্বশক্তিমান ভগবান ও আমার পূর্বপুরুষদের নামে সর্বান্তকরণে শপথ নিচ্ছি যে আমি আর এস এসের একজন সদস্য হলাম এবং ভারতবর্ষের সব ধরনের মহানুভবতার জন্য কাজ করে যাবো। আমি হিন্দু ধর্ম, হিন্দু সমাজ ও হিন্দু সংস্কৃতির উন্নতি ও উৎকর্ষতার জন্য নিবেদিত প্রাণ। আমি সৎভাবে, কোনরকম স্বার্থব্যতিরেখে, সর্বান্তিক প্রয়াসে সংঘের কাজ করবো। এবং সারাজীবন আমি এই কাজে অঙ্গীকারবদ্ধ। ভারত মাতা কি জয়।

সুতরাং শাসক আর এস এস ক্যাডাররা ভারতের সংবিধান ও তার বিধিনিষেধের প্রতি মোটেই আস্থাশীল নন। তাঁরা ভারতকে ধর্মীয় রাষ্ট্রতে পরিণত করতে চায় যেভাবে মুসলিম লিগ ইসলামের নামে পাকিস্থান তৈরি করেছিল।

গণতন্ত্রের বিপক্ষে

আর এস এস গণতন্ত্রের পক্ষে নয়। এরা সব সময় দাবি করে এসেছে যে ভারতবর্ষ শাসন করবে একটি সর্বগ্রাসী সরকার। ১৯৪০ সালে আর এস এসের হেডকোয়ার্টার নাগপুরে ১৩৫০ জনের ক্যাডারের জনসভায় গোলওয়ালকর ঘোষণা করেন,    

এক পতাকা, এক নেতা, এক আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আর এস এস ভারতবর্ষের কোনে কোনে হিন্দুভার প্রদীপ প্রজ্বলন করছে।

আর এস এস এক পতাকা, এক নেতা, এক আদর্শ এর প্রচার ধ্বনি নাৎসি ও ইউরোপের  ফ্যাসিস্ট  দলগুলির থেকে প্রত্যক্ষভাবে ধার করা। একটি মজাদার বিষয় হল এই মিটিং-এ হিন্দু মহাসভার বর্ষীয়ান নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী উপস্থিত ছিলেন। এই মুখার্জী আবার ঘটনাক্রমে ১৯৪২ এর  স্বাধীনতাপূর্ব মুসলিম লিগ ও হিন্দু মহাসভার কোয়ালিশন সরকারে উপমুখ্যমন্ত্রি ছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিপক্ষে

আর এস এস ভারতীয় সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধে এককাট্টা। এটি স্পষ্ট হয় গোলওয়ালকরের ভারতীয় জাতীয় সংহতির ১৯৬১ সালের প্রথম অধিবেশনে পাঠানো এক বার্তার  মধ্যে দিয়ে,

     আজকের যুক্তরাষ্ট্রীয়  শাসন ব্যবস্থা কেবলমাত্র বিছিন্নতাবাদের জন্ম দেয় না, এটিকে সযত্নে                       লালন পালনও করে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ভারতের এক জাতির ধারণা কে অস্বীকার করে ও ধ্বংস করে। এটিকে অবশ্যই সমূলে উৎপাটিত করতে হবে, সংবিধানকে শুদ্ধ করতে হবে,      এবং এককেন্দ্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।        

ভারতীয় সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধে আর এস এস ভাববাদীদের চিন্তাগুলি কোন অসংলগ্ন কিছু নয়। এটি তাঁদের অন্যতম মূল ইস্যু। আর এস এসের পবিত্র গন্থ, ‘বাঞ্চ অফ থটস’-এ একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় আছে যার শিরোনাম ‘ওয়ান্টেড আ ইউনিটারি স্টেট’। গোলওয়ালকর যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিকল্পের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন,  

     সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী পদক্ষেপ হবে ভারতীয় সংবিধান সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রীয় কথাটিকে চিরতরে মাটির গভীরে পুঁতে দেওয়া। সব স্বায়ত্তশাসিত বা আধা স্বায়ত্তশাসিত স্টেটগুলিকে   একটি স্টেটের (ভারত) এর অধীনে নিয়ে আসা এবং এর সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করা এক দেশ, এক রাষ্ট্র, এক আইনসভা, এক কার্যনির্বাহীর। ভারতে আঞ্চলিকতার নামে বা     সাম্রদায়িক বা ভাষাগত বা এ জাতীয় অন্য কোন কারণের উপর নির্ভর করে গর্ব করা    যাবে না। এগুলিকে ভারতের সংহত  সম্প্রীতির পথে বাঁধা হতে দেওয়া যাবে না।সংবিধানকে   পুনরায় পরীক্ষা করে পুনরায় খসড়া তৈরি করতে হবে যাতে করে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা      বাস্তবায়িত করা যায়। এই কাজের মাধ্যমে দক্ষতার সঙ্গে এই অশুভ প্রচার যে ভারতবর্ষ     বহু জাতি, বহু ভাষার পাশাপাশি বাস কে নস্যাৎ করতে হবে।ভারতের বহুত্ববাদের ধারণাটি     প্রথমত ব্রিটিশদের দ্বারা লালিত হয়। পরে আমাদের দেশের নেতারাও নির্বুদ্ধিতার সাথে এই ধারণাটিকে আত্মভূত করেন।                    

যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ভারতের সংবিধানের একটি মূল স্তম্ভ।আর এই স্তম্ভকে,কেন্দ্র ও রাজ্যের উভয় ক্ষেত্রে ধ্বংস করতে আর এস এসের ক্যাডাররা দিনাতিপাত করছেন।সব থেকে  মারাত্বক দিক হল এরা চরম এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় আস্থাশীল হলেও এরা অনেক রাজ্যেই সরকার চালাচ্ছে। এর  দ্বারা আর এস এসের ভণ্ডামি যেমন প্রমাণিত হয়, ঠিক তেমনি এরা ভিতর থেকে ভারতীয়  যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ক্ষয় করছে। উদাহরণ স্বরূপ আমরা দেখেছি যখন মোদি সরকার অসংবিধানিকভাবে উত্তরাখণ্ড ও অরুণাচলের সরকারকে ভেঙে দিতে উদ্যত হলে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট তখন হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হন।

 (Abu Siddik translated a chapter “Does RSS have faith in Democracy, Secularism and Federalism?” from Shamsul Islam’s book Know the RSS, 13th ed. New Delhi: Pharos Media, 2018.)                  

You may also like